আমরা চার বন্ধু একই সরল রেখায় না বসে কিছুটা গোলাকৃতি হয়ে বসে আছি। বনজ উষ্ণতায় পরির্পূণ সুগন্ধী নারী যেখানে বসে আছে, সেখান থেকে আমাদের সাথে ওর দুরত্ব ও ছাতিম গাছের দুরত্ব বলা যায় সমানই হবে। আমরা চার বন্ধু দু’টি প্রাণের অস্তিত্ব সমান ভাবে অনুভব করছি। দু’টির পার্থক্য হলো এই যে, ছাতিম বৃক্ষটি পৃথিবীর তাবৎ নিরবতাকে বুকে ধারণ করে তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। আর সবুজাভ সুগন্ধী নারী ফাল্গুন চৈত্রের শেষ বেলাকার কোলাহল মুখর পাখীর মত কলরব মুখর। ছাতিম গাছের শাখায় শাখায় ফুল ফুটেছে। ফুলের গন্ধে চারদিক যেন উচ্ছসিত হয়ে আছে। ছাতিম ফুল কি অন্ধকারে এতো গন্ধ ছড়ায়! কথাটা বলেই সুগন্ধি নারী চারদিকটা দেখলো। সে অন্ধকারে ছাতিম ফুলের তীব্রতা ছাড়া আর কোনো কিছুরই অস্তিত্ব অনূভব করতে পারলো না। কেবল অন্ধকারে কি যেন মনে মনে খুঁজে বেড়ালো।
সুগন্ধি নারী তারপরও বললো, ‘অন্ধকারের মাঝেও বিমূর্ত আলোকরাশি ফল্গু ধারার মতো বয়ে বেড়ায়। যে দেখতে পায় সে-ই যেন সীমার মাঝে রবি ঠাকুরের মতো অসীমের ঠিকানা খুঁজে ফেরে’।
আমরা চারজন পুরুষের মধ্যে প্রথমে কেউ কোনো কথা বললো না। আমরা সবাই দারুন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি আমাদের সামনে বসা রূপবতী শ্যামল প্রকৃতির মতো নরম মেয়ে মানুষটার মুখের দিকে। যদিও তার মুখ আলো আধাঁরের মাঝে পরিস্কার ভাবে দেখা যাচ্ছে না। তারপরও ক্রস রোডের পৌরসভার এনার্জি বাল্ব এর ক্ষীণ আলোর রেখায় মেয়ে মানুষটার অস্পষ্ট মুখের রেখা কিছুটা দেখা যাচ্ছে।
আমাদের মধ্যে অর্থাৎ আমরা চারজন পুরুষের মধ্যে হঠাৎ করে যেন স্থির জলের মাঝে কিছু পরলে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তেমনি আলোড়ন দেখা দিলো। হেমন্তের বাতাসে ভর করে অচেনা এক মাদকীয় ঘ্রাণ আমাদেরকে কাঁপিয়ে তোলে কিংবা বলা যায় আমাদেরকে অজানা বেদনায় জাগিয়ে তোলে। আমরা কেউ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এই মাদকীয় ঘ্রাণ কিসের। আমাদের আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে আমাদের বন্ধুদের একজন বললো, ‘এই মাদকীয় ঘ্রাণ হেমন্তের বাতাসে ভর করে দূর দুরান্ত থেকে ভেসে আসছে’।
আমাদের যে বন্ধুটির চরিত্র রসকষহীন পাথরের মতো সে বললো, ‘তোরা এতো কথা বলছিস কেন। এখনো কি বুঝতে পারছিস না পাগল করা এই মাদকীয় ঘ্রাণ কোথা থেকে আসছে। তোরা কি এতোই বোকা। একেবারে বোধহীন হয়ে গেছিস’।
আমাদের চারজনের মধ্যে একজন বললো, ‘না বুঝতে পারছি না মাতাল হাওয়ায় ভেসে আসা উষ্ণ মাদকীয় গন্ধটা কিসের। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে কি বুঝার জন্য এতো ব্যাকুল হতাম। বুঝতে পারছি না বলেই তো আমরা এই অচেনা গন্ধটা নিয়ে এতো কথা বলছি’।
এবার শরীরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে আমাদের বন্ধুদের মধ্যে যে বন্ধুটি রঙ্গীন রঙ্গীন পোষাকে পরিপাটি হয়ে কিংবা শরীরে দেশি বিদেশি গন্ধ মেখে ঘুরে বেড়ায়, সে বললো, ‘বোকারা শুধু কথাই বলে যাচ্ছে। এখনো বুঝতে পারছে না পাগল হাওয়ায় ভেসে আসা এই মাদকীয় ঘ্রাণটা কিসের’।
আমাদের স্টাইলিশ বন্ধুটির কথা শুনে আমরা বাকী তিন বন্ধু কিছুটা রাগে কিছুটা অনুরাগে সমস্বরে বলে উঠলাম, ‘তাহলে তুই-ই বল এই পাগল করা গন্ধটার উৎসটা কোথায়’।
স্টাইলিশ বন্ধু এবার বললো, ‘বাতাসে ভেসে আসা এই গন্ধটা আর কিছু নয়। এই গন্ধটা হচ্ছে ছাতিম ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ। আমরা যেখানে বসে আছি তার পাশেই-তো ছাতিম গাছটা দাঁড়িয়ে আছে’।
আমরা চারবন্ধু স্টাইলিশ বন্ধুটার কথা শুনে পাশের ছাতিম গাছটার দিকে তাকালাম। দেখলাম সেখানে কেবল ছাতিম গাছ নয়, আমাদের সাথে যে সুগন্ধী নারীটি আড্ডা দিচ্ছিলো, সেই সুগন্ধী রূপবতী শ্যামলী নারীর ছায়াটি যেন জীবন্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে আমরা চারবন্ধু যেন এক ধাঁধার মঝে আটকে যাই। আমরা বুঝতে পারছি না ছাতিম গাছটা কি শ্যামল রমণী হয়ে গেছে, না কি শ্যামল রমণী ছাতিম গাছ হয়ে গেছে। সবচেয়ে বড় কথা আমারা যে পাগল করা মাদকীয় ঘ্রাণ পাচ্ছি তার উৎসের ব্যাখ্যাটাই বা-কি।
কবি, গল্পকার ও আইনজীবী
সূএ:পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম