ছবি সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক : নুরুল হক মোল্লা ওরফে নুরাল পাগলা রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ পৌরসভার পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের হাতেম মোল্লার ছোট ছেলে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করা নুরাল দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে সরকারের দেওয়া বিশেষ সুযোগে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। তবে পাশ করেছিলেন কিনা তা সমসাময়িক কেউ বলতে পারেননি। কৈশোর বয়স থেকে মাটির বদনা বাজিয়ে গান করতেন তিনি। নির্দিষ্ট কোনো পেশায় না থাকলেও ঘুড়ি ও টুপি বানাতেন, টুকটাক কবিরাজি করতেন। তবলা বাজানো তার শখ ছিল। বসতি ছিল একটি ছনের ঘরে। কালক্রমে কোটিপতি হয়ে ওঠা সেই নুরাল পাগলা এখন দেশজুড়ে আলোচনায়।
ইসলামবিরোধী নানা কর্মকাণ্ডের জন্য সারাজীবনই তিনি বিতর্কের মধ্যে ছিলেন। ২৩ আগস্ট তার মৃত্যু হয়। ১৩ দিন পর ৫ সেপ্টেম্বর শুক্রবার বিক্ষুব্ধ জনতা তার আলিশান বাড়ি ও আস্তানায় হামলা চালায়। কবর থেকে লাশ তুলে আগুন দেয়।
এক প্রতিবেশী জানান, নুরাল ৮০ ও ৯০-এর দশকে কবিরাজি করে কারও কাছ থেকে টাকা নিতেন না। কেউ কিছু নিয়ে এলে নিজের কাছে রাখতেন। খাদ্যদ্রব্য হলে তা বাড়িতে নিয়ে বাবা-মাকে খাওয়াতে বলতেন। পরে সাংসারিক টানাপড়েনে রোগীদের কাছ থেকে টাকা ও উপঢৌকন নিতে শুরু করেন। পাশাপাশি গান-বাজনার আসর বসাতেন নিয়মিত। এর মধ্যেই আশির দশকে তিনি নিজেকে ইমাম মাহদী দাবি করে দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। তৎকালীন আলেম-ওলামারা এটাকে ভন্ডামি আখ্যা দিয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তুললে তিনি এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ম্যানেজ করে ১৯৯৩ সালের ২৩ মার্চ মুচলেকা দিয়ে এলাকায় ফেরেন। কিন্তু ওয়াদা ভেঙে তিনি আবারও দরবারের কার্যক্রম চালু করেন।
স্থানীয়রা জানান, নুরাল পাগলা পবিত্র আল কুরআনকে ‘ভুজপাতা’ বা মূল্যহীন বলতেন। পবিত্র কালেমা ও আজানে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাম বাদ দিয়ে নিজের নাম যুক্ত করে তা প্রচার করতেন। কখনো কখনো দরবারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে সৃষ্টিকর্তা দাবি করে ভক্তদের সেজদা নিতেন। তার মৃত্যুর পর ভক্তদের তার কবর তাওয়াফ করার অসিয়তও করেন। তবে ভক্তরা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
দুই বড় ভাই সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ও দুলাল মোল্লার পরিবারের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক ছিল না নুরাল পাগলার। দুই ভাইয়ের অংশের পৈতৃক জমি নামমাত্র মূল্য দিয়ে জোর করে তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছেন বলে বড় ভাইয়ের ছেলে লিটন অভিযোগ করেছেন।
তিনি জানান, জমিজমা নিয়ে দীর্ঘদিন এলাকায় বিচার-সালিশের মধ্যে লিটনকে মামলা দিয়ে জেলও খাটিয়েছেন নুরাল। বাজারে কুলি-মজুরের কাজ করলেও ধনাঢ্য চাচা তাদের কখনো খোঁজ নেয়নি।
তিনি বলেন, ভক্ত ছাড়া কোনো প্রতিবেশী বা এলাকার লোকজনের সঙ্গে তার তেমন সম্পর্ক ছিল না। তবে ৫ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেশীরাই নুরাল পাগলার পরিবারের অনেক সদস্য ও ভক্তকে জনরোষ থেকে রক্ষা পেতে সহায়তা করেন।
রাজবাড়ী জেলা সদরের খানখানাপুর এলাকার জনৈক দলিল লেখক শামসু মহুরির মেয়ে তার ভক্ত আনোয়ারা খাতুনকে বিয়ে করেন নুরুল হক। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। তারাও সামাজিক জীবনের বাইরে অনেকটা সংরক্ষিত জীবনযাপন করেন।
কালক্রমে বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়ে ওঠেন নুরাল। উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বিশাল বাড়িতে একটি তিন তলা ভবন এবং দুটি ছোট ভবন রয়েছে। রয়েছে কয়েকটি দামি গাড়ি। অথচ তার কখনোই উল্লেখযোগ্য আয়ের উৎস ছিল না। তবে তার বড় ছেলে মেহেদী নুরতাজ ওরফে নুরতাজ নোভার ঢাকায় গার্মেন্ট ব্যবসা রয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। নুরতাজের বিরুদ্ধে ঢাকা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আস্তানা গড়ে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রচারণা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। এ নিয়ে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও চলমান রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, দরবারের আড়ালে তারা খ্রিষ্ট ধর্মের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। দরবারের ভক্ত ও ও হামলায় নিহত রাসেল মোল্লার বাবা আজাদ মোল্লার করা মামলায় দাবি করা হয়, অজ্ঞাত আসামিরা নুরাল পাগলার দরবারে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও মারধর করে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি করেছে। এছাড়া দরবার শরিফে ভক্তদের দেওয়া ৪০ লাখের বেশি টাকা, ৫০ লাখ টাকার স্বর্ণালংকার, ৫৫ লাখ টাকার মূল্যবান জিনিসপত্রসহ ১ কোটি ৪৫ লাখ টাকার জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা।
বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় ২৩ আগস্ট ভোরে ঢাকার একটি হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। রাতে মাটি থেকে ১২ ফুট উঁচুতে বিশেষ কায়দায় তাকে দাফন করা হয়। যে বেদির ওপর তাকে দাফন করা হয়, সেটি পবিত্র কাবা ঘরের আদলে তৈরি মজবুত পাকা ইমারত।
বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ হন স্থানীয় আলেম ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে উপজেলা ইমাম-আকিদা রক্ষা কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটি সংবাদ সম্মেলন করে এবং জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে প্রতিকারের আল্টিমেটাম দেয়। কিন্তু দাবি পূরণ না হওয়ায় ৫ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ সমাবেশ আহ্বান করা হয়। সমাবেশ হতে বেরিয়ে একদল উচ্ছৃঙ্খল ব্যক্তি নুরাল পাগলার বাড়ি ও দরবারে হামলা চালায়।
গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি রাকিবুল ইসলাম জানান, পুলিশের ওপর হামলা ও ভক্ত রাসেল মোল্লাকে পিটিয়ে হত্যা মামলায় বুধবার পর্যন্ত ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। দুই মামলায় আসামির সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার। ভিডিও ফুটেজ যাচাই করে অপরাধীদের গ্রেফতার করতে তারা কাজ করছেন। এছাড়া হামলায় উসকানিদাতাদেরও চিহ্নিত করে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সূএ: বার্তাবাজার ডটকম