ছবি সংগৃহীত
খুজিস্তা নূর ই নাহারিন: সময়টা ১৯৯৩। আমার বিয়ে প্রায় ঠিক। ছেলেটিকে আমার পছন্দের মূল কারণ হচ্ছে, সে ভীষণ ভদ্র এবং সৎ। আমি যেমন মিথ্যে বলা অপছন্দ করি সেও করে। প্রয়োজনে চুপ থাকব, কিন্তু মিথ্যে বলব না। বুয়েট থেকে পাস করার পর সান্ধ্যকালীন এমবিএ করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। পাশাপাশি চাকরি করছে একটি প্রাইভেট টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানিতে। মাস্টার্স পরীক্ষার পর আমাদের বিয়ে।
লম্পট ফটিকের অনভিপ্রেত ঘটনা আমার চিন্তার জগতে সবকিছু এলোমেলো করে দিল। বারবার একটি কথাই মাথার ভিতর ঘুরপাক খেতে থাকল- একজন নারী যত শিক্ষিত আর সচেতন হোক, যত যোগ্যতাসম্পন্নই হোক কী ভীষণ অসহায়! তার নিজের রূপই তার প্রধান শত্রু।
প্রায় এক মাস পর হলের বাইরে এসেছি। টিংকুর রাজনৈতিক এক ছোট ভাই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন ছোট্ট একটি পয়গাম নিয়ে। টিংকু ভাই আমার সঙ্গে কেবল একটিবার দেখা করতে চান। চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমি তোমার সাথে এক কাপ চা খেতে চাই, তোমার কি সময় হবে?’
ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকুর সঙ্গে আমার পরিচয় ’৯২ সালে। আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ করি। সেই সংগঠনের এক বড় নেতা আমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। নেতাকে বলেছি, আমার বিয়ে ঠিক। তিনি বলেছেন, ‘তাতে কী, বিয়ে তো হয়নি এখনো।’
বিভিন্ন খাদ্যে অ্যান্টি-ডায়াবেটিস একটিভিটির ওপর রিসার্চ করছি, থিসিস গ্রুপ, সামনে আমার মাস্টার্স পরীক্ষা। দিনমান লাইব্রেরি আর ল্যাবরেটরিতে দৌড়াতে দৌড়াতে দিন শেষ। আমি দলের সব কর্মকান্ড থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিই। ৩০ বছর আগের সমাজ আর এখনকার সমাজে পার্থক্য অনেক। তাছাড়া রাজনৈতিক কোনো নেতার স্ত্রী হব, স্বপ্নেও ভাবিনি। নেতাদের স্ত্রী হওয়া মানে নিজেকে বেঁধে গাঙের জলে ফেলে দেওয়া।
একদিন বিকালে ক্লাস শেষে হলে ফিরে দেখি, একটি মেয়ে আমার জন্য একটি চিরকুট রেখে গেছে। চিরকুটে টেলিফোন নম্বরসহ লেখা, ‘ফোন দিও।’ আমি ভাবলাম, হয়তো আমার ছোট ভাবি।
ল্যান্ডফোনের সেই সময়টিতে মোবাইল ফোনের সুবিধা ছিল না, যোগাযোগের জন্য কেবলই কয়েনবক্স। কয়েকটি আট আনার কয়েন জোগাড় করে তাড়াতাড়ি ফোন দিলাম। একটি কয়েনে সময় মাত্র তিন মিনিট। আমি আমার ভাই-ভাবির কথা জিজ্ঞেস করি, ও-পাশ থেকে একটি পুরুষ কণ্ঠ ভ্রুক্ষেপহীন কথা বলেই চলেছে। বিরক্ত আমি তাদের বিদ্রুপের স্বরে বলি, ‘নারীর কণ্ঠ শোনামাত্রই ফাজলামো শুরু করেছেন। অথচ, আমি আপনাকে চিনি না, জানিও না।’ পুরুষ কণ্ঠটি এবার সচকিত হয়ে ততধিক রাগতস্বরে গম্ভীর গলায় বললেন, ‘শুরু থেকে বলো, কে তুমি, এই নম্বরে কেন ফোন দিয়েছ?’
