আত্মমর্যাদা

সুলেখা আক্তার শান্তা :
বলা হয় বাবা পরিবারের বটবৃক্ষ। রাকিব বাল্যকালে হতে সেই বটবৃক্ষের ছায়া থেকে বঞ্চিত। মা তাদের পুরো পরিবারকে আস্টেপৃষ্টে বেঁধে সেই ছায়ার অভাব পূরণের চেষ্টা করে চলেছে। রাকিবের পিতা আচমকা একদিন পরিবার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
রাকিব ছোটবেলা থেকে ধার্মিক প্রকৃতির। রোজা নামাজে অনুরক্ত। রাকিবকে কখনো কোন কিছু বলে কয়ে করাতে হয়নি। যা করার সে নিজে থেকেই করে। এজন্য মা মমতা তাকে খুব ভালবাসে। শুধু মা নয় পরিবারের সবাই রাকিবকে ভালোবাসে। দুই ভাই এক বোন এবং মাকে নিয়ে তাদের সংসার। সবাইকে ফেলে পিতার এমন অন্তর্ধানের কারণ সে খুঁজে পায় না। আগে এ নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল এখন সয়ে গেছে। মাকে খুব কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। সে নিয়তিকে মেনে নিয়েছে, ভাগ্যে বোধ হয় এভাবেই লেখা আছে। রাকিবের পড়ালেখার প্রতি গভীর আগ্রহ। মা তার পড়ালেখার খরচ চালাতে পারবে না। সে বাস্তবতা মেনে নেয়। কোন একটা বই পেলে রাকিব মনোযোগ সহকারে পড়ে। মমতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিরবে। ছেলেটা পড়ালেখা করতে চায় কিন্তু সেই আশা পূরণ করতে পারে না।
রাকিবের খালু ইদ্রিস আহমেদ, তার গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ আছে। সেই গ্যারেজে রাকিবকে কাজে লাগাতে চান। মমতা ছেলেকে দিতে চান না। আমার এইটুকু ছেলে অমন ভারী কাজ করতে পারবে না। ইদ্রিস বলেন, রাকিব কাজ করতে পারবে কে বলল? ওকে আমি শিখাইয়া নেব। গ্যারেজে তো আরো মানুষ আছে তাদের কাজ করা দেখে ও শিখে নেবে। আর আমি ওকে দিয়ে তো কাজ করাব না। ও আমার সঙ্গে থাকবে। গ্যারেজের মালিকের আত্মীয় ওর একটা দাম আছে না! ও সেই ভাবে থাকবে। রাকিব সোৎসাহে বলে, মা আমি খালুর ওখানে সঙ্গে কাজ করবো। মমতা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে। কোন কথা তাঁর মুখে আসে না। ইদ্রিস আহমেদ মমতাকে বলেন, আপা কালকে আমার সঙ্গে রাকিবকে নিয়ে যাব। বাবা রাকিব তুমি ভোরে উঠে রেডি হয়ে থেকো।
রাকিব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে রেডি হতে থাকে। মাকে ডাকে, মা আমি রেডি খালু এসে ডাক দিলেই বের হব। মমতা ছেলের কথায় অবাক হন, বাবা তুমি যাবা? হ্যাঁ মা, খালু কাল যেখানে সব ঠিক করে গেলেন, সেখানে না যাই কিভাবে? মমতার খারাপ লাগে। ছেলের নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা দেখে মমতা খুশি হন। ইদ্রিস রাকিবদের বাসার সামনে আসেন। দেখেন রাকিব রেডি হয়ে আছে। দেখে বলেন, বা বেডা বাহ! নিজের গাড়িতে করে ইদ্রিস আহমেদ রাকিবকে নিয়ে গ্যারেজে আসেন। নিজের আসনে বসে পাশে রাকিবকে বসান। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে বাসায় ফিরতে রাত একটা দেড়টা বেজে যায়। ইদ্রিস রাকিব কে বাসায় দিয়ে নিজে বাসায় চলে যান। মমতা অনেক রাত্রে ছেলেকে ফিরতে দেখে বলেন, এইটুকু ছেলে আমার এত রাত পর্যন্ত কাজে থাকে। আর পুরো শরীরটা রাকিবের কালিতে মাখা। না বাবা তোমাকে আর কাজে যেতে হবে না। রাকিব মাকে বুঝিয়ে বলে, মা কোন কাজই সহজ না সব কাজই কঠিন। মা তুমি আমার জন্য দুশ্চিন্তা করো না। কাজ করতে আমার কোন কষ্ট হয় না। রাকিব ভাবে, মায়ের সামনে এমন কালি মাখা পোশাকে সে আসব না। গ্যারেজের জন্য আলাদা পোশাক রাখবো। রাকিবের খাওয়া দাওয়া সারতে আরো রাত হয়ে যায়। সে শুয়ে পড়ে সকালে উঠতে হবে সেই তাড়ায়। রাকিব নিয়মিত কাজে যায়। সে খালুকে বলে, খালু কখনো কোনো ছুটি চাইনা। শুধু আমাকে ছুটি দিবেন যখন তাবলীগ জামাতে কোথাও যেতে হয়। ইদ্রিস আহমেদ বলেন, ঠিক আছে। রাকিব কখনো শার্ট প্যান্ট পড়ে না। তার সব সময়ের পোশাক পাঞ্জাবি পায়জামা আর মাথায় টুপি। রাকিব যখন বেতন পায় খুব খুশি হয়। বেতন এনে মায়ের হাতে দেয়। মমতা ছেলের বেতন পেয়ে খুশি। কিন্তু টাকাটা যখন খুলে দেখে তখন সে মনে খুব দুঃখ পায়! পরিশ্রম অনুযায়ী ছেলেকে পারিশ্রমিক দেয়নি ইদ্রিস। সে ইদ্রিসের সঙ্গে কথা বলে। দেখো ইদ্রিস রাকিব তোমার সঙ্গে যেভাবে পরিশ্রমটা দেয় সেইভাবে ওকে বেতনটা দিও। ইদ্রিস বলেন, আপা ওকে যা দেই তা তো বেতন হিসেবে দেই না। ওকে একটু হাত খরচা দেই। ও আমার সাথে থাকতে থাক ওর ভবিষ্যৎ আমি করে দেব। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করেন না। রাকিব ছুটি নিয়ে মাঝেমধ্যে তাবলীগ জামাতের চিল্লায় যায়।
রাকিব গ্যারেজে কাজ শুরু করার পর থেকে ইদ্রিস আহমেদের ব্যবসায় উন্নতি হয়। সে কিছু জমি জমা ক্রয় করেন। রাকিবের পিঠে হাত রেখে ইদ্রিস আহমেদ বলেন, বেটা ভাবিস না আমার এই অবস্থার পিছনে তোর অনেক অবদান। তোর ভবিষ্যৎ আমি করে দেব। তোকে আমি একটা বাড়ি করে দেবো। ইদ্রিস আহমেদের বন্ধু মিলন সিকদার একদিন বলেন, বন্ধু আমি তোমার কাছে রাকিবকে চাই। রাকিবকে চাও মানে? তোমার গাড়ির গ্যারেজ তো উইঠা গেল বন্ধু। কিন্তু আমি তো পড়ে গেলাম। তাই আমি রাকিবকে চাইছিলাম আমার গ্যারেজের জন্য। ইদ্রিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, না বন্ধু রাকিবকে দেওয়া যাবে না।
রাকিবকে না দেওয়ায় মিলন শিকদারের মনে প্রতিহিংসা শুরু হয়। ইদ্রিস গ্যারেজ দিয়ে বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে গেল। আর আমি পারছি না কিছু করতে। চিন্তা করে কী করা যায়। সব কিছুর দায়িত্বে আছে রাকিব। কোন কিছু করে রাকিবকে ফাঁসাতে হবে। যাতে রাকিবকে ইদ্রিস আর গ্যারেজে না রাখে। যেমন কথা তেমন কাজ। মিলন ইদ্রিসের গ্যারেজের লোক হাত করেন। গাড়ির মেরামতের পার্সের একটা বড় চালান রাত্রে সরিয়ে ফেলে। ইদ্রিস আহমেদ গ্যারেজে গিয়ে দেখে তার গ্যারেজে চুরি হয়েছে। গ্যারেজে কোন মালামাল নেই। এ কাজ কিভাবে হলো সে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন। অনেক খোঁজখবর করে মালামাল গুলো উদ্ধার করতে পারে। সে জানতে চায় গ্যারেজ থেকে কিভাবে মালামাল গুলো বের হলো। তারা রাকিবের নাম বলে। রাকিব আমাদের কাছে মাল বিক্রি করেছে। এ কথা শোনার পর ইদ্রিস আহমেদ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। যে ছেলেকে এত ভালো জানি সেই ছেলে এই কাজ করতে পারলো! যে ছেলে এত নামাজ রোজা করে সেই ছেলে এই কাজ কিভাবে করে! ওকে আর আমার গ্যারেজে রাখবো না। ইদ্রিস আহমেদ রাকিবকে তাড়িয়ে দেন। যাবার সময় রাকিব জিজ্ঞেস করে, খালু আমার অপরাধ কী? আপনি আমাকে তাড়াচ্ছেন কেন? ইদ্রিস উচ্চস্বরে বলেন, তোর অপরাধ তুই জানিস না? তুই আমার গ্যারেজ থেকে মাল সরিয়েছিস তা আবার বিক্রি করে দিয়েছিস। কোন চোরের জায়গা নেই আমার কাছে। রাকিব হাউ মাউ করে কেঁদে দেয়। নিষ্ঠার সঙ্গে যার গ্যারেজে বিশটা বছর খাটলাম, সেই ছোটকাল থেকে। আজ আমার কপালে এই অপবাদ জুটল। কোনদিন বেতন-ভাতা নিয়েও কথা বলিনি যা দিয়েছেন তাই নিয়েছি। ইদ্রিস বলেন, বেতন-ভাতা নেস নাই দেইখা আজ আমার এই সর্বনাশ করলি! রাকিব অভিমান নিয়ে চলে যায়। মায়ের কাছে সব বৃতান্ত খুলে বলে। মমতা বলেন, যে ছেলে নিষ্ঠার সঙ্গে এত বছর কাজ করলো সেই ছেলের নামে এমন বদনাম দিতে বুক কাঁপল না। রাকিব বলে, না খেয়ে মরে যাব তাও উনার সামনে আর যাব না। আল্লাহ নিশ্চয়ই এক ভাবে আমাদের বাঁচাবেন।
বছর দুয়েক পর ইদ্রিস আহমেদ আসেন মমতার কাছে। আমি রাকিবকে ফিরিয়ে নিতে চাই। মমতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তোমার ওখানে রাকিব আর যাবেনা। চোরকে কেন নিতে এসেছ? আমার ছেলে তো চোর! তোমার লক্ষ লক্ষ টাকার মাল বিক্রি করে ফেলছে। আপা আমাকে আর লজ্জা দিবেন না। এই কাজ রাকিব করেনি আমি পরে জানতে পেরেছি। এই কাজ করেছে আমার বন্ধু। জানতে পেরেই আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আমি রাকিবকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাই। মমতা বলেন, আমার ছেলেকে তুমি অপবাদ দিয়ে খালি হাতে বিদায় করেছিলে। তুমি বলছিলে রাকিবের ভবিষ্যৎ তুমি করে দেবে। কিছুই তো দাওনি দিয়েছো মিথ্যা অপবাদ। এই দুইটা বছর আমাদের কিভাবে গেছে, কিভাবে কেটেছে আমাদের দিনরাত, একটা বারও খোঁজ নাওনি। ওই কাজ অন্য কেউ করেছে জানতে পেরেছ বলে আমার কাছে এসেছ, না হলে তো কোনদিন আর আসতে না। যেটা ভেবেছিলে সেটা নিয়েই থাকো। আমাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে আমাদের থাকতে দাও। রাকিবের কথাও তাই। ইদ্রিস আহমেদ ফিরে যান। রাকিব মাকে বলে, মা অন্যের রাজপ্রাসাদ নিজের জন্য সুখ বয়ে আনে না। সুখ যদি থাকে নিজের গড়া কুঁড়ে ঘরেই থাকে।
Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অনেক সাংবাদিক নিজের আখের গোছানোর জন্য দালালি করেন: মির্জা ফখরুল

» ভেঙে পড়া রাষ্ট্রকে গঠন বিএনপির পক্ষে সম্ভব : তারেক রহমান

» সিএনজি চালকদের শৃঙ্খলভাবে গাড়ি চালানোর আহ্বান মঈন খানের

» নগদ টাকা ও সরঞ্জামসহ ১৯ জুয়াড়ি গ্রেপ্তার

» শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে অস্থির ইন্দোনেশিয়া

» আমরা তরুণদের হাতে বাংলাদেশকে তুলে দিতে চাই : জামায়াত আমির

» এই গেইম কোত্থেকে চলতেছে আমরা ঠিকই বুঝি: হান্নান মাসউদ

» আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের ‘বিশেষ’ তালিকা করছে পুলিশ

» রমজানের একদিন আগে নফল রোজা রাখা জায়েজ?

» বাদুড়ের শরীরে নতুন করোনার সন্ধান, মানবদেহেও ছড়ানোর শঙ্কা

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

আত্মমর্যাদা

সুলেখা আক্তার শান্তা :
বলা হয় বাবা পরিবারের বটবৃক্ষ। রাকিব বাল্যকালে হতে সেই বটবৃক্ষের ছায়া থেকে বঞ্চিত। মা তাদের পুরো পরিবারকে আস্টেপৃষ্টে বেঁধে সেই ছায়ার অভাব পূরণের চেষ্টা করে চলেছে। রাকিবের পিতা আচমকা একদিন পরিবার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
রাকিব ছোটবেলা থেকে ধার্মিক প্রকৃতির। রোজা নামাজে অনুরক্ত। রাকিবকে কখনো কোন কিছু বলে কয়ে করাতে হয়নি। যা করার সে নিজে থেকেই করে। এজন্য মা মমতা তাকে খুব ভালবাসে। শুধু মা নয় পরিবারের সবাই রাকিবকে ভালোবাসে। দুই ভাই এক বোন এবং মাকে নিয়ে তাদের সংসার। সবাইকে ফেলে পিতার এমন অন্তর্ধানের কারণ সে খুঁজে পায় না। আগে এ নিয়ে তার আক্ষেপ ছিল এখন সয়ে গেছে। মাকে খুব কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। সে নিয়তিকে মেনে নিয়েছে, ভাগ্যে বোধ হয় এভাবেই লেখা আছে। রাকিবের পড়ালেখার প্রতি গভীর আগ্রহ। মা তার পড়ালেখার খরচ চালাতে পারবে না। সে বাস্তবতা মেনে নেয়। কোন একটা বই পেলে রাকিব মনোযোগ সহকারে পড়ে। মমতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিরবে। ছেলেটা পড়ালেখা করতে চায় কিন্তু সেই আশা পূরণ করতে পারে না।
রাকিবের খালু ইদ্রিস আহমেদ, তার গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ আছে। সেই গ্যারেজে রাকিবকে কাজে লাগাতে চান। মমতা ছেলেকে দিতে চান না। আমার এইটুকু ছেলে অমন ভারী কাজ করতে পারবে না। ইদ্রিস বলেন, রাকিব কাজ করতে পারবে কে বলল? ওকে আমি শিখাইয়া নেব। গ্যারেজে তো আরো মানুষ আছে তাদের কাজ করা দেখে ও শিখে নেবে। আর আমি ওকে দিয়ে তো কাজ করাব না। ও আমার সঙ্গে থাকবে। গ্যারেজের মালিকের আত্মীয় ওর একটা দাম আছে না! ও সেই ভাবে থাকবে। রাকিব সোৎসাহে বলে, মা আমি খালুর ওখানে সঙ্গে কাজ করবো। মমতা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে। কোন কথা তাঁর মুখে আসে না। ইদ্রিস আহমেদ মমতাকে বলেন, আপা কালকে আমার সঙ্গে রাকিবকে নিয়ে যাব। বাবা রাকিব তুমি ভোরে উঠে রেডি হয়ে থেকো।
রাকিব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে রেডি হতে থাকে। মাকে ডাকে, মা আমি রেডি খালু এসে ডাক দিলেই বের হব। মমতা ছেলের কথায় অবাক হন, বাবা তুমি যাবা? হ্যাঁ মা, খালু কাল যেখানে সব ঠিক করে গেলেন, সেখানে না যাই কিভাবে? মমতার খারাপ লাগে। ছেলের নিষ্ঠা এবং একাগ্রতা দেখে মমতা খুশি হন। ইদ্রিস রাকিবদের বাসার সামনে আসেন। দেখেন রাকিব রেডি হয়ে আছে। দেখে বলেন, বা বেডা বাহ! নিজের গাড়িতে করে ইদ্রিস আহমেদ রাকিবকে নিয়ে গ্যারেজে আসেন। নিজের আসনে বসে পাশে রাকিবকে বসান। সারাদিনের কাজকর্ম শেষে বাসায় ফিরতে রাত একটা দেড়টা বেজে যায়। ইদ্রিস রাকিব কে বাসায় দিয়ে নিজে বাসায় চলে যান। মমতা অনেক রাত্রে ছেলেকে ফিরতে দেখে বলেন, এইটুকু ছেলে আমার এত রাত পর্যন্ত কাজে থাকে। আর পুরো শরীরটা রাকিবের কালিতে মাখা। না বাবা তোমাকে আর কাজে যেতে হবে না। রাকিব মাকে বুঝিয়ে বলে, মা কোন কাজই সহজ না সব কাজই কঠিন। মা তুমি আমার জন্য দুশ্চিন্তা করো না। কাজ করতে আমার কোন কষ্ট হয় না। রাকিব ভাবে, মায়ের সামনে এমন কালি মাখা পোশাকে সে আসব না। গ্যারেজের জন্য আলাদা পোশাক রাখবো। রাকিবের খাওয়া দাওয়া সারতে আরো রাত হয়ে যায়। সে শুয়ে পড়ে সকালে উঠতে হবে সেই তাড়ায়। রাকিব নিয়মিত কাজে যায়। সে খালুকে বলে, খালু কখনো কোনো ছুটি চাইনা। শুধু আমাকে ছুটি দিবেন যখন তাবলীগ জামাতে কোথাও যেতে হয়। ইদ্রিস আহমেদ বলেন, ঠিক আছে। রাকিব কখনো শার্ট প্যান্ট পড়ে না। তার সব সময়ের পোশাক পাঞ্জাবি পায়জামা আর মাথায় টুপি। রাকিব যখন বেতন পায় খুব খুশি হয়। বেতন এনে মায়ের হাতে দেয়। মমতা ছেলের বেতন পেয়ে খুশি। কিন্তু টাকাটা যখন খুলে দেখে তখন সে মনে খুব দুঃখ পায়! পরিশ্রম অনুযায়ী ছেলেকে পারিশ্রমিক দেয়নি ইদ্রিস। সে ইদ্রিসের সঙ্গে কথা বলে। দেখো ইদ্রিস রাকিব তোমার সঙ্গে যেভাবে পরিশ্রমটা দেয় সেইভাবে ওকে বেতনটা দিও। ইদ্রিস বলেন, আপা ওকে যা দেই তা তো বেতন হিসেবে দেই না। ওকে একটু হাত খরচা দেই। ও আমার সাথে থাকতে থাক ওর ভবিষ্যৎ আমি করে দেব। ও নিয়ে আপনি চিন্তা করেন না। রাকিব ছুটি নিয়ে মাঝেমধ্যে তাবলীগ জামাতের চিল্লায় যায়।
রাকিব গ্যারেজে কাজ শুরু করার পর থেকে ইদ্রিস আহমেদের ব্যবসায় উন্নতি হয়। সে কিছু জমি জমা ক্রয় করেন। রাকিবের পিঠে হাত রেখে ইদ্রিস আহমেদ বলেন, বেটা ভাবিস না আমার এই অবস্থার পিছনে তোর অনেক অবদান। তোর ভবিষ্যৎ আমি করে দেব। তোকে আমি একটা বাড়ি করে দেবো। ইদ্রিস আহমেদের বন্ধু মিলন সিকদার একদিন বলেন, বন্ধু আমি তোমার কাছে রাকিবকে চাই। রাকিবকে চাও মানে? তোমার গাড়ির গ্যারেজ তো উইঠা গেল বন্ধু। কিন্তু আমি তো পড়ে গেলাম। তাই আমি রাকিবকে চাইছিলাম আমার গ্যারেজের জন্য। ইদ্রিস কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন, না বন্ধু রাকিবকে দেওয়া যাবে না।
রাকিবকে না দেওয়ায় মিলন শিকদারের মনে প্রতিহিংসা শুরু হয়। ইদ্রিস গ্যারেজ দিয়ে বাড়ি গাড়ির মালিক হয়ে গেল। আর আমি পারছি না কিছু করতে। চিন্তা করে কী করা যায়। সব কিছুর দায়িত্বে আছে রাকিব। কোন কিছু করে রাকিবকে ফাঁসাতে হবে। যাতে রাকিবকে ইদ্রিস আর গ্যারেজে না রাখে। যেমন কথা তেমন কাজ। মিলন ইদ্রিসের গ্যারেজের লোক হাত করেন। গাড়ির মেরামতের পার্সের একটা বড় চালান রাত্রে সরিয়ে ফেলে। ইদ্রিস আহমেদ গ্যারেজে গিয়ে দেখে তার গ্যারেজে চুরি হয়েছে। গ্যারেজে কোন মালামাল নেই। এ কাজ কিভাবে হলো সে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন। অনেক খোঁজখবর করে মালামাল গুলো উদ্ধার করতে পারে। সে জানতে চায় গ্যারেজ থেকে কিভাবে মালামাল গুলো বের হলো। তারা রাকিবের নাম বলে। রাকিব আমাদের কাছে মাল বিক্রি করেছে। এ কথা শোনার পর ইদ্রিস আহমেদ বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। যে ছেলেকে এত ভালো জানি সেই ছেলে এই কাজ করতে পারলো! যে ছেলে এত নামাজ রোজা করে সেই ছেলে এই কাজ কিভাবে করে! ওকে আর আমার গ্যারেজে রাখবো না। ইদ্রিস আহমেদ রাকিবকে তাড়িয়ে দেন। যাবার সময় রাকিব জিজ্ঞেস করে, খালু আমার অপরাধ কী? আপনি আমাকে তাড়াচ্ছেন কেন? ইদ্রিস উচ্চস্বরে বলেন, তোর অপরাধ তুই জানিস না? তুই আমার গ্যারেজ থেকে মাল সরিয়েছিস তা আবার বিক্রি করে দিয়েছিস। কোন চোরের জায়গা নেই আমার কাছে। রাকিব হাউ মাউ করে কেঁদে দেয়। নিষ্ঠার সঙ্গে যার গ্যারেজে বিশটা বছর খাটলাম, সেই ছোটকাল থেকে। আজ আমার কপালে এই অপবাদ জুটল। কোনদিন বেতন-ভাতা নিয়েও কথা বলিনি যা দিয়েছেন তাই নিয়েছি। ইদ্রিস বলেন, বেতন-ভাতা নেস নাই দেইখা আজ আমার এই সর্বনাশ করলি! রাকিব অভিমান নিয়ে চলে যায়। মায়ের কাছে সব বৃতান্ত খুলে বলে। মমতা বলেন, যে ছেলে নিষ্ঠার সঙ্গে এত বছর কাজ করলো সেই ছেলের নামে এমন বদনাম দিতে বুক কাঁপল না। রাকিব বলে, না খেয়ে মরে যাব তাও উনার সামনে আর যাব না। আল্লাহ নিশ্চয়ই এক ভাবে আমাদের বাঁচাবেন।
বছর দুয়েক পর ইদ্রিস আহমেদ আসেন মমতার কাছে। আমি রাকিবকে ফিরিয়ে নিতে চাই। মমতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, তোমার ওখানে রাকিব আর যাবেনা। চোরকে কেন নিতে এসেছ? আমার ছেলে তো চোর! তোমার লক্ষ লক্ষ টাকার মাল বিক্রি করে ফেলছে। আপা আমাকে আর লজ্জা দিবেন না। এই কাজ রাকিব করেনি আমি পরে জানতে পেরেছি। এই কাজ করেছে আমার বন্ধু। জানতে পেরেই আমি আপনার কাছে ছুটে এসেছি। আমি রাকিবকে আমার কাছে নিয়ে যেতে চাই। মমতা বলেন, আমার ছেলেকে তুমি অপবাদ দিয়ে খালি হাতে বিদায় করেছিলে। তুমি বলছিলে রাকিবের ভবিষ্যৎ তুমি করে দেবে। কিছুই তো দাওনি দিয়েছো মিথ্যা অপবাদ। এই দুইটা বছর আমাদের কিভাবে গেছে, কিভাবে কেটেছে আমাদের দিনরাত, একটা বারও খোঁজ নাওনি। ওই কাজ অন্য কেউ করেছে জানতে পেরেছ বলে আমার কাছে এসেছ, না হলে তো কোনদিন আর আসতে না। যেটা ভেবেছিলে সেটা নিয়েই থাকো। আমাদের দুঃখ কষ্ট নিয়ে আমাদের থাকতে দাও। রাকিবের কথাও তাই। ইদ্রিস আহমেদ ফিরে যান। রাকিব মাকে বলে, মা অন্যের রাজপ্রাসাদ নিজের জন্য সুখ বয়ে আনে না। সুখ যদি থাকে নিজের গড়া কুঁড়ে ঘরেই থাকে।
Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com