নঈম নিজাম:কুমিল্লা থেকে এক বন্ধু ফোন করে জানতে চাইলেন হয়ে যাওয়া সিটি ভোট নিয়ে লিখলাম না কেন? সিইসি ভোটের আগে বললেন এক কথা। পরে বললেন আরেক। ইসির ভূমিকাও কঠিনভাবে হলো প্রশ্নবিদ্ধ। সবকিছুতে তারা এত তালগোল পাকাল অকারণে। বললাম, কুমিল্লার ভোট নিয়ে এখন আর বলার কিছু নেই। বিশ্বকে তাক লাগানো স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিয়ে উৎসবের ঢেউ চলছে। সারা দেশের মানুষ নতুন উদ্দীপনায় বলীয়ান। দক্ষিণের দুয়ার খোলায় আনন্দিত টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, রূপসা থেকে পাথুরিয়ার মানুষ। পদ্মা সেতু বিশ্ববাসীকে নতুন বার্তা দিয়ে গেল। আবার কুমিল্লা সিটি ভোটের ফলও একসঙ্গে অনেক বার্তা দিয়েছে সবাইকে। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগ পেয়েছে এক বার্তা, বিএনপি আরেক। নির্বাচন কমিশনও জানতে পেরেছে তারা চাইলে কী করতে পারে আর কী পারে না। প্রশাসনের সীমাবদ্ধতাও বেরিয়ে এসেছে। দিনভর চাইলে ভালো ভোট করা যায়, মানুষ তা-ও জেনেছে। শেষ মুহূর্তে অকারণে উঠে আসা ঝামেলা তৈরি না হলে সবকিছুই ঠিক ছিল। এখন আওয়ামী লীগ খুশি কুমিল্লা সিটি থেকে সাক্কু যুগের অবসান হওয়ায়। বিএনপিরও শক্তিশালী আরেক অংশ আরও বেশি খুশি। তারা চেয়েছিল দলীয় প্রার্থী পরাজিত হোক। রাজনীতি থেকে বিদায় নিন সাক্কু। প্রার্থী হারানোর টার্গেট নিয়ে হাজি ইয়াছিন গ্রুপ ভোটে দাঁড়িয়েছিল। সবাই ভেবেছিলেন, কায়সার ১০ হাজারের বেশি ভোট পাবেন না। অতীতে বিদ্রোহী প্রার্থীদের পরিণাম ভালো ছিল না কুমিল্লায়। কিন্তু কায়সার ২৯ হাজার ভোট পেয়ে সবাইকে চমকে দিলেন। হারিয়েও দিলেন সাক্কুকে। সাক্কুর পরাজয়ে কুমিল্লা বিএনপির হাজি ইয়াছিন গ্রুপ উজ্জীবিত। তাঁরাও আছেন আনন্দ উৎসবে। এবার আসি আ ক ম বাহারের কথায়। সিইসি ভোটের পর বুঝলেন বাহার সাহেব কুমিল্লায় সঠিক অবস্থানে ছিলেন। তাঁরা আগে বুঝলে এত বিতর্ক হতো না। রিফাতকে জিতিয়ে এমপি আ ক ম বাহার প্রমাণ করলেন কুমিল্লায় তিনি একক অবস্থান ও উচ্চতা নিয়ে আছেন। এখানে আপাতত কারও ভাগ বসানোর সুযোগ নেই।
আ ক ম বাহারের আরেকটি পজিটিভ অবস্থান তিনি কুমিল্লাকে আবেগ দিয়েই ভালোবাসেন। এ কারণে মেঘনা নয়, কুমিল্লা নামেই বিভাগ দাবি করছেন। রাজনীতি করতে হলে মানুষের মনের ভাষা বুঝতে হয়। মানুষের আবেগ কুমিল্লা নামেই হোক বিভাগ। তখনকার ত্রিপুরা এখনকার কুমিল্লার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য। কবি নজরুলের প্রেম, বিরহ, দ্রোহের শহর আমাদের এ কুমিল্লা। শিল্প-সংস্কৃতির শহরটি এখন যানজটে অচল থাকলেও ব্রিটিশ শাসনকালে এটি ছিল ত্রিপুরার প্রাণকেন্দ্র ছিল। ত্রিপুরার জমিদার বীরেন চন্দ্রের প্রশাসনিক দফতর ছিল এখানেই। এখনো ত্রিপুরার মহারাজাদের অনেক স্মৃতি রয়ে গেছে। আছে শচীন দেববর্মণের স্মৃতি বসতভিটা। জাতীয় কবি নজরুলের বাবুদের সেই তালপুকুর এখনো টিকে আছে স্মৃতির মিনার হয়ে। কুমিল্লায় নজরুলের হাজারো স্মৃতি। ফরিদা বিদ্যানিকেতনের বিপরীতের সেই স্মৃতির ঘরগুলো হয়তো নেই। কিন্তু এখনো রসমালাই ও খাদির ঐতিহ্য কুমিল্লার বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে নজরুলের নিঃশ্বাসের শব্দ। নজরুলের অনেক স্মৃতি এখনো গবেষকদের লেখনীতে ঠিকভাবে উঠে আসেনি। এসেছে প্রেম ও বিয়ের বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা। সে যুগে কলকাতার একজন প্রকাশক ছিলেন আলী আকবর খান, যাঁর বাড়ি ছিল মুরাদনগরের দৌলতপুরে। তাঁর সঙ্গে কবি নজরুলের ছিল গভীর সম্পর্ক। ১৯২১ সালে একদিন তিনি কবি নজরুলকে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন কুমিল্লায়। তারপর নিয়ে যান মুরাদনগরের দৌলতপুরে গ্রামের বাড়ি। সে বাড়িতে একদিন পুকুরঘাটে খোলা চুলের এক তরুণীর ছায়া দেখলেন নজরুল। বিস্ময়নয়নে তাকালেন। দুজনের চোখাচোখি হলো। দৃষ্টিবিনিময়েই নজরুল নাম দিলেন নার্গিস। তাঁর আসল নাম সৈয়দা খাতুন।
মেয়েটি ছিল আলী আকবর খানের ভাগনি। নজরুল তাঁর ভালোলাগার কথা জানালেন। সিদ্ধান্ত হলো নজরুলের সঙ্গে বিয়ে হবে সেই তরুণীর। সৈয়দা খাতুনের ভাইয়ের বিয়ের দিন আয়োজন হলো আরেকটি বিয়ের। সৈয়দা খাতুন নার্গিসের সঙ্গে বিয়ের পিঁড়িতে বসলেন নজরুল। বিয়ে পড়ানোর পর সবাই জানতে চাইলেন এই বাউন্ডুলেকে ঘরজামাই করে রাখতে হবে। তাঁর চালচুলো কিছু নেই। মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিবাদে নজরুলের মন খারাপ হয়ে গেল। সবার কাছ থেকে খারাপ ব্যবহার পেয়ে কবির অভিমানী চোখে নেমে এলো অশ্রুর বান। মাঝরাতে তিনি মুরাদনগর ছাড়লেন। চলে এলেন কুমিল্লা শহরে সুন্দরী বিরজা দেবীর ঘরে। তাঁকে মা ডাকলেন। ৩০ মাইল হেঁটে আসা নজরুল ছিলেন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। তাঁর মন ভেঙে গেছে। বারবার আর্তনাদ করছেন। সে আর্তনাদ সইতে পারছিলেন না বিরজা দেবী। বিরজা দেবীর পুত্র বীরেন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নজরুলের সঙ্গে ছিলেন তখন। সন্তানের স্নেহে তিনি নজরুলকে ঠাঁই দিলেন। বিরজা সুন্দরীর ভাশুরের মেয়ে প্রমীলার সঙ্গে নজরুলকে বিয়ে দিলেন। সে যুগে সে সময়ে একজন মুসলমান কবির সঙ্গে হিন্দু মেয়ের বিয়ে দেওয়া কি সম্ভব? ভাবতে পারেন ৩০ মাইল হেঁটে কবি আশ্রয় নিয়েছিলেন এক হিন্দু বাড়িতে! প্রমীলার মূল নাম আশালতা দেবী। সেসব নিয়ে আরেক দিন লিখব। নজরুলের দ্রোহ, প্রেম, বিরহের সেই শহর কুমিল্লায় একই সময়ে সুরের ঝঙ্কার তুলতেন শচীনকর্তা। নারীজাগরণের প্রথম বাতিঘর নবাব ফয়জুন্নেছার বিকাশও কুমিল্লা থেকে। তিনি ইংরেজি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন সে সময় কুমিল্লায়। নবাব ফয়জুন্নেছা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, শচীন দেববর্মণ ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের স্মৃতির কুমিল্লাকে বলা হতো অসাম্প্রদায়িক চেতনার শহর। ঐতিহ্যের কুমিল্লার কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাঝেমধ্যে আমাদের ক্ষত করে। কষ্ট দেয়।
নবনির্বাচিত মেয়র আরফানুল হক রিফাতের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ কুমিল্লার হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। যানজট আর জঞ্জালের কবল থেকে এ শহরকে রক্ষা করা। টমছম ব্রিজের ওপর উড়ালসড়ক নির্মাণ। জলাবদ্ধতার কবল থেকে নগরবাসীকে নিস্তার দান। রিফাতকে ফিরিয়ে আনতে হবে সিটির ইমেজ। নগর ভবনকে বানাতে হবে মানুষের সেবাকেন্দ্র। যানজট নিরসনে নতুন চিন্তা করতে হবে। ইঞ্জিনচালিত রিকশা আর নসিমন মার্কা যানবাহন কুমিল্লা শহরে এত বেশি দরকার আছে কি না ভাবতে হবে। রাস্তাঘাট সংস্কার করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি প্ল্যান নিয়ে। টমছম ব্রিজের ভয়াবহ যানজট দূরীকরণে ভাবতে হবে বিকল্প নিয়ে। সিটির নামে কুমিল্লা এখন একটা জঞ্জালের শহর। সব জঞ্জাল দূর করার চ্যালেঞ্জ এখন আরফানুল হক রিফাতের ওপর। একজন মানুষ চাইলে অনেক কিছু করতে পারে। একজন রাজনীতিবিদের জন্য মেয়র হওয়ার গৌরব অর্জন বিশাল ঘটনা। নবনির্বাচিত মেয়রকে বলছি, কবি নজরুল, শচীন দেববর্মণের শহরের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনুন। মানুষ ইতিবাচক অবস্থানে কুমিল্লাকে দেখতে চায়। বিভাগ হলে কুমিল্লার ব্যস্ততা আরও বাড়াবে। এ কারণে দরকার পরিকল্পিত নগরায়ণের। প্রয়োজনে দেশের খ্যাতিমান পরিবেশবিদ ও স্থাপত্যবিদদের নিয়ে যান কুমিল্লায়। তাঁদের কাছ থেকে পরামর্শ নিন কীভাবে ঢেলে সাজাবেন আগামীর কুমিল্লাকে।
বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। পিছিয়ে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইউটিউবে পাকিস্তানের এক ব্লগারের একটি ভিডিও দেখছিলাম। পদ্মা সেতু নিয়ে ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন সেই ব্লগার। বিশ্বজুড়ে স্থাপত্যের বিস্ময় পদ্মা সেতু। স্বাধীনতার পর একজন মার্কিন কূটনীতিক বাংলাদেশকে উপাধি দিয়েছিলেন তলাবিহীন ঝুড়ি। সেই বাংলাদেশ আজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে উন্নতি-সমৃদ্ধির সোপানে। এগিয়ে চলেছে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। বাংলাদেশের এ অপ্রতিরোধ্য গতি থামানোর আর সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করতে পারে! বলতে পারে তোমাদের ঋণ নেব না। তোমাদের পাত্তা না দিলেও আমাদের চলবে। পাকিস্তানি ব্লগার বারবার বলছেন, সফলভাবে করোনার অর্থনীতি মোকাবিলা করেছে বাংলাদেশ। এ কঠিনতম সময়ে তারা নির্মাণ করেছে প্রমত্তা পদ্মার ওপর বিশাল সেতু। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাকিস্তান শিখতে পারে বাংলাদেশ থেকে। আজ পাকিস্তান বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আফসোস করছে। তাদের অর্থনীতিবিদরা টক শোয় গিয়ে বাংলাদেশের উঠে দাঁড়ানোর প্রশংসা করেন। রাজনীতিবিদরা অবাক বিস্ময় নিয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়া দেখেন। সঠিক নেতৃত্ব থাকলে একটি দেশ অতি সহজে সামনে যেতে পারে। একজন মাহাথির মালয়েশিয়াকে বদলে দিয়েছেন। লি কুয়ান ইউ গড়ে তুলেছেন আধুনিক সিঙ্গাপুর। একটা সময় মালয়েশিয়ার সঙ্গে একই মানচিত্রে ছিল সিঙ্গাপুর। নিজেদের