হঠাৎ করেই বেড়েছে ভয়ংকর মাদক আফিমের চাহিদা। মাঝেমধ্যে কিছু ধরাও পড়ছে। তবে ধরা পড়া আফিমের চালানগুলোর গন্তব্য কোথায় ছিল তা এখনো অজানা রয়ে গেছে। গত বছর থেকে এ পর্যন্ত পাঁচটি বড় অভিযানের মধ্যে তিনটি মামলার চার্জশিট দেওয়া হলেও তাতে উঠে আসেনি আফিমের গন্তব্য। তবে সংশ্লিষ্টদের কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশে অফিমের ব্যবহার নেই বললেই চলে। কেবল বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে আফিম পাচারের ক্ষেত্রে। কেউ কেউ বলছেন, বর্তমানে কিছু শিক্ষিত তরুণ নতুন মাদকে ঝুঁকছে। তারাই হয়তো আফিমকে আবার বিভিন্নভাবে মরণ নেশায় ব্যবহার করছে। র্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল এম এ ইউসুফ বলেন, ‘চাহিদা থাকার কারণেই সরবরাহ হচ্ছে। তবে আমাদের হাতে গ্রেফতাররা প্রায় সবাই দ্বিতীয় সারির এবং মূলত বহনকারী। চালানের গন্তব্য ঢাকা ছাড়া কোথায় ছিল তা জানা সম্ভব হয়নি। ইতোমধ্যে তিনটি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। সীমান্তবর্তী গহিন অরণ্যে কিছু আফিমের চাষ হয় বলে গ্রেফতাররা জানিয়েছেন।’ ইউএনওডিসির পরামর্শক ও ডিএনসির সাবেক পরিচালক আবু তালেব বলেন, ‘হঠাৎ করে আফিম ধরা পড়ার বিষয়টি উদ্বেগের। আশির দশকের শুরুতেই আফিমের ব্যবহার মাদকসেবীদের কাছে কমতে শুরু করে। হয়তো নজরদারির বাইরে থেকে গাঁজার কেকের মতো করে এমন ক্ষেত্রে আফিমের ব্যবহার হচ্ছে। তবে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ আফিম থেকেই হেরোইন তৈরি হয়। হয়তো যেসব দেশে হেরোইনের চাহিদা রয়েছে সেখানে এসব চালান যাচ্ছিল।’ ১ জুলাই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসানের নেতৃত্বে একটি দল রাজধানীর পল্টন থেকে ২ কেজি আফিমসহ আবুল মোতালেব (৪৬) নামে একজনকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বনশ্রী আবাসিক এলাকা থেকে জাহাঙ্গীর সিদ্দিক ভুঁইয়া (৪৪) নামে আরেকজনকে আরও ১ কেজি আফিমসহ গ্রেফতার করে। ওষুধের কাঁচামালের আড়ালে রাজধানীতে আনা হয়েছিল এ ৩ কোটি টাকার আফিম। একটি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমেই ফেনী থেকে এ চালানটি ঢাকায় আনা হয়েছিল। পাঠিয়েছিলেন একজন চিকিৎসক। এ বিষয়ে ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্লাহ কাজল বলেন, ‘আমরা শিগগিরই গ্রেফতারদের রিমান্ডে আনতে আদালতের অনুমতি চাইব। আশা করছি তাদের কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে।’
জানা গেছে, আফিম একটি ‘ক’ শ্রেণির মাদক। আফিমকে প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমেই তৈরি হয় আরেক ভয়ংকর মাদক হেরোইন, চেতনানাশক ওষুধ মরফিন ও নেশাজাতীয় কোডিন। আশির দশক পর্যন্ত নেশা হিসেবে সরাসরি আফিম ব্যবহৃত হতো। সেবীদের বড় একটি অংশ ছিল উপজাতি। মহল্লাকেন্দ্রিক আফিমের দোকান ছিল। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি বছর ১০ শতাংশ করে আফিমের ব্যবহার কমিয়ে আনার টার্গেট দিয়ে ১৯৮১ সালে আফিম নিষিদ্ধ করা হয়। আফগানিস্তান, ভারতের পূর্বাঞ্চলের সাত রাজ্য, চীনের উত্তরাঞ্চলের ইউহান প্রদেশ ছাড়াও পাকিস্তান ও ইরানে এর চাষাবাদ হয়। হেরোইনের মতোই আফিম গ্রহণের ক্ষতিকর অনেক দিক রয়েছে। এটি গ্রহণে শ্বাসকষ্ট হতে পারে, গ্রহণকারী অবচেতন হয়ে পড়তে পারে। মুখ ও নাক শুকিয়ে যাওয়া, বমিভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদির পাশাপাশি বেশি পরিমাণে ব্যবহারে মৃত্যুও ঘটতে পারে।
চলতি বছরের ১৯ এপ্রিল বান্দরবানের থানচি উপজেলায় আফিম কেনাবেচার সময় ১ কোটি টাকা মূল্যের ১ কেজি আফিমসহ রুম তুই ম্রো (৩০), সন রাই ম্রো (২৫) ও রিংওয়ই ম্রোকে (২২) গ্রেফতার করে র্যাব-৭-এর একটি দল। সে সময় র্যাব-৭-এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (মিডিয়া) মো. নূরুল আবছার বলেছিলেন, এদের সঙ্গে থাকা প্লাস্টিকের বস্তা তল্লাশি করে পলিথিনে মোড়ানো অবস্থায় ১ কেজি আফিম উদ্ধার করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার ও বান্দরবানের বিভিন্ন মাদক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে আফিম সংগ্রহ করে তারা। পরে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আফিম ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের কাছে বিক্রি করে আসছে।
এর আগে ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া থেকে সাড়ে ৩ কোটি টাকার আফিমসহ বাবু মারমা নামে এক যুবককে গ্রেফতার করে র্যাব। বাবু মারমা বান্দরবান সদর উপজেলার তংজংগা পাড়ার মংছোর ছেলে।
গত বছরের ২২ আগস্ট বান্দরবানের রোয়াংছড়ি থেকে আনুমানিক ৪ কোটি ৩০ লাখ টাকার ৪ দশমিক ৩ কেজি আফিমসহ প্রথোয়াই মার্মা (৭০) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে র্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছিলেন, প্রথোয়াই মার্মা দীর্ঘদিন ধরে দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে মাদকদ্রব্য আফিম উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাত করে পাইকারি মাদক ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে আসছেন। এর কিছুদিন আগে গত বছরের ৯ মার্চ থানচি উপজেলার সাংগু ব্রিজসংলগ্ন মাইক্রো স্টেশনের পাশে যৌথ বাহিনী ৩ কেজি ৭০০ গ্রাম আফিমসহ লেংরাও ম্রো (১৯) নামে এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে।
সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন