শায়লা জাবীন : ২০১০ সালের শেষের দিকে, বিকেল ৪টা বেজে কুঁড়ি মিনিট প্রায়, বাড়ির নাম নিঝুম ভিলা।
মানুষের কোনো কমনসেন্স নেই আজকাল, এত ছাগল পাগল চারপাশে… যত্তসব, একা একা গজ গজ করতে করতে ঘরে ঢুকে কাঁধের ব্যাগটা ঠাস করে টেবিলের ওপরে রাখলো ঝুমা, প্রাণবন্ত কিন্তু বেশ ঝাল।
নিশাত একটা বই পড়ছিল বিছানায় শুয়ে শুয়ে, ঝুমার কথা শুনে বই থেকে ডুবন্ত মুখটা তুলে বললো, তোর খুব আছে? খুবই শান্ত স্নিগ্ধ লাবণ্যময় একটা মেয়ে, শান্ত স্বচ্ছ পুকুরের জল যেমন।
আপা, আমি জানি তোর আনকমন সেন্সও আছে, কিন্ত তু্ই আগে শোন কী হয়েছে, তাহলে না বুঝবি আমি কেন চিল্লাচ্ছি…
দুই মিনিট, মানে ১২০ সেকেন্ডের মধ্যে বলতে পারলে বল, তা না হলে বলার দরকার নেই, এই ঘর থেকে বিদায় হ, বইয়ের ভেতরে ঢুকে গেছি, এখন অন্য কিছু মাথায় ঢুকাতে চাই না…
ঝুমা বললো, আচ্ছা দুই মিনিটেই হবে শোন,
আমি বাসার সামনে নেমে রিকশাওয়ালাকে একটা ৫০ টাকার নোট দিলাম, ভাড়া ৩০ টাকা, কিন্তু রিকশাওয়ালা আমাকে ফেরত দিলো ১০ টাকা! বললাম আর ১০ টাকা কই?
বলে ভাঙতি নাই আফা! কেমনটা লাগে, বললাম বিকেল ৪টার সময় কেন ভাঙতি থাকবে না? সারাদিন তাহলে কি রিকশা চালাইছেন? বলে ৩টার সময় রিকশা নিয়ে বের হইছি আফা, আপনে দুই নম্বর কাস্টমার।
কি? আমি দুই নম্বর!!! আপনার এত বড় সাহস, সাধে কি আর রিকশাওয়ালা হইছেন, বুইড়া বেটা তাও কথা বলার কোনো আক্কেল নাই, দেন ৫০ টাকা ফেরত দেন, আমি বাসা থেকে ভাঙতি এনে দিচ্ছি, এমন সময় উল্টা দিকের বাসার ফেল্টুস মবিন ভাই এসে বলে ঝুমা, ২০ টাকা আমি দিচ্ছি তোমাকে, রিকশাওয়ালাদের সঙ্গ ঝগড়া করে না, ভালো দেখায় না, এসব কি তোমাকে মানায়?
