আবু আফজাল সালেহ , কবি ও প্রাবন্ধিক:
কলাবউ’ নিশিকান্ত রায় সম্পাদিত লালমনিরহাট থেকে প্রকাশিত স্মরণিকা। এতে ১৪টি প্রবন্ধ, ৫০টি কবিতা, ১২টি গল্প, ১১টি ছড়া, ২টি ভ্রমণকাহিনি, ৩টি স্মৃতিকথা রয়েছে। এ ছাড়া ‘ছবিতে’ বিভাগে রিয়াংকা রায়ের একটি চিত্রকর্ম রয়েছে। লেখার পাশাপাশি অক্ষরবিন্যাস, মেকাপ মানানসই। সম্পাদনা পর্ষদের আন্তরিকতার ছোঁয়া রয়েছে প্রতিটি লেখায়, প্রতিটি পাতায়।
প্রতিষ্ঠিত গল্পকার দীলতাজ রহমান, মনি হায়দার প্রমুখের পাশাপাশি নবীন গল্পকারের গল্পও রয়েছে। অদিতি ঘোষ দস্তিদারের ‘খদ্দের’, কমল রায়ের ‘জিমির পুজো’, গোপাল চন্দ্র মন্ডলের ‘ইচ্ছে’, তপশ্রী পালের ‘সিঁদুরখেলা’ গল্পগুলো পাঠককে আকৃষ্ট করবে। দীলতাজ রহমানের ‘চোর’ গল্পের শেষ লাইনটি কতই না মোহনীয়, ‘…তারপর আমাকে নিয়ে শরৎ-আকাশে সুদূরের মেঘ হয়ে নীহারিকাপুঞ্জ ছুঁতে…’। উত্তম কুমার রায়ের ‘সনাতন (হিন্দু) বৈদিক আইন’ প্রবন্ধে হিন্দু আইনের উৎস, উত্তরাধিকার অধিকার প্রভৃতি সম্পর্কে জানা যাবে। অসীম সাহার ‘বিদ্যাসাগর: ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাপুরুষ’ শিরোনামীয় প্রবন্ধে পাঠক বিদ্যাসাগর ও অন্যান্য বিষয়ে ঋদ্ধ হতে পারবেন।
আনোয়ার কামালের কবিতা ‘সোনালী ধানে নুয়ে পড়েছে পুরোটা মাঠ/মাকড়সা জাল ফেলে ধরছে ফড়িং (হেমন্তের ধ্বনিময় স্ফুরিণে)’—কবিতার শুরুটাই কী সুন্দর চিত্রকল্পে, কী সুন্দর হৃদয়গ্রাহী। ‘মানব বন্ধন আর মানব মিছিলে আঁকছে ছিন্নভিন্ন জিজ্ঞাসা’ (ছিন্ন জিজ্ঞাসা/আবদুস সালাম)—কী সুন্দর বার্তা দিচ্ছে। উল্লেখিত কবিতাদ্বয় ছাড়াও আভা সরকার মন্ডলের ‘হাত রেখো না’, চৌধুরী ফেরদৌসের ‘স্টোন গার্ল’, আলেয়া ফেরদৌসী লাকীর ‘না ফিরলেও ক্ষতি নেই’, বঙ্গ রাখালের ‘শরৎ’, মিঠুল মাসুদের ‘উল্টো স্রোত’ কবিতাগুলো বেশ ভালো। এখানে ‘গোধূলিবেলায় ধরলার তীরে’ শিরোনামে লালমনিরহাটের স্মৃতিময় নদী ধরলা নিয়ে আমার ছোট একটি সমিল পদ্য রয়েছে। সুন্দর চিত্র বা চিত্রকল্প বা অপূর্ব উপমা-উৎপ্রেক্ষা, অলংকার এবং ঝরঝরে শব্দবুননের কিছু কবিতাংশ বা ছড়াংশ তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারছি না:
১.
একটি ক্ষয়িষ্ণু পাথরের থাবা
মলমের প্রলেপ দেওয়া আকাশ
সূর্য রশ্মি টেনে রেখেছে
(একটি ক্ষয়িষ্ণু পাথরের থাবা, গোলাম রসুল)
২.
পৃথিবী তো পাল্টেছে মা
প্রযুক্তিতে দারুণ প্রসার
অবস্থা কি স্বর্গ রাজ্যে?
রথই আছে? নাকি সসার?
(মায়ের বাহন, চন্দনকৃষ্ণ পাল)
৩.
আহা অসময়
ময়ূরপেখম কাশফুল…
বৃষ্টিতে নেতিয়ে যায় বয়োবৃদ্ধ
স্তনের মতো!
(সূর্য বনাম ঈশ্বর, বিনয় কর্মকার)
৪.
ময়ূরের রঙ ফিকে হয়ে গেছে বলে
যারা মাথার চুলের ভেতর হাত চালায়
অথবা মাঝপথে মুঠো করে ধরে
অন্যহাত শূন্যে ছুড়ে দেয়
(রঙহীন দেশে, হরিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়)
৫.
মা তোমাকে ভালোবাসি
মা ডাকো আর আম্মা ডাকো
মাম্মি কিংবা মম,
মায়ের তাতে মর্যাদা-মান
হয় না কিছু কম।
(মা তোমাকে ভালোবাসি, ওয়াসিফ-এ খোদা)
তমা দত্তের ‘স্মৃতির অকপটে’, অর্ণব চক্রবর্তীর ‘আগমনী হতে বিসর্জন’ কিংবা পলক কুমার মন্ডলের ‘আমার পুজোর দিনগুলো’র মতো ‘স্মৃতিকথা’ গদ্যগুলো পুরাতন অনেক কিছু ভাসিয়ে দেবে, নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নেবে। ভ্রমণগদ্য ‘ঋষি জাবালির তপস্যা ভূমিতে (দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী)’ ভারতের বান্ধবগড় উদ্যানের গল্প ও বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময় হবে। বালির গল্প, অভিজ্ঞতা, অবসর সময় নিয়ে শৌর্য দীপ্তের ‘জাতীয় বীর: গনেশ’ আরেকটি নান্দনিক ভ্রমণগদ্য।
সম্পাদক নিশিকান্ত রায়ের ‘কলাবউ কথা’ আলোচনায় আর্টস (কলা), পূজা, কলাবউ পরিচিতি পাঠককে অনেককিছু জানাবে। রায় এ প্রবন্ধের প্রায় প্রথমদিকে বলেছেন, ‘…‘কলাবউ’ যেন সেই আকুলতা মাখানো এক অনন্য নিবিড় শিল্প কলা। যার শুরু ও শেষ নেই। সমগ্র বিশ্বসত্তার এক মিলন মোহনা। কলা ও বউ শব্দ দুটো ছোট হলেও এর বিস্তার অসীম। দুটো শব্দেই আছে সৃষ্টিময়তাকে মেলে ধরার উদ্বাহু উচ্ছ্বাস এবং বর্ষজীবী হয়ে টিকে থাকার চৈতন্য শক্তি।’ আমরা মনে করি ‘কলাবউ’ অসুরগুলোকে ভেঙেচুরে রূপ, রস ও গন্ধে ভরপুর হয়ে উঠবে।
১৬০ পৃষ্ঠার বইটির বিনিময় মূল্য ২০০ টাকা। প্রচ্ছদ, অক্ষরবিন্যাস বা কাগজের মান সন্তোষজনক। সংগ্রহে রাখার মতো একটি স্মরণিকা এটি। সূূএ:জাগোনিউজ২৪.কম