বিস্তারিত জানিয়ে বলি, দুপুরে কেউ ছিল এখানে যে আমাকে ফোন করতে বলেছে, কিন্তু তিনি নিশ্চয়ই আপনি নন। আপনার নাম-পরিচয় কিছুই আমি জানি না, চিনিও না। আপনিও নিশ্চয়ই আমাকে চেনেন না।
আর্কিমিডিসের ইউরেকার মতো এবার চিৎকার দিয়ে অপরিচিত কণ্ঠস্বর বলে উঠল, ‘ওহো তুমি সেই মুন্নি!’ নিজে ডা. জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু পরিচয় জানিয়ে বলেন, আমি এখনই তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসছি। আমি খানিকটা বিস্মিত হয়ে বলি, ‘আপনি ছাত্রনেতা, বিকালবেলা রোকেয়া হলের গেটে এখন প্রেমিকদের ভিড় প্রেমিকাদের অপেক্ষা, এই ভিড় ঠেলে আপনি আসবেন?’
কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা আমার সঙ্গে তার দেখা করতেই হবে। ঠিক হলো তিনি একটি নীল রঙের চেক শার্ট পরে আসবেন কিন্তু আমাকে কীভাবে চিনবেন? আমি বললাম গেটের সামনের সবচেয়ে লম্বা মেয়েটিই আমি আর আমার পরনে সি-গ্রিন কালারের তাঁতের শাড়ি, পায়ে চটি স্যান্ডেল, মাথায় এলো খোঁপা, কাঁধে ঝুলানো কাপড়ের ব্যাগ।
ঠিক ১০ মিনিট পর রোকেয়া হলের গেটে তার সঙ্গে দেখা হলো আমার। কলা অনুষদের ভাষা ইনস্টিটিউট আর লাইব্রেরির মাঝের অর্ধেক করা দেয়ালে বসলাম দুজন। আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন ক্রমাগত।
ভীষণ রাগ হলো আমার, এই লোকটি আমাকে জাজ করছেন, শিল্প-সাহিত্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, দেশ-বিদেশ, ক্রীড়াঙ্গন সম্বন্ধে গল্প করার ছলে মূলত মেধার পরীক্ষা নিচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম কত্ত বড় সাহস! শেষ বেলায় অঙ্ক নিয়ে পরীক্ষা। বললেন এক লাখকে শূন্য দিয়ে গুণ করলে কত হয়? এবার তেলে-বেগুনে জ্বলে উত্তর দিলাম আপনি যে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলছেন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের ছাত্রী। কেবল SSC, HSC, নয় সাবসিডিয়ারিতেও অঙ্কে লেটার মার্কস পাওয়া। এটা কী প্রশ্ন করলেন আপনি? এবার তিনি লজ্জা পেলেন।
কোনোকিছুতেই হারাতে না পেরে অবশেষে বললেন, ‘তুমি তো কালো, এত অহংকার কীসের, তোমাকে এত বড় একজন লিডার বিয়ে করতে চেয়েছে এতেই তো ধন্য হওয়ার কথা ছিল?’
