সংগৃহীত ছবি
অনলাইন ডেস্ক : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছেই দিয়াবাড়ী আর্মি ক্যাম্প। বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই ওই ক্যাম্প থেকে সেনা দস্যরা ছুটে আসেন। এসেই তাঁরা দেখতে পান বিধ্বস্ত জ্বলন্ত বিমানটির কাছে পড়ে আছে দুটি মরদেহ। মরদেহ দুটি এক মা ও তাঁর সন্তানের।
দুজন সেনা সদস্য তাঁদের ইউনিফর্ম খুলে ঢেকে দেন মরদেহ দুুটি। এই ঘটনার ভিডিও, ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকে জানতে চান, নিজেদের ইউনিফর্ম দিয়ে মা ও ছেলের মরদেহ ঢেকে দেওয়া সেনা সদস্যদের পরিচয়। কারো মন্তব্য, মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই দেশের সেনাবাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে যে উদ্ধার তৎপরতা চালিয়েছে তা দায়িত্ব, মানবিকতা ও দক্ষতার অনন্য এক উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সেনাবাহিনীর এই মানবিক দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে আবারও প্রমাণিত হলো, দেশের সংকটময় মুহূর্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মুহূর্তে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব কিছু ছাপিয়ে মানবতার নিবেদিত প্রাণ। রোমান রনি নামের একজনের মন্তব্য, ‘এটা শুধু ইউনিফর্ম না। এটা সৈনিকদের শরীরের চামড়া, পবিত্র পোশাক। মানবতার পথেই রয়েছে আমাদের সেনাবাহিনী।’
আরেকজন মন্তব্য করেছেন, ‘যোগ্য সেনাবাহিনীর হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ।’ মোহাম্মদ ইব্রাহিম নামের একজন লিখেছেন, ‘এ জন্যই বলা হয়, সেনাবাহিনী বাংলাদেশের গর্ব।’ সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও বলছেন, ‘অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে মানুষের জন্য ওদের এই ভালোবাসা আর মানবিকতা প্রদর্শনে অভিভূত হয়েছি এবং গভীরভাবে আন্দোলিত হয়েছি।’
প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানান, ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন এবং দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা এলাকাটি থেকে আহতদের দ্রুত নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া সেনা সদস্যের মানবিক ও সাহসিকতা বিশেষভাবে চোখে পড়ে। একজন শিক্ষার্থী ক্লাসরুমে আটকে পড়ে আগুনের তাপে অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। বিষয়টি এক সেনা সদস্যের চোখে পড়ার পর তিনি বালতির পানি এনে ছাত্রটির গায়ে ঢালেন। হাতুড়ি দিয়ে জানালা ভেঙে তাকে জীবিত উদ্ধার করেন।
যে দুই সেনা সদস্যের ইউনিফর্মে ঢাকা হয় মা ও ছেলের মরদেহ : জানা যায়, সেদিন দিয়াবাড়ীর সেনা ক্যাম্পের মেজর মেহেদী হাসান ও সৈনিক আশিক এই মানবতার দৃষ্টান্ত রাখেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে এসে দিয়াবাড়ী সেনা ক্যাম্পের মেজর মেহেদী হাসান বলেন, ‘দুর্ঘটনার পরপরই আমরা প্রথম রেসপন্স টিম হিসেবে দুর্ঘটনাস্থলে প্রবেশ করি। স্পটে প্রবেশের পর দুটি মরদেহ দেখতে পাই। সম্ভবত একজন মা ও তাঁর ছেলে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের জন্য তাঁদের ইউনিফর্মটা গর্বের। আমরা তখন ওই মা ও তাঁর সন্তানের সম্মানটাকে প্রাধান্য দিই। আমি ও আমার সঙ্গের সৈনিক আশিক আমাদের গর্বের ইউনিফর্ম খুলে মরদেহ দুটি ঢেকে দিই। আমাদের পোশাকের চেয়ে ওই মা-ছেলের মরদেহের সম্মান আমাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছিল। এরপর আমরা উদ্ধারকাজ শুরু করি। আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টা থেকে সাড়ে ৭টা পর্যন্ত উদ্ধারকাজ অব্যাহত থাকে।
আমাদের যার যতটুকু সম্ভব সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। হতাহতের সঠিক সংখ্যা স্কুল কর্তৃপক্ষ এবং হাসপাতালগুলোর সমন্বয়ে পাওয়া যাবে। আমাদের মেইন ফোকাস ছিল উদ্ধার। কতজনকে উদ্ধার করতে পেরেছি, তার হিসাব রাখা ওই সময় আমাদের মধ্যে কাজ করেনি। যাদের সামনে পেয়েছি, তাদেরই নিরাপদে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এরপর ক্যাম্পে ফিরে আসি।’
