ছবি সংগৃহীত
অনলাইন ডেস্ক : আজ ১৪ আগস্ট, বৃহস্পতিবার। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ, মুফাসসিরে কোরআন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২৩ সালের এই দিনে, রাত ৮টা ৪০ মিনিটে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৩ বছর।
আল্লামা সাঈদী ছিলেন এমন এক আলেম, যিনি গত পাঁচ দশক ধরে দেশ-বিদেশে কোরআনের ভাষ্য তুলে ধরেছেন এক ভিন্ন ও প্রাঞ্জল ঢংয়ে। তার সুললিত কণ্ঠ, সাহিত্যসম্মত উচ্চারণ, বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণভিত্তিক তাফসির এবং ইসলামী সমাজ বিনির্মাণের আহ্বানে লাখো মানুষ হয়ে উঠেছিল তার অনুগামী।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ১৯৪০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের জিয়ানগর উপজেলার সাঈদখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মাওলানা ইউসুফ সাঈদী ছিলেন একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ। প্রাথমিক ধর্মীয় শিক্ষা শেষে ১৯৬৪ সালে তিনি মাদরাসা শিক্ষার সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং এরপর পাঁচ বছর নানা বিষয়ের ওপর গভীর গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৬০ সালে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার চার ছেলে, রাফীক, শামীম, মাসুদ ও নাসিম—সকলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমাজসেবায় যুক্ত ছিলেন বা আছেন।
আল্লামা সাঈদী ১৯৬৭ সাল থেকে ‘দাঈ ইলাল্লাহ’ হিসেবে কাজ শুরু করেন। তিনি পৃথিবীর ৫২টি দেশ ভ্রমণ করে কোরআনের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন। তার তাফসির মাহফিলগুলোতে লাখো মানুষ জমায়েত হতো। চট্টগ্রাম প্যারেড গ্রাউন্ডে তার বাৎসরিক পাঁচ দিনের মাহফিলে দুইবার কাবা শরীফের ইমামও উপস্থিত ছিলেন। সিলেট, রাজশাহী, বগুড়া, খুলনা, কুমিল্লা, ঢাকা—দেশজুড়ে তার মাহফিল ছিল ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়।
আল্লামা সাঈদী ছিলেন একজন সুলেখক ও গবেষক। তার রচিত বইয়ের সংখ্যা ৭৭টিরও বেশি। এর মধ্যে রয়েছে ‘তাফসিরে সাঈদী’, ‘সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালিন’, ‘কোরআনের দৃষ্টিতে মহাকাশ ও বিজ্ঞান’, ‘কাদিয়ানীরা কেন মুসলিম নয়’, ‘ইসলামে শ্রমিকের অধিকার’ প্রভৃতি। তার রচিত কিছু গ্রন্থ বিদেশেও অনুদিত হয়েছে।
১৯৭৯ সালে তিনি জামায়াতে ইসলামীতে যোগ দেন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত দলটির নায়েবে আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পরপর দু’বার পিরোজপুর-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০১ সালে তার প্রচেষ্টায় ইন্দুরকানী উপজেলাকে জিয়ানগর উপজেলায় রূপান্তর করা হয়।
তার ওপর চারবার সরাসরি গুলিবর্ষণসহ একাধিকবার হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। ১৯৭৩, ১৯৭৪, ১৯৮৬ ও ১৯৯২ সালে এসব হামলা ঘটে। প্রতিবারই অলৌকিকভাবে রক্ষা পান।
২০১০ সালের ২৯ জুন তার শহীদবাগের বাসা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। শুরুতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মামলা, পরে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়। ২০১৩ সালে ফাঁসির রায় দেওয়া হয়। এরপর আপিলে তার রায় কমে গিয়ে হয় যাবজ্জীবন। প্রায় ১৩ বছর কারাবন্দি ছিলেন তিনি।
তার পরিবার অভিযোগ করে আসছে, তাকে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তার হার্টে রিং, ডায়াবেটিসসহ একাধিক রোগ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। মৃত্যুর দিন কারাগার থেকে গাজীপুর, সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার সময় সিসিইউ সাপোর্টহীন অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করা হয়।
আল্লামা সাঈদী ১৯৭১ সালে যশোরে বসবাস করতেন। যুদ্ধ শুরু হলে নিরাপত্তার জন্য পরিবারসহ বাঘারপাড়ায় আশ্রয় নেন এবং পরে নিজ গ্রামে চলে আসেন। তার বিরুদ্ধে যুদ্ধকালীন কোনো অপরাধের অভিযোগ স্বাধীনতার পরে চার দশক পর্যন্ত কেউ কখনো তোলেনি। ১৮ খণ্ডের ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র’-এও তার নাম নেই।
তার মৃত্যুর পর লাখো মানুষের অংশগ্রহণে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। তার বই, ওয়াজ, ভিডিও, সিডি আজও অসংখ্য মানুষের জীবনধারায় প্রভাব ফেলছে। অনেক অমুসলিম তার ভাষণে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছেন বলেও দাবি রয়েছে।