অবাধ্য ভাবনা

তসলিমা নাসরিন : ১. পাকিস্তানের করাচিতে সেদিন একটি হিন্দু মন্দিরের ভেতরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেললো কিছু মুসলমান। বাংলাদেশেও ঘটে এমন। আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয়, দেশভাগ না হলে কী হতো? আমার মনে হয়, দেশভাগ না হলে হিন্দু মুসলমানে ঘন ঘন দাঙ্গা লাগত, প্রচুর মানুষের মৃত্যু হতো। দেশভাগ হয়েই বা কী হয়েছে? দেশভাগ হলেও হিন্দু মুসলমানের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা কমেনি। যদি এমন হতো, সব হিন্দু ওদিকে, সব মুসলমান এদিকে, তাহলে কি অসন্তোষ, ঘৃণা আর রক্তপাতের অবসান হতো? হতো বলেও কিন্তু মনে হয় না। হিন্দুদের উঁচু জাত আর নীচু জাতে ঘৃণা ঠিকই টিকে থাকতো, প্রগতিশীল আর কট্টর মুসলমানে ঘৃণা টিকে থাকতো, সুন্নি, শিয়া, আহমদিয়া, বাহাই, সুফির মধ্যে ঘৃণা টিকে থাকতো। মারামারি লেগেই থাকতো। আসলে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে, শিক্ষিত এবং সভ্য না হতে পারলে, ঘৃণা আর ভায়োলেন্স থেকে মানুষের মুক্তি নেই।

 

২. আমি ইসলাম পছন্দ করি না, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি মুসলমানদের অপছন্দ করি। আমি ইসলামি মৌলবাদের বা ইসলামি সন্ত্রাসের বিপক্ষে বলে যদি কেউ মনে করে আমি ট্রাম্পপন্থি, সে ভুল। যদি মনে করে, যেহেতু আমি ইসলাম পছন্দ করি না, সেহেতু আমি ইসলাম ছাড়া বাকি সব ধর্ম পছন্দ করি, অথবা আমি ইসলামবিরোধী কট্টর ডানপন্থি দলের সমর্থক, তাহলেও ভুল। অনেকেই সরল অঙ্কে অভ্যস্ত। তারা মনে করে, তুমি আরএসএস হলে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চাইবে; আরএসএস না হওয়া মানে সিভিল কোড না চাওয়া। কিন্তু আমি যে আরএসএসের প্রচ- বিরোধী হয়েও ইউনিফর্ম সিভিল কোডের প্রচ- পক্ষে, তার বেলায়? মানুষ বোঝে না যে কিছু মানুষ যেদিকে সবাই যাচ্ছে সেদিকে যায় না, কিছু মানুষ মানবতার জন্য উঁচু হয়ে দাঁড়ায়।

 

৩. একখানা ‘জান্নাতের পাসপোর্ট’ দেখার সুযোগ হলো। বাংলাদেশে বানানো হয়েছে এই সবুজ পাসপোর্ট। ধর্মের ব্যবসায়ীরা বানিয়েছে। তারা মানুষের মগজ ধোলাই করে, আর মানুষকে জিহাদে টেনে নিয়ে যায়। ঠিকঠাক জিহাদ করলে অর্থাৎ বিধর্মীদের এবং ইসলামের সমালোচকদের খুন করলে এই পাসপোর্ট উপহার দেওয়া হয়। বোকা লোকগুলো ভেবে নেয় তারা এই পাসপোর্ট নিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরে হেঁটে চলে যাবে জান্নাতে। অন্যদের মতো হাশরের মাঠে তাদের ইমানের পরীক্ষা দিতে হবে না বা পুলসিরাত পার হতে হবে না। 

পশ্চিম আফ্রিকার গরিব দেশ বুরকিনা ফাসোতে বহুদিন থেকে জিহাদিরা অবলীলায় মানুষ খুন করছে। এদেরও নিশ্চয়ই জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল। জিহাদিরা গরিব দেশ আর ধনী দেশে কোনও পার্থক্য করে না। নৃশংসতার কোনও দৈশিক সীমানা, সত্যি বলতে, নেই।

 

৪. সেক্স আর কঞ্জিউমেশানে পার্থক্য কী? পার্থক্য খুব বড় কিছু নয়। তবে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য, সেটি হলো, সেক্স শব্দটি পলিটিক্যালি কারেক্ট নয়, কঞ্জিউমেশান শব্দটি কারেক্ট। কেউ যখন বলেন, ‘তিনি বিয়েটা কঞ্জিউমেট করেছিলেন’, তখন সেটা পলিটিক্যালি কারেক্ট, কিন্তু যদি কঞ্জিউমেট শব্দটি না বলে বলেন ‘তিনি বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে সেক্স করেছিলেন’, তখন সেটা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট।

 

কোদালকে ‘কোদাল’ না বলে ‘খনন করার নিমিত্তে লৌহ ও কাষ্ঠ নির্মিত দীর্ঘ হাতলের একটি সরঞ্জাম’ বলাটাই অনেকের পছন্দ।

 

৫. নোবেল প্রাইজ পাওয়া বিজ্ঞানী স্যর টিম হান্ট একটা কনফারেন্সে নারী-বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘ল্যাবের মেয়েরা খালি প্রেমে পড়ে, তাদের প্রেমে ছেলেদের পড়াতে চায়, আর কিছু বললেই কেঁদে ওঠে, ছেলেদের আর মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ল্যাব হওয়াই ভালো।’ স্যার টিম হান্টকে পরে ক্ষমা চাইতে হয়েছে তাঁর মন্তব্যের জন্য, কিন্তু ক্ষমা তিনি পাননি। তাঁকে ইংল্যান্ডের ইউসিএল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সায়েন্স অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে, শুধু ওই মন্তব্যটুকুর জন্য। হ্যাঁ, শুধু ওই মন্তব্যটুকুর জন্য। ভাবছি দেশ কতটা সভ্য হলে টিম হান্টের সামান্য ওই সেক্সিস্ট মন্তব্যে আপত্তি করে। আমাদের উপমহাদেশে যদি সেক্সিজমের কারণে চাকরি খাওয়ার ব্যবস্থা হয়, তাহলে খুব কম পুরুষেরই চাকরি রক্ষা পাবে।

 

৬. বাংলাদেশে আজকাল ধর্ষক ধরা পড়ছে, মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ছে, চোর ডাকাত ধরা পড়ছে, খুনি ধরা পড়ছে…সবাই দেখছি ধার্মিক। ছোটবেলায় টুপিদাড়িওয়ালা কোনও লোক দেখলে ভাবতাম লোকটি নীতিমান। বড়বেলায় প্রচুর টুপিদাড়িওয়ালার মধ্যেই দেখছি লুকিয়ে আছে নষ্ট এবং নিকৃষ্ট।

 

৭. বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আশা কী করতে পারি ধর্ষণ ঘটবে না আর? যদি পুরুষেরা এখন ধর্ষণ না করে, তাহলে কি কারণে করবে না? মৃত্যুদন্ডের ভয়ে। কিন্তু ধর্ষণের ইচ্ছেটা তো রয়েই যাবে। পুরুষের নারীবিদ্বেষী মানসিকতা ধর্ষণ ঘটায়, নারীবিদ্বেষী এই মানসিকতার কিন্তু কোনও পরিবর্তন ঘটছে না। সেইটি ঘটা সবচেয়ে জরুরি। পুরুষ যেদিন থেকে ধর্ষণ বন্ধ করবে এই বিশ্বাসে যে তার কোনও অধিকার নেই কারও সঙ্গে অশোভন এবং অশ্লীল আচরণ করার, কাউকে অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করার, সেইদিন ধর্ষণ সত্যিকার বন্ধ হবে। কিন্তু কী করে বন্ধ হবে, ঘরে বাইরে প্রতিদিন শেখানো হচ্ছে মেয়েরা পুরুষের ভোগের বস্তু। একদিকে মেয়েরা যে ভোগের বস্তু তা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া জায়েজ, আরেকদিকে ভোগের বস্তুদের ভোগ করাটা জায়েজ নয়। মুশকিলই বটে।

 

৮. মেয়েরা যতদিন না রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুরুষের সঙ্গে সমান হচ্ছে, ততদিন তাদের নিজের পরিচয়ে নিজের বাঁচাটা নিশ্চিতই দুরূহ। যতদিন না তারা শারীরিক স্বাধীনতা অর্জন করছে, ততদিন তাদের মানসিক স্বাধীনতাও কচুপাতায় জলের মতো, এই থাকে তো এই থাকে না।

 

৯. ভারতবর্ষে দুই-তৃতীয়াংশ বিবাহিত মেয়ে নির্যাতিত হচ্ছে স্বামী দ্বারা। যেদিন প্রতিটি নির্যাতিত মেয়েই অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মেয়েই বধূ নির্যাতন মামলায় অত্যাচারী স্বামীদের জেলে ভরবে, সেদিনই বুঝবো মেয়েরা এই ভারতবর্ষে সামান্য হলেও সচেতন হয়েছে, সামান্য হলেও আত্মসম্মানবোধ তাদের আছে। যেদিন তাদের ভয় ঘুচে যাবে, দ্বিধা দূর হবে, সেদিন বুঝবো মেয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করেছে। আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় কিছু না কিছু বেরোয়।

 

১০. পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ভিকটিম। এ কথা যেমন ঠিক, নারী আত্মঘাতী এটাও ঠিক। আজ যদি নারীরা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতো, আত্মপরিচয়ের সংকটমোচনে নিজেরা বিচ্ছিন্ন না থেকে সংগঠিত হতো, নারীর সঙ্গে নারীর যোগাযোগ যদি আরও বেশি হতো, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা যদি বাড়তো, যদি তারা আন্তরিকভাবে পরস্পরের হাতে সহযোগিতার হাত রাখতো, নারীর ক্ষমতায়নে এক নারী আরেক নারীর পাশে দাঁড়াতো, তবে চুর চুর করে ভেঙে পড়তো পুরুষতন্ত্র, বাসযোগ্য হতো জগৎ।

 

১১. আমি মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলি, এটা অনেক মেয়ের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। অনেক সময় মেয়েদের স্বাধীনতা বিষয়ে আমি যা বলি, তা মেয়েরা যত বোঝে, তার চেয়ে বেশি পুরুষেরা বোঝে। বোঝে, কারণ, স্বাধীনতা ভোগ করে পুরুষ অভ্যস্ত, স্বাধীনতার অর্থ তারা তাই জানে। পুরুষেরা আমার লেখার বিরুদ্ধে বলে, কারণ তারা ঠিক জানে আমি কী বলতে চাইছি। নারীরা আমার লেখার বিরুদ্ধাচরণ করে, কারণ তারা ঠিক জানে না আমি কী বলতে চাইছি। দুজনের বিরোধিতার ভাষাটা এক, কারণটা ভিন্ন।

 

১২. মেয়েদের কাপড় চোপড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে চায় ধর্ষক পুরুষ। অচেনা কারও সঙ্গে কোনও অনুমতি ছাড়াই যৌন সঙ্গমের ইচ্ছে হতেই পারে পুরুষের, কারও ওপর পেশির জোর দেখানোর ইচ্ছে হতেই পারে তাদের, কাউকে খুন করার ইচ্ছে হতেই পারে- কিন্তু এসব বদ ইচ্ছেগুলোকে সংবরণ করতে হবে, এ ছাড়া উপায় নেই। সভ্য হতে হলে এর বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি মানুষ সভ্য না হলে দেশটিরও সভ্য হয়ে ওঠা হয় না।

 

১৩. জন্মের পর থেকে যত নারীবিদ্বেষ পুরুষেরা শিখেছে- তা সবার আগে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে হবে। ওসব আবর্জনা মস্তিষ্কে রেখে নতুন বপন করে সুস্থ কিছু ফলানো সম্ভব নয়। নারীকে শ্রদ্ধা করো- এই শিক্ষা কোনও কাজে আসবে না, কারণ নারীকে ঘৃণা করো এই শিক্ষা পেয়েই বেড়ে উঠেছে অধিকাংশ পুরুষ। আসলে ‘নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীও মানুষ’ ইত্যাদি যত না মাথায় প্রবেশ করানো দরকার, তার চেয়ে মাথা থেকে ‘নারী যৌন বস্তু’, ‘নারীকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পুরুষের আছে’ এ ধরনের বিশ্বাস মাথা থেকে বের করে দেওয়া বেশি দরকার।

 

১৪. মেয়েদের বোরখা পরার অর্থ হলো, ‘মেয়েরা লোভের জিনিস, ভোগের বস্তু’, মেয়েদের শরীরের কোনও অংশ পুরুষের চোখে পড়লে পুরুষের যৌন কামনা আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে, লোভ লালসার বন্যা নামে, ধর্ষণ না করে ঠিক শান্তি হয় না। পুরুষদের এই যৌন সমস্যার কারণে মেয়েদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হবে। এই হলো সপ্তম শতাব্দীতে জন্ম হওয়া ধর্মীয় বিধান। এই বিধানের অলিখিত ভাষ্য হলো, পুরুষেরা সব অসভ্য, সব বদ, সব যৌন কাতর, ধর্ষক, তারা নিজেদের যৌন ইচ্ছেকে দমন করতে জানে না, জানে না বলেই শরীরের আপাদমস্তক ঢেকে রাখার দায়িত্ব মেয়েদের নিতে হয়।

 

১৫. মেয়েদের পোশাককে পুরুষেরা তাদের রাজনীতির বিষয় করেছে। মেয়েরা যৌন হেনস্তার শিকার হলে তারা মেয়েদের পোশাককে দোষ দেয়। সমাজ যে সভ্য হয়নি, শিক্ষিত হয়নি, সমাজ যে এখনো মেয়েদের দ্বিতীয় লিঙ্গ বলে বিচার করে, মেয়েদের যৌনবস্তু বলে মনে করে- এ কথা স্বীকার করে না, এ নিয়ে উদ্বিগ্নও হয় না। বরং মেয়েদের আদেশ বা উপদেশ দেয় ছোট পোশাক ছেড়ে বড় পোশাক পরার, এ পোশাক না পরে সে পোশাক পরার। জিন্স না পরে সালোয়ার পরার, সালোয়ার না পরে শাড়ি পরার। বিশেষজ্ঞরা এই যে এত বলছেন যে মেয়েদের পোশাকের কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটে না, তারপরও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে মেয়েরা বা মেয়েদের পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়, দায়ী ধর্ষক, দায়ী ধর্ষকের নারীবিদ্বেষ, দায়ী ধর্ষকের অজ্ঞতা, মূর্খতা, পুরুষতান্ত্রিকতা।

 

আচ্ছা, পুরুষের ওপর ঘটা কোনও যৌন হেনস্তার দায় কি পুরুষের কোনও পোশাকের ওপর দেওয়া হয়? দেওয়া হলে পোশাক বদলানোর উপদেশ কি মুহুর্মুহু বর্ষণ করা হয় পুরুষের ওপর? মেয়েদের ওপর চলা অন্যায়ের, সত্যিই, কোনও সীমা নেই, শেষ নেই।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» নির্বাচিত সরকারই দেশ পুনর্গঠন করতে পারে: তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

» ইয়াবাসহ দুইজনকে গ্রেফতার

» বদলে যাচ্ছে ফেসবুক মেসেঞ্জার

» সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত

» রাষ্ট্রের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলেরও সংস্কার প্রয়োজন : সেলিমা রহমান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

অবাধ্য ভাবনা

তসলিমা নাসরিন : ১. পাকিস্তানের করাচিতে সেদিন একটি হিন্দু মন্দিরের ভেতরের মূর্তি ভেঙ্গে ফেললো কিছু মুসলমান। বাংলাদেশেও ঘটে এমন। আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে হয়, দেশভাগ না হলে কী হতো? আমার মনে হয়, দেশভাগ না হলে হিন্দু মুসলমানে ঘন ঘন দাঙ্গা লাগত, প্রচুর মানুষের মৃত্যু হতো। দেশভাগ হয়েই বা কী হয়েছে? দেশভাগ হলেও হিন্দু মুসলমানের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা কমেনি। যদি এমন হতো, সব হিন্দু ওদিকে, সব মুসলমান এদিকে, তাহলে কি অসন্তোষ, ঘৃণা আর রক্তপাতের অবসান হতো? হতো বলেও কিন্তু মনে হয় না। হিন্দুদের উঁচু জাত আর নীচু জাতে ঘৃণা ঠিকই টিকে থাকতো, প্রগতিশীল আর কট্টর মুসলমানে ঘৃণা টিকে থাকতো, সুন্নি, শিয়া, আহমদিয়া, বাহাই, সুফির মধ্যে ঘৃণা টিকে থাকতো। মারামারি লেগেই থাকতো। আসলে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠতে না পারলে, শিক্ষিত এবং সভ্য না হতে পারলে, ঘৃণা আর ভায়োলেন্স থেকে মানুষের মুক্তি নেই।

 

২. আমি ইসলাম পছন্দ করি না, এর মানে কিন্তু এই নয় যে আমি মুসলমানদের অপছন্দ করি। আমি ইসলামি মৌলবাদের বা ইসলামি সন্ত্রাসের বিপক্ষে বলে যদি কেউ মনে করে আমি ট্রাম্পপন্থি, সে ভুল। যদি মনে করে, যেহেতু আমি ইসলাম পছন্দ করি না, সেহেতু আমি ইসলাম ছাড়া বাকি সব ধর্ম পছন্দ করি, অথবা আমি ইসলামবিরোধী কট্টর ডানপন্থি দলের সমর্থক, তাহলেও ভুল। অনেকেই সরল অঙ্কে অভ্যস্ত। তারা মনে করে, তুমি আরএসএস হলে ইউনিফর্ম সিভিল কোড চাইবে; আরএসএস না হওয়া মানে সিভিল কোড না চাওয়া। কিন্তু আমি যে আরএসএসের প্রচ- বিরোধী হয়েও ইউনিফর্ম সিভিল কোডের প্রচ- পক্ষে, তার বেলায়? মানুষ বোঝে না যে কিছু মানুষ যেদিকে সবাই যাচ্ছে সেদিকে যায় না, কিছু মানুষ মানবতার জন্য উঁচু হয়ে দাঁড়ায়।

 

৩. একখানা ‘জান্নাতের পাসপোর্ট’ দেখার সুযোগ হলো। বাংলাদেশে বানানো হয়েছে এই সবুজ পাসপোর্ট। ধর্মের ব্যবসায়ীরা বানিয়েছে। তারা মানুষের মগজ ধোলাই করে, আর মানুষকে জিহাদে টেনে নিয়ে যায়। ঠিকঠাক জিহাদ করলে অর্থাৎ বিধর্মীদের এবং ইসলামের সমালোচকদের খুন করলে এই পাসপোর্ট উপহার দেওয়া হয়। বোকা লোকগুলো ভেবে নেয় তারা এই পাসপোর্ট নিয়ে শর্টকাট রাস্তা ধরে হেঁটে চলে যাবে জান্নাতে। অন্যদের মতো হাশরের মাঠে তাদের ইমানের পরীক্ষা দিতে হবে না বা পুলসিরাত পার হতে হবে না। 

পশ্চিম আফ্রিকার গরিব দেশ বুরকিনা ফাসোতে বহুদিন থেকে জিহাদিরা অবলীলায় মানুষ খুন করছে। এদেরও নিশ্চয়ই জান্নাতে যাওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল। জিহাদিরা গরিব দেশ আর ধনী দেশে কোনও পার্থক্য করে না। নৃশংসতার কোনও দৈশিক সীমানা, সত্যি বলতে, নেই।

 

৪. সেক্স আর কঞ্জিউমেশানে পার্থক্য কী? পার্থক্য খুব বড় কিছু নয়। তবে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য, সেটি হলো, সেক্স শব্দটি পলিটিক্যালি কারেক্ট নয়, কঞ্জিউমেশান শব্দটি কারেক্ট। কেউ যখন বলেন, ‘তিনি বিয়েটা কঞ্জিউমেট করেছিলেন’, তখন সেটা পলিটিক্যালি কারেক্ট, কিন্তু যদি কঞ্জিউমেট শব্দটি না বলে বলেন ‘তিনি বিয়ের পর স্ত্রীর সঙ্গে সেক্স করেছিলেন’, তখন সেটা পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট।

 

কোদালকে ‘কোদাল’ না বলে ‘খনন করার নিমিত্তে লৌহ ও কাষ্ঠ নির্মিত দীর্ঘ হাতলের একটি সরঞ্জাম’ বলাটাই অনেকের পছন্দ।

 

৫. নোবেল প্রাইজ পাওয়া বিজ্ঞানী স্যর টিম হান্ট একটা কনফারেন্সে নারী-বিজ্ঞানীদের সম্পর্কে একবার বলেছিলেন, ‘ল্যাবের মেয়েরা খালি প্রেমে পড়ে, তাদের প্রেমে ছেলেদের পড়াতে চায়, আর কিছু বললেই কেঁদে ওঠে, ছেলেদের আর মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা ল্যাব হওয়াই ভালো।’ স্যার টিম হান্টকে পরে ক্ষমা চাইতে হয়েছে তাঁর মন্তব্যের জন্য, কিন্তু ক্ষমা তিনি পাননি। তাঁকে ইংল্যান্ডের ইউসিএল বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইফ সায়েন্স অধ্যাপকের পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয়েছে, শুধু ওই মন্তব্যটুকুর জন্য। হ্যাঁ, শুধু ওই মন্তব্যটুকুর জন্য। ভাবছি দেশ কতটা সভ্য হলে টিম হান্টের সামান্য ওই সেক্সিস্ট মন্তব্যে আপত্তি করে। আমাদের উপমহাদেশে যদি সেক্সিজমের কারণে চাকরি খাওয়ার ব্যবস্থা হয়, তাহলে খুব কম পুরুষেরই চাকরি রক্ষা পাবে।

 

৬. বাংলাদেশে আজকাল ধর্ষক ধরা পড়ছে, মাদক ব্যবসায়ী ধরা পড়ছে, চোর ডাকাত ধরা পড়ছে, খুনি ধরা পড়ছে…সবাই দেখছি ধার্মিক। ছোটবেলায় টুপিদাড়িওয়ালা কোনও লোক দেখলে ভাবতাম লোকটি নীতিমান। বড়বেলায় প্রচুর টুপিদাড়িওয়ালার মধ্যেই দেখছি লুকিয়ে আছে নষ্ট এবং নিকৃষ্ট।

 

৭. বাংলাদেশে এখন ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। আশা কী করতে পারি ধর্ষণ ঘটবে না আর? যদি পুরুষেরা এখন ধর্ষণ না করে, তাহলে কি কারণে করবে না? মৃত্যুদন্ডের ভয়ে। কিন্তু ধর্ষণের ইচ্ছেটা তো রয়েই যাবে। পুরুষের নারীবিদ্বেষী মানসিকতা ধর্ষণ ঘটায়, নারীবিদ্বেষী এই মানসিকতার কিন্তু কোনও পরিবর্তন ঘটছে না। সেইটি ঘটা সবচেয়ে জরুরি। পুরুষ যেদিন থেকে ধর্ষণ বন্ধ করবে এই বিশ্বাসে যে তার কোনও অধিকার নেই কারও সঙ্গে অশোভন এবং অশ্লীল আচরণ করার, কাউকে অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করার, সেইদিন ধর্ষণ সত্যিকার বন্ধ হবে। কিন্তু কী করে বন্ধ হবে, ঘরে বাইরে প্রতিদিন শেখানো হচ্ছে মেয়েরা পুরুষের ভোগের বস্তু। একদিকে মেয়েরা যে ভোগের বস্তু তা মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া জায়েজ, আরেকদিকে ভোগের বস্তুদের ভোগ করাটা জায়েজ নয়। মুশকিলই বটে।

 

৮. মেয়েরা যতদিন না রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে পুরুষের সঙ্গে সমান হচ্ছে, ততদিন তাদের নিজের পরিচয়ে নিজের বাঁচাটা নিশ্চিতই দুরূহ। যতদিন না তারা শারীরিক স্বাধীনতা অর্জন করছে, ততদিন তাদের মানসিক স্বাধীনতাও কচুপাতায় জলের মতো, এই থাকে তো এই থাকে না।

 

৯. ভারতবর্ষে দুই-তৃতীয়াংশ বিবাহিত মেয়ে নির্যাতিত হচ্ছে স্বামী দ্বারা। যেদিন প্রতিটি নির্যাতিত মেয়েই অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মেয়েই বধূ নির্যাতন মামলায় অত্যাচারী স্বামীদের জেলে ভরবে, সেদিনই বুঝবো মেয়েরা এই ভারতবর্ষে সামান্য হলেও সচেতন হয়েছে, সামান্য হলেও আত্মসম্মানবোধ তাদের আছে। যেদিন তাদের ভয় ঘুচে যাবে, দ্বিধা দূর হবে, সেদিন বুঝবো মেয়েরা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করেছে। আত্মসম্মানবোধ থাকলে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর উপায় কিছু না কিছু বেরোয়।

 

১০. পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী ভিকটিম। এ কথা যেমন ঠিক, নারী আত্মঘাতী এটাও ঠিক। আজ যদি নারীরা নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হতো, আত্মপরিচয়ের সংকটমোচনে নিজেরা বিচ্ছিন্ন না থেকে সংগঠিত হতো, নারীর সঙ্গে নারীর যোগাযোগ যদি আরও বেশি হতো, পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি এবং শ্রদ্ধা যদি বাড়তো, যদি তারা আন্তরিকভাবে পরস্পরের হাতে সহযোগিতার হাত রাখতো, নারীর ক্ষমতায়নে এক নারী আরেক নারীর পাশে দাঁড়াতো, তবে চুর চুর করে ভেঙে পড়তো পুরুষতন্ত্র, বাসযোগ্য হতো জগৎ।

 

১১. আমি মেয়েদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতার কথা বলি, এটা অনেক মেয়ের কাছে বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়। অনেক সময় মেয়েদের স্বাধীনতা বিষয়ে আমি যা বলি, তা মেয়েরা যত বোঝে, তার চেয়ে বেশি পুরুষেরা বোঝে। বোঝে, কারণ, স্বাধীনতা ভোগ করে পুরুষ অভ্যস্ত, স্বাধীনতার অর্থ তারা তাই জানে। পুরুষেরা আমার লেখার বিরুদ্ধে বলে, কারণ তারা ঠিক জানে আমি কী বলতে চাইছি। নারীরা আমার লেখার বিরুদ্ধাচরণ করে, কারণ তারা ঠিক জানে না আমি কী বলতে চাইছি। দুজনের বিরোধিতার ভাষাটা এক, কারণটা ভিন্ন।

 

১২. মেয়েদের কাপড় চোপড়ের ওপর দোষ চাপিয়ে নিজের দোষ ঢাকতে চায় ধর্ষক পুরুষ। অচেনা কারও সঙ্গে কোনও অনুমতি ছাড়াই যৌন সঙ্গমের ইচ্ছে হতেই পারে পুরুষের, কারও ওপর পেশির জোর দেখানোর ইচ্ছে হতেই পারে তাদের, কাউকে খুন করার ইচ্ছে হতেই পারে- কিন্তু এসব বদ ইচ্ছেগুলোকে সংবরণ করতে হবে, এ ছাড়া উপায় নেই। সভ্য হতে হলে এর বিকল্প নেই। দেশের প্রতিটি মানুষ সভ্য না হলে দেশটিরও সভ্য হয়ে ওঠা হয় না।

 

১৩. জন্মের পর থেকে যত নারীবিদ্বেষ পুরুষেরা শিখেছে- তা সবার আগে তাদের মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিতে হবে। ওসব আবর্জনা মস্তিষ্কে রেখে নতুন বপন করে সুস্থ কিছু ফলানো সম্ভব নয়। নারীকে শ্রদ্ধা করো- এই শিক্ষা কোনও কাজে আসবে না, কারণ নারীকে ঘৃণা করো এই শিক্ষা পেয়েই বেড়ে উঠেছে অধিকাংশ পুরুষ। আসলে ‘নারীকে শ্রদ্ধা করো, নারীও মানুষ’ ইত্যাদি যত না মাথায় প্রবেশ করানো দরকার, তার চেয়ে মাথা থেকে ‘নারী যৌন বস্তু’, ‘নারীকে যা ইচ্ছে তাই করার অধিকার পুরুষের আছে’ এ ধরনের বিশ্বাস মাথা থেকে বের করে দেওয়া বেশি দরকার।

 

১৪. মেয়েদের বোরখা পরার অর্থ হলো, ‘মেয়েরা লোভের জিনিস, ভোগের বস্তু’, মেয়েদের শরীরের কোনও অংশ পুরুষের চোখে পড়লে পুরুষের যৌন কামনা আগুনের মতো দাউ দাউ করে জ্বলে, লোভ লালসার বন্যা নামে, ধর্ষণ না করে ঠিক শান্তি হয় না। পুরুষদের এই যৌন সমস্যার কারণে মেয়েদের আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে হবে। এই হলো সপ্তম শতাব্দীতে জন্ম হওয়া ধর্মীয় বিধান। এই বিধানের অলিখিত ভাষ্য হলো, পুরুষেরা সব অসভ্য, সব বদ, সব যৌন কাতর, ধর্ষক, তারা নিজেদের যৌন ইচ্ছেকে দমন করতে জানে না, জানে না বলেই শরীরের আপাদমস্তক ঢেকে রাখার দায়িত্ব মেয়েদের নিতে হয়।

 

১৫. মেয়েদের পোশাককে পুরুষেরা তাদের রাজনীতির বিষয় করেছে। মেয়েরা যৌন হেনস্তার শিকার হলে তারা মেয়েদের পোশাককে দোষ দেয়। সমাজ যে সভ্য হয়নি, শিক্ষিত হয়নি, সমাজ যে এখনো মেয়েদের দ্বিতীয় লিঙ্গ বলে বিচার করে, মেয়েদের যৌনবস্তু বলে মনে করে- এ কথা স্বীকার করে না, এ নিয়ে উদ্বিগ্নও হয় না। বরং মেয়েদের আদেশ বা উপদেশ দেয় ছোট পোশাক ছেড়ে বড় পোশাক পরার, এ পোশাক না পরে সে পোশাক পরার। জিন্স না পরে সালোয়ার পরার, সালোয়ার না পরে শাড়ি পরার। বিশেষজ্ঞরা এই যে এত বলছেন যে মেয়েদের পোশাকের কারণে ধর্ষণের মতো অপরাধ ঘটে না, তারপরও কেউ বিশ্বাস করতে চায় না যে মেয়েরা বা মেয়েদের পোশাক ধর্ষণের জন্য দায়ী নয়, দায়ী ধর্ষক, দায়ী ধর্ষকের নারীবিদ্বেষ, দায়ী ধর্ষকের অজ্ঞতা, মূর্খতা, পুরুষতান্ত্রিকতা।

 

আচ্ছা, পুরুষের ওপর ঘটা কোনও যৌন হেনস্তার দায় কি পুরুষের কোনও পোশাকের ওপর দেওয়া হয়? দেওয়া হলে পোশাক বদলানোর উপদেশ কি মুহুর্মুহু বর্ষণ করা হয় পুরুষের ওপর? মেয়েদের ওপর চলা অন্যায়ের, সত্যিই, কোনও সীমা নেই, শেষ নেই।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।   সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com