মেজর মেহেদী বলেন, ‘দুর্ঘটনার দুই থেকে তিন মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই। দুর্ঘটনাস্থলের ১০০ থেকে ১৫০ গজের মধ্যেই আমাদের ক্যাম্প। এয়ারক্রাফটা যে জায়গায় ক্র্যাশ করে সেই জায়গায় আগুনের প্রজ্বালনটা ছিল। তার কাছাকাছি দুটি মরদেহ পড়ে ছিল। স্পটে পৌঁছে আমরা প্রথমে এটি দেখতে পাই। এরপর আমরা উদ্ধারকাজ শুরু করি। স্কুলের বারান্দার দুই পাশে যে গ্রিল ছিল তা ভেঙে ভেতরের হতাহতদের নামিয়ে আনার কাজে ব্যবহার করি। ভেতর থেকে আমাদের সৈনিকরা সবাই চেষ্টা করেছেন। জীবিত এবং আহত অবস্থায় যারা ছিল, যতটা পেরেছি, আগুন নির্বাপণ করার মাধ্যমে ভেতেরে প্রবেশ করে অনেকাংশে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। হাসপাতালে খবর নিলেই জানতে পারবেন অনেক ছাত্র-ছাত্রী এখনো চিকিৎসাধীন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে বলতে হয়, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে তাদের সহযোগিতা কোনো অংশেই কম না। আমাদের ২৫ জনের মতো সৈনিক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ক্রিটিক্যাল অবস্থায় কেউ নেই। বর্তমানে ১১ জনের মতো ঢাকা সিএমএইচে চিকিৎসাধীন আছেন।’
সেনা বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন : ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. জাহেদুর রহমান সেনা সদস্যদের এই উদ্ধার তৎপরতা সম্পর্কে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের সব ক্রান্তিলগ্নে সেনাবাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিমান দুর্ঘটনায় সেনাবাহিনী অত্যন্ত দরদের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখিয়েছে। গত ২১ জুলাই ২০২৫ তারিখে ৬ স্বতন্ত্র এয়ার ডিফেন্স ব্রিগেড কমান্ডার উত্তরার দিয়াবাড়ীতে সেনা ক্যাম্প পরিদর্শনে ছিলেন। ক্যাম্পটি মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কাছেই। দুপুর ১টা ১২ মিনিটের সময় হঠাৎ বিকট শব্দে ক্যাম্পের সবাই সতর্ক হয়ে ওঠেন।
এরই মধ্যে একজন সৈনিক এবং একজন বেসামরিক ব্যক্তি দৌড়ে এসে বলেন যে স্কুলে বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে ইউনিট অধিনায়ক লে. কর্নেল তাহসিন, মেজর মেহেদী, ক্যাপ্টেন তামজীদ এবং অন্য অফিসার ও সৈনিকরা দৌড়ে ঘটনাস্থলের দিকে যেতে থাকেন। দুই মিনিটের মধ্যে ওঁরা স্কুল প্রাঙ্গণে পৌঁছেন। মেজর মেহেদী স্কুলের সামনে ওয়াকওয়েতে একজন নারীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখেন, যাঁর মুখমণ্ডলের অর্ধাংশ উড়ে গেছে এবং কিছুটা দূরেই একটি শিশুর মৃতদেহ। তাৎক্ষণিকভাবে মেজর মেহেদীর মনে যে অনুভূতিটি জাগে সেটি হলো একজন মায়ের আবরু রক্ষা করা। তিনি এবং তাঁর সহযোদ্ধা গানার আশিক নিজেদের ইউনিফরম খুলে মা ও সন্তানের মৃতদেহ ঢেকে দেন।
একজন সৈনিকের সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে গর্বের বিষয় তাঁর ইউনিফর্ম। ওঁরা মা ও সন্তানকে তাঁদের গর্ব আর প্রিয় পরিচ্ছদ দিয়ে ঢেকে দিয়েছেন। আমি একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য হিসেবে মানুষের জন্য ওঁদের এই ভালোবাসা আর মানবিকতা প্রদর্শনে অভিভূত হয়েছি এবং গভীরভাবে আন্দোলিত হয়েছি। আমি ওঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় দ্রুততার সঙ্গে উদ্ধারকাজ পরিচালিত হয়েছে বলে জেনেছি। কমান্ডার, অধিনায়ক, মেজর মেহেদী এবং উদ্ধারকাজে জড়িত সব সেনা সদস্যকে সাধুবাদ জানাই। নিশ্চয়ই তাঁরা নিঃস্বার্থভাবে দেশের সেবায় নিজেদের নিয়োগ করবেন। দুর্ঘটনায় নিহত সবার আত্মার জন্য প্রার্থনা করি এবং আশা করি যে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্পন্ন হবে।’
মেজর জেনারেল (অব.) কাজী ইফতেখার-উল-আলমের মতে, মাইলস্টোনে বিমান বিধ্বস্তের দুর্ঘটনাটি এত মর্মান্তিক, এত হৃদয়বিদারক, এত বেশি শিশুর হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া কোনো মানবিকতা দিয়ে পূরণ করা যায় না।
তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এসব শিশু একদিন বড় হয়ে জাতির নেতৃত্ব দিতে পারত, দেশের জন্য অবদান রাখতে পারত। এটাকে কোনোভাবেই, কোনো কিছু দিয়েই কাভার করা সম্ভব নয়। যে পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের হারিয়েছে, যে শিক্ষকরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে নিজেদের জীবন দিয়েছেন, সেই সব পরিবারের, সেই শিক্ষকদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। তার পরও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে যেভাবে দ্রুত ছুটে গেছেন, স্টেচারের অপেক্ষা করেননি, যা দিয়ে হোক, যেভাবে হোক আহতদের উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচানোর জন্য হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন। বিরামহীন সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেখানে সমস্যা তৈরি করে সাধারণ উত্সুক জনতা। উদ্ধারকাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ভবিষ্যতে কোনো দুর্ঘটনার উদ্ধারকাজে এই বিষয়টি আমাদের মনে রাখতে হবে।’ সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