সংগৃহীত ছবি
মামুনূর রহমান হৃদয় , ফিচার লেখক : সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে, চোখ মুছতে মুছতে রান্নাঘরে ঢুকলেই চা-প্রেমীদের প্রথম নজর পড়ে চায়ের দিকে। এক-দু কাপ চা যেন কখনো পুরো তৃপ্তি দেয় না। মন চায় একটু বড়সড় চুমুক, যাতে পেট আর মন দুটোই পরিপূর্ণ হয়। এই চাওয়াটাই যখন কল্পনার ডালপালা মেলে, তখনই মাথায় আসে, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় চায়ের কাপ যদি আমার হতো!’ লম্বাকৃতির সাদা পর্সেলিনের মগ, যেন কোনো উঁচু ভবন। তার ভেতর থেকে উঠছে ধোঁয়ার সর্পিল কুণ্ডলী, যা মিশে যাচ্ছে আকাশের মেঘের সঙ্গে।
তবে জানলে অবাক হবেন বাস্তবেই রয়েছে বিশাল আকৃতির চায়ের কাপ। যেটার চা আপনি খেয়ে শেষ করতে পারবেন না পুরো বছরেও। মেক্সিকোতে রয়েছে এমনই একটি চায়ের কাপ। বিশাল এই চায়ের কাপের মধ্যে আছে ৯১২৩ লিটার চা। যদি একজন দিনে গড়ে ৩ কাপ চা (প্রতি কাপ ২৪০ মিলিলিটার) খান, তাহলে দিনে মোট ৭২০ মিলিলিটার চা হবে। এই পরিমাণে খেলে পুরো কাপটি ফাঁকা করতে সময় লাগবে প্রায় ৩৫ বছর। যদি দিনে ২ কাপ খান, তাহলে সময় বাড়ে প্রায় ৫২ বছর, আর দিনে ৪ কাপ খেলে সময় কমে প্রায় ২৬ বছর।
২০২৩ সালের ৭ জুন মেক্সিকোর মধ্য-উত্তরাঞ্চলের চামড়াজুতোর রাজধানী লেয়োনের গুয়ানাহুয়াতো রাজ্যে এই চায়ের কাপ প্রথম প্রদর্শিত হয়। শহরের কেন্দ্রস্থ প্লাসা ফুন্দিদোরেসে ‘টনিক ওয়ার্ল্ড সেন্টার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়েছিল ৩.২৮ মিটার উঁচু ও ৩.১৮ মিটার ব্যাসের স্টিল-স্যান্ডউইচ নির্মাণের এই বিশাল কাপ। যার ধারণ ক্ষমতা ৯১২৩ লিটার। উদ্দেশ্য স্পষ্ট গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে ‘লার্জেস্ট কাপ অব হট টি’ শিরোপা দখল করা।
সকালের নরম রোদ যখন লেয়োনে জৌলুস ছড়াচ্ছিল, তখনি বিশাল কন্টেনার-লরিতে করে এসে নামল ৯৬ কেজি ওজনের টি-ব্যাগ। যা একটি চালের বস্তার ওজনের সমান! ঠিক তখন থেকেই শহরজুড়ে ছড়িয়ে গেল টুকটাক সন্দেহ আর উৎকণ্ঠা। এত লিটার পানি একসঙ্গে গরম করলে কি কাপের ধাতু বাঁকবে না? তাপমাত্রা সমান থাকবে তো? কেউ ভয়ে বললো, ‘এই যদি ফুটো হয়?’ আবার কেউ হাসিমুখে ভিডিও-লাইভে চলে গেল, যেন যে কোনো মুহূর্তে ‘ট্র্যাজেডি’ দেখবে!
আয়োজকেরা অবশ্য আগাম ব্যবস্থা নিয়েছিল। ইন্ডাস্ট্রিয়াল হিটার আর ডিজিটাল থার্মাল সেন্সর বসিয়ে রেখেছিল কাপের গায়ে। যাতে ৯০-৯৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গরম পানিতেই সঠিকভাবে চায়ের পাতা মিশে যায়।
চার ঘণ্টা টানা ফুটন্ত পানি, এলাচ, দারুচিনি, আদার মিশ্র সুবাসে চারপাশের বাতাসের গন্ধ বদলে গেল। যেখানে সাধারণ দিনে চামড়ার কাঁচামালের গন্ধ থাকে, সেদিন ছিল ‘টি-প্যারাডাইস’। দুপুর গড়াতেই গিনেসের নীল স্যুট পরিহিত বিচারক দল এসে ঘণ্টাব্যাপী মাপজোক শেষ করলো।
দর্শকের শ্বাস যেন বাধা; কারণ নিয়ম পরিষ্কার ‘চা গরম থাকতেই হবে’ নইলে রেকর্ড বাতিল। শেষমেশ স্পিকারে ঘোষণা ভেসে উঠলো ‘অফিসিয়ালি এটেম্পট সাকসেসফুল’। মুহূর্তেই বাজি-পটকা, গান, হাততালির ঝড়। পুরো লেয়োনে যেন এক ঢোক গরম চা খেয়েই হুঁশ ফিরে পেল!
