সুমি ইসলাম:
পর্ব ১
বেশ কয়েকবার রিং হওয়ার পর অবশেষে আবির কল রিসিভ করল।
এপাশ থেকে তিথি সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, ‘আবির কই তুমি? এতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি ফোন রিসিভ করছ না কেন? কী সমস্যা তোমার?’
‘আরে আমার কী সমস্যা হবে, রেডি হচ্ছিলাম, তাই ফোনটা রিসিভ করতে পারিনি। এখন বের হবো, এতবার কল দিচ্ছো কেন বলো তো? জরুরি কিছু?’
‘কোথায় যাবা তুমি,’ বেশ ঝাঁঝালো স্বরে জানতে চাইল তিথি।
‘কোথায় আবার! রিপন-কাজল আসছে ওদের সঙ্গে মাওয়া যাব।’
‘না, কোথাও যাবা না। আমি আসছি, টিএসসিতে বসো, আমার আসতে একঘণ্টা লাগবে, তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে,’ বলেই লাইনটা কেটে দিলো তিথি।
আবির তিথির ওপরে বেশ বিরক্ত হলো, সবসময় তিথি এমনটাই করে, নিজের কথা শেষ হলেই লাইন কেটে দেবে। অপরপক্ষেরও যে কিছু বলার থাকতে পারে সেটা ভাবেই না। ইদানীং এটা আরো বেশি বেড়েছে। কোনো কথায় বলা যায় না, ফোঁস করে উঠে। আবির ওর বন্ধুদের টিএসসিতে এসে অপেক্ষা করতে বলে।
দ্রুত রেডি হতে হবে। বাসায় এখন বাবা নেই, মাকে যেকোনো কিছু বলে এখনই বের হতে হবে। আবিরের সঙ্গে আজ একটা ফয়সালা করতেই হবে, ভাবে তিথি।
আলমারি থেকে কালো একটা তাঁতের শাড়ি বের করে দ্রুত পরে নিলো। খোলা চুল, কপালে কালো একটা টিপ, হালকা লিপষ্টিক আর চোখে গাঢ় করে কাজল দিয়ে দুই মিনিট আয়নার সামনে দাঁড়ায়ে নিজেকে দেখে নিলো সে। এত হালকা সাজ, তারপরও যেন অপ্সরা। আয়নাতে নিজেকে একটু আলতো করে ছুঁয়ে দিলো আনমনে, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে থেকে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে মায়ের রুমের দিকে গেল।
তিথির মা তাজনিহার জামান বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। ঘুমাচ্ছেন নাকি জেগে আছেন বোঝা যাচ্ছে না। ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতেই তাজনিহার জামান মৃদু স্বরে বললেন, ‘আবিরের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিস বুঝি?’
‘মা, তুমি কেমন করে সব বোঝো বলো তো?’ অবাক হয়ে তিথি জানতে চাইল। ধীর পায়ে মায়ের পাশে গিয়ে বসে বলল, ‘মা একটা ফয়সালা তো করতেই হবে। বাবা বের হতে দেবে না, তাই এখনই একটু যেতে হবে, বাবা বাসায় ফিরলে তুমি একটু ম্যানেজ করে নিও প্লিজ।’
শোয়া থেকে উঠে বসে তাজনিহার বেগম বললেন, ‘যা, তবে মনে রাখিস তুই বড়ো হয়েছিস, ভালো-মন্দ বোঝার ক্ষমতা তোর হয়েছে। আশা করি বাবার মতের বিরুদ্ধে কিছু করবি না। তোর বাবার একটা সন্মান আছে সেটা মাথায় রাখবি, তোর বাবা তোকে অনেক আদরে মানুষ করেছেন, তোর আদর ভাগাভাগি হবে বলে আর কোনো সন্তান নেইনি আমরা। তিনি সবসময় বলে এসেছেন, ‘আমার মেয়ে আমার আদর্শে মানুষ হবে। আমার মেয়ে লেখাপড়া শিখে অনেক বড়ো কিছু হবে, একনামে সবাই তাকে চিনবে, সবাই বলবে জামান সাহেব মেয়েকে মানবিক মানুষরূপে গড়ে তুলেছেন।’
‘তোকে নিয়ে তার অনেক বড়ো স্বপ্নরে মা। বাবার স্বপ্নটাকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিস না। তোর বাবা সহ্য করতে পারবেন না।’
‘মা, আমি কখনোই বাবার স্বপ্নটাকে ভেঙে দিতে চাচ্ছি না, আমি লেখাপড়া শেষ করব, বিসিএস দেবো। বাবা যা চান তাই করব মা। আমার রেজাল্ট দেখো, ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে আমি ফার্স্টক্লাস মার্ক পেয়েছি, থার্ড ইয়ারে আমি ক্লাসের মধ্যে টপার, ফাইনালেও ভালো করব মা।’
তাজনিহার জামান বলেন, ‘বল ইন শা আল্লাহ, কোনো ভালো কাজ করার মনবাসনা থাকলে সেটা বলার সময় ইন শা আল্লাহ বলতে হয়রে মা। শোন তিথি, আবিরের ব্যাপারটাতে তোর বাবা অনেক কষ্ট পেয়েছেন, তিনি চান তোর লেখাপড়া শেষ হওয়ার পরে তুই বিসিএস দিবি, তারপর ম্যাজিস্ট্রেট হবি, জজ হবি। তোকে দেখে সবাই সন্মান করবে, তোর ক্যারিয়ার গড়ে তুলবি, তারপর তুই বিয়ে করবি। এটা তিনি দেখে যেতে চান।’
‘মা, আমি তো সে ব্যাপারে কোনো বিরোধিতা করিনি, আবিরের সঙ্গেও আমার এমনটাই কথা হয়েছে। মাস্টার্স শেষ হলেই আমরা বিয়ে করব মা, বিয়ের পরে পিএইচডি করি আর বিসিএস দেই সেটা অবশ্যই দেবো। বাবার স্বপ্ন আমি কখনোই ভেঙে যেতে দেবো না মা। ততদিনে আবির হয় চাকরি করবে নয়তো ওর বাবার বিজনেসটাতে ভালোভাবে বুঝে নেবে। কিন্তু বাবা এটা কী করলেন বলো তো মা, আবিরের কথা শুনে আমার ভার্সিটিতে যাওয়া বন্ধ করে দিলেন। আমার বাইরে যাওয়া নিষেধ করে দিলেন। আমাকে ঘরে বন্দি করে রেখেছেন। এটা কেমন কথা বলো তো মা, সামনে আমার অনার্স ফাইনাল এক্সাম। আর আমি কি ছোটো এখন? যথেষ্ট বড়ো হয়েছি। বাবা কিন্তু এগুলো বাড়াবাড়ি করছেন। আমার নিজেরও তো কোনো পছন্দ-অপছন্দ থাকতে পারে। বাবার কাছে তো আমি অনুভূতিহীন, যন্ত্রমানবের মতো। তিনি যা যা বলবেন আমাকে চাবি দেওয়া পুতুলের মতো সেটাই মেনে নিয়ে সেভাবেই কাজ করে যেতে হবে। এটা তো মোটেই ঠিক না মা।’
‘নিজে যখন মা হবি তখন বুঝবি। এখন এসব তোর মাথায় আসবে না। তোর বাবা সবসময়ই তোর ভালো চান, হয়তো-বা তিনি তোর ব্যাপারে একটু বেশিই চিন্তা করেন। কিন্তু ভেবে দেখ তো, তোর বাবা সারাজীবন কত কষ্ট করলেন, সরকারি চাকুরীজীবী হওয়ার কারণে যতবার ট্রান্সফার হয়েছেন তোর লেখাপড়ার যেন ক্ষতি না হয় সেই কথা ভেবে আমাদেরকে ঢাকায় রেখে নিজে ওসব কর্মস্থলে গিয়ে একা একা থেকেছেন, প্রমোশন না নিয়ে আমাদের জন্য ঢাকায় পোস্টিং নিয়েছেন।
‘তোর কষ্ট হবে বলে তোকে আলাদা গাড়ি কিনে দিয়েছেন, যেন তোর কোচিং, টিউশন, স্কুল-কলেজ-ভার্সিটিতে যেতে কষ্ট না হয়। তোর নামে এখনই বাড়ি করে দিয়েছেন, তার যা কিছু আছে সবই তো তোর জন্য। তিনি যে এত কষ্ট করছে সেটাও তো তোর জন্য। তোর যেন কোনো অবহেলা না হয় সেই জন্য আমি ঢাকা ভার্সিটিতে আইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স করে, বার কাউন্সিল থেকে সনদ নেওয়ার পরও আমাকে প্র্যাকটিস করতে দেননি। আমিও সেটা নিজের ইচ্ছেতেই মেনে নিয়েছি। কারণ আমাদের দুজনার কাছেই আমাদের সন্তানটা বড়ো ছিল, তার ভবিষ্যৎয়ের জন্য আমরা আমাদের জীবনের অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছি।’
‘মা, আমি তো কোনো কিছু অস্বীকার করছি না। আমি সব জানি, কিন্তু এখন মাঝে মাঝে মনে হয় এই সবকিছু বাবা নিজের জন্য চেয়েছেন, দেখো মা, ছোটোবেলায় নাচ-গান ড্রয়িংয়ে সব প্রতিযোগিতাতে আমি প্রথম হতাম। কখনো সেকেন্ড হলে আমার রক্ষা ছিল না। আমার ওপর দিয়ে স্টিমরোলার চালানো হতো। আমার অনেক কষ্ট হতো মা। আমি ক্লান্ত হয়ে যেতাম, তুমি বুঝতে মা, কিন্তু বাবা কখনো বুঝতে চাইতেন না। তার কথা ছিল অমুকের মেয়ে এত ভলো করেছে, তমুকের ছেলে এই করেছে, তার মেয়েকেও ভালো করতে হবে। তার মেয়েকেও পারতে হবে।’
‘তিথি তোকে বুঝতে হবে, বাবা তোর ভালোর জন্যই এসব করেছেন।’
‘দেখো মা, বাবা চেয়েছেন আমি ভিকারুন নিসা নুনে ভর্তি হই, আমি তাই করেছি। বাবা চাইতেন আমি যেন গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে হলিক্রস থেকে এইচএসসিতে ভর্তি হই, আমি তাই করেছি। তিনি চেয়েছিলেন আমি যেন মেধা তালিকাতে থাকি, পত্রিকাতে, টিভিতে যেন আমাকে নিয়ে ইন্টারভিউ নেয়-আমি সেটাই করেছি। বাবা চেয়েছেন আমি যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ে বিসিএস দেই, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চান্স পেয়েছি, ভালো রেজাল্ট করছি, ইন শা আল্লাহ ফাইনালে আমার ওপরে কেউ যাবে না।’
‘এগুলো কি তুই কাউকে ভাগ দিতে পারবি? এগুলো কি তোর বাবা নিজের জন্য করেছেন? তোর জন্য করেছেন, তুই ভালো রেজাল্ট করেছিস এটা তো তোর জন্যই ভালো।’
‘কিন্তু এগুলো তো সব বাবার জন্যই করেছি মা। আমার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো, বাবা সেখানে নিষেধাঙ্গা জারি করে দিলেন। আমি মেনে নিলাম। আমি চেয়েছিলাম ক্রেডিট ট্রান্সফার করে বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করব-বাবা সেটাতে চরম বিরোধিতা করলেন। সেও মেনে নিলাম। আর আমার একটা বিষয় বাবা মেনে নিতে পারবেন না? এটা কেমন কথা বলো তো মা? আমি তো সবকিছুই বাবার মনের মতো করে করেছি, বাবার ইচ্ছা-শখকে প্রাধান্য দিয়েছি। তাহলে বাবা কেন আমার একটা ইচ্ছাকে মেনে নেবেন না?’
‘আমি এত প্রশ্নের উত্তর দিতে পারব না, তবে শোন, তুই যখন মা হবি তখন বুঝবি, সন্তানের জন্য বাবা-মা কতটা সেক্রিফাইস করে, তাদের সময়কে, তাদের শখ, আহ্লাদকে কীভাবে মাটি চাপা দেয় শুধুমাত্র সন্তানদের জন্য। তোর বাবা ছোটোবেলাতে অনেক কষ্ট করে মানুষ হয়েছেন। তোর দাদা ছিলেন স্বল্প আয়ের মানুষ, আট ছেলেমেয়েকে লেখাপড়া করানো ছিল তারজন্য কষ্টসাধ্য ব্যাপার, তোর বাবা-চাচারা খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করে লেখাপড়া শিখেছেন। তোর বাবা তার নিজের চেষ্টাতে আজ এখানে, এই পর্যায়ে পৌঁছেছেন। তার অতৃপ্ত বাসনাগুলোকে তিনি তোর মাধ্যমে পূরণ করতে চান। যাইহোক আবারও বলছি যেটাই করবি বুঝে শুনে করবি।’
‘মা, আমি সব বুঝে শুনেই করছি, আমি আবিরকে ছাড়া অন্য কাউকে ভাবতেও পারব না। আমি আবিরকে ভালোবাসি মা। তাছাড়া আবিরদের পরিবারের ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো, ওদের পরিবারের যে যেখানে আছেন সবাই প্রতিষ্ঠিত। আংকেলের দেশে-বিদেশে বিজনেস, ঢাকায় ওদের সাতটা বাড়ি, আমেরিকাতে দুইটা বাড়ি, ওদের কাছে আমরাই বরং কম। মা, তুমি বাবাকে বোঝাও, বাবা এমন যেন না করেন। আমাকে ক্লাস করতে যেন দেন, আমার ক্যারিয়ারের লক্ষ্যে পৌঁছাতে তো আমাকে লেখাপড়া করতে হবে, ক্যাম্পাসে যেতে না দিয়ে বাবা তো আমার ক্যারিয়ারের প্রথম ধাপেই আমাকে পঙ্গু করে দিচ্ছেন।’
‘কোনো বাবা-মা তার সন্তানের ক্যারিয়ার নষ্ট করেন না। সব বাবা-মা তাদের সন্তানের ক্যারিয়ার গড়ে দেওয়ার জন্য নিজের জীবনটাকেও স্যাক্রিফাইস করে।’
‘মা তুমি শুধু আমার সঙ্গে থেকো আর আমার জন্য দোয়া কইরো।’
‘শোন, পৃথিবীর সব মা-বাবা তাদের সন্তানদের জন্য সবসময় দোয়া করেন, সন্তানদের ভালোর জন্য তাদের দোয়া করার কোনো কারণ লাগে না। সন্তানরাই মা-বাবাদেরকে বোঝে না।’
‘আমি আসছি মা। দেরি হয়ে যাচ্ছে, তুমি বাবাকে একটু বুঝিয়ে বইলো।’
সন্তান বড়ো হয়ে গেলে আর মা-বাবার বাঁধনে আটকে থাকে না। তিথির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবেন তাজনিহার জামান।
সুমি ইসলাম
শান্তিনগর , ঢাকা
ফেসবুক থেকে নেওয়া
Facebook Comments Box