অর্থনীতি মোকাবিলা করতে গিয়ে মালয়েশিয়া তখন হিমশিম খাচ্ছিল। তাই তারা তখন সিঙ্গাপুরকে ছেড়ে দেয়। মালয়েশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সেদিন সিঙ্গাপুরের নেতৃত্ব চোখের পানি ফেলে আফসোস করছিলেন। সেই সিঙ্গাপুর শুধু যোগ্য নেতৃত্বের কারণে আজকের বিশাল অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। গতিশীল নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া উঠে দাঁড়িয়েছে। বদলে দিয়েছে নিজেদের। বাংলাদেশেরও সময় এসেছে বদলে যাওয়ার। বদলে দেওয়ার।
বাংলাদেশ কি পারবে বিশ্ব বাস্তবতার কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে? করোনাকালে বিশ্ব অর্থনীতি কঠিন চ্যালেঞ্জে পড়েছে। বেড়েছে মুদ্রাস্ফীতি। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। সারা দুনিয়ার বাজারে যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে। লাগামছাড়া জিনিসপত্রের দাম। এ কঠিন অর্থনীতির যুগে বাংলাদেশ শেষ করেছে পদ্মা সেতু নির্মাণ। সবকিছু এত সহজ ছিল না। কিন্তু ছিলেন একজন দৃঢ়চেতা সাহসী নেত্রী, যিনি সব চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করেছেন। তাক লাগিয়ে দিয়েছেন সবার নিষেধাজ্ঞা পরিহার করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে। এভাবে সবাই পারে না। তিনি পেরেছেন। কারণ তাঁর বাবা ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর ভিতরের শক্তি সততা ও নিষ্ঠার। ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে তিনি বঙ্গবন্ধুবিহীন এক জীর্ণ বিভক্ত আওয়ামী লীগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। তারপর শত ঝড় মোকাবিলা করেছেন একাকী। নতুন মাত্রায় দাঁড় করিয়েছেন আওয়ামী লীগকে। জাতির পিতাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছেন সব চক্রান্ত ও মিথ্যাচারের জবাব দিয়ে। জাগিয়ে তুলেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। বিশ্ববাসীর কাছে উপহার দিয়েছেন নতুন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু বিবিসির জরিপে অর্জন করেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির স্থান। শেখ হাসিনার চেয়ে বেশি অভিজ্ঞ নেতা এখন বিশ্বের কোথাও ক্ষমতায় নেই।
দীর্ঘ সময় টানা ক্ষমতায় থাকারও ইতিহাস গড়েছেন। উঠে এসেছেন অন্য উচ্চতায়। তাঁর সাহস ও শক্তি এখন বিশ্বজুড়েই এক অপার বিস্ময়। জাদুকরী ক্ষমতায় তিনি বিশাল জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন। মোকাবিলা করেছেন দুঃসময়ের অর্থনীতি। পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করে প্রমাণ দিয়েছেন তিনি পারছেন। তিনি পারেন। তাঁকে ঘিরেই আজ মানুষের মনে নতুন করে তৈরি হয়েছে আত্মবিশ্বাস। বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার ধারাবাহিকতায় এখন দরকার শুধু এ আত্মবিশ্বাস ধরে রাখা।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন। সূূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন