শফিকুল ইসলাম শফিক। একসময় ফেরি করে গামছা বিক্রি করতেন। এরপর শুরু করেন পান ব্যবসা ও কসাইয়ের কাজ। পরবর্তী সময়ে জড়ান বিমানবন্দরকেন্দ্রিক ‘ল্যাগেজ পার্টি’তে। গড়ে তোলেন সোনা চোরাচালানের নেটওয়ার্ক। ঢাকা থেকে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতে সোনা চোরাচালান করে হয়ে যান কোটিপতি চোরাকারবারি।
উত্তরার জমজম টাওয়ারের একাংশের মালিক তিনি। এ ছাড়া নামে-বেনামে গড়েছেন অঢেল সম্পদ। বৃহত্তর উত্তরার উত্তরখান থানার একচ্ছত্র অধিপতিও। সোনা চোরাচালানের কারণে ‘গোল্ডেন শফি’ নামে বেশি পরিচিত এলাকায়। একজন হকার থেকে ভোজবাজির মতো আজ হাজার কোটি টাকার এই মালিক। তার বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না কেউ।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের টানা দুবারের কাউন্সিলর এই শফি। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দ্রুতই মামলার তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে বলে জানান তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
যেভাবে উত্থান শফির
১৯৯৬ সালের ৯ মে। ব্রিটিশ পাসপোর্টধারী বাংলাদেশি সুরত মিয়া ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন। তার আচরণ অসংলগ্ন, পাঁড় মাতালের মতো। একপর্যায়ে কেউ তার পেটে কাচের বোতল ঢুকিয়ে দিলে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। সুরত মিয়া হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার স্ত্রী সৈয়দা শামসিয়া বেগম বাদী হয়ে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় কাস্টমসের তিন কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের পক্ষে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়ে জয় করে নেন স্বর্ণের হরিণ। বিমানবন্দরে গড়ে তোলেন সোনা ও অর্থ চোরাচালানের বিশাল নেটওয়ার্ক। জিরো থেকে হিরো বনে যান। এখন ঘোরেন কোটি টাকার গাড়িতে। মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে বিদেশে পাচার করেন অর্থ।
একসময় বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ‘গোল্ডেন শফি’। পরে খোলস পাল্টে বনে যান আওয়ামী লীগ নেতা। নির্বিঘ্নে টাকা পাচার করতে ‘শফি অ্যান্ড ব্রাদার্স’ নামে একটি একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্ত করেন সিভিল এভিয়েশনে। টানা তিন বছর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার পার্কিং, ময়লা নিষ্কাশন ও কনকর্ড হলের ইজারাদার ছিল এই প্রতিষ্ঠান।
শফির সোনার কারবারে একপর্যায়ে সহযোগীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনির। দোকানের সেলসম্যান থেকে ‘গোল্ডেন মনির’ এবং হকারের পেশা থেকে আসা ‘সোনা শফি’ মানিকজোড় হয়ে ওঠেন। দুজনে মিলে হাজার হাজার কোটি টাকা কামান, অবৈধ পথে গড়ে তোলেন বিশাল বিত্তবৈভব।
২০২০ সালের ২১ নভেম্বর সকালে মেরুল বাড্ডার বাসা থেকে র্যা বের হাতে আটক হন গোল্ডেন মনির। এরপর কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম আত্মগোপনে চলে যাওয়ার খবর আসে গণমাধ্যমে।
কে এই শফি
শফিক ওরফে সোনা শফি উত্তরখানের কাচকুড়া বেতগী গ্রামের মৃত ফজন উদ্দিনের ছেলে। চার ভাই-বোনের মধ্যে পরিবারের সবার বড় তিনি। তার বিরুদ্ধে উত্তরার দুই থানায় কয়েকটি মামলা আছে। সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর হওয়ার পরে এলাকায় আরো আধিপত্য বিস্তার করেন তিনি। দিনের পর দিন শফি ও তার ক্যাডার বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয় কাচকুড়া এলাকার বহু মানুষ।
শফির যত সম্পদ
জমজম টাওয়ার ছাড়াও উত্তরার প্রায় প্রকল্পে মালিকানা আছে গোল্ডেন শফির। শফি সিন্ডিকেট রাজউক থেকে উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ৯০ কাঠার একটি প্লট বরাদ্দ নেয়। তবে গোল্ডেন মনির গ্রেপ্তারের পর সেই লিজ বাতিল করা হয়। সেক্টরে একাধিক ফ্ল্যাটের মালিকসহ নামে-বেনামে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েন সোনা শফি।
বিমানবন্দরে কথিত কিছু অসাধু কর্মকর্তার বদৌলতে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে সব অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করেন এই শফি। বিমানবন্দরের অভ্যন্তরীণ সব স্তরে প্রভাব খাটিয়ে দাপিয়ে বেড়ান স্বর্ণ চোরাচালানের গডফাদার শফি।
এদিকে গোল্ডেন শফি ‘জমজম টাওয়ারের’ মালিক হলেও সাফা টাওয়ারের মালিকানায় তাকে রাখা হয়নি। অথচ সাফা টাওয়ার করতে জমজম টাওয়ার বন্ধক রেখে ব্যাংক থেকে ৭০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়। এখানেও শফির চালাকি রয়েছে বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা কী বলছেন
গেল বছরের ১১ মে গোল্ডেন শফি ও তার ১০ সহযোগীর বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা করেন সিআইডির পরিদর্শক মো. ইব্রাহিম হোসেন। রাজধানীর বাড্ডা থানায় করা এই মামলায় আসামি- সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন, তার ভাই হায়দার আলী, কাউন্সিলর শফিকুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন শফি, তার অন্যতম সহযোগী গোল্ডেন মনির, মনিরের সহযোগী আবদুল হামিদ, মনিরের স্ত্রী রওশন আক্তার, ছেলে রাফি হোসেন, বোন নাসিমা আক্তার, নাসিমার স্বামী হাসান আলী খান, মনিরের আরেক ভগ্নিপতি নাহিদ হোসেন।
মামলাটি তদন্ত করছেন সিআইডির পরিদর্শক ছাদেক আলী। ঢাকা টাইমসকে তিনি জানান, বর্তমানে মামলাটি তদন্তাধীন রয়েছে। শফির অনেক সম্পদ পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অবৈধভাবে উপার্জিত যেসব সম্পদ পাওয়া যাবে, সেভাবেই প্রতিবেদন দাখিল করবেন তারা।
এই মামলার পরে গোল্ডেন শফি সিআইডির সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না কিংবা তিনি কোথায় আছেন জানতে চাইলে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা তদন্তকেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছি। তাকে (শফি) ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তিনি আসেননি। যতটুকু শুনেছি, তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিন নিয়েছেন।’
যা বললেন গোল্ডেন শফি
তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) এই বিতর্কিত কাউন্সিলর। ঢাকা টাইমসকে তিনি বলেন, ‘সব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আমি মানুষের জন্য কাজ করি। জনপ্রিয়তা আছে বলেই দুবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। আর মানি লন্ডারিং আইনে সিআইডির করা মামলায় বর্তমানে জামিনে আছি।’
সাফা টাওয়ার করতে ‘জমজম টাওয়ার’ বন্ধক রেখে ৭০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই টাওয়ারে (সাফা টাওয়ার) তার মালিকানায় নেই কেন, জানতে চাইলে শফি বলেন, `এগুলো করে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। ওরা (গোল্ডেন মনির ও উপজেলার চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন) জাল কাগজপত্র করে এগুলো করেছে। আমি অবৈধ কোনো কাজের সঙ্গে জড়িত না।’
সূএ:ঢাকাটাইমস