এবার আমি রাগ করার পরিবর্তে হেসে ফেললাম। হাসতে হাসতেই বললাম, ‘ক্লিওপেট্রার গায়ের রং কেমন ছিল আপনি কি তা জানেন?’ দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না-সূচক উত্তর করলেন। এবার আরও জোরে হেসে বললাম, ‘এই যে আমার মতো, কালো।’ ঈষৎ অসহায় অনুভব করলেন বলে মনে হলো।
ক্ষণিকের জন্যই, পরমুহূর্তেই বললেন তিনি ভবিষ্যৎ এমপি। গাড়ি-বাড়ি, শাড়ি-গহনার কোনো অভাব হবে না তোমার। মেয়েরা তো এসবই চায় তোমার সমস্যা কী? এত ভালো প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে পরে পস্তাবে।
আমি বললাম, না, টিংকু ভাই। আমি অতি সাধারণ একটি মেয়ে। কোনো কিছুতেই লোভ নেই, কেবল শান্তিপূর্ণ জীবন চাই।
এরপর পরিচিতজনের ভিড়ে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে বহুবার। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ। ফটিকের কাহিনি নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আমি। ভাষা ইনস্টিটিউটের সামনে টিংকুর রাজনৈতিক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলা অবস্থায় হঠাৎ ফটিক এলো কোথা থেকে। রাগে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত জ্বলে উঠল নিমিষেই। কেবল বললাম, ‘এই বদমাশকে যদি স্যান্ডেল দিয়ে পিটিয়ে মারতে মারতে মেরে ফেলতে পারতাম, দুগালে ঠাস ঠাস চড় দিতে পারতাম।’
সামনে বসা লোকটি কেবল জিজ্ঞেস করলেন, নাম কী, কোন সাবজেক্টে পড়ে, কোন হলে থাকে, রাজনৈতিক পরিচয় কী?
পর দিন রোকেয়া হলে থাকা ববি এসে বলল, ‘মুন্নি আপা টিংকু ভাই আপনাকে একটা কল দিতে বলছে।’ ফোন করার সঙ্গে সঙ্গে টিংকু জিজ্ঞেস করল, ‘কী করেছে তোমাকে?’ একটা ঠান্ডা হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল যেন শরীরজুড়ে। থমকে গেলাম, খানিকক্ষণ চুপ থেকে বললাম না, কিছু করেনি।
আমি কিছু করিনি বললেও টিংকু থেমে থাকেনি। ওই বদমাশকে ধরে এনে চেহারা দেখেছে, উত্তমমধ্যম দিয়েছে। টিংকুর বারংবার প্রশ্ন এক কাপ চা খেতে কত মিনিট লাগে?
সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত ল্যাবে থাকি আমার সময়ের প্রচ- অভাব। সন্ধ্যা ৭টায় হল গেট বন্ধ। শুক্রবারের দিনও ছুটি নেই। কারণ, থিসিস জমা দেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। অতএব ফজর নামাজের পর ছাড়া সম্ভব নয়। ঠিক হলো অ্যানএক্স বিল্ডিংয়ের সামনে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফোরথ ক্লাস এমপ্লয়িদের হোটেলে বসে চা খাব। কারণ, ক্যাম্পাসের বাইরে কিছুতেই বের হব না আমি।
রোকেয়া হল মেইন বিল্ডিং ৪৬-এ তখন আমার রুমমেট লায়লা আপা। মানে বর্তমানে পোল্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর সুলতানা লায়লা হোসেইন। লায়লা আপার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বোন আর বান্ধবীর থেকে একটু বেশি। দুজন দুজনের কাছে পেটের কথা না বললে যেন ভাত হজম হয় না। সারা রাত জেগে দুজনে আড্ডা দিই আর গান শুনি।
লায়লা আপাকে বললাম, ‘টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে কাল চা খেতে যাব সকালে। সঙ্গে সঙ্গে লায়লা আপা বললেন, ‘অসম্ভব, কিছুতেই আমি যেতে দেব না তোমাকে। বুঝতে পারছ না, মুন্নি তুমি বিপদে পড়বে।’
লায়লা আপার কথা শিরোধার্য। সকালে চা খেতে গেলাম না। এমনকি টিংকু ভাইয়ের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ করারও চেষ্টা করলাম না।
বেশ কিছুদিন পর আমার ল্যাবে হঠাৎ হন্তদন্ত টিংকু ভাই এসে হাজির। বললেন, ক্ষমা চাইতে এসেছি, সেদিন সকালে আসতে পারিনি বলে। লায়লা আপার পরামর্শমতো এবার আমি মেপে মেপে কথা বললাম, মেপে মেপে হাসলাম।
ল্যাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করছি আর টিংকু ভাই আমার পাশে উঁচু টুলটাতে বসে কথা বলছেন। মশিউজ্জামান স্যারকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন, আপনার ছাত্রীর কাছে একটু প্রয়োজনে এসেছি। স্যার আর টিংকু ভাই দুজন দুজনের পূর্বপরিচিত। স্যার স্বভাবসূলভ হালকা হাসি টেনে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন, ‘আমার ছাত্রীর গন্তব্য বহুদূর। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে সবেমাত্র। আসল পড়াশোনায় ঢুকবে এখন। বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রি আনবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে নতুবা বৈজ্ঞানিক হবে।’
স্যার চলে যাওয়ার পর টিংকু ভাই বললেন, ‘যতই লেখা পড়ার কথা বল আমি জানি দুদিন পর তোমার বিয়ে হয়ে যাবে। আমার সাথে তোমার হয়তো কোনোদিনই দেখা হবে না আর, কিন্তু যখন চায়ের পেয়ালা হাতে নেবে তখনই আমাকে মনে পড়বে। তখন আফসোসের চেয়ে আগামীকাল সকালে চলো একসঙ্গে চা খাই।’
আজ লায়লা আপা নেই, রুমে আমি একা। ফজর নামাজ শেষে কতক্ষণ পায়চারি করলাম। হেঁটে হেঁটে একবার ভাবী যাব আরেকবার ভাবী যাব না। অবশেষে কাপড় পরে টিএসসির সামনে এসে দাঁড়ালাম। নীল রঙের গাড়ির ভিতরে টিংকু ভাই বসে আছেন। বললাম বাইরে আসেন হেঁটে হেঁটে চা খেতে যাই, ওখান থেকে কার্জন হল। আপনি রিকশা নিয়ে ফিরে আসবেন।
টিংকু ভাই নামতে না নামতেই বৃষ্টি শুরু হলো। তিনি বললেন, বৃষ্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত গাড়িতে বসে অপেক্ষা করি। ভাবার সুযোগ নেই, কারণ আমি ভিজে যাচ্ছি। তিনি বললেন, চলো ক্যাম্পাসের চারপাশ ঘুরে আসি। এত বৃষ্টি, বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কোথায় ক্যাম্পাস, গাড়ি চলছে এয়ারপোর্ট রোড ধরে ফাঁকা রাস্তায়।
ভীষণ ভয় পেয়ে বললাম ফিরে চলুন, আমাকে ক্যাম্পাসে নামানোর আগে গাড়ি থামাবেন না, প্লিজ। এত বৃষ্টিতে গাড়ি এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ, সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, আমি সিটের সঙ্গে সেঁটে বসে আছি। রাস্তার পাশে গাড়ি চলা হঠাৎ থামিয়ে বললেন গান শুনবে, গান শুনলে তোমার ভালো লাগবে। আমি কোনোমতে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ালাম। তিনি ছাড়লেন সুমনের গান, ‘প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই, তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই…।’ এই গানের অর্থ আমি বুঝি, কিন্তু কোনো কথা বলছি না। তার দিকে তাকাচ্ছিও না। নিচের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বললাম, ‘আপনি জানেন তো কদিন পর আমার বিয়ে, সব ঠিকঠাক।’
কোনো কিছু না বলে তিনি গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। কারও মুখে কোনো কথা নেই। তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না আর। সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়িতে বেজে চলেছে সুমনের ক্যাসেট। হঠাৎ জেনি কাবাব ঘরের সামনে গাড়ি পার্ক করে বললেন, ‘নামো, তোমাকে চা খাওয়াই।’ ততক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে। চা খেতে খেতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে কথা বলা শুরু করলাম।
লেখক : মানবতাবাদী লেখিকা । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন