অসামাজিক কার্যকলাপের সংজ্ঞা নারী ও পুরুষে ভিন্ন কেন?

তসলিমা নাসরিন : নতুন খবর হলো, রংপুরের পীরগাছায় মেয়েকে হত্যা করে বিদ্যুতের খুঁটির নিচে পুঁতে রেখে বাবা নিজেই মামলা করেছেন। মেয়ের অসামাজিক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। সোমবার সন্ধ্যায় মেয়ে হত্যার বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন তিনি। মেয়েটির নাম লিপি। পুলিশে চাকরি করে এমন এক ছেলের সঙ্গে লিপির বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, লিপির কারণেই সেই বিয়ে টেকেনি। বিবাহবিচ্ছেদের পর এলাকায় এসে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে লিপি। এ নিয়ে গ্রামে একাধিকবার সালিশ বৈঠকও হয়। এক পর্যায়ে তাকে ধরে বেঁধে ঢাকার সাভারে একটি পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করার জন্য পাঠানো হয়। গত ঈদে লিপি ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে রফিকুল ইসলাম জানতে পারেন লিপি অন্তঃসত্ত্বা। এরপর এক গভীর রাতে লিপিকে ঘুমন্ত অবস্থায় গলায় পা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেন। মেরে ফেলার পর পাশের ধানখেতে তাকে পুঁতে রাখেন। কিন্তু দু’দিন পর রফিকুল ইসলাম ভয় পান যে লাশ যদি কেউ দেখে ফেলে, তাহলে বিপদ হবে। কন্যার বিপদ চাইলেও নিজের বিপদ তিনি চান না। তাই কন্যার লাশটিকে ধানক্ষেত থেকে সরিয়ে আরও দূরে নিয়ে পুঁতে রাখেন। পুলিশ জানায়, গত ২৫ জুলাই সকালে একটি সমতল জমিতে বৈদ্যুতিক খুঁটি সংলগ্ন এলাকায় উঁচু মাটির ঢিপি দেখে কিছু লোকের সন্দেহ হয়। উৎসুক লোকেরা মাটি খুঁড়ে মানুষের শরীরের কিছুটা অংশ দেখতে পায়। পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে মাটির নিচ থেকে লিপির লাশটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ পরে জানতে পারে লাশটি রফিকুল ইসলামের কন্যা লিপির।

 

খবরটি পড়ছিলাম আর পুরো ঘটনাটি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। রফিকুল ইসলাম নিজের মেয়ে সম্পর্কে বলেছেন, মেয়েটি নেশা করতো, আর অসামাজিক কাজ করতো। এখানে অসামাজিক কাজ বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তা নিশ্চয়ই পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, পুরুষের সঙ্গে প্রেম করা এবং পুরুষের সঙ্গে শোয়া। মেয়েদের জন্য এসবই অসামাজিক কাজ। পুরুষেরা যদি নারীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো, নারীর সঙ্গে প্রেম করতো, তাদের সঙ্গে শুতো,-তাহলে কিন্তু পুরুষকে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার দোষ দেওয়া হতো না। রফিকুল ইসলামই এ দোষ তাঁর নিজের পুত্রকে দিতেন না। তবে তাঁর পুত্র যদি চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজ করতো, মেয়েদের যৌন হেনস্তা করতো, ধর্ষণ করতো, কোনও মেয়েকে অন্তঃসত্ত্বা করতো বা নিরীহ মানুষকে পেটাতো, চাবুক মেরে চামড়া তুলে ফেলতো, মেয়েদের মুখে এসিড ছুড়ে মারতো, কখনও বা মেয়েদের খুনও করতো,-তাহলে হয়তো তিনি বলতেন যে ছেলে অসামাজিক কাজ করছে, অথবা হয়তো তাও বলতেন না, বরং ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন, ছেলেকে যে করেই হোক ডিফেন্ড করতেন, সব রকম চেষ্টা করতেন যে-কোনও ধরনের শাস্তি থেকে ছেলেকে বাঁচাতে। তারপর একসময় ভালো পাত্রী দেখে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিতেন। শুধু রফিকুল ইসলামের সংসারে নয়, প্রতিটি সংসারেই পুত্র এবং কন্যার পার্থক্য অনেকটা এমনই। যে কাজটি মেয়েরা করলে ‘অনৈতিক’, সে কাজটি পুরুষেরা করলে ‘অনৈতিক’ নয়।

 

রফিকুল ইসলাম বলেছেন লিপি নেশা করতো, তিনি কি তাঁর পুত্র নেশা করলে দেশের সবাইকে তা বলে বেড়াতেন, পুত্রকে হত্যা করতেন, তারপর মাটির তলায় পুঁতে ফেলতেন? নিশ্চয়ই তা করতেন না। পুত্র নেশা করলেও, কোনও উপার্জন না করলেও, বেকার বাউন্ডুলে, নেশাগ্রস্ত নষ্ট পুত্রকে তিনি খাওয়াতেন পরাতেন, শুধু পুত্রকে নয়, পুত্রের স্ত্রী সন্তানকে খাওয়ানো পরানোর ভারও তিনি নিতেন। বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি।

রফিকুল ইসলাম নিজের মেয়ে লিপির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বা লিপিকে খুন করার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আরও একটি অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, লিপির বিয়ে ভেঙেছে লিপির দোষেই। ধরা যাক তাঁর পুত্র শামীমের যদি কোনও কারণে বিয়ে ভাঙত, তাহলে কি তিনি তাঁর পুত্রের দোষ দিতেন? নিশ্চয়ই নয়, বলতেন, পুত্রবধূর দোষেই বিয়ে ভেঙেছে। মেয়েদের দোষ দেওয়া, মেয়েদের নিন্দে করা, মেয়েদের ঘৃণা করা অত্যন্ত সহজ। নারীবিদ্বেষী সমাজ এসবে বাহবা দেয়।

 

রফিকুল ইসলামের শাস্তি হবে হয়তো। কিন্তু তিনি নিজ কন্যাকে নিজের হাতে খুন করার জন্য অনুতপ্ত হবেন বলে আমার মনে হয় না। লিপিকে খুন করার পক্ষে প্রচুর লোককে তিনি পাবেন। সুতরাং তাঁর মনে হবে তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন। তাঁর কাজ দেখে অনেকে উৎসাহিত হবে অনৈতিক এবং অসামাজিক কাজ করলে নিজের কন্যাকেও রেহাই না দিতে। নিজের পিতাই যদি খুন করে মেয়েদের, নিজের ঘরেই যদি মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, তবে কোথায় নিরাপত্তা? মেয়েরা আসলে ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়, রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, ইস্কুল-কলেজে, কোথাও নয়। কত যে মানুষের হাত-পা নিশপিশ করে মেয়েদের গলা টিপে মেরে ফেলতে বা গলায় পায়ের চাপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে। পৃথিবীতে পিতাই যদি মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, নিরাপদ তবে কে? এর একটিই উত্তর, কেউ নয়।

 

সপ্তাহখানিক আগে আরও একটি খবর পড়লাম। টাঙ্গাইলে প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে এক কলেজছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। কলেজছাত্রীটিকে তার প্রেমিক আতিক বেড়ানোর কথা বলে করটিয়া থেকে উঠিয়ে গোসাই জোয়াইর এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে এক স্কুলের মাঠে প্রেমিক ও তার বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে। শুধু মাঠে নয়, এরপর নদীর পাড়ে নিয়েও তাকে ধর্ষণ করে ওরা। এ-সময় এলাকার লোকেরা টের পেয়ে ওই কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। প্রেমিকেরা যে ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেমিকাদের দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে বন্ধুসহ গণধর্ষণ করে, এ নতুন কিছু নয়। হামেশাই হচ্ছে।

 

১৯৯২ সালে নিমন্ত্রণ নামে আমি একটি উপন্যাসিকা লিখেছিলাম। উপন্যাসিকায় দেখিয়েছিলাম শীলা নামের এক কিশোরী মনসুর নামের এক যুবকের প্রেমে পড়ে। মনসুর শীলার প্রেমে পড়ার কথা জানতে পেরে একদিন শীলাকে দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করে। শীলা সেজেগুজে প্রেমিকের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে প্রেমিক এবং তার বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। মনসুর বন্ধুবান্ধবসহ শীলাকে ধর্ষণ করবে বলেই শীলাকে নিমন্ত্রণ করেছিল একটি নির্জন বাড়িতে। আমি যখন উপন্যাসিকাটি লিখেছিলাম, আমি এরকম কোনও ঘটনার কথা তখন শুনিনি। অনুমান করেছিলাম পুরুষেরা কত নির্মম হতে পারে এবং মেয়েরা কতটা বিশ্বাস করতে পারে পুরুষদের বিশেষ করে প্রেমিকদের! নিমন্ত্রণ লেখার জন্য আমাকে প্রচুর নিন্দে শুনতে হয়েছিল। লোকের বিচ্ছিরি ঘৃণার শিকার হতে হয়েছিল। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে বলেছে আমি অবাস্তব গল্প লিখেছি, আমি পর্নোগ্রাফি লিখেছি, আমি পুরুষবিদ্বেষী ইত্যাদি। তারা আজ কোথায়? এই যে তথাকথিত প্রেমিকেরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ করছে, এসব খবর দেখে বা শুনে তারা কী বলে এখন? আমি অবাস্তব গল্প লিখেছিলাম? আমি পুরুষবিদ্বেষী? ধর্ষণের নির্মম নিষ্ঠুর বর্ণনা করেছিলাম বলে আমি পর্নোগ্রাফি লিখেছিলাম? আসলে নারীবিদ্বেষী লোকেরা আমাকে চিরকালই পুরুষবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে এবং আমার দিকে ঢিল ছুড়েছে। নারীর ওপর নির্যাতনকে তারা কখনও নির্যাতন বলে স্বীকার করে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা সেই নির্যাতনের শিকার হয়। অবশ্য তাতেই বা ক’জনের চক্ষু খোলে? খুললে তো রফিকুল ইসলামের খুলতো, নিজের কন্যাকে নির্যাতন করে নিজেই হত্যা করতেন না।

 

নিমন্ত্রণ উপন্যাসিকাটির মাধ্যমে আমি কিশোরী তরুণীদের বলতে চেষ্টা করেছিলাম পুরুষেরা ‘ভালোবাসি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করা উচিত নয় যে তারা সত্যিই ভালোবাসে। নতুন পরিচয়ের পর পুরুষেরা দূরে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে বিশ্বাস করা উচিত নয় যে তারা নিরাপদ কোথাও তাদের নিয়ে যাচ্ছে। কাউকে বিশ্বাস করতে হলে দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে মিশতে হয়। কাকে বিশ্বাস করা যায়, কার ওপর ভরসা করা যায়, তা আমরা আগে থেকে বুঝতে পারি না। মেয়েরা ‘প্রেম’ ব্যাপারটাকে খুব পছন্দ করে। তাই ভেবে নেয় প্রেমের গল্প-উপন্যাসের পুরুষের মতো, প্রেমের নাটক-সিনেমার পুরুষের মতো, তাদের প্রেমিক পুরুষেরাও বুঝি একই রকম প্রেমে দিওয়ানা। কিন্তু একসময় অনেকের টনক নড়ে, আঘাত পায়। বিয়ে করার আগেও আঘাত পায়, বিয়ে করার পরও আঘাত পায়। অগত্যা আঘাতকে নিজেদের ভবিতব্য ভেবে নিতে বাধ্য হয়।

 

সমাজ যদি হয় কঠোরভাবে পুরুষতান্ত্রিক, নারীকে যদি বাধ্য করা হয় পুরুষের অধীনতা মেনে নিতে, তবে পদে পদে আমরা নারীর জীবনকে অনিরাপদ হতে দেখবো। পুরুষকে নিয়েই বাস করতে হয় সমাজে। আর এই পুরুষই যদি নারীকে দুর্বল এবং পরনির্ভর হতে বাধ্য করে, শতাব্দীর পর শতাব্দী বাধ্য করে; যদি নারীকে স্বৈরিণী এবং নরকের দ্বার বলে মনে করে, শতাব্দীর পর শতাব্দী মনে করে; তবে নারী কিন্তু কোনও না কোনও সময় নিজের অজান্তেই পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। সে-কারণে নারীকেও দেখি নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকারের বিরুদ্ধে অবিকল পুরুষের মতো দাঁড়িয়ে যেতে। এটি নারী ও পুরুষ কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। মানুষ নিজের সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ক্রমাগত পেছনে নিচ্ছে, অথবা যেখানে ছিল সেখানেই থামিয়ে রাখছে। মহাকাশ-বিজ্ঞান এগিয়ে গেল, চিকিৎসা-বিজ্ঞান এগিয়ে গেল, প্রযুক্তি এগোলো, শিল্প-সাহিত্য এগোলো, অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছুর পরিবর্তন হলো, উন্নতি হলো, কেবল সামাজিক ব্যবস্থারই কিছু হলো না, সমাজের কাঠামোরও কোনও বদল হলো না, নারী পুরুষের বৈষম্য যেখানে ছিল, সেখানেই বহাল তবিয়তে রয়ে গেল। আমাদের কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না নারীকে পেছনের কাতারে রেখে, পরমুখাপেক্ষী রেখে, নারীকে দাসীবৃত্তির দায়িত্ব দিয়ে, নারীকে নির্যাতন করে, সমাজের সত্যিকার কোনও উন্নতি করা যায় না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।   সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ডিবির মশিউর সাময়িক বরখাস্ত

» মোটরসাইকেলে চালকসহ দুইজনের বেশি বহন না করার নির্দেশ

» ইসলামী শাসনব্যবস্থা ছাড়া বৈষম্য দূর হবে না : মামুনুল হক

» নির্বাচনের দিনক্ষণ জানতে বিদেশি অংশীজনরা অপেক্ষা করছে : খসরু

» বিস্ফোরক মামলায় খালাস পেলেন তারেক রহমান

» তুর্কি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপি

» রাশিয়ার নতুন ওরেশনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চলবে: পুতিন

» গুজব প্রতিরোধে সহায়তা চায় প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

» পুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত

» এআই নিয়ে কাজ করবে গ্রামীণফোন ও এরিকসন

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

অসামাজিক কার্যকলাপের সংজ্ঞা নারী ও পুরুষে ভিন্ন কেন?

তসলিমা নাসরিন : নতুন খবর হলো, রংপুরের পীরগাছায় মেয়েকে হত্যা করে বিদ্যুতের খুঁটির নিচে পুঁতে রেখে বাবা নিজেই মামলা করেছেন। মেয়ের অসামাজিক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে তিনি এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন রফিকুল ইসলাম। সোমবার সন্ধ্যায় মেয়ে হত্যার বর্ণনা দিয়ে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন তিনি। মেয়েটির নাম লিপি। পুলিশে চাকরি করে এমন এক ছেলের সঙ্গে লিপির বিয়ে দিয়েছিলেন বাবা। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, লিপির কারণেই সেই বিয়ে টেকেনি। বিবাহবিচ্ছেদের পর এলাকায় এসে অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে লিপি। এ নিয়ে গ্রামে একাধিকবার সালিশ বৈঠকও হয়। এক পর্যায়ে তাকে ধরে বেঁধে ঢাকার সাভারে একটি পোশাক তৈরির কারখানায় কাজ করার জন্য পাঠানো হয়। গত ঈদে লিপি ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে রফিকুল ইসলাম জানতে পারেন লিপি অন্তঃসত্ত্বা। এরপর এক গভীর রাতে লিপিকে ঘুমন্ত অবস্থায় গলায় পা দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেন। মেরে ফেলার পর পাশের ধানখেতে তাকে পুঁতে রাখেন। কিন্তু দু’দিন পর রফিকুল ইসলাম ভয় পান যে লাশ যদি কেউ দেখে ফেলে, তাহলে বিপদ হবে। কন্যার বিপদ চাইলেও নিজের বিপদ তিনি চান না। তাই কন্যার লাশটিকে ধানক্ষেত থেকে সরিয়ে আরও দূরে নিয়ে পুঁতে রাখেন। পুলিশ জানায়, গত ২৫ জুলাই সকালে একটি সমতল জমিতে বৈদ্যুতিক খুঁটি সংলগ্ন এলাকায় উঁচু মাটির ঢিপি দেখে কিছু লোকের সন্দেহ হয়। উৎসুক লোকেরা মাটি খুঁড়ে মানুষের শরীরের কিছুটা অংশ দেখতে পায়। পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ এসে মাটির নিচ থেকে লিপির লাশটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। পুলিশ পরে জানতে পারে লাশটি রফিকুল ইসলামের কন্যা লিপির।

 

খবরটি পড়ছিলাম আর পুরো ঘটনাটি যেন চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম। রফিকুল ইসলাম নিজের মেয়ে সম্পর্কে বলেছেন, মেয়েটি নেশা করতো, আর অসামাজিক কাজ করতো। এখানে অসামাজিক কাজ বলতে যা বোঝানো হচ্ছে তা নিশ্চয়ই পুরুষের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানো, পুরুষের সঙ্গে প্রেম করা এবং পুরুষের সঙ্গে শোয়া। মেয়েদের জন্য এসবই অসামাজিক কাজ। পুরুষেরা যদি নারীর সঙ্গে ঘুরে বেড়াতো, নারীর সঙ্গে প্রেম করতো, তাদের সঙ্গে শুতো,-তাহলে কিন্তু পুরুষকে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার দোষ দেওয়া হতো না। রফিকুল ইসলামই এ দোষ তাঁর নিজের পুত্রকে দিতেন না। তবে তাঁর পুত্র যদি চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজ করতো, মেয়েদের যৌন হেনস্তা করতো, ধর্ষণ করতো, কোনও মেয়েকে অন্তঃসত্ত্বা করতো বা নিরীহ মানুষকে পেটাতো, চাবুক মেরে চামড়া তুলে ফেলতো, মেয়েদের মুখে এসিড ছুড়ে মারতো, কখনও বা মেয়েদের খুনও করতো,-তাহলে হয়তো তিনি বলতেন যে ছেলে অসামাজিক কাজ করছে, অথবা হয়তো তাও বলতেন না, বরং ছেলের পক্ষ নিয়ে কথা বলতেন, ছেলেকে যে করেই হোক ডিফেন্ড করতেন, সব রকম চেষ্টা করতেন যে-কোনও ধরনের শাস্তি থেকে ছেলেকে বাঁচাতে। তারপর একসময় ভালো পাত্রী দেখে ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দিতেন। শুধু রফিকুল ইসলামের সংসারে নয়, প্রতিটি সংসারেই পুত্র এবং কন্যার পার্থক্য অনেকটা এমনই। যে কাজটি মেয়েরা করলে ‘অনৈতিক’, সে কাজটি পুরুষেরা করলে ‘অনৈতিক’ নয়।

 

রফিকুল ইসলাম বলেছেন লিপি নেশা করতো, তিনি কি তাঁর পুত্র নেশা করলে দেশের সবাইকে তা বলে বেড়াতেন, পুত্রকে হত্যা করতেন, তারপর মাটির তলায় পুঁতে ফেলতেন? নিশ্চয়ই তা করতেন না। পুত্র নেশা করলেও, কোনও উপার্জন না করলেও, বেকার বাউন্ডুলে, নেশাগ্রস্ত নষ্ট পুত্রকে তিনি খাওয়াতেন পরাতেন, শুধু পুত্রকে নয়, পুত্রের স্ত্রী সন্তানকে খাওয়ানো পরানোর ভারও তিনি নিতেন। বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছি।

রফিকুল ইসলাম নিজের মেয়ে লিপির বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে বা লিপিকে খুন করার পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে আরও একটি অভিযোগ করেছেন। বলেছেন, লিপির বিয়ে ভেঙেছে লিপির দোষেই। ধরা যাক তাঁর পুত্র শামীমের যদি কোনও কারণে বিয়ে ভাঙত, তাহলে কি তিনি তাঁর পুত্রের দোষ দিতেন? নিশ্চয়ই নয়, বলতেন, পুত্রবধূর দোষেই বিয়ে ভেঙেছে। মেয়েদের দোষ দেওয়া, মেয়েদের নিন্দে করা, মেয়েদের ঘৃণা করা অত্যন্ত সহজ। নারীবিদ্বেষী সমাজ এসবে বাহবা দেয়।

 

রফিকুল ইসলামের শাস্তি হবে হয়তো। কিন্তু তিনি নিজ কন্যাকে নিজের হাতে খুন করার জন্য অনুতপ্ত হবেন বলে আমার মনে হয় না। লিপিকে খুন করার পক্ষে প্রচুর লোককে তিনি পাবেন। সুতরাং তাঁর মনে হবে তিনি ঠিক কাজটিই করেছেন। তাঁর কাজ দেখে অনেকে উৎসাহিত হবে অনৈতিক এবং অসামাজিক কাজ করলে নিজের কন্যাকেও রেহাই না দিতে। নিজের পিতাই যদি খুন করে মেয়েদের, নিজের ঘরেই যদি মেয়েদের নিরাপত্তা নেই, তবে কোথায় নিরাপত্তা? মেয়েরা আসলে ঘরে-বাইরে কোথাও নিরাপদ নয়, রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে, ইস্কুল-কলেজে, কোথাও নয়। কত যে মানুষের হাত-পা নিশপিশ করে মেয়েদের গলা টিপে মেরে ফেলতে বা গলায় পায়ের চাপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলতে। পৃথিবীতে পিতাই যদি মেয়েদের জন্য নিরাপদ নয়, নিরাপদ তবে কে? এর একটিই উত্তর, কেউ নয়।

 

সপ্তাহখানিক আগে আরও একটি খবর পড়লাম। টাঙ্গাইলে প্রেমিকের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে এক কলেজছাত্রী গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। কলেজছাত্রীটিকে তার প্রেমিক আতিক বেড়ানোর কথা বলে করটিয়া থেকে উঠিয়ে গোসাই জোয়াইর এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে এক স্কুলের মাঠে প্রেমিক ও তার বেশ কয়েকজন বন্ধু মিলে কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করে। শুধু মাঠে নয়, এরপর নদীর পাড়ে নিয়েও তাকে ধর্ষণ করে ওরা। এ-সময় এলাকার লোকেরা টের পেয়ে ওই কলেজছাত্রীকে উদ্ধার করে টাঙ্গাইল হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। প্রেমিকেরা যে ভুলিয়ে ভালিয়ে প্রেমিকাদের দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে বন্ধুসহ গণধর্ষণ করে, এ নতুন কিছু নয়। হামেশাই হচ্ছে।

 

১৯৯২ সালে নিমন্ত্রণ নামে আমি একটি উপন্যাসিকা লিখেছিলাম। উপন্যাসিকায় দেখিয়েছিলাম শীলা নামের এক কিশোরী মনসুর নামের এক যুবকের প্রেমে পড়ে। মনসুর শীলার প্রেমে পড়ার কথা জানতে পেরে একদিন শীলাকে দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করে। শীলা সেজেগুজে প্রেমিকের নিমন্ত্রণ খেতে গিয়ে প্রেমিক এবং তার বন্ধুদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়। মনসুর বন্ধুবান্ধবসহ শীলাকে ধর্ষণ করবে বলেই শীলাকে নিমন্ত্রণ করেছিল একটি নির্জন বাড়িতে। আমি যখন উপন্যাসিকাটি লিখেছিলাম, আমি এরকম কোনও ঘটনার কথা তখন শুনিনি। অনুমান করেছিলাম পুরুষেরা কত নির্মম হতে পারে এবং মেয়েরা কতটা বিশ্বাস করতে পারে পুরুষদের বিশেষ করে প্রেমিকদের! নিমন্ত্রণ লেখার জন্য আমাকে প্রচুর নিন্দে শুনতে হয়েছিল। লোকের বিচ্ছিরি ঘৃণার শিকার হতে হয়েছিল। আবালবৃদ্ধবনিতা সকলে বলেছে আমি অবাস্তব গল্প লিখেছি, আমি পর্নোগ্রাফি লিখেছি, আমি পুরুষবিদ্বেষী ইত্যাদি। তারা আজ কোথায়? এই যে তথাকথিত প্রেমিকেরা বন্ধুবান্ধব নিয়ে মেয়েদের ধর্ষণ করছে, এসব খবর দেখে বা শুনে তারা কী বলে এখন? আমি অবাস্তব গল্প লিখেছিলাম? আমি পুরুষবিদ্বেষী? ধর্ষণের নির্মম নিষ্ঠুর বর্ণনা করেছিলাম বলে আমি পর্নোগ্রাফি লিখেছিলাম? আসলে নারীবিদ্বেষী লোকেরা আমাকে চিরকালই পুরুষবিদ্বেষী আখ্যা দিয়ে আমাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে এবং আমার দিকে ঢিল ছুড়েছে। নারীর ওপর নির্যাতনকে তারা কখনও নির্যাতন বলে স্বীকার করে না, যতক্ষণ না পর্যন্ত তাদের মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যা সেই নির্যাতনের শিকার হয়। অবশ্য তাতেই বা ক’জনের চক্ষু খোলে? খুললে তো রফিকুল ইসলামের খুলতো, নিজের কন্যাকে নির্যাতন করে নিজেই হত্যা করতেন না।

 

নিমন্ত্রণ উপন্যাসিকাটির মাধ্যমে আমি কিশোরী তরুণীদের বলতে চেষ্টা করেছিলাম পুরুষেরা ‘ভালোবাসি’ বলার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাস করা উচিত নয় যে তারা সত্যিই ভালোবাসে। নতুন পরিচয়ের পর পুরুষেরা দূরে কোথাও নিয়ে যেতে চাইলে বিশ্বাস করা উচিত নয় যে তারা নিরাপদ কোথাও তাদের নিয়ে যাচ্ছে। কাউকে বিশ্বাস করতে হলে দীর্ঘ সময় তার সঙ্গে মিশতে হয়। কাকে বিশ্বাস করা যায়, কার ওপর ভরসা করা যায়, তা আমরা আগে থেকে বুঝতে পারি না। মেয়েরা ‘প্রেম’ ব্যাপারটাকে খুব পছন্দ করে। তাই ভেবে নেয় প্রেমের গল্প-উপন্যাসের পুরুষের মতো, প্রেমের নাটক-সিনেমার পুরুষের মতো, তাদের প্রেমিক পুরুষেরাও বুঝি একই রকম প্রেমে দিওয়ানা। কিন্তু একসময় অনেকের টনক নড়ে, আঘাত পায়। বিয়ে করার আগেও আঘাত পায়, বিয়ে করার পরও আঘাত পায়। অগত্যা আঘাতকে নিজেদের ভবিতব্য ভেবে নিতে বাধ্য হয়।

 

সমাজ যদি হয় কঠোরভাবে পুরুষতান্ত্রিক, নারীকে যদি বাধ্য করা হয় পুরুষের অধীনতা মেনে নিতে, তবে পদে পদে আমরা নারীর জীবনকে অনিরাপদ হতে দেখবো। পুরুষকে নিয়েই বাস করতে হয় সমাজে। আর এই পুরুষই যদি নারীকে দুর্বল এবং পরনির্ভর হতে বাধ্য করে, শতাব্দীর পর শতাব্দী বাধ্য করে; যদি নারীকে স্বৈরিণী এবং নরকের দ্বার বলে মনে করে, শতাব্দীর পর শতাব্দী মনে করে; তবে নারী কিন্তু কোনও না কোনও সময় নিজের অজান্তেই পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। সে-কারণে নারীকেও দেখি নারীর স্বাধীনতা এবং অধিকারের বিরুদ্ধে অবিকল পুরুষের মতো দাঁড়িয়ে যেতে। এটি নারী ও পুরুষ কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। মানুষ নিজের সমাজকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে ক্রমাগত পেছনে নিচ্ছে, অথবা যেখানে ছিল সেখানেই থামিয়ে রাখছে। মহাকাশ-বিজ্ঞান এগিয়ে গেল, চিকিৎসা-বিজ্ঞান এগিয়ে গেল, প্রযুক্তি এগোলো, শিল্প-সাহিত্য এগোলো, অর্থনীতি-রাজনীতি সবকিছুর পরিবর্তন হলো, উন্নতি হলো, কেবল সামাজিক ব্যবস্থারই কিছু হলো না, সমাজের কাঠামোরও কোনও বদল হলো না, নারী পুরুষের বৈষম্য যেখানে ছিল, সেখানেই বহাল তবিয়তে রয়ে গেল। আমাদের কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না নারীকে পেছনের কাতারে রেখে, পরমুখাপেক্ষী রেখে, নারীকে দাসীবৃত্তির দায়িত্ব দিয়ে, নারীকে নির্যাতন করে, সমাজের সত্যিকার কোনও উন্নতি করা যায় না।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।   সূএ :বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com