কাজে আসছে না অ্যান্টিবায়োটিক

যশোরের রাজিউর রহমান (৫২) সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মাস দুয়েক আগে। হাঁটুর নিচের অংশ ভেঙে ও থেঁতলে যাওয়ায় তার অপারেশন করেন চিকিৎসক। কিছুদিন পর ওই জায়গায় ইনফেকশন হলে বাধে বিপত্তি। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করেনি তার শরীরে।

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তুষার মাহমুদ  বলেন, ‘এই রোগীর পায়ে ইনফেকশন হলে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিই। কিন্তু দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিক তার শরীরে কাজ করছে না। ২০টি অ্যান্টিবায়োটিকের টেস্ট দিলে দেখা যায়, রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর বা রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। তারপর আরও ২০টি টেস্ট দিলে দেখা যায় সেগুলোও অকার্যকর তার শরীরে। এরপর সব অ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট দিয়ে দেখা যায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই তার শরীরে কাজ করছে না। এর মধ্যে তার পায়ের মাংসের পচন হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার পা কেটে বাদ দিতে হবে। পরে তার পায়ের মাংস কেটে ফেলতে হয়েছে। শুধু এই একজন রোগী নন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রোগী এখন নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোগীদের এই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।’

 

অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে-বিদেশে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেও রোগী সুস্থ হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা মহামারির মতো বিপজ্জনক। এ কারণে একটি দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়লে সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা থাকবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করলে এবং চিকিৎসকের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন না করলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। গত মে মাসে দেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে সভা হয়েছে। ওই সভায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘দেশের ফার্মেসিগুলোয় যারা কাজ করেন তাদের অনেকেরই অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ধারণা কম। আট বিভাগের ৪২৭টি ফার্মেসির ওপর জরিপ করে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ কর্মী অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে জানেন না। মানুষ কিনতে চাইলেই তারা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন।’ অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে ও সহজে অ্যান্টিবায়োটিক চেনাতে ওষুধের মোড়কে লাল রং ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ঠেকাতে আইন করছে সরকার। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন  বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে জীবাণু অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আমরা এ বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করেছি। দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক চেনাতে মোড়কে লাল রং ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে আইন হচ্ছে। এর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংপর্যায়ে রয়েছে। দ্রুতই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে।’ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি। 

আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এবং ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ে ১০টি হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীদের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সেগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করেছে। হাসপাতালগুলোর মধ্যে আছে- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতাল। গবেষকরা ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে ৭ হাজার ৪৮৫ ও ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ে ৭ হাজার ৬৫৮ জন রোগীকে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক পর্যালোচনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এ তালিকায় আছে- সেফট্রিয়াক্সোন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, ফ্লুুক্লোক্সাসিলিন, মেরোপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামোক্সোসিলিন + ক্যালভুলানিক অ্যাসিড, সেফুরোক্সিম, মোস্কিফ্লোক্সাসিন ও মেট্রোনিডাজোল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যান্টিবায়োটিকটি ৩৬ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান  বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পরবর্তী মহামারি হিসেবে দেখা দেবে। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হতে থাকলে মানুষের চিকিৎসায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিক হাতে থাকবে না। নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক কম ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো যে কদিন সেবন করতে বলবেন তা সম্পন্ন করতে হবে। এর যথেচ্ছ ব্যবহার বিপদ ডেকে আনবে।’ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ঠিকমতো কাজ করে কি না তা-ও পরীক্ষা করেছেন গবেষকরা। তাঁরা দেখেছেন, সরকারি হাসপাতালে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা সেফট্রিয়াক্সোন কাজ করে না। বেসরকারি হাসপাতালে তা ৪৩ শতাংশ। এভাবে প্রায় প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের কমবেশি অকার্যকর হওয়ার প্রমাণ গবেষকরা পেয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওষুধটির পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। ২০১৯ সালে সংস্থাটি এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করে। প্রথমে ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণি। এ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা কম। এগুলো সাধারণত বেশি ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘ওয়াচ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যবহার করা যাবে, তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আর ‘রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে মরণাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে বা আইসিইউতে। আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোয় ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে ২৮ শতাংশ। ‘ওয়াচ’ শ্রেণির ব্যবহার হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এই শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়েছে ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ‘রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবহার হতে দেখা গেছে। আইসিইউতে থাকা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে সবচেয়ে বেশি বিপত্তি বাধছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স রোগীর হার অনেক বেশি। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করায় রোগীর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মো. আনিছুর রহমান  বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী এলে প্রয়োজনীয় টেস্ট করে ওষুধ প্রয়োগ শুরু করি। কিন্তু ব্লাড বা ইউরিন কালচার করে দেখা যায় রোগী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স। পরীক্ষায় যে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় তা যে অ্যান্টিবায়োটিকে নির্মূল হওয়ার কথা, তা হয় না। এর কারণ সরকারি হাসপাতালে আসার আগে অধিকাংশ রোগী বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকেন। সেখানে এত অপ্রয়োজনীয় পরিমাণ ও বেশি মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় যে পরবর্তীতেও সব ওষুধ আর রোগীর শরীরে কাজ করে না। আবার অনেক রোগীও চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের ডোজ পূর্ণ করেন না কিংবা পরামর্শ ছাড়া ওষুধ কিনে সেবন করেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে আইসিইউতে অনেক রোগীর কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কার্যকর হয় না। চোখের সামনে রোগীর পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতন না হলে অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনো পথ থাকবে না।’   সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বিশ্ব অ্যাক্রেডিটেশন দিবস আজ

» ঈদের তৃতীয় দিনও চলবে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম : উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

» সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে নিয়ে যা বললেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» এবার করোনা আক্রান্ত নেইমার

» দেশ ছাড়লেন শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির

» নির্বাচনের আগেই জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র দিতে হবে: হাসনাত আব্দুল্লাহ

» প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠক হলে দেশের জন্য পজিটিভ মেসেজ: প্রেস সচিব

» হৃদরোগীরাও কি কোরবানির মাংস খাবেন?

» কানাডায় নৌকাডুবিতে প্রাণ গেল বাংলাদেশি পাইলট ও ব্যবসায়ীর

» ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজাসহ আটক

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

কাজে আসছে না অ্যান্টিবায়োটিক

যশোরের রাজিউর রহমান (৫২) সড়ক দুর্ঘটনায় পায়ে আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন মাস দুয়েক আগে। হাঁটুর নিচের অংশ ভেঙে ও থেঁতলে যাওয়ায় তার অপারেশন করেন চিকিৎসক। কিছুদিন পর ওই জায়গায় ইনফেকশন হলে বাধে বিপত্তি। কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কাজ করেনি তার শরীরে।

 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. তুষার মাহমুদ  বলেন, ‘এই রোগীর পায়ে ইনফেকশন হলে আমরা অ্যান্টিবায়োটিক দিই। কিন্তু দেখা যায়, অ্যান্টিবায়োটিক তার শরীরে কাজ করছে না। ২০টি অ্যান্টিবায়োটিকের টেস্ট দিলে দেখা যায়, রোগীর শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর বা রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেছে। তারপর আরও ২০টি টেস্ট দিলে দেখা যায় সেগুলোও অকার্যকর তার শরীরে। এরপর সব অ্যান্টিবায়োটিক টেস্ট দিয়ে দেখা যায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই তার শরীরে কাজ করছে না। এর মধ্যে তার পায়ের মাংসের পচন হাড় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে তার পা কেটে বাদ দিতে হবে। পরে তার পায়ের মাংস কেটে ফেলতে হয়েছে। শুধু এই একজন রোগী নন, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স রোগী এখন নিয়মিত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার রোগীদের এই মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে।’

 

অযৌক্তিক, অপ্রয়োজনীয় ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়ছে। বিজ্ঞানী ও জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, দেশে-বিদেশে গবেষণায় দেখা যাচ্ছে জীবাণু অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেও রোগী সুস্থ হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা মহামারির মতো বিপজ্জনক। এ কারণে একটি দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যের অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ার ঝুঁকি আছে। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়লে সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিরোধব্যবস্থা থাকবে না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ফার্মেসি থেকে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে সেবন করলে এবং চিকিৎসকের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স সম্পন্ন না করলে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়। গত মে মাসে দেশের অ্যান্টিবায়োটিক পরিস্থিতি নিয়ে সভা হয়েছে। ওই সভায় ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম সাবরিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘দেশের ফার্মেসিগুলোয় যারা কাজ করেন তাদের অনেকেরই অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে ধারণা কম। আট বিভাগের ৪২৭টি ফার্মেসির ওপর জরিপ করে দেখা গেছে, ৬৭ শতাংশ কর্মী অ্যান্টিবায়োটিক সম্পর্কে জানেন না। মানুষ কিনতে চাইলেই তারা অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেন।’ অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার কমাতে ও সহজে অ্যান্টিবায়োটিক চেনাতে ওষুধের মোড়কে লাল রং ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহার ঠেকাতে আইন করছে সরকার। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. আইয়ুব হোসেন  বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারে জীবাণু অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে। আমরা এ বিষয়ে জরিপ পরিচালনা করেছি। দেশব্যাপী সচেতনতামূলক কাজ করা হচ্ছে। অ্যান্টিবায়োটিক চেনাতে মোড়কে লাল রং ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার ঠেকাতে আইন হচ্ছে। এর খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংপর্যায়ে রয়েছে। দ্রুতই জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হবে।’ প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি করলে ২০ হাজার টাকা জরিমানার প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানান তিনি। 

আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজি ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত এবং ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ে ১০টি হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডের রোগীদের দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক ও সেগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা ও পর্যালোচনা করেছে। হাসপাতালগুলোর মধ্যে আছে- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহীর ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জালালাবাদ রাগীব-রাবেয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শামসুদ্দিন আহমেদ হাসপাতাল। গবেষকরা ২০১৭-১৯ সালের মধ্যে ৭ হাজার ৪৮৫ ও ২০২১ সালের জুন-জুলাইয়ে ৭ হাজার ৬৫৮ জন রোগীকে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক পর্যালোচনা করেছেন। তাতে দেখা গেছে ১০টি অ্যান্টিবায়োটিক সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। এ তালিকায় আছে- সেফট্রিয়াক্সোন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, সিপ্রোফ্লোক্সাসিন, ফ্লুুক্লোক্সাসিলিন, মেরোপেনেম, সেফিক্সিম, অ্যামোক্সোসিলিন + ক্যালভুলানিক অ্যাসিড, সেফুরোক্সিম, মোস্কিফ্লোক্সাসিন ও মেট্রোনিডাজোল। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় সেফট্রিয়াক্সোন। অ্যান্টিবায়োটিকটি ৩৬ শতাংশের বেশি রোগীর ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান  বলেন, ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স পরবর্তী মহামারি হিসেবে দেখা দেবে। অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হতে থাকলে মানুষের চিকিৎসায় কোনো অ্যান্টিবায়োটিক হাতে থাকবে না। নতুন কোনো অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত মানুষের জীবন বিপন্ন হয়ে উঠবে। তাই অ্যান্টিবায়োটিক কম ব্যবহার করতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শমতো যে কদিন সেবন করতে বলবেন তা সম্পন্ন করতে হবে। এর যথেচ্ছ ব্যবহার বিপদ ডেকে আনবে।’ অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ঠিকমতো কাজ করে কি না তা-ও পরীক্ষা করেছেন গবেষকরা। তাঁরা দেখেছেন, সরকারি হাসপাতালে ৭৬ শতাংশ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা সেফট্রিয়াক্সোন কাজ করে না। বেসরকারি হাসপাতালে তা ৪৩ শতাংশ। এভাবে প্রায় প্রতিটি অ্যান্টিবায়োটিকের কমবেশি অকার্যকর হওয়ার প্রমাণ গবেষকরা পেয়েছেন। অ্যান্টিবায়োটিকের অকার্যকারিতা রোধ করতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ওষুধটির পর্যায়ক্রমিক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিল। ২০১৯ সালে সংস্থাটি এ পর্যন্ত উদ্ভাবিত অ্যান্টিবায়োটিকগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করে। প্রথমে ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণি। এ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিকগুলোর অকার্যকর হওয়ার প্রবণতা কম। এগুলো সাধারণত বেশি ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ‘ওয়াচ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিকগুলো ব্যবহার করা যাবে, তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে। আর ‘রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করতে হবে মরণাপন্ন রোগীদের ক্ষেত্রে বা আইসিইউতে। আইইডিসিআর ও আমেরিকান সোসাইটি ফর মাইক্রোবায়োলজির গবেষণায় দেখা গেছে, হাসপাতালগুলোয় ‘অ্যাক্সেস’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়েছে ২৮ শতাংশ। ‘ওয়াচ’ শ্রেণির ব্যবহার হয়েছে দ্বিগুণের বেশি। এই শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়েছে ৬৯ দশমিক ৪ শতাংশ। ‘রিজার্ভ’ শ্রেণির অ্যান্টিবায়োটিক শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ ব্যবহার হতে দেখা গেছে। আইসিইউতে থাকা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিক দিতে সবচেয়ে বেশি বিপত্তি বাধছে। অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স রোগীর হার অনেক বেশি। অ্যান্টিবায়োটিক কাজ না করায় রোগীর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটছে না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ও আইসিইউ ইনচার্জ ডা. মো. আনিছুর রহমান  বলেন, ‘আমাদের হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী এলে প্রয়োজনীয় টেস্ট করে ওষুধ প্রয়োগ শুরু করি। কিন্তু ব্লাড বা ইউরিন কালচার করে দেখা যায় রোগী অ্যান্টিবায়োটিক রেজিট্যান্স। পরীক্ষায় যে ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় তা যে অ্যান্টিবায়োটিকে নির্মূল হওয়ার কথা, তা হয় না। এর কারণ সরকারি হাসপাতালে আসার আগে অধিকাংশ রোগী বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকেন। সেখানে এত অপ্রয়োজনীয় পরিমাণ ও বেশি মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় যে পরবর্তীতেও সব ওষুধ আর রোগীর শরীরে কাজ করে না। আবার অনেক রোগীও চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধের ডোজ পূর্ণ করেন না কিংবা পরামর্শ ছাড়া ওষুধ কিনে সেবন করেন। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে আইসিইউতে অনেক রোগীর কোনো অ্যান্টিবায়োটিকই কার্যকর হয় না। চোখের সামনে রোগীর পরিস্থিতি খারাপ পর্যায়ে চলে যায়। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে সচেতন না হলে অসুস্থ হলে চিকিৎসার কোনো পথ থাকবে না।’   সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com