সুলেখা আক্তার শান্তা:
মোতাহার সংসার বিরাগী মানুষ। সব ছিল তাঁর, স্ত্রী সন্তান নিয়ে সুখের সংসার। একদিন আগুন লেগে সব পুড়ে ছারখার। আগুন লাগার খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল বাসায়, ততক্ষণে সব শেষ। দেখতে পেল বউ আর ছেলের অঙ্গার হওয়া দেহাবশেষ। ছেলেটা মাকে আঁকড়ে ধরে ছিল। বোঝা যায় বাঁচার জন্য কি সংগ্রামটা না করেছে তাঁরা। কোন সান্ত্বনায় প্রশমিত হয় না মন। অন্যমনস্ক হয়ে ঘুরে বেড়ায়। অন্য দিনের মতো হাঁটছিল রাস্তায়। অদ্ভুত কান্ড ঘটে সেদিন, এক শিশু হামাগুড়ি দিয়ে তাঁর পায়ের কাছে এসে পড়ে। শিশুটির শরীরের নরম স্পর্শ মোতাহারের পায়ে লাগে। তিনি চমকে ওঠেন। শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে চারদিকে তাকান। সামনে তাকিয়ে দেখেন এক মহিলা রাস্তায় অচেতন পড়ে আছে। শিশুটি মহিলার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। মোতাহার বুঝতে পারেন মহিলা শিশুটির মা। মহিলার চোখে মুখে পানি ছিটা দিলে চোখ মেলে তাকান। মোতাহার জিজ্ঞেস করেন, কোথা থেকে আসছেন কোথায় যাবেন? সে বলেন কোথায় যাব জানিনা। আমার কোন ঠিকানা নেই। মোতাহার হোসেন কেমন যেন দায়িত্বে আটকে যান। সে তাঁর নাম জানতে চান, কী হয়েছে তা জানতে চান। মহিলা ক্ষীণ কন্ঠে বলেন, আমার নাম লিলি, গায়ে খুব জ্বর। মোতাহার বলেন, ঠিক আছে আগে আপনাকে ডাক্তারের কাছে নেই তারপর দেখা যাবে কী করা যায়। লিলি বলেন, ডাক্তার দেখানোর টাকা নেই। লিলিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় নিয়ে যান। কয়েকদিন পর লিলি একটু সুস্থ হন। মোতাহার হোসেন লিলির কাছে তাঁর ব্যাপারে জানতে চান। লিলি বলেন, তাঁর ঘর সংসার সবই ছিল। দুর্ভাগা কপাল তাই সে সবকিছু হারিয়েছেন। অকালে স্বামী মারা যান। সন্তান নিয়ে আমি স্বামীর বাড়িতেই ছিলাম। কিন্তু সম্পত্তির লোভে দেবর ভাসুর আমার সন্তানকে মেরে ফেলার পরিকল্পনা করে। আমি জীবন বাঁচাতে সন্তান নিয়ে বাড়ি থেকে পালাই। সন্তান বেঁচে থাকলে আমার সব হবে। আমি ওই সম্পত্তি চাই না। আমি একটু নিরাপদ আশ্রয় চাই। মোতাহার আশ্বস্ত করেন, ঠিক আছে। আপনি যে কদিন প্রয়োজন এখানে থাকতে পারেন। আমাকে আপনার বড় ভাই বলে মনে করতে পারেন। লিলির চোখে অশ্রু এসে পড়ে। ভাই আমি তো আশ্রয় হীন ছিলাম, আপনার কথায় ভরসা পেয়ে খুব শান্তি পেলাম। মোতাহারের অগোছালো জীবন কিঞ্চিৎ গোছালো হতে শুরু করে। নিয়মিত ঘরে ফেরার তাগিদ অনুভব করেন।
