কণ্ঠকে শুধু যোগাযোগের প্রধান উপায় ভাবলে ভুল হবে। বাক্যের ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা আমাদের ব্যবহার করা শব্দের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনার কথা কী প্রভাব সৃষ্টি করবে তার ৩৮ শতাংশ নির্ভর করে কণ্ঠের ওঠানামার (tone) অপর। আর তাই দৈনন্দিন সাংসারিক বা কর্মক্ষেত্রে কথাবার্তার জন্য ভালো কণ্ঠের গুরুত্ব অনেক বেশি।
পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারী মানুষের জন্য কণ্ঠই সব কিছু। পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারী বলতে বুঝি যাদের পেশার জন্য কণ্ঠ প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক। যেমন: গায়ক, অভিনেতা, শিক্ষক, উকিল, ধারাভাষ্যকার, কলসেন্টারের কর্মী ইত্যাদি।
পরিসংখ্যানে কণ্ঠের সমস্যা
আমেরিকায় ২৯ শতাংশ মানুষ জীবনে কোনো না কোনো সময় কণ্ঠের সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং এতে যে কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় তার অর্থমূল্য প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার। বছরে প্রতি ১৩ জনে একজন এ সমস্যায় পড়েন। বয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে মহিলা এবং শিশুদের ক্ষেত্রে ছেলেরা এ সমস্যায় বেশি আক্রান্ত হয়। আমেরিকায় পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারীদের মাঝে এ বিষয়ে চালানো জরিপ অনুযায়ী শিক্ষকদের ১১ শতাংশ কণ্ঠের সমস্যায় ভুগছেন। শিক্ষক ছাড়া অন্য পেশার ক্ষেত্রে এ হার ৬.২ শতাংশ। কণ্ঠের সমস্যায় চাকরি হারিয়েছেন এমন সংখ্যা শিক্ষক ২০ শতাংশ এবং অন্য পেশাজীবী ৪ শতাংশ। অন্যান্য জরিপে দেখা যায়, ৪৬.৯ শতাংশ কণ্ঠশিল্পী, ৪৫ শতাংশ কলসেন্টারের কর্মী কণ্ঠের সমস্যার কারণে কর্মক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হন।
কণ্ঠের সমস্যার কারণ কী
১. কণ্ঠনালির প্রদাহ দুই ধরনের। যেমন- তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস। কণ্ঠনালির ভাইরাসজনিত, আবহাওয়া পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণেও কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। যদি ব্যাকটেরিয়ার কারণে কণ্ঠনালিতে ইনফেকশন ও শ্বাসকষ্ট হয়, তখন চিকিৎসা দরকার। পাকস্থলীর অ্যাসিড রিফলাক্সের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে। ধূমপান, অতিরিক্ত চা বা পানীয় পান, হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার বা যাদের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে।
২. অতি উচ্চৈঃস্বরে অতিরিক্ত কথা বললে, দীর্ঘমেয়াদি বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বললে কণ্ঠনালির প্রদাহ হতে পারে।
৩. পলিপ, নডিউল বা সিস্ট, রক্তক্ষরণ।
৪. গলার স্বর পরিবর্তনের ২১ দিনের মধ্যে ভালো না হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। কণ্ঠনালির ক্যান্সার প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় করে চিকিৎসা করলে সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায় এবং এ রোগের সব ধরনের চিকিৎসা যেমন- সার্জারি, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি আমাদের দেশে বিদ্যমান।
কণ্ঠের যত্নে কিছু উপদেশ-
১. সবার আগে দরকার সচেতনতা। অনেকেই জানে না তাদের পেশার জন্য সুস্থ ও সুন্দর কণ্ঠ কতটা জরুরি।
২. নিজের কণ্ঠ নিজে শুনতে হবে, যেন কোনো সমস্যা তাড়াতাড়ি আন্দাজ করা যায়। সমস্যা তিন সপ্তাহের বেশি থাকলে নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।
৩. আর্দ্রতা কণ্ঠের সুস্থতার জন্য অত্যন্ত জরুরি; তাই প্রতিদিন অন্তত ২ লিটার পানি পান করতে হবে।
৪. কণ্ঠ ব্যবহারে সাবধানী হোন। অতি উচ্চ বা পরিবর্তিত স্বরে কথা বলবেন না।
৫. এলকোহল, কফি, চা, কোমলপানীয় শরীরের কোষে পানিশূন্যতা ঘটায়। এগুলো অল্প পরিমাণে পান করলে সমস্যা নেই, তবে বেশি নয়।
৬. ধূমপান, এলকোহল, তামাক, গাঁজা ও অন্যান্য নেশা সম্পূর্ণ পরিহার করুন।
৭. ঘুমাতে যাওয়ার কমপক্ষে ২ ঘণ্টা আগে খাওয়া শেষ করুন এবং অল্প আহার করুন।
৮. অতিরিক্ত টেলিফোন ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।
৯. অপ্রয়োজনে বারবার গলা পরিষ্কার/কাশি দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
১০. শুষ্ক আবহাওয়া কণ্ঠের জন্য ক্ষতিকর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের বাতাস, যাতে জলীয়বাষ্প কম, কণ্ঠের আর্দ্রতা কমিয়ে দেয়। রাতে আর্দ্রতাকরণ যন্ত্র ব্যবহার করুন।
১১. উড়োজাহাজে বাতাস শুষ্ক থাকে। কফি, চা, কোমলপানীয় এড়িয়ে চলুন। প্রতি ঘণ্টায় কমপক্ষে ৮ আউন্স পানি পান করুন।
১২. গলায় গারগিল করা যেতে পারে (১/২ টেবিল চামচ লবণ+১/২ টেবিল চামচ বেকিং সোডা+৬ আউন্স হালকা গরম পানি)।
১৩. অনেক সময় গলা শুকনা থাকলে অথবা মিউকাস জমে থাকলে আমরা জোরে কাশি দিয়ে গলা পরিষ্কার করার চেষ্টা করি, যা অত্যন্ত ক্ষতিকর। এ জন্য যা করবেন- প্রথমে বুক ভরে শ্বাস নিন, কিছুক্ষণ ধরে রাখুন, এবার শ্বাস ছাড়ার সময় আস্তে শব্দ করুন।
১৪. এলার্জি বা ঠান্ডার সমস্যায় আমরা হরহামেশা এন্টিহিস্টামিন ওষুধ ব্যবহার করি। এন্টিহিস্টামিন ওষুধ কণ্ঠের শুষ্কতার কারণ। সম্ভব হলে এগুলো এড়িয়ে স্টেরয়েড স্প্রে নাকে ব্যবহার করুন।
১৫. পেশাগত কণ্ঠ ব্যবহারকারীদের NSAID জাতীয় ব্যথার ওষুধ এড়িয়ে চলা উচিত।
১৬. যখন বেশি মিউকাস উৎপন্ন হয় তখন মিউকাস তরলকারী ওষুধ ব্যবহার করতে পারেন।
১৭. স্থানীয় চেতনানাশক যথেচ্ছ ব্যবহার করবেন না।
১৮. ধোয়া/ধুলা/দূষিত বাতাস এড়িয়ে চলুন। ১৯. গান গাওয়ার সময় শারীরিক, মানসিক অবসাদমুক্ত থাকতে হবে। হালকা গরম পানিতে গারগিল করতে পারেন। ২০. নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং পর্যাপ্ত ঘুমান। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন