সেলাই করা খোলা মুখ ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক…’

ছবি সংগৃহীত

 

মোফাজ্জল করিম :আজকাল টিভি চ্যানেলগুলোতে একটা সংবাদ সারাদিন, সারারাত একটু পরপরই প্রচারিত হচ্ছে। এতে না সংবাদ পরিবেশকরা, না দর্শকরা বিরক্তবোধ করেন, না কোনো মহল থেকে কোনো প্রতিবাদ বা সমালোচনা শোনা যায়। গত বেশ কিছুদিন যাবৎ এটা চলে আসছে। সংবাদটি হচ্ছে, ইসরাইল কর্তৃক গাজায় বোমা মেরে রোজ শত শত ফিলিস্তিনি নিধন।

 

গত এক বছরে প্রায় অর্ধলাখ নিরীহ নিরস্ত্র আবালবৃদ্ধবনিতা ইসরাইলি বিমান আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। এঁরা সবাই বেসামরিক নাগরিক। আক্রমণকারীরা যেন বেছে বেছে সাধারণ মানুষকে টার্গেট করছে। এমনকি হাসপাতালগুলোও বাদ যাচ্ছে না।

 

টিভি চ্যানেলে আমরা একদিকে দেখছি বোমা-আক্রমণের ধ্বংসলীলা, আর তার পাশাপাশি অগণিত লাশের দাফন-কাফনের জন্য জীবিতদের আকুল প্রচেষ্টা। টিভির পর্দায় এ দৃশ্য প্রতিদিনের। যেন পরিচালক এই চিত্রনাট্য পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে রাজি নন! তা না হয় হলো। বুঝলাম এটাই গাজাবাসীর বিধিলিপি।

 

ইহুদিদের হাতে তারা নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত এই দৃশ্যই দেখে যেতে হবে টিভির পর্দায়। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সবই কি লোপ পেয়েছে? তাদের মুখপাত্র জাতিসংঘ এবং কোনো কোনো বিশ্বমোড়ল মাঝে মাঝে এক-আধটা বাণী দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (৫ নভেম্বর) শেষ মুহূর্তে একজন প্রধান প্রার্থী (কমলা হ্যারিস) যা হোক তবু এ বিষয়ে ছোট্ট করে হলেও একটু জবান খুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে গাজার যুদ্ধ থামাবেন। ভালো কথা। কিন্তু তিনি ও তাঁর বস জো বাইডেন সাহেব তো এতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ থামাতে বলেননি তাঁদের সাঙাত নেতানিয়াহুকে।

 

সবাই জানে নেতানিয়াহু সাহেব কাদের মদদ পেয়ে নেতা হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র যদি এই মিয়াকে বলে ‘খেল খতম, পয়সা হজম, যাও বাচ্চা সো রহো’, তাহলে এই বাচ্চার আর এক মিনিটও যুদ্ধ চালানোর তাকত থাকবে না। তবে নেতানিয়াহুর এই মুরব্বি এটা বলার আগে দশবার চিন্তা করবেন। কারণ তাঁর দেশের এত বিশালকায় অর্থনীতি যাদের কাঁধের ওপর ভর করে আছে, তারা তো সবাই নেতানিয়াহু মিয়ার সহোদর ভ্রাতা—ইহুদি। তাই বলছিলাম কি, কমলা নির্বাচনে জিতলেই কি যুদ্ধ থামাতে পারতেন? আর তা ছাড়া দুনিয়ার যেখানেই যুদ্ধ-টুদ্ধ হোক সেখানে মার্কিন সমরাস্ত্র, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি ছাড়া কি যুদ্ধ হয়? তাই নানা হিসাব-নিকাশের পর আমার ধারণা, কেউ যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে চানও তবু তা হবে কাকস্য পরিবেদনা। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ থেমে গেলে বেচারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে না খেয়ে মরতে হবে।

 

এদিকে সম্প্রতি গাজা-যুদ্ধের একটা নতুন দিক উন্মোচিত হওয়ার খবর জানা গেল। যে ইহুদিরা হররোজ কয়েক শ মুসলিম নিধনের খবর না শুনে শুতে যায় না, তারা নাকি রাজধানী তেল আবিবে যুদ্ধবিরতির পক্ষে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এবং ধীর লয়ে হলেও তাদের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নাকি ক্রমেই বিস্তারলাভ করছে। বিষয়টা কী? ইসরাইলিরা হঠাৎই বেহেড মাংসাশী থেকে একেবারে নিরামিষাশী হয়ে গেল যে বড়? বিষয় আর কিছুই না। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ হওয়ার বিপরীতে দু’চারজন ইহুদির লাশও যে পড়ে না এমন নয়। তা ছাড়া গাজার কারাগারে কিছুসংখ্যক ইসরাইলি বন্দী আছে, যাদের মুক্তির জন্য মাঝে মাঝেই তেল আবিবের পথে-ঘাটে মিটিং-মিছিল হয়। নেতানিয়াহু সাহেবের সরকারের জন্য এটা একটা বিষফোঁড়া। আন্দোলনকারীরা সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে : চাই না এমন যুদ্ধ। বন্ধ করো যুদ্ধ, ফেরত আনো আমাদের সন্তানদের। এই ইস্যুতে নেতানিয়াহুর নেতাগিরি নাকি বড় রকমের হুমকির মুখে।

 

ফিলিস্তিন তথা সমগ্র আরববিশ্বের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে এটা একটা দারুণ প্লাস পয়েন্ট। এটাকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের এই জাতশত্রুকে একেবারে কুপোকাত করতে না পারলেও তার জাতীয় ঐক্যের মাজা ভেঙে দিতে পারে। আর ঐক্য নাই তো যত বড় হিরোও হও না কেন, আসলে তুমি একটা জিরো। অবশ্য আরবদের ঐক্যের ব্যাপারে সবক দেওয়ার কিছু নেই। অর্থনৈতিকভাবে এত শক্তিশালী আরবদের এই একটি বিষয়ে দারুণ কমতি থাকার কারণে বর্তমান বিশ্বের মোড়লরা তাদের অপাঙক্তেয় মনে করে। আরবরা যদি একটিবার ঐক্যবদ্ধভাবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত, তাহলে ইসরাইলের সাধ্য ছিল না গাজাতে এই নরমেধযজ্ঞ চালিয়ে যায়। কিন্তু তা তো হবে না। ইসরাইলিরা ঠিকই জানে, ন’মণ তেলও হবে না, রাধাও নাচবে না।

 

আর বিশ্ববিবেক? ওটা তো মনে হয় গাজার ব্যাপারে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আশ্চর্য, প্রতিনিয়ত যে শত শত শিশু, জরাক্রান্ত বৃদ্ধবৃদ্ধা, অসহায় নারীপুরুষ মারা যাচ্ছে, তাতে এই কুম্ভকর্ণের মোটেই নিদ্রাভঙ্গ হচ্ছে না। যেন গাজার এই নিরীহ নিষ্পাপ আদমসন্তানগুলোর জন্য কারো কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এটা যদি গাজা না হয়ে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো শহর-বন্দর-গ্রাম হতো, তাহলে কল্পনা করুন বিশ্বব্যাপী কী রকম প্রতিবাদের ঝড় উঠত, মারমার কাটকাট করে ছুটে আসত ছোট-বড় সবাই। আর বড় মিয়ারা চোখমুখ বুজে থাকলে আমাদের মতো গরিব-নাচাররা আগ বাড়িয়ে কিছু বলার বা করার প্রশ্নই আসে না। সেই ইংরেজি প্রবাদবাক্যটা এসব ব্যাপারে সবাই মেনে চলে : ‘ফুলস্ রাশ ইন হোয়্যার অ্যাঞ্জেলস্ ফিয়ার টু ট্রেড’ (‘দেবদূতেরা যেখানে পা বাড়াতে সাহস পায় না, সেখানে বোকারাই দ্রুত ছুটে যায়’।)

 

কেন জানি আজকাল আমার মনে হয় মানুষের মন থেকে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার মতো সুকুমার বৃত্তিগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। তা না হলে যে মানুষটি গণজমায়েতে বা মিছিলে গুলি মেরে মানুষ হত্যা করে দিব্যি নির্বিকার থাকতে পারে, রাতে বাড়ি ফিরে নাওয়া-খাওয়া সেরে আয়েশ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে প্রিয় টিভি সিরিয়াল দেখতে পারে বৌ-বাচ্চা নিয়ে, কোলে বসা শিশুটিকে আদরে আদরে ভাসিয়ে দিতে পারে, সে কীভাবে এ রকম ভাবলেশহীন থাকতে পারে? যেন একটু আগে সে গুলি মেরে আরেক মা-বাবার স্বপ্নের ধনকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়নি—যেন ওটা ছিল ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহক একটি মশা। যেন ওটাকে ধ্বংস করে বিরাট এক পুণ্যের কাজ করেছে সে। আর তার নিয়ন্ত্রক হাজার হাজার অপকর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে, ১৭ কোটি মানুষকে ‘শোকসাগরে ভাসিয়ে’, হেলিকপ্টারে চড়ে ‘বাই বাই টা টা’ জানিয়ে পগারপার হয়ে গেলেন। একবারও এই ‘মূঢ় ম্লান মূক মুখের’ মানুষগুলোর কথা ভেবে দেখলেন না। এমনকি তাঁর অগণিত হুকুমবরদারের কথাও না।

 

একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পার করে এসে আমরা, এই গ্রহের মানুষেরা, কোথায় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পরস্পর পরস্পরকে কাছে টেনে নেব ভালোবাসার বন্ধনে তা না, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’, এবং তার ‘নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’ থেকে মুক্তির জন্য আকুল প্রার্থনা করে গেছেন (‘শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য,/করুণাঘন, ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য’) তাই আমাদের ললাটলিখন হয়ে রইল। আর কবিগুরুর সমসাময়িক আমাদের লালমনিরহাটের কবি শেখ ফজলুল করিম বলে গেছেন : ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেই সুরাসুর। রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়/আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনই পুড়িতে হয়।’… আর তারপরই কবি তাঁর অমর বাণী উচ্চারণ করেছেন এই ভাবে : ‘প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মিলি যবে পরস্পরে/স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়েঘরে’।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

[email protected]    সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» সোহরাওয়ার্দী আমৃত্যু আইনের শাসন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন

» বাংলাদেশ নয় বরং ভারতে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন জরুরি: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

» আসছে শৈত্যপ্রবাহ

» ভারতীয় শাড়ি রাস্তায় ছুড়ে আগুনে পোড়ালেন রিজভী

» ভারতীয় নাগরিক আটক

» এনফিল্ডসহ কোটি টাকার ভারতীয় পণ্য জব্দ

» আইনজীবী সাইফুল হত্যার প্রধান আসামি চন্দন গ্রেপ্তার

» লেবানন থেকে দেশে ফিরেছেন আরো ৬৫ জন

» ডিজিটাল অ্যারেস্ট থামাতে ৫৯ হাজার হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট ব্লক

» টি-টোয়েন্টিতে নতুন বিশ্বরেকর্ড, ২০ ওভারে উঠল ৩৪৯ রান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সেলাই করা খোলা মুখ ‘কোথায় স্বর্গ, কোথায় নরক…’

ছবি সংগৃহীত

 

মোফাজ্জল করিম :আজকাল টিভি চ্যানেলগুলোতে একটা সংবাদ সারাদিন, সারারাত একটু পরপরই প্রচারিত হচ্ছে। এতে না সংবাদ পরিবেশকরা, না দর্শকরা বিরক্তবোধ করেন, না কোনো মহল থেকে কোনো প্রতিবাদ বা সমালোচনা শোনা যায়। গত বেশ কিছুদিন যাবৎ এটা চলে আসছে। সংবাদটি হচ্ছে, ইসরাইল কর্তৃক গাজায় বোমা মেরে রোজ শত শত ফিলিস্তিনি নিধন।

 

গত এক বছরে প্রায় অর্ধলাখ নিরীহ নিরস্ত্র আবালবৃদ্ধবনিতা ইসরাইলি বিমান আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন। এঁরা সবাই বেসামরিক নাগরিক। আক্রমণকারীরা যেন বেছে বেছে সাধারণ মানুষকে টার্গেট করছে। এমনকি হাসপাতালগুলোও বাদ যাচ্ছে না।

 

টিভি চ্যানেলে আমরা একদিকে দেখছি বোমা-আক্রমণের ধ্বংসলীলা, আর তার পাশাপাশি অগণিত লাশের দাফন-কাফনের জন্য জীবিতদের আকুল প্রচেষ্টা। টিভির পর্দায় এ দৃশ্য প্রতিদিনের। যেন পরিচালক এই চিত্রনাট্য পরিবর্তন-পরিমার্জন করতে রাজি নন! তা না হয় হলো। বুঝলাম এটাই গাজাবাসীর বিধিলিপি।

 

ইহুদিদের হাতে তারা নিশ্চিহ্ন না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববাসীকে প্রতিনিয়ত এই দৃশ্যই দেখে যেতে হবে টিভির পর্দায়। কিন্তু পৃথিবীর মানুষের বিবেক-বুদ্ধি সবই কি লোপ পেয়েছে? তাদের মুখপাত্র জাতিসংঘ এবং কোনো কোনো বিশ্বমোড়ল মাঝে মাঝে এক-আধটা বাণী দিয়েই কি তাদের দায়িত্ব শেষ মনে করেন? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের (৫ নভেম্বর) শেষ মুহূর্তে একজন প্রধান প্রার্থী (কমলা হ্যারিস) যা হোক তবু এ বিষয়ে ছোট্ট করে হলেও একটু জবান খুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি নির্বাচিত হলে গাজার যুদ্ধ থামাবেন। ভালো কথা। কিন্তু তিনি ও তাঁর বস জো বাইডেন সাহেব তো এতদিন পর্যন্ত যুদ্ধ থামাতে বলেননি তাঁদের সাঙাত নেতানিয়াহুকে।

 

সবাই জানে নেতানিয়াহু সাহেব কাদের মদদ পেয়ে নেতা হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র যদি এই মিয়াকে বলে ‘খেল খতম, পয়সা হজম, যাও বাচ্চা সো রহো’, তাহলে এই বাচ্চার আর এক মিনিটও যুদ্ধ চালানোর তাকত থাকবে না। তবে নেতানিয়াহুর এই মুরব্বি এটা বলার আগে দশবার চিন্তা করবেন। কারণ তাঁর দেশের এত বিশালকায় অর্থনীতি যাদের কাঁধের ওপর ভর করে আছে, তারা তো সবাই নেতানিয়াহু মিয়ার সহোদর ভ্রাতা—ইহুদি। তাই বলছিলাম কি, কমলা নির্বাচনে জিতলেই কি যুদ্ধ থামাতে পারতেন? আর তা ছাড়া দুনিয়ার যেখানেই যুদ্ধ-টুদ্ধ হোক সেখানে মার্কিন সমরাস্ত্র, যুদ্ধবিমান ইত্যাদি ছাড়া কি যুদ্ধ হয়? তাই নানা হিসাব-নিকাশের পর আমার ধারণা, কেউ যদি যুদ্ধ বন্ধ করতে চানও তবু তা হবে কাকস্য পরিবেদনা। বাস্তবতা হচ্ছে, দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ থেমে গেলে বেচারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে না খেয়ে মরতে হবে।

 

এদিকে সম্প্রতি গাজা-যুদ্ধের একটা নতুন দিক উন্মোচিত হওয়ার খবর জানা গেল। যে ইহুদিরা হররোজ কয়েক শ মুসলিম নিধনের খবর না শুনে শুতে যায় না, তারা নাকি রাজধানী তেল আবিবে যুদ্ধবিরতির পক্ষে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। এবং ধীর লয়ে হলেও তাদের এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নাকি ক্রমেই বিস্তারলাভ করছে। বিষয়টা কী? ইসরাইলিরা হঠাৎই বেহেড মাংসাশী থেকে একেবারে নিরামিষাশী হয়ে গেল যে বড়? বিষয় আর কিছুই না। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ হওয়ার বিপরীতে দু’চারজন ইহুদির লাশও যে পড়ে না এমন নয়। তা ছাড়া গাজার কারাগারে কিছুসংখ্যক ইসরাইলি বন্দী আছে, যাদের মুক্তির জন্য মাঝে মাঝেই তেল আবিবের পথে-ঘাটে মিটিং-মিছিল হয়। নেতানিয়াহু সাহেবের সরকারের জন্য এটা একটা বিষফোঁড়া। আন্দোলনকারীরা সারাক্ষণ কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করছে : চাই না এমন যুদ্ধ। বন্ধ করো যুদ্ধ, ফেরত আনো আমাদের সন্তানদের। এই ইস্যুতে নেতানিয়াহুর নেতাগিরি নাকি বড় রকমের হুমকির মুখে।

 

ফিলিস্তিন তথা সমগ্র আরববিশ্বের জন্য ইসরাইলের বিরুদ্ধে এটা একটা দারুণ প্লাস পয়েন্ট। এটাকে কাজে লাগিয়ে তারা তাদের এই জাতশত্রুকে একেবারে কুপোকাত করতে না পারলেও তার জাতীয় ঐক্যের মাজা ভেঙে দিতে পারে। আর ঐক্য নাই তো যত বড় হিরোও হও না কেন, আসলে তুমি একটা জিরো। অবশ্য আরবদের ঐক্যের ব্যাপারে সবক দেওয়ার কিছু নেই। অর্থনৈতিকভাবে এত শক্তিশালী আরবদের এই একটি বিষয়ে দারুণ কমতি থাকার কারণে বর্তমান বিশ্বের মোড়লরা তাদের অপাঙক্তেয় মনে করে। আরবরা যদি একটিবার ঐক্যবদ্ধভাবে এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াত, তাহলে ইসরাইলের সাধ্য ছিল না গাজাতে এই নরমেধযজ্ঞ চালিয়ে যায়। কিন্তু তা তো হবে না। ইসরাইলিরা ঠিকই জানে, ন’মণ তেলও হবে না, রাধাও নাচবে না।

 

আর বিশ্ববিবেক? ওটা তো মনে হয় গাজার ব্যাপারে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আশ্চর্য, প্রতিনিয়ত যে শত শত শিশু, জরাক্রান্ত বৃদ্ধবৃদ্ধা, অসহায় নারীপুরুষ মারা যাচ্ছে, তাতে এই কুম্ভকর্ণের মোটেই নিদ্রাভঙ্গ হচ্ছে না। যেন গাজার এই নিরীহ নিষ্পাপ আদমসন্তানগুলোর জন্য কারো কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এটা যদি গাজা না হয়ে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো শহর-বন্দর-গ্রাম হতো, তাহলে কল্পনা করুন বিশ্বব্যাপী কী রকম প্রতিবাদের ঝড় উঠত, মারমার কাটকাট করে ছুটে আসত ছোট-বড় সবাই। আর বড় মিয়ারা চোখমুখ বুজে থাকলে আমাদের মতো গরিব-নাচাররা আগ বাড়িয়ে কