আজি হতে শতবর্ষ পরে

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ; ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ অমর কবিতাটি পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গেছি ভাবনার জগতে। শতবর্ষ পরে আমাকে, আপনাকে বা আমাদের কেউ কি মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে? শতবর্ষ আগে যারা ছিলেন তাদের কি আমরা মনে রেখেছি? জীবনে কেউই অমর নয় সত্য, কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে কারও কারও অমরত্বের রহস্য কী?

 

জীবন তো ক্ষণস্থায়ী, পদ্মপাতার জল। কবির যেমন হাহাকার- ‘দম ফুরাইলেই ঠুস’ বা ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইব রংতামাশা’, বাউলের তেমনই উপলব্ধি- ‘একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার, কেন বান্ধ দালান ঘর।’ এটাই নির্মম সত্য। কিন্তু এ ক্ষুদ্র জীবনে চলার পথে আমরা কি তা মনে রাখি? কত ভালোবাসা! কত স্বপ্ন! জীবন ঘিরে কত আয়োজন! জীবন সাজাতে, জীবন রাঙাতে মেধা-শ্রম-সময়ের কি অফুরান বিনিয়োগ! অথচ ভেবে দেখি না, পৃথিবী থাকার স্থান নয়, চিরদিন এখানে থাকা যায় না, কেউ থাকেনি, থাকতে পারেনি, থাকতে পারবেও না, থাকা সম্ভবও নয়। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। তার পরও আমরা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখি, সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে আমৃত্যু দৌড়ে চলেছি। এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে ১০০ বছর পরের কথা একটু কল্পনা করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১২২। আজ আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে সময় আমাদের একজনও হয়তো বেঁচে থাকব না। আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। যখন ২১২২ সাল, আমাদের প্রায় সবার দেহ তখন মাটির নিচে, অস্তিত্ব তখন রুহের জগতে। ফেলে যাওয়া সুন্দর বাড়িটা, শখের গাড়িটা, জমিজমা, ধনসম্পদ, টাকাপয়সা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভোগ করবে। একই নিয়মে দিন চলবে, কর্মযজ্ঞ চলবে। ‘তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে, কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে’। পৃথিবীর বুকে আজকের এই বেঁচে থাকা, এত হইচই, এত মায়াকান্না সব এভাবেই চলতে থাকবে। থাকব না শুধু আমি- ‘একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালী নেই’। আচ্ছা, তখন কি আমার কথা কেউ ভাববে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি আমাকে বা আমাদের মনে রাখবে? আমার স্মৃতিচারণা করবে? নাকি যাদের জন্য সব করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের হাতে সময় হবে না আমাকে মনে রাখার। তারা হয়তো তখন নতুন স্বপ্নে বিভোর, নতুন উদ্যমে জীবন সাজাচ্ছে, সেই একই চক্রে বাঁধা পড়ছে, অজান্তে।

যদি নিজেদের প্রশ্ন করি- আমরাই কি আমাদের ১০০ বছর আগের প্রজন্মকে মনে রেখেছি? আমাদের দাদার দাদা, নানার নানা বা অন্য পূর্বপুরুষের কথা কি আমরা জানি? তাদের নামটাই বা আমরা কতজন বলতে পারব? মাত্র দুই কি তিন পুরুষের ব্যবধানে নামটা পর্যন্ত হারিয়ে যায়, পরিচয় তো পরে। নেহাতই যুগশ্রেষ্ঠ পুরুষ বা নারী না হলে, সবাই হারিয়ে যায় কালের অন্তরালে। তাহলে ১০০ বছর পর ওই সময়ের প্রজন্মের কেউ কেনই বা আমাদের মনে রাখবে।

 

এ ভাবনা কষ্টকর বইকি। তাহলে পৃথিবীতে এসে এত কিছু অর্জন করে আমাদের কী লাভ হলো? যে পিতা-মাতা সন্তানের জন্য জীবনের সব সময়, শ্রম, ধনদৌলত বিনিয়োগ করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই; চলে যাওয়ার পর তাঁদের কথা কেউ মনে রাখে না, ভাবে না, স্মরণ করে না। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? আসলে এ পৃথিবীতে নিজের বলে কিছুই নেই। জীবনের যা অর্জন তার কিছুই মৃত্যুর পর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না। একমাত্র আকুতি যদি বেঁচে থাকা যায় কারও স্মৃতি হয়ে, কিন্তু এ ভাগ্যই বা কজনের হয়। শূন্য থেকে এসে আবার শূন্যেই মিলিয়ে যাওয়া- মানবজন্মের বোধহয় সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।

 

আসলে আমরা কীসের পেছনে ছুটে চলেছি? একেবারে শৈশব থেকে যে প্রচন্ড দৌড়, এর গন্তব্য কোথায়? আমরা স্কুলে ভালো রেজাল্টের জন্য, কর্মে সাফল্য আর পদোন্নতির জন্য, অর্থ-যশ-খ্যাতি-ক্ষমতার জন্য ছুটে চলি। অন্যকে টেনে নামাতে, ছিদ্রান্বেষণে, কালিমা লেপনে ছোটাছুটির অন্ত নেই। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যও কত প্রাণান্ত চেষ্টা, তাতে কি শেষরক্ষা হয়? একসময় কিন্তু দেহটাই শেষ হয়ে যায়। এ ছুটে চলার মাঝে ‘বারবার কারও পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই’। অথচ ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান’। আর শেষকালে মনে হয় ‘তুমি কার, কে তোমার’, কী রেখে যাই, কী নিয়ে যাই, কার স্মৃতিতে ঠাঁই পাই। দৌড়ই যার একমাত্র কর্ম, গন্তব্যেই তার সমাপ্তি। অনাগতকাল কেন তবে আমাকে মনে রাখবে?

 

চলে যাওয়া অসংখ্য প্রজন্মের পথ বেয়ে আমরা এ জীবন লাভ করেছি, আবার আগামীতে এমনি অসংখ্য প্রজন্মের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাব। এই অনন্ত মিছিলের মাঝে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরা যায়? এক আকাশ নামহীন তারার মাঝে ধ্রুবতারা হওয়ার মূলমন্ত্র কী? ভালো কাজ। জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যু। মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে, পাড়ি জমাতে হবে পরপারে, তাকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের মনোজগতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ভালো কাজ। মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষের তরে জীবন উৎসর্গ করে, মানুষের প্রয়োজনে নিজের সময়-সম্পদ-সামর্থ্য ঢেলে দিয়েই মানুষের স্মৃতিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব। আসলে বাস্তবতা হচ্ছে এ জীবনটা আমাদের কল্পনার চেয়েও ছোট। এই স্বল্প সময় বিলাস ব্যসনে পার করে দেওয়া যায় বইকি, কিন্তু তার চেয়ে হাজার গুণে উত্তম হবে পরার্থে পরিচালিত করা। একবার ভাবুন, আপনার চলে যাওয়ার ১০০ বছর পরও মানুষ আপনাকে মনে রাখছে, এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে? কবির ভাষায়, ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’

 

কিন্তু আমরা কি তা করছি? মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, আল্লাহতায়ালা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যেন তারা স্রষ্টার আরাধনা এবং অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। তেমন আচরণ কি আমরা করছি? আমরা কি নিজের সময়, শ্রম, জ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করছি? বরং এর বিপরীত। আমরা যা বলি আর আমরা যা করি, দুইয়ের মধ্যে থেকে যায় বিস্তর ফারাক। একটুতেই একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লেগে যাই। নিজ স্বার্থে সামান্য আঘাত এলে কটুকথা বলতে দ্বিধাবোধ করি না। আজ আমরা সামান্য কারণে মানুষের প্রতি বিরাগভাজন হই, মানুষকে ঠকাই, পরনিন্দা করি, অন্যের হক নষ্ট করি, অবিচার করি, মারামারি করি, এমনকি মানুষকে খুনও করে ফেলি। মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধবিগ্রহ, লোভ-লালসা, অহংকার, সহনশীলতার অভাব, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থপরতা এখন পৃথিবীব্যাপী ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। মানবিক মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, মানবতা, পরার্থপরতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষ এখন স্বার্থের জালে এমনভাবে বন্দি যে, তারা সময়ে সময়ে অন্ধ হয়ে যায়। স্বার্থের জন্য ভাই ভাইয়ের বুকে, সন্তান পিতা-মাতার বুকে, স্বামী স্ত্রীর বুকে, স্ত্রী স্বামীর বুকে ছুরি বসিয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। নারী নির্যাতন, যৌননিপীড়ন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অপহরণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, এমনকি শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ, পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দল এবং হতাহতের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী অ্যাটম বোমা থেকে শুরু করে ভয়ানক মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। এসব অস্ত্র তো মানুষকে মারার আর মানবতা ধ্বংস করার জন্যই। আর এসবের মূলে রয়েছে লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব আর নৈতিকতার নিদারুণ অবক্ষয়। আমরা পাশবিক নির্যাতনের কথা বলি, আসলে কি পশুরা ততটাই পাশবিক? মানুষের অমানবিক কার্যাবলিতে মনুষ্যত্ব কি সমাজে আছে? মানুষের কল্পনার বাইরে মানুষের দ্বারাই অস্বাভাবিকের চেয়েও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। পাশবিকতার কাছে মানবিকতা আজ ধরাশায়ী।

 

অথচ ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে অহংকার কিংবা নাশকতা কোনোটাই শোভা পায় না। কারণ এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আমার নয়। কোনো কিছু কি আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব? আমি শূন্য হাতে এসেছি আর শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। নতুন জগতে ২১২২ সালে কবরে শুয়ে হয়তো আমরা সবাই এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারব। সত্যি দুনিয়াটা কতই না তুচ্ছ ছিল, একে ঘিরে দেখা স্বপ্নগুলো কতই না নগণ্য ছিল। এ স্বল্প সময়ে নিজেরা নিজেদের মাঝে লাভ আর লোভের জন্য প্রতিযোগিতা না করে যদি দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করি, নিজের জ্ঞান জনকল্যাণে ব্যবহার করি, ভোগবিলাসে মত্ত না হয়ে নিজের সামান্য যা কিছু প্রয়োজন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে বাকিটা সমাজের জন্য বিলিয়ে দিই তবেই মানুষ আমাদের মনে রাখবে। জীবনে ভালো থাকার জন্য কাউকে জুলুম করে, কারও হক নষ্ট করে পয়সার মালিক হওয়ার চাইতে সবাইকে ভালোবেসে, সবার ভালোবাসা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া, অন্নহীনকে অন্ন আর বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, জ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হবে এমন কিছু করা কতই না উত্তম। এ নশ্বর জীবনে আমাদের যা কিছু অর্জন, হোক তা সম্পদ, জ্ঞান, খ্যাতি বা প্রভাব; তা যদি মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করা যায়, তা-ই হবে শতবর্ষ পরেও মানুষের মনের মুকুরে বেঁচে থাকার উপলক্ষ। মৃত্যুর পর মানুষের মনে থাকার চেয়ে বড় কোনো অর্জন আর কী হতে পারে?

 

যা বলছিলাম। জীবন ছোট আর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ভালো কাজের সুযোগ অগুনতি, কিন্তু সময় কম। এখন যদি অবহেলা করি, যে কাজগুলো করলে মানুষ মৃত্যুর পরও তাদের হৃদয়ে স্থান করে দিত তা যদি না করি, নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর পর শুধু আফসোসই থেকে যাবে। তখন সৎকর্মের ইচ্ছা ষোলো আনা থাকলেও, সামর্থ্য থাকবে না একবিন্দু! রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল বন্ধ হয় না- ১. সাদাকায়ে জারিয়াহ (যেমন মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, রাস্তা, বাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, হাসপাতাল স্থাপন, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি)। ২. এমন জ্ঞান (ইলম) যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। ৩. সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ এর সুযোগও যদি নিতে হয়, তার সূচনা করতে হবে বেঁচে থাকতেই।

 

তাই আসুন, মানুষকে ভালোবাসি, অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই। জীবন যে দুই দিনের, সেই অল্প সময়টাকে মানুষের কাজে লাগাই। এতে ক্ষণকালের ভোগবিলাস হয়তো কম হবে, কিন্তু তার প্রতিদান পাওয়া যাবে পরবর্তী অনন্ত জীবনে, যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না কখনো। অন্তত পরকালে বিশ্বাসী যারা, তাদের এতে দ্বিমত হওয়ার কোনো উপায় নেই।

 

যে উদ্দেশ্য নিয়ে আল্লাহ আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আমরা কি তার মর্যাদা দিতে পারছি? মনে রাখতে হবে, আমাদের সবারই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী চলা, সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে ভালো কাজ করা উচিত। যে ধর্মই মেনে চলেন না কেন, সব ধর্মই মানবসেবার কথাই বলে। মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মানুষকে ঠকানো, মানুষের ক্ষতি করা কোনো ধর্মই প্রশ্রয় দেয় না। আমরা অনেকেই নিজধর্ম সম্পর্কে জানি না, আনুগত্য করি না এবং অন্যের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাই না, বরং ভিন্ন মত-ধর্মের মানুষকে অবজ্ঞা করি। ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার উদ্ভব ঘটে। সুতরাং ধর্মীয় অনুশাসন সুন্দরভাবেই মেনে চলা উচিত এবং এর মাধ্যমে কিন্তু আমরা নিজের পরকালকে গোছানোর পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মেরও উপকার করে যাচ্ছি। আর নিজের কাজের মাধ্যমে যদি মানুষের উপকার করে যেতে পারি, তা হলেই স্থান করে নিতে পারব তাদের মনের মণিকোঠায়, রয়ে যাব স্মৃতির ভান্ডারে, মানুষ মনে রাখবে যুগ যুগ।

 

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুশয্যার একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি মাত্র ৩৩ বছর বেঁচে ছিলেন। এ অল্প সময়েই হয়েছিলেন দিগি¦জয়ী বীর। কিন্তু মৃত্যুর সময় তিনি আসলে কী নিয়ে গেলেন? বলা হয়, মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তাঁর জেনারেলদের ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। আমার প্রথম অভিপ্রায়, শুধু ডাক্তাররা আমার কফিন কবরস্তানে বহন করে নিয়ে যাবে। আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে কবরস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথের দুই পাশে আমার কোষাগারে সংরক্ষিত টাকাপয়সা, মণিমুক্তা, সোনাদানা, রুপা ছড়িয়ে দেবে। শেষ অভিপ্রায়, কফিন বহনের সময় আমার দুই হাতের তালু ওপর দিকে রেখে কফিনের বাইরে রাখবে।’ উপস্থিত সবাই আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলেন না। তখন তাঁর একজন প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, ‘হে মহামান্য! অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে। কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’ দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি দুনিয়ার মানুষের সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমি আমার ডাক্তারদের কফিন বহন করতে বলেছি, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে ডাক্তাররা রোগের চিকিৎসা করে মাত্র, মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। মৃত্যু যখন আসবে তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তাররা একসঙ্গে মিলেও বাঁচাতে পারবে না। কবরস্তানের পথে সোনাদানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনাদানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক ধনসম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। এ দুনিয়ায় অর্জিত সম্পদ দুনিয়াতেই থেকে যাবে। আর কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যে, আমরা এ দুনিয়ায় খালি হাতে এসেছিলাম, যখন সময় ফুরিয়ে যাবে, তখন আবার খালি হাতেই চলে যাব।’ আলেকজান্ডারের এ অভিপ্রায় থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি?

বাউলের ভাষায়, ‘খ্রিস্টান হইলে কফিনে, মুসলিম হইলে কাফনে, হিন্দু হইলে চিতায় পুড়ে ছাই। ও মানব, দুই দিনের এই দুনিয়াতে, গৌরব করার নাই রে কিছু নাই।

 

স্বামী বিবেকানন্দের একটা বাণী দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘হে মানুষ! কোথায় চলে যাবি রে, পদচিহ্ন রেখে যা।’ জীবন একটাই। চিহ্ন রেখে যাওয়ার সুযোগও একটাই। এ সুযোগ যে নেবে, সে-ই রয়ে যাবে শতবর্ষের স্মৃতিতে।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৫৩ বছর পর দেশ গড়ার এক সুবর্ণ সুযোগ আমাদের এসেছে: মাসুদ সাঈদী

» নির্বাচনে যত দেরি ষড়যন্ত্র তত বাড়বে: তারেক রহমান

» অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ চারজন মাদক চোরা কারবারি আটক

» সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রস্তাব, যা জানালেন বদিউল আলম

» ২ মার্চ ‘জাতীয় পতাকা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান মঈন খানের

» কোনো নিরীহ মানুষ যেন হয়রানির শিকার না হয়: আইজিপি

» সুন্দর ব্যবহার ও আচরণের বিনিময়ে জান্নাত! হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী।

» বাংলাদেশ ব্যাংকের স্পট লোন পেলেন সিলেটের সিএমএসএমই উদ্যোক্তারা

» ‘ইউসিবি নাইট’ আয়োজনে গ্রাহক ও অংশীদারদের অব্যাহত সহযোগিতার স্বীকৃতি

» ইসলামপুর ওয়ার্ড কৃষক দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

আজি হতে শতবর্ষ পরে

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ; ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ অমর কবিতাটি পড়তে পড়তে আমি হারিয়ে গেছি ভাবনার জগতে। শতবর্ষ পরে আমাকে, আপনাকে বা আমাদের কেউ কি মনে রাখবে? কেন মনে রাখবে? শতবর্ষ আগে যারা ছিলেন তাদের কি আমরা মনে রেখেছি? জীবনে কেউই অমর নয় সত্য, কিন্তু মানুষের স্মৃতিতে কারও কারও অমরত্বের রহস্য কী?

 

জীবন তো ক্ষণস্থায়ী, পদ্মপাতার জল। কবির যেমন হাহাকার- ‘দম ফুরাইলেই ঠুস’ বা ‘এক সেকেন্ডের নাই ভরসা, বন্ধ হইব রংতামাশা’, বাউলের তেমনই উপলব্ধি- ‘একদিন মাটির ভিতরে হবে ঘর রে মন আমার, কেন বান্ধ দালান ঘর।’ এটাই নির্মম সত্য। কিন্তু এ ক্ষুদ্র জীবনে চলার পথে আমরা কি তা মনে রাখি? কত ভালোবাসা! কত স্বপ্ন! জীবন ঘিরে কত আয়োজন! জীবন সাজাতে, জীবন রাঙাতে মেধা-শ্রম-সময়ের কি অফুরান বিনিয়োগ! অথচ ভেবে দেখি না, পৃথিবী থাকার স্থান নয়, চিরদিন এখানে থাকা যায় না, কেউ থাকেনি, থাকতে পারেনি, থাকতে পারবেও না, থাকা সম্ভবও নয়। থাকা নয়, বরং চলে যাওয়াই সুনিশ্চিত। তার পরও আমরা আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখি, সোনার হরিণ বা মরীচিকার পেছনে আমৃত্যু দৌড়ে চলেছি। এখন ২০২২ সাল। আজ থেকে ১০০ বছর পরের কথা একটু কল্পনা করি। ক্যালেন্ডারের পাতায় তখন ২১২২। আজ আমরা যারা এ পৃথিবীতে বেঁচে আছি, সে সময় আমাদের একজনও হয়তো বেঁচে থাকব না। আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাব। যখন ২১২২ সাল, আমাদের প্রায় সবার দেহ তখন মাটির নিচে, অস্তিত্ব তখন রুহের জগতে। ফেলে যাওয়া সুন্দর বাড়িটা, শখের গাড়িটা, জমিজমা, ধনসম্পদ, টাকাপয়সা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ভোগ করবে। একই নিয়মে দিন চলবে, কর্মযজ্ঞ চলবে। ‘তখন এমনি করেই বাজবে বাঁশি এই নাটে, কাটবে গো দিন আজও যেমন দিন কাটে’। পৃথিবীর বুকে আজকের এই বেঁচে থাকা, এত হইচই, এত মায়াকান্না সব এভাবেই চলতে থাকবে। থাকব না শুধু আমি- ‘একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি, শুধু সেই সেদিনের মালী নেই’। আচ্ছা, তখন কি আমার কথা কেউ ভাববে? আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি আমাকে বা আমাদের মনে রাখবে? আমার স্মৃতিচারণা করবে? নাকি যাদের জন্য সব করতে গিয়ে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলাম, তাদের হাতে সময় হবে না আমাকে মনে রাখার। তারা হয়তো তখন নতুন স্বপ্নে বিভোর, নতুন উদ্যমে জীবন সাজাচ্ছে, সেই একই চক্রে বাঁধা পড়ছে, অজান্তে।

যদি নিজেদের প্রশ্ন করি- আমরাই কি আমাদের ১০০ বছর আগের প্রজন্মকে মনে রেখেছি? আমাদের দাদার দাদা, নানার নানা বা অন্য পূর্বপুরুষের কথা কি আমরা জানি? তাদের নামটাই বা আমরা কতজন বলতে পারব? মাত্র দুই কি তিন পুরুষের ব্যবধানে নামটা পর্যন্ত হারিয়ে যায়, পরিচয় তো পরে। নেহাতই যুগশ্রেষ্ঠ পুরুষ বা নারী না হলে, সবাই হারিয়ে যায় কালের অন্তরালে। তাহলে ১০০ বছর পর ওই সময়ের প্রজন্মের কেউ কেনই বা আমাদের মনে রাখবে।

 

এ ভাবনা কষ্টকর বইকি। তাহলে পৃথিবীতে এসে এত কিছু অর্জন করে আমাদের কী লাভ হলো? যে পিতা-মাতা সন্তানের জন্য জীবনের সব সময়, শ্রম, ধনদৌলত বিনিয়োগ করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য নিজের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছিলেন, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই; চলে যাওয়ার পর তাঁদের কথা কেউ মনে রাখে না, ভাবে না, স্মরণ করে না। এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে? আসলে এ পৃথিবীতে নিজের বলে কিছুই নেই। জীবনের যা অর্জন তার কিছুই মৃত্যুর পর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া যাবে না। একমাত্র আকুতি যদি বেঁচে থাকা যায় কারও স্মৃতি হয়ে, কিন্তু এ ভাগ্যই বা কজনের হয়। শূন্য থেকে এসে আবার শূন্যেই মিলিয়ে যাওয়া- মানবজন্মের বোধহয় সবচেয়ে বড় আক্ষেপ।

 

আসলে আমরা কীসের পেছনে ছুটে চলেছি? একেবারে শৈশব থেকে যে প্রচন্ড দৌড়, এর গন্তব্য কোথায়? আমরা স্কুলে ভালো রেজাল্টের জন্য, কর্মে সাফল্য আর পদোন্নতির জন্য, অর্থ-যশ-খ্যাতি-ক্ষমতার জন্য ছুটে চলি। অন্যকে টেনে নামাতে, ছিদ্রান্বেষণে, কালিমা লেপনে ছোটাছুটির অন্ত নেই। স্বাস্থ্যরক্ষার জন্যও কত প্রাণান্ত চেষ্টা, তাতে কি শেষরক্ষা হয়? একসময় কিন্তু দেহটাই শেষ হয়ে যায়। এ ছুটে চলার মাঝে ‘বারবার কারও পানে ফিরে চাহিবার নাই যে সময়, নাই নাই’। অথচ ‘কালস্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন ধন মান’। আর শেষকালে মনে হয় ‘তুমি কার, কে তোমার’, কী রেখে যাই, কী নিয়ে যাই, কার স্মৃতিতে ঠাঁই পাই। দৌড়ই যার একমাত্র কর্ম, গন্তব্যেই তার সমাপ্তি। অনাগতকাল কেন তবে আমাকে মনে রাখবে?

 

চলে যাওয়া অসংখ্য প্রজন্মের পথ বেয়ে আমরা এ জীবন লাভ করেছি, আবার আগামীতে এমনি অসংখ্য প্রজন্মের ভিড়ে আমরা হারিয়ে যাব। এই অনন্ত মিছিলের মাঝে নিজেকে কীভাবে তুলে ধরা যায়? এক আকাশ নামহীন তারার মাঝে ধ্রুবতারা হওয়ার মূলমন্ত্র কী? ভালো কাজ। জীবনের অমোঘ সত্য মৃত্যু। মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতেই হবে, পাড়ি জমাতে হবে পরপারে, তাকে ফাঁকি দিয়ে মানুষের মনোজগতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ভালো কাজ। মানুষের জন্য কাজ করে, মানুষের তরে জীবন উৎসর্গ করে, মানুষের প্রয়োজনে নিজের সময়-সম্পদ-সামর্থ্য ঢেলে দিয়েই মানুষের স্মৃতিতে স্থান করে নেওয়া সম্ভব। আসলে বাস্তবতা হচ্ছে এ জীবনটা আমাদের কল্পনার চেয়েও ছোট। এই স্বল্প সময় বিলাস ব্যসনে পার করে দেওয়া যায় বইকি, কিন্তু তার চেয়ে হাজার গুণে উত্তম হবে পরার্থে পরিচালিত করা। একবার ভাবুন, আপনার চলে যাওয়ার ১০০ বছর পরও মানুষ আপনাকে মনে রাখছে, এর চেয়ে বড় অর্জন আর কী হতে পারে? কবির ভাষায়, ‘পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও, তার মত সুখ কোথাও কি আছে আপনার কথা ভুলিয়া যাও।’

 

কিন্তু আমরা কি তা করছি? মানুষ তো সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, আল্লাহতায়ালা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই কিন্তু মানুষকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। যেন তারা স্রষ্টার আরাধনা এবং অন্যের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। তেমন আচরণ কি আমরা করছি? আমরা কি নিজের সময়, শ্রম, জ্ঞান মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত করছি? বরং এর বিপরীত। আমরা যা বলি আর আমরা যা করি, দুইয়ের মধ্যে থেকে যায় বিস্তর ফারাক। একটুতেই একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া-বিবাদে লেগে যাই। নিজ স্বার্থে সামান্য আঘাত এলে কটুকথা বলতে দ্বিধাবোধ করি না। আজ আমরা সামান্য কারণে মানুষের প্রতি বিরাগভাজন হই, মানুষকে ঠকাই, পরনিন্দা করি, অন্যের হক নষ্ট করি, অবিচার করি, মারামারি করি, এমনকি মানুষকে খুনও করে ফেলি। মানুষের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি, মারামারি, কাটাকাটি, হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা, যুদ্ধবিগ্রহ, লোভ-লালসা, অহংকার, সহনশীলতার অভাব, ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থপরতা এখন পৃথিবীব্যাপী ভয়ংকর রূপ ধারণ করছে। মানবিক মূল্যবোধ, মায়া-মমতা, মানবতা, পরার্থপরতা আজ ভূলুণ্ঠিত। মানুষ এখন স্বার্থের জালে এমনভাবে বন্দি যে, তারা সময়ে সময়ে অন্ধ হয়ে যায়। স্বার্থের জন্য ভাই ভাইয়ের বুকে, সন্তান পিতা-মাতার বুকে, স্বামী স্ত্রীর বুকে, স্ত্রী স্বামীর বুকে ছুরি বসিয়ে দিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। নারী নির্যাতন, যৌননিপীড়ন, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অপহরণ, যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন, এমনকি শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণ, পারিবারিক ও সামাজিক কোন্দল এবং হতাহতের মতো অপ্রত্যাশিত ঘটনা সমাজে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী অ্যাটম বোমা থেকে শুরু করে ভয়ানক মারণাস্ত্র তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। এসব অস্ত্র তো মানুষকে মারার আর মানবতা ধ্বংস করার জন্যই। আর এসবের মূলে রয়েছে লোভ-লালসা, স্বার্থপরতা, সামাজিক মূল্যবোধের অভাব আর নৈতিকতার নিদারুণ অবক্ষয়। আমরা পাশবিক নির্যাতনের কথা বলি, আসলে কি পশুরা ততটাই পাশবিক? মানুষের অমানবিক কার্যাবলিতে মনুষ্যত্ব কি সমাজে আছে? মানুষের কল্পনার বাইরে মানুষের দ্বারাই অস্বাভাবিকের চেয়েও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। পাশবিকতার কাছে মানবিকতা আজ ধরাশায়ী।

 

অথচ ক্ষণস্থায়ী এই জীবনে অহংকার কিংবা নাশকতা কোনোটাই শোভা পায় না। কারণ এ পৃথিবীতে যা কিছু আছে তা আমার নয়। কোনো কিছু কি আমি সঙ্গে নিয়ে যেতে পারব? আমি শূন্য হাতে এসেছি আর শূন্য হাতেই ফিরে যেতে হবে। নতুন জগতে ২১২২ সালে কবরে শুয়ে হয়তো আমরা সবাই এ বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারব। সত্যি দুনিয়াটা কতই না তুচ্ছ ছিল, একে ঘিরে দেখা স্বপ্নগুলো কতই না নগণ্য ছিল। এ স্বল্প সময়ে নিজেরা নিজেদের মাঝে লাভ আর লোভের জন্য প্রতিযোগিতা না করে যদি দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করি, নিজের জ্ঞান জনকল্যাণে ব্যবহার করি, ভোগবিলাসে মত্ত না হয়ে নিজের সামান্য যা কিছু প্রয়োজন তাতে সন্তুষ্ট হয়ে বাকিটা সমাজের জন্য বিলিয়ে দিই তবেই মানুষ আমাদের মনে রাখবে। জীবনে ভালো থাকার জন্য কাউকে জুলুম করে, কারও হক নষ্ট করে পয়সার মালিক হওয়ার চাইতে সবাইকে ভালোবেসে, সবার ভালোবাসা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া, অন্নহীনকে অন্ন আর বস্ত্রহীনকে বস্ত্র দেওয়া, জ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ উপকৃত হবে এমন কিছু করা কতই না উত্তম। এ নশ্বর জীবনে আমাদের যা কিছু অর্জন, হোক তা সম্পদ, জ্ঞান, খ্যাতি বা প্রভাব; তা যদি মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করা যায়, তা-ই হবে শতবর্ষ পরেও মানুষের মনের মুকুরে বেঁচে থাকার উপলক্ষ। মৃত্যুর পর মানুষের মনে থাকার চেয়ে বড় কোনো অর্জন আর কী হতে পারে?

 

যা বলছিলাম। জীবন ছোট আর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। ভালো কাজের সুযোগ অগুনতি, কিন্তু সময় কম। এখন যদি অবহেলা করি, যে কাজগুলো করলে মানুষ মৃত্যুর পরও তাদের হৃদয়ে স্থান করে দিত তা যদি না করি, নিশ্চিতভাবে মৃত্যুর পর শুধু আফসোসই থেকে যাবে। তখন সৎকর্মের ইচ্ছা ষোলো আনা থাকলেও, সামর্থ্য থাকবে না একবিন্দু! রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়। তবে তিনটি আমল বন্ধ হয় না- ১. সাদাকায়ে জারিয়াহ (যেমন মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, রাস্তা, বাঁধ নির্মাণ, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, হাসপাতাল স্থাপন, বৃক্ষরোপণ ইত্যাদি)। ২. এমন জ্ঞান (ইলম) যার দ্বারা মানুষ উপকৃত হয়। ৩. সুসন্তান, যে তার জন্য দোয়া করে।’ এর সুযোগও যদি নিতে হয়, তার সূচনা করতে হবে বেঁচে থাকতেই।

 

তাই আসুন, মানুষকে ভালোবাসি, অসহায়দের প্রতি সাহায্যের হাতটা বাড়িয়ে দিই। জীবন যে দুই দিনের, সেই অল্প সময়টাকে মানুষের কাজে লাগাই। এতে ক্ষণকালের ভোগবিলাস হয়তো কম হবে, কিন্তু তার প্রতিদান পাওয়া যাবে পরবর্তী অনন্ত জীবনে, যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না কখনো। অন্তত পরকালে বিশ্বাসী যারা, তাদের এতে দ্বিমত হওয়ার কোনো উপায় নেই।

 

যে উদ্দেশ্য নিয়ে আল্লাহ আমাদের এ সুন্দর পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন, আমরা কি তার মর্যাদা দিতে পারছি? মনে রাখতে হবে, আমাদের সবারই ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী চলা, সত্য ও ন্যায়ের পথে থেকে ভালো কাজ করা উচিত। যে ধর্মই মেনে চলেন না কেন, সব ধর্মই মানবসেবার কথাই বলে। মানুষকে কষ্ট দেওয়া, মানুষকে ঠকানো, মানুষের ক্ষতি করা কোনো ধর্মই প্রশ্রয় দেয় না। আমরা অনেকেই নিজধর্ম সম্পর্কে জানি না, আনুগত্য করি না এবং অন্যের ধর্মের প্রতি সম্মান দেখাই না, বরং ভিন্ন মত-ধর্মের মানুষকে অবজ্ঞা করি। ফলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামার উদ্ভব ঘটে। সুতরাং ধর্মীয় অনুশাসন সুন্দরভাবেই মেনে চলা উচিত এবং এর মাধ্যমে কিন্তু আমরা নিজের পরকালকে গোছানোর পাশাপাশি পরবর্তী প্রজন্মেরও উপকার করে যাচ্ছি। আর নিজের কাজের মাধ্যমে যদি মানুষের উপকার করে যেতে পারি, তা হলেই স্থান করে নিতে পারব তাদের মনের মণিকোঠায়, রয়ে যাব স্মৃতির ভান্ডারে, মানুষ মনে রাখবে যুগ যুগ।

 

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মৃত্যুশয্যার একটি গল্প প্রচলিত আছে। তিনি মাত্র ৩৩ বছর বেঁচে ছিলেন। এ অল্প সময়েই হয়েছিলেন দিগি¦জয়ী বীর। কিন্তু মৃত্যুর সময় তিনি আসলে কী নিয়ে গেলেন? বলা হয়, মৃত্যুশয্যায় আলেকজান্ডার তাঁর জেনারেলদের ডেকে বলেছিলেন, ‘আমার মৃত্যুর পর তিনটি ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে। আমার প্রথম অভিপ্রায়, শুধু ডাক্তাররা আমার কফিন কবরস্তানে বহন করে নিয়ে যাবে। আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে কবরস্তানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথের দুই পাশে আমার কোষাগারে সংরক্ষিত টাকাপয়সা, মণিমুক্তা, সোনাদানা, রুপা ছড়িয়ে দেবে। শেষ অভিপ্রায়, কফিন বহনের সময় আমার দুই হাতের তালু ওপর দিকে রেখে কফিনের বাইরে রাখবে।’ উপস্থিত সবাই আলেকজান্ডারের এই অদ্ভুত অভিপ্রায়ে বিস্মিত হন। কিন্তু এ ব্যাপারে তাঁকে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পাচ্ছিলেন না। তখন তাঁর একজন প্রিয় সেনাপতি তাঁর হাতটা তুলে ধরে চুম্বন করে বলেন, ‘হে মহামান্য! অবশ্যই আপনার সব অভিপ্রায় পূর্ণ করা হবে। কিন্তু আপনি কেন এই বিচিত্র অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন?’ দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে আলেকজান্ডার বললেন, ‘আমি দুনিয়ার মানুষের সামনে তিনটি শিক্ষা রেখে যেতে চাই। আমি আমার ডাক্তারদের কফিন বহন করতে বলেছি, যাতে লোকে অনুধাবন করতে পারে ডাক্তাররা রোগের চিকিৎসা করে মাত্র, মৃত্যুর থাবা থেকে কাউকে রক্ষা করতে অক্ষম। মৃত্যু যখন আসবে তখন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ডাক্তাররা একসঙ্গে মিলেও বাঁচাতে পারবে না। কবরস্তানের পথে সোনাদানা ছড়িয়ে রাখতে বলেছি মানুষকে এটা বোঝাতে যে, ওই সোনাদানার একটা কণাও আমার সঙ্গে যাবে না। আমি এগুলো পাওয়ার জন্য সারাটা জীবন ব্যয় করেছি, কিন্তু নিজের সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারছি না। মানুষ বুঝুক ধনসম্পদের পেছনে ছোটা সময়ের অপচয় মাত্র। এ দুনিয়ায় অর্জিত সম্পদ দুনিয়াতেই থেকে যাবে। আর কফিনের বাইরে আমার হাত ছড়িয়ে রাখতে বলেছি যাতে মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে যে, আমরা এ দুনিয়ায় খালি হাতে এসেছিলাম, যখন সময় ফুরিয়ে যাবে, তখন আবার খালি হাতেই চলে যাব।’ আলেকজান্ডারের এ অভিপ্রায় থেকে আমরা কি কোনো শিক্ষা নিতে পেরেছি?

বাউলের ভাষায়, ‘খ্রিস্টান হইলে কফিনে, মুসলিম হইলে কাফনে, হিন্দু হইলে চিতায় পুড়ে ছাই। ও মানব, দুই দিনের এই দুনিয়াতে, গৌরব করার নাই রে কিছু নাই।

 

স্বামী বিবেকানন্দের একটা বাণী দিয়ে শেষ করছি। তিনি বলেছিলেন, ‘হে মানুষ! কোথায় চলে যাবি রে, পদচিহ্ন রেখে যা।’ জীবন একটাই। চিহ্ন রেখে যাওয়ার সুযোগও একটাই। এ সুযোগ যে নেবে, সে-ই রয়ে যাবে শতবর্ষের স্মৃতিতে।

লেখক : প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com