নিশাত কেমন আছে? অনেকদিন দেখি না…
আরে আমাকে বলবে দুই নম্বর আর আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেব? আর এক মফিজ আসছে আমাকে কি মানায় শেখাতে, কেমন লাগে বলো…
ব্যাস, আর একটা কথাও বলবি না, ১২০ সেকেন্ড শেষ। রিকশাওয়ালা তোকে তার আজকের দিনের দ্বিতীয় কাস্টমার বলতে দুই নম্বর বলছে, যেহেতু তোর কমন, আনকমন কোনো সেন্সই নাই, তাই তু্ই বুঝিস নাই।
এখন অন্য ঘরে যা…
বলে নিশাত বইতে ডুবে গেলো
ঝুমা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো নিশাতের দিকে, এত সুন্দরী একটা মেয়ে একইসঙ্গে মানবিক এবং অমানবিক দুটোই কীভাবে হয়, এটা তার মাথায় আসে না।
কিন্ত এখন কথা বাড়ালে বিপদ…
সে ঘর থেকে বেরিয়ে তার মা সালেহা বেগমের কাছে গেলো।
সালেহা বেগম উল দিয়ে কি যেন বুনছেন, সামনেই শীতকাল, হয়তো মহানের জন্য মাফলার বা মোজা। সালেহা বেগম নামকরা সুন্দরী ছিলেন, টিউব লাইটের মতো ফর্সা, এখনো আছেন তবে তার মেয়েরা কেউ তার মতো গেদগেদা ফর্সা না। তিনি আবার ছেলে বলতে পাগল, ছেলের গার্ল ফ্রেন্ডকে গেলো শীতে উলের টুপি বানিয়ে দিয়েছে। আর ওদের বাবা সিদ্দিক সাহেব ভাত ঘুমে, যিনি মানুষ হিসেবে কেমন বোঝা মুশকিল, কখনো মনে হয় বেশ বোকা, কখনো মনে হয় জটিল তবে দেখতে বেশ সরল।
সিদ্দিক ঢাকা ওয়াসাতে চাকরি করতেন, বছর দুয়েক হলো রিটায়ার করেছেন, রিটায়ারমেন্টের টাকা নিয়ে অনেক আগে কিনে রাখা নিকুঞ্জের এই জমিটায় দোতালা বাড়ি করেছেন। ৬ মাস হলো তারা সবাই দোতলা উঠেছেন, নীচতলাটা ভাড়া দিয়েছেন।
বাড়ির নাম নিঝুম ভিলা, নিশাতের নি, ঝুমার ঝু আর মহান ম নিয়ে সিদ্দিকুর রহমান বাড়িটার নাম রেখেছেন নিঝুম ভিলা। বড় মেয়ে নিশাত এবার অনার্স ফাইনাল দিলো, মেঝো মেয়ে ঝুমা অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে, সবার ছোট ছেলে মহান এবার এইচএসসি শেষ করলো।
আম্মু শোনো, তোমার বড় মেয়ে যে দিন দিন রোবোটিক হয়ে যাচ্ছে সেই খবর রাখো?
বলতে বলতে ঝুমা ধপাস করে সালেহা বেগমের পাশে বসলো…
কেন, সে আবার কি করলো?
খাবার টেবিলে ভাত তরকারি ঢেকে রাখা, যা খেয়ে নে,
বাম দিকে ঢাকা খাবার তোর আর ডান দিকেরটা মহানের খাবার, সাড়ে ৪টা বাজে, পাঁচটা বাজলেই মহান চলে আসবে।
কেন আমি ডানদিকের ঢেকে রাখা খাবার খেলে সমস্যা কি?
একমাত্র ছেলের জন্য বেশি করে খাবার রাখছো?
তুমি কি ভাবছো এই ছেলে বড় হয়ে তোমাদের খাওয়াবে দেখা শোনা করবে?
কচু করবে, সে নিজের আখের গুছিয়ে কেটে পড়বে, আমি ছাড়া তোমাকে আর আব্বুকে কেউ দেখবে না, এমনকি আপাও না, ও বেশি ভালো, ওর ভাগে বজ্জাত কিসিমের জামাই পড়বে, মন চাইলেও সে তোমাদের জন্য কিছু করতে পারবে না।
সালেহা বেগম উল বোনা বাদ দিয়ে ঝুমার দিকে করুণ মুখে তাকিয়ে আছেন, এই মেয়ে তার শাশুড়ির মতো হয়েছে, যা ইচ্ছে হয় তাই বলে, আগে পিছে কথার রেশ কি হবে কোনো চিন্তা নাই, মুখে বললেন, তোর মুখে কি কিছুই আটকায় না?
তু্ই এভাবে কথা বলিস কেন? আর সারাক্ষণ মহানের পিছে লাগিস কেন? দুজনের জন্য একই খাবার রাখা টেবিলের দুইপাশে। নিশাতের জন্য পাত্র দেখা হচ্ছে, এর মধ্যে তু্ই এসব কি বলিস?
আম্মু আমি একদম ঠিক বলছি, তোমার কাছে তো আমি বজ্জাত, দেখো আমার ভাগে কিন্ত ভালো জামাই পড়বে, সাত চড়েও একটা টু শব্দ করবে না, বলে খাওয়ার টেবিলের দিকে হাঁটা দিলো ঝুমা… সূএ: জাগোনিউজ২৪.কম