শায়লা জাবীন :
মনোচিকিৎসক পারিজাত রহমান। চেম্বারে বসে রোগীর ফাইলে চোখ বুলাচ্ছেন। সামনে এক ভদ্রলোক বসা। নাম সিফাত রহমান। বয়স ৩৮ হবে, বিবাহিত। চাকরিজীবী।
আজই প্রথম এসেছেন তার কাছে। চুপচাপ বসে রয়েছেন। নিজের দু’হাত কোলের ওপর রেখে নিজের হাতের আঙুলের দিকেই তাকিয়ে রয়েছেন। সিফাতের ফাইল থেকে চোখ তুলে পারিজাত রহমান বললেন, কেমন আছেন?
জ্বী ভালো না। ভালো থাকলে তো কেউ মনোচিকিৎসকের কাছে আসে না।
পারিজাত মনে মনে একটু অবাকই হলেন, সচরাচর কাউকে কুশল জিজ্ঞাসা করলে ভালোই বলেন সবাই, তার মানে সিফাত বেশ স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড , যেটা একদিক দিয়ে ভালো।
আমি আপনাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
জ্বী, আমার স্ত্রীর নাম জাফিরা হক, ৯ বছর হলো বিয়ে হয়েছে। দুইটা বাচ্চাও আছে, সাত বছর হলো আমরা অস্ট্রেলিয়া এসেছি।
আমি ফুলটাইম প্রফেশনাল জব করি প্রাইভেট সেক্টরে আইটিতে।
জাফিরা একটা চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে জব করে। আমাদের মোটামুটি সেটেল ম্যারেজ। দুইপক্ষের উদ্যোগেই বিয়ের আগে ২/৩ বার দেখা করেছিলাম বাইরে। প্রায় ৩/৪ মাস ফোনে কথা হয়েছে। এরপর বিয়ে হয়ে যায়।
আচ্ছা,বলুন…তারপর
সমস্যা হলো; জাফিরা এবং তার মা বোন!
বাংলাদেশেও আমি ভালো চাকরি করতাম, বলতে পারেন তার মা-বোনের যন্ত্রণা থেকে বাঁচতেই স্কিল মাইগ্রেশন নিয়ে অস্ট্রেলিয়া এসেছি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, আমি বুঝতে পারছি সমস্যা যত না জাফিরার মা, বোনের তার চেয়ে অনেক বেশি জাফিরার,
যা দিন দিন বাড়ছেই।
আমি বহু চেষ্টা করেছি, অনেক বুঝিয়েছি। জানি না আমার বোঝানোর পদ্ধতি সঠিক ছিল কিনা। কিন্তু জাফিরা একদমই প্যাকেজ প্রোগ্রাম। আমার সংসারে আমার কোথাও কোনো ভূমিকা নেই শুধু টাকা ইনকাম করা ছাড়া। এছাড়া বাচ্চাদের দেখভাল, বাসা ভাকুয়াম, লন মো বাজার করা ইত্যাদিসহ জাফিরা যা বলবে সবকিছু শুনতে হবে। না শুনলেই সমস্যা, ঝগড়া-ঝাটি, অশান্তি, ভাঙচুর,কথা বন্ধ।
আমার এখন সবকিছু ফেলে পালাতে ইচ্ছে করে। নিজের জীবন নিজেরই অসহ্য লাগে। কি করবো বুঝি না। তাই আপনার কাছে আসা।
কি করেন জাফিরা এবং তার মা বোন? যদি একটু বিস্তারিত বলতেন বা দুই একটা উদাহরণ দেন তাহলে বুঝতে সুবিধা হতো।
সিফাত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো… কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, কি করে না? তারাই তো সব করে। বিয়ে করেছিলাম কত স্বপ্ন নিয়ে। সংসার হবে, হাসি, আনন্দ-দুঃখ-বেদনা সবই থাকবে তার সঙ্গে থাকবে মায়া, ভালোবাসা।
কিন্তু বিয়ের পরদিন থেকেই দেখছি, আমরা কি খাবো, কি পরবো, কোথায় যাবো, কখন ঘুমাবো, কখন উঠবো, কার সঙ্গে মিশবো, কাদের বাসায় যাব, কাদের দাওয়াত দেব, কি বাজার করবো, কাকে কত টাকার উপহার দেবো, কবে বাচ্চা নেবো, সেই বাচ্চা কীভাবে পালবো, হলিডেতে কোথায় যাবো, অসুস্থ হলে কোনো চিকিৎসক দেখাবো ইত্যাদি সবকিছুই জাফিরার মা সিদ্ধান্ত নেবেন।
ক্ষেত্র-বিশেষে তার বোন এবং জাফিরা সেগুলোর অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে এবং আমাকেও মেনে চলতে বাধ্য করে। আমি কোনো কিছু নিয়ে কিছু বলতে চাইলেই ভয়াবহ চিৎকার চেঁচামেচি, অকথ্য ভাষায় গালাগালি। আমি কিছু নাকি জানি না, বুঝি না। আনকালচারড।
তার মা যা বলে তা সব আমাদের ভালোর জন্য বলে। মেয়ের সংসার বলে কত উপকার করে, তার বোন পৃথিবীতে সবচেয়ে গুণবতী, রূপবতী নারী, এমনকি ঐশ্বরিয়া রায় ও নাকি খালি ফর্সা, অত সুন্দর না! কিন্তু তার বোন সুন্দর আর গুণের ট্রেন। বাদ বাকি পৃথিবীর সব মেয়েরা আমড়া কাঠের ঢেঁকি।
এসব কতদিন ভালো লাগে বলেন?
সারাদিনে দুই থেকে তিনবার জাফিরা তার মা আর বোনের সঙ্গে ফোনে, ভিডিওকলে কথা বলে, আচ্ছা বলুক। কিন্তু তারা যা বলেন সেই মোতাবেক আমার সংসার চলে। এমনকি আমি কোথায় বাড়ি কিনবো, কি ফার্নিচার কিনবো বাচ্চারা কোন স্কুলে যাবে, পাবলিক/প্রাইভেট/ইসলামিক এগুলোও।
আমি জাফিরাকে অনেক বুঝিয়েছি, অনেকবার বলেছি। এটা আমাদের দুজনের সংসার, যেকোনো সিদ্ধান্ত আমরা দু’জনে মিলে নেব, সবকিছুই কেন তোমার মা-বোনকে বলো? তারা তাদের সংসার করুক। সেখানে তো আমরা মাথা ঘামাই না।
কিন্তু জাফিরা কিছুই বুঝতে চায় না, কান্নাকাটি, অকথ্য ভাষায় গালাগালি। এমন ভাষা যে আপনাকে বলতেও খারাপ লাগছে। এমন মোমের পুতুল মার্কা সংসার তো আমি চাইনি, যেখানে আমি দিনরাত কষ্ট করবো কিন্তু আমার কোনো কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নাই।
বুঝতে পেরেছি। আপনার মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে জাফিরার সম্পর্ক কেমন?
উপরে উপরে ভালো, বেশ মিষ্টি। ভেতরে নিম তিতা।
যেমন?
আমার আম্মা খুবই নিরীহ মানুষ। আমাদের সংসার নিয়ে সে কোনো কথাই বলেন না, সেই সুযোগও নেই। আম্মা একবার এসেছিল অস্ট্রেলিয়া বছর চারেক আগে, কোনো অর্ডার আদেশ তো করেইনি বরং তিনি এসে রান্নাবান্না, কাপড় গোছানো, বাচ্চাদের খাওয়ানো, বাগানের কাজে জাফিরাকে হেল্প করছে।
কিন্তু জাফিরার সেখানেও সমস্যা
কেন?
কেন আমার মা এতকিছু করে?
শ্বাশুড়ি এত কাজ করলে কি ছেলের বউ হয়ে বসে থাকা যায়? সে তার প্রিয় টিভি সিরিয়াল দেখতে পারে না, আমার আম্মার সঙ্গে বসে বসে কাজ করতে হয়। অন্য ভাবিদের শাশুড়িরা বেড়াতে এসে নাকি খালি এটা খাব। ওটা বানাও বলে অর্ডার করে আর শপিং করে বাড়ি ভরে ফেলে আর আমার আম্মা বলে ক্ষেত, কাজের বুয়ার মতো খালি কাজ করে! আম্মা তো জাফিরা আর আমাকেই সহযোগিতা করতেন। যেন আমাদের কাজ থেকে ফিরে কম কাজ করতে হয়, এরপরেও এগুলো শুনতে কেমন লাগে বলেন?
আপনার ওয়াইফ কি আমার এখানে আসবেন?
প্রশ্নই ওঠে না। আমি আজকে আমার অফিস থেকে এসেছি এবং এই সেশন শেষে অফিসে ব্যাক করবো। জাফিরা যদি জানে যে আমি সাইকোলজিস্টের কাছে এসেছি বাসায় কেয়ামত হয়ে যাবে। আমার সামনেই তার মা-বা-বোনকে ফোন করে সব বলে দিয়ে আর এক বিশ্রী নাটক তৈরি করবে।
আচ্ছা, আপনি এখন কি চান?
আমি এসব থেকে নিস্তার চাই। আমার বুদ্ধিতে আমি ফেইল, তাই আপনার কাছে অনেক আশা নিয়ে এসেছি, আপনি যেহেতু আমাদের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসেছেন হয়তো ভালো বলতে পারবেন আমি এখন কি করবো?
জাফিরা অসম্ভব টিপিক্যাল একটা মেয়ে। এখানকার কোনো বাসার দাওয়াতে গেলেও সে হাত পা নেড়ে তার মায়ের প্রশংসা শুরু করে শেষ করে বোনের গুণকীর্তন দিয়ে অথবা বোনের গুণাবলী দিয়ে শুরু হয় এবং তার মা কি বলেছেন তা দিয়ে শেষ হয়।
আপনার সঙ্গে আপনার শ্বশুরবাড়ির সদস্যদের সম্পর্ক কেমন?
আমার সঙ্গে ভালো, আমার সাথে কথা যদিও খুবই কম হয়। তারা এমনিতে মানুষ খারাপ না। কিন্তু হাতে প্রচুর সময়। অন্যের সংসারে অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ করেন। কোথায় থামতে হবেন বুঝে উঠতে পারেন না বলে আমার মনে হয়। আর আমার শ্বশুরের অবস্থা আমার মতোই, তার বাসায় কোনো ভয়েস নাই, সব সিদ্ধান্ত নেয় আমার শাশুড়ি।
আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক কেমন?
এটা একটা জটিল প্রশ্ন। উত্তর ভালো, মন্দ দুটোই। সম্পর্ক ভালো কারণ আমি প্রতি মুহূর্তে স্যাক্রিফাইস করছি, মেনে নিচ্ছি, সংসারের স্বার্থে কিন্তু শান্তি পাচ্ছি না কিছুতেই।
ভেতরে ভেতরে মেনে নিতে নিতে এখন নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। ব্লাড প্রেসার হাই, মন ভালো লাগে না। কোথাও বেড়াতে যেতে বা নতুন সার্ট প্যান্ট কোনোকিছুই ভালো লাগে না। মাঝে মাঝে জাফিরা কেউ অসহ্য লাগে। এত অবুঝ। সিম্পল একটা কথা বলেছিলাম যে তোমার মা-বোন তো এখানে থাকেন না, তুমি না বললে ওনারা এসব জানেন কিভাবে? না বললেই হয়।
জিনিসপত্র সব ছুড়ে ফেলে জঘন্য, গালাগালি চলতেই থাকে। বাচ্চাগুলো ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে। অথচ জাফিরা পুরো আউট অব অর্ডার। আমি বলে নিমকহারাম, তার মা আমাকে এত পছন্দ করেন, আমি বেড়াতে গেলে বড় মাছ সেরা পেটি, ছাগলের ঠ্যাং নিজের মেয়েকে না খাওয়ায়ে আমাকে খাওয়ায় তবুও আমি এমন করি, তাদের দেখতে পারি না! ইত্যাদি।
আচ্ছা বলেন তো বাংলাদেশের মায়েরা এমন কেন? মেয়ে তো তাদের, সেরাটা তো মেয়েকেই খাওয়ানো উচিত, মেয়ে জামাইকে খাওয়াতে হবে কেন? আমি তো বলিনি আমাকে খাওয়াতে, তারপরে আবার সেই খোঁচা ও দিতে!
পারিজাত রহমান হাসছেন, হেসে বললেন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মায়েরা মেয়ের চেয়ে মেয়ে জামাইকে গুরুত্ব দিয়ে আসলে নিজের মেয়েরই ক্ষতি করেন কিন্তু তারা সেটা বোঝেন না, ভাবেন মেয়ে জামাইকে বেশি আদর যত্ন করলে মনে হয় মেয়েকে জামাই অনেক সুখে শান্তিতে রাখবেন!
এই কাগজে কিছু প্রশ্ন লেখা আছে, আপনি অনুগ্রহ করে আপনার ফ্রি সময়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে উত্তর লিখবেন, আমাকে উত্তরগুলো ইমেইল করতে পারেন। বা উত্তরগুলো লিখে পরের সেশনে নিয়ে আসেন প্লিজ। ধন্যবাদ আমার এখানে আসার জন্য।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ ধৈর্য্য নিয়ে আমার এসব শোনার জন্য, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন কাউকে বলতে পারছিলাম না। আবার নিজের ভেতরেও মেনে নিতে পারছি না।
সিফাত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে কাগজটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। সূএ : জাগোনিউজ২৪.কম