লিলি আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেন গোছানো একটা সংসার জীবন ছাড়া মোতাহারের আর কোন কিছুর প্রয়োজন নাই। লিলিকে পরিচয় দেয় স্বামীহারা ছোট বোন হিসেবে। সেই পরিচয় স্থায়ী হয়ে যায় তাঁদের জীবনে। লিলি নিজে একটা কাজকর্ম করতে চেয়েছিল কিন্তু মোতাহার বাধা দেন। দুটো জীবন চালানোর মতো সংস্থান তাঁর আছে যদি কখনো না থাকে তখন দেখা যাবে। ধীরে ধীরে লিলির ছেলে কনক বড় হয়। খেলার সাথীরা সাইকেল নিয়ে খেলে, কনক বায়না ধরে সাইকেলের জন্য। এ কথা মামা মোতাহার কানে আসে। হাতে টাকা নাই ভাগিনার দাবি কী করে পূরণ করবে। বোনকে না জানিয়ে সে ইট ভাঙ্গার কাজ করে ভাগিনার জন্য সাইকেল কিনে নিয়ে আসে। মোতাহার হোসেন লুকাইতে চাইলেও লিলির চোখে সে ফাঁকি দিতে পারেন না। তুমি সাইকেল নিয়ে এসেছো ছেলে আমার খুশি হয়েছে তাতে আমিও খুশি। কিন্তু তোমার হাতে একি অবস্থা? না কিছু না। তুমি না বললেই হইবে? ভাই তুমি বোনের চোখ ফাঁকি দিতে চাও? কাজ করার সময় হাতে চোট লেগেছে। তাতে হাত ফুলে আছে। এতে এমন কিছু না। লিলি বলেন, তুমি আমার রক্তের ভাই না হলেও আমার জন্য তুমি যা করতেছ, আমি এই ঋণ কী দিয়া শোধ দেব? পাগল বোন আমার এটা কোন ঋণ না। আমার শূন্য জীবন তোমরা এসে পূর্ণ করেছ। বোনের ভালোবাসা পাই, ভাগ্নের ভালোবাসা পাই এটাই কম কিসের? আগুন আমার স্বপ্ন বিলীন করে দিয়েছিল। মনে করেছিলাম বেঁচে আর কী হবে! কিন্তু তোমরা আমাকে বাঁচতে শেখালে। লিলির মনে অনেকদিন ধরে একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সুযোগ পেয়ে এটা বলে ফেলেন। ভাই কিছু মনে করো না। তুমি আবার বিয়ে করো সংসার করো। মোতাহার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সংক্ষেপে বলেন, না বোন সে আমার দ্বারা হবে না। আমি আমার বউ-বাচ্চাকে ভুলতে পারব না। লিলি চুপ হয়ে যান এ প্রসঙ্গ নিয়ে আর কথা বলেন না। তাকে আপ্লুত করে আত্মত্যাগের বিরল মহিমা।
লিলির ছেলের পড়াশোনা শেষ। বড় স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে মানুষ করেছেন। ছেলে পড়ালেখা শেষ করে চাকরি করবে। তাঁর স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়েছে। ছেলে এখন নামকরা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। আগের বাসা ছেড়ে একটা ভাল বাসায় উঠে। মোতাহার হোসেন খুশি হন। তাঁর ভাগিনার জীবন সফলতা পেয়েছে। এবার ভালো একটা মেয়ে দেখে ছেলেকে বিয়ে করাবে। কনক বলে, মামা তুমি আর কাজ করবে না। আমাকে মানুষ করতে গিয়ে তুমি অনেক পরিশ্রম করেছ। আর তোমাকে পরিশ্রমের কাজ করতে দেবো না। এখন থেকে তুমি বিশ্রাম নেবে। মোতাহার বলেন, না ভাগ্নে বসে থেকে কী করব? তার চেয়ে কাজে কর্মে থাকা ভালো। শরীর ভালো থাকবে। কনক বলে, না মামা তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। না শুনলে দেশান্তরী হব। মোতাহার ঘাবড়ে যান! ঠিক আছে ভাগ্নে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না আমি কাজ থেকে অবসর নেব। এবার হলো তো? কনক বলে, হ্যাঁ মামা এবার ঠিক আছে।
কনক সাবিনার বিয়ে হয়। বিয়ের পরের জীবন কেমন হবে তার পূর্ব অনুমান করা দুরূহ। কথাটি পুরুষ মহিলা উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাবিনার ক্ষেত্রে ঘটতে থাকে তেমন অনুমান বহির্ভূত কান্ড। সাবিনার অহংকারী ও দাম্ভিক স্বভাব কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশ পেতে শুরু করে। শ্বশুর বাড়ি আসতে না আসতে খাটাতে থাকে অধিকারের কর্তৃত্ব। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং বিলাসিতায় কোন কিছুর কমতি নাই। শ্বশুর শাশুড়ির স্বল্প খরচটাই তার চোখে অনেক বড় হয়ে ধরা দেয়। শ্বশুরের খরচ শাশুড়ির খরচ নিয়ে স্বামীর সাথে নিত্যদিন কথা বলে। কনক বলে, তুমি কী শুরু করেছ? অফিস থেকে আসতেই কানের কাছে ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু হয়। সাবিনা রাগে ফেটে পড়ে। আমি ঘ্যানর ঘ্যানর করি? এই যে তুমি লোকটাকে মামা বলো সে কি তোমার আপন মামা? যদি না হয় তাহলে কোথাকার কে তাঁকে তোমরা বাসায় রাখতে যাবা কেন? সাবিনা তুমি যার কথা বলছ তিনি আপন না হলেও আপনার চেয়ে বেশি। সেই ব্যক্তিকে নিয়ে তুমি এভাবে কথা বলছো?
আমার স্বামীর টাকা খরচ হবে আমি সেটা বলবো না?
তর্ক বিতর্ক শুনে লিলি এগিয়ে আসেন, কী হয়েছে বৌমা?
আপনারা যে লোকটাকে রেখেছেন সে তো আপনাদের কোন আপনজন নয়। তাঁর পিছে আমার স্বামীর টাকা খরচ হচ্ছে না? বৌমা তুমি এসব কী বলছো? যাঁর কথা বলছো তাঁর দরুনেই আমরা মা ছেলে বেঁচে আছি। মানুষের জীবন যাপন করছি। আমার ছেলেকে পড়ালেখা করাইতে পারছি। তুমি যাঁর কথা বলছ, সে আমার ভাই।
সে তো আপনার আপন ভাই না। কোথাকার কাকে বাড়িতে জায়গা দিয়েছেন তাঁকে বানাইছেন ভাই। আপনার সাথে কী সম্পর্ক ছিল কে জানে!
আমি তোমার শাশুড়ি। তুমি আমাকে নিয়ে এসব কী বলছো? এরপর আর তোমার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলা যায় না।
মোতাহার হোসেন লিলিকে বলেন, বৌমা কী যেন বলল আমার কানে আসলো। লিলি বলেন, না ভাই কোন কিছু বলে নাই। মোতাহার বলেন, বোন আমার এখানে থাকা নিয়ে কি কোন সমস্যা? লিলি অসহায়ের মতো নিচের দিকে তাকিয়ে থাকেন। অশ্রু গোপন করে বলেন, না ভাই তুমি কী শুনতে কী শুনেছো। মোতাহার বলেন, কী জানি বোন কী শুনলাম। মোতাহার হোসেনের বয়স হয়েছে। শরীরটা তেমন ভালো যায় না। বাসায় শুয়ে বসে দিন কাটে। একদিন লিলিকে বলেন, বোন আমার না কী জানি খাইতে মন চায় কিন্তু বলতে পারি না। সাবিনা শুনে বলে, এত খাই, খাই করেন কেন? রুম একটা দখল করে বসে আছেন। মোতাহার হোসেন এ কথা শুনে লজ্জায় মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখেন। লিলি বলেন, খাইতে চায় তা শুনেই তুমি চিল্লাইয়া বাড়ি মাথায় নিছো। এই মানুষটা তোমার স্বামীকে মানুষ করতে গিয়ে কত পরিশ্রম করছে তুমি জানো? সাবিনা বলে, তাকে মানুষ করতে গিয়ে আপনারা কী করছেন সেটা আমি শুনতে চাই না। সব বাবা মাকেই তাদের সন্তানকে মানুষ করতে হয়, আপনারা তাই করেছেন। লিলি বলেন, তুমি যে মানুষটাকে নিয়ে কথা বলছো আমার এই ভাই আমাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছেন। আমার সন্তানের আবদার পূরণ করছে আমাকে না জানিয়ে। তুমি সেই মানুষটা নিয়ে কথা বলছো? সাবিনা শাশুড়িকে বলে, আমাকে চোখ রাঙিয়ে কথা বলবেন না। আমার স্বামীকে মানুষ করছেন তার খোটা আপনি আমাকে দিচ্ছেন? আমার স্বামী আসুক আমি আর এই বাড়িতে থাকবো না। মোতাহার হোসেন বলেন, বৌমা তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিও না। তার চেয়ে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। লিলি বলেন, ভাই তুমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে মনে করছ আমি এই বাড়িতে থাকব? তা আমি কখনোই থাকবো না।
কনক বাসায় আসে, আসতেই সাবিনা অভিযোগ নিয়ে বসে। আমি আর এই বাড়িতে থাকবো না। তোমার মা, মামা তোমাকে মানুষ করতে গিয়ে অনেক কষ্ট করেছে। তাই সেই কষ্টের প্রতিদান দিতে চাই আমি এই বাড়িতে না থেকে। কনক বলে, কী শুরু করেছো তুমি। আমার বুড়া মা আর মামাটা তোমার কাছে এতই বেশি হলো? এই মামা আমার চাওয়া পাওয়া পূর্ণ করেছে। সাবিনা বলে, তোমার মা আর মামা এ কথা বলে আমার কান ঝালাপালা করে দিলো। এখন তুমিও ওই কথা বলছ? থাকবো না এখানে, চলে যাব বাপের বাড়ি। তোমার পিছনে যাঁদের অবদান আছে তাদের নিয়ে তুমি থাকো। সাবিনা কাপড়-চোপড় গুছিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়। তখন মোতাহার বলেন, বৌমা আমার জন্য তুমি চলে যাবে কেন? আমি তোমাদের আপন কেউ না, পরগাছা আমি চলে যাই। মোতাহের হোসেন ব্যাগ গুছিয়ে চলে যেতে নেন। লিলি বলেন, দাঁড়াও ভাই যেখানে তোমার স্থান নেই সেখানে আমিও থাকতে চাই না আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব। লিলি ছেলেকে বলেন, বাবা তোরা ভালো থাকিস তোদের জন্য সব সময় দোয়া রইলো। মোতাহার বলেন, বোন তুমি তোমার ছেলের কাছে থাকো। লিলি বলেন, ভাই আমি এখানে থাকবো ঠিকই কিন্তু তোমাকে রাইখা আমি ভালো থাকবো না। জানিনা কতদিন বেঁচে থাকবো, যতদিন বাঁচি তোমার সঙ্গেই থাকব। মোতাহার হোসেন আর লিলি বের হয়ে যান। কনক অশ্রুসিক্ত চোখে মা আর মামার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে এক বুক গ্লানি নিয়ে। আমাকে মানুষ করে এই কি প্রতিদান পাওয়ার কথা ছিল মা আর মামার। ভাবে, বিগত আর আগত উভয়কে রক্ষার চিরদিনের দুরূহ কাজটি করতে পারলো না সে।
Facebook Comments Box