চট্টগ্রামে নবজাতক ও শিশুদের ৪০ ভাগই হচ্ছে তিন ধরনের অণুজীবের আক্রমণের শিকার- যা অ্যান্টিবায়োটিকসহ কোনো ওষুধেই হচ্ছে না নিরাময়। তবে শুধু শিশু নয়, সব মিলিয়ে অন্তত ৭০ ভাগ মানুষের শরীরেই কমপক্ষে একটি অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না।
এর কারণ হিসেবে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ও অসম্পন্ন কোর্সের ব্যবহারকে দুষছেন গবেষকরা। তাদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ও অসম্পন্ন কোর্সের ব্যবহারের ফলে পরবর্তীতে বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করছে না। এছাড়া পোল্ট্রি ফিডে বেড়ে চলেছে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার। মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক কার্যক্ষমতা হারানোর এটিও একটি কারণ বলে মনে করছেন তারা। এর বাইরে স্তন্যদানকারী মায়ের কাছ থেকেও শিশুদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী শক্তিশালী অণুজীব।
২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত টানা দুই বছর চট্টগ্রামের দুটি হাসপাতালে এক হাজার রোগীকে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে একটি গবেষণা চালানো হয়। এতে পুরুষ ছিলেন ৪৩০ জন ও নারী ছিলেন ৫৭০ জন। শতকরা হিসেবে পুরুষের সংখ্যা ৪৩ শতাংশ ও নারী ৫৭ শতাংশ। পুরো সংখ্যার ৫০ শতাংশই ছিল শিশু।
ঐ গবেষণায় দেখা গেছে, এসব শিশুর মধ্যে ৪০ শতাংশই ভুগছিল অন্তত তিন ধরনের ইনফেকশনে- যাতে কোনো কাজই দিচ্ছিল না অ্যান্টিবায়োটিক। তবে এভাবে মানুষের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যক্ষমতা কমতে থাকলে ভবিষ্যতে শিশুদের চিকিৎসা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে আশঙ্কা করছেন গবেষকরা।
অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে ‘সুপারবাগস্’
গবেষকরা বলছেন, কোনো অ্যান্টিবায়োটিক যখন মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার হয়, তখন শরীরে সেই ওষুধের প্রতি রেজিস্ট্যান্স (প্রতিরোধ) তৈরি হয়। শরীরে থাকা ব্যাকটেরিয়া হয়ে ওঠে ওষুধের চেয়ে শক্তিশালী। ফলে ওষুধটি আর সহজে কাজ করতে চায় না।
অতিরিক্ত ক্ষমতাসম্পন্ন এ ধরনের জীবাণুকূলকে চিকিৎসা পরিভাষায় ‘সুপারবাগস্’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ফলে এখনই সচেতন না হলে এক পর্যায়ে সুপারবাগসের সঙ্গে লড়াই করার মতো কোনো ওষুধই পাওয়া যাবে না বলে আশঙ্কা করছেন তারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা পরিচালনা ও প্রকাশনা দফতরের অর্থায়নে পাঁচটি বয়সশ্রেণির ওপর পরিচালিত গবেষণাটি গত ১০ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘প্লস ওয়ান’-এ প্রকাশিত হয়। নবজাতক থেকে শুরু করে ৬০ বছরের বেশি বয়সী রোগীদের নিয়ে এ গবেষণা চালানো হয়। এতে শূন্য থেকে ১৫ বছরের নিচে রোগী ছিল ৪৭৬ জন, ১৫ থেকে ৩০ বছরের ১৮৬ জন, ৩০ থেকে ৪৫ বছরের ১০৯ জন, ৪৫ থেকে ৬০ বছরের ১৩০ জন ও ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ছিলেন ৯৯ জন।
গবেষণায় যুক্ত ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক-গবেষক ড. আদনান মান্নান ও মাহবুব হাসান, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাহিদ সুলতানা এবং নবজাতক নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রের (এনআইসিইউ) পরিচালক ডা. ওয়াজির আহমেদ। তাদের সহযোগিতায় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আফরোজা আক্তার তন্বী। পুরো গবেষণায় আরো সহযোগিতা দেয় চট্টগ্রামের ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকিউলার অ্যাপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ।
চট্টগ্রামের এ গবেষণায় দেখা গেছে, এ অঞ্চলের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মাল্টি-ড্রাগ প্রতিরোধী কেপিএন স্ট্রেইনের ব্যাপকতা খুব বেশি। দেখা গেছে- আগে নিউমোনিয়ায় ভুগেছেন এমন চারজন পুরুষের মধ্যে তিনজনের শরীরেই পুরোপুরি কার্যক্ষমতা হারিয়েছে তিন বা তার চেয়ে বেশি অ্যান্টিবায়োটিক।
এর আগে, একই বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের (এমজিএইচ) এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রেই মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ছে শিশুরা।
বেশি অকার্যকর চার অ্যান্টিবায়োটিক
চট্টগ্রামের চিকিৎসকরা ক্ল্যাবসিয়েলা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের দিয়ে থাকেন এমন ২০টি অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা দেখা হয় সর্বশেষ গবেষণায়। অ্যান্টিবায়োটিকগুলো হলো- অ্যামিকাসিন, জেনটামাইসিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, লিভোফ্লক্সাসিন, মেরোপেনেম, কোট্রিমোক্সাজোল, নাইট্রোফিউরানটোইন, সেফট্রিয়াক্সন, অ্যাজিথ্রোমাইসিন, অ্যামোক্সিক্লাভ, সেফেপিম, ইমিপেনেম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম, সেফটাজিডিম, সেফুরোক্সিম, ক্লোরামফেনিকল ও এম্পিসিলিন।
গবেষণায় দেখা গেছে, এসব অ্যান্টিবায়োটিকের মধ্যে সেফুরোক্সিম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম ও সেফটাজিডিম গোত্রের অ্যান্টিবায়োটিকগুলো রোগীর শরীরে কাজ করছে খুবই কম। সেফুরোক্সিম, সেফিক্সিম, সেফোট্যাক্সিম, সেফটাজিডিম, সেফেপিম ও সেফট্রিয়াক্সন যথাক্রমে ৭৮ দশমিক ৯৬, ৭৬ দশমিক ৯৮, ৭৪ দশমিক ৬৯, ৭৪ দশমিক ২৫, ৬৮ দশমিক ২৪ ও ৬৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ হারে অকার্যকর পাওয়া গেছে।
হাসপাতালে ‘সুপারবাগস্’
গবেষণায় আরো দেখা গেছে, হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের সিংহভাগই অ্যান্টিবায়োটিক-প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ও জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত হচ্ছে চারটি স্থান থেকে। সেগুলো হলো- হাসপাতালের বেসিন, বিছানার চাদর ও দেয়াল, অপরিচ্ছন্ন খাবার এবং নালার পানি। মূলত হাসপাতালে নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে তৈরি হয় ‘সুপারবাগস্’। সেই সুপারবাগস্ই স্বাস্থ্যকর্মীদের অপরিষ্কার হাতসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে পুরো হাসপাতালে। চলে যায় এক রোগী থেকে অন্য রোগীতেও।
অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে শরীরে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এমন একাধিক জিনও শনাক্ত হয়েছে গবেষণায়। যার মধ্যে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রেই মিলেছে এনডিএম-১ নামে এক জিনের উপস্থিতি। এছাড়া এসএইচভি-১১ নামে অপর এক জিনের উপস্থিতি ৪০ ভাগ ও ইউজিই জিনের বিস্তার ৩০ ভাগ পাওয়া গেছে। ফলে এখনই জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয় রোধে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া ও প্লাজমিডের নিয়মিত নজরদারি এবং নিয়মিত ক্লিনিক্যাল শনাক্তকরণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন গবেষকরা।