কিন্তু মজার মোড় ঘুরলো সপ্তাহখানেক পর। শহুরে গসিপে ফিসফাস উঠল কাপের তলায় নাকি সূক্ষ্ম ছিদ্র দেখা গেছে। ধাতু এত তাপে সামান্য প্রসারিত হয়ে চা চুঁইয়ে পড়েছে। আয়োজকেরা মুখ গোমড়া করে বললো, ‘মিথ্যে কথা, আমরা ফুড-গ্রেড সিল্যান্ট লাগিয়েছি।’ কাছের জুতোর দোকানি খিলখিলিয়ে জানিয়েছে, ‘দুই-তিন ফোঁটা পড়ে ছিল, টেপ মেরে সামলে নিয়েছে।’ এই আধা-সত্য আর আধা-রসিকতা মিলিয়েই তো শহরের উন্মাদনা বাঁচে। যেমন: ২০১৮ সালে দুবাইয়ের ৫০০০ লিটার ‘কারাক-টি’ রেকর্ডের পরও শোনা গিয়েছিল, মরুভূমির ধুলায় স্বাদ নাকি ফিকে হয়েছিল!
বৃহৎ কাপে ঢালা সেই ৯১২৩ লিটার রং চা পরে প্লাস্টিক বা কাগজের মগে করে বিলিয়ে দেওয়া হয় পথচারী, ট্যাক্সি-ড্রাইভারদের মাঝে। এমনকি দূর থেকে ভিড় দেখতে আসা পর্যটকদেরও। শিশুরা হাতে পেয়েই ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় কাপের চা’ বলে উচ্ছ্বাসে ছবি তুলেছে। অনেকে ইনস্টাগ্রামে চায়ের ইমোজি দিয়ে ‘টি নেইডো ইন লেয়োন’ অর্থাৎ ‘লেয়োন শহরে চা ঝড়’ হ্যাশট্যাগে ছড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয় ক্যাফেতে সেদিন অন্যান্য পানীয় বিক্রি অর্ধেকে নেমে গেছে। সবার মনেই ছিল ‘রেকর্ডের স্বাদ’ কেমন, সেটা না চেখে ফিরবে না।
অতএব বোঝাই যায়, এই ধরনের বিশাল আয়োজন কেবল রেকর্ড বইয়ের জন্য নয়… এটা শহরের ব্র্যান্ডিং, পর্যটন টানার অনন্য কৌশল, আর সামাজিক মিলনমেলাও।
আজ বিশ্ব চা দিবস। প্রতি বছর ঘটা করেই এই দিবস পালন করেন চাপ্রেমীরা। চা শুধু পানীয় নয়, এটি আমাদের জীবনের খুশির মুহূর্তগুলোকে একসঙ্গে গেঁথে রাখে। একটি সাধারণ চায়ের কাপের মধ্যে লুকিয়ে থাকে বন্ধুদের গল্প, পরিবারের হাসি, দেশের সংস্কৃতি আর এমনকি পুরো পৃথিবীর মানুষজনের আন্তরিকতা।
প্রতিবার নতুন কোনো রেকর্ড ভাঙার মানে হলো, পৃথিবীর অন্য কোনো প্রান্তের শহরও নিজের প্রতিভার জানান দিচ্ছে। হয়তো আগামী বছর কোনো উপকূলীয় বন্দর ১১ হাজার লিটার ‘লেমন টি’ দিয়ে আয়োজন করবে বিশাল ‘কাপ-ক্লাউড ফেস্ট’। অথবা হিমালয়ের পাদদেশে স্থাপন হবে বিশাল এক সবুজ চায়ের বায়োডিগ্রেডেবল বাটি, যা ব্যবহার শেষে মাটিতে পুঁতে কম্পোস্ট হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বলা যায়, রেকর্ড ভাঙার মধ্যেই তো সাফল্যের মজা, আর মানুষের কৌতূহলও থামার নয়।
সব শেষে ভাবলে, এই গ্রহটাই যেন এক বিশাল চায়ের পাত্র। আমরা প্রত্যেকে একটু একটু করে কাড়ি-কাড়ি উষ্ণ জলতাপে নিজেদের গন্ধ ছড়াই, অনুভূতির রং মিলাই। কোথাও সামান্য ফুটো ধরলেও, টেপ লাগিয়ে আবার এগিয়ে যাই। কারণ আসল রসতো রেকর্ডের সংখ্যায় নয়, মিলেমিশে খেয়ে-হেসে কাটানো সেই বৈশ্বিক চায়ের আসরে। যেখানে এক চুমুকেই দূরের শহর লেয়োনের গল্প এসে মিশে যায় নিজের দুধ-চায়ের কাপে। তথ্যসূত্র: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস , জাগোনিউজ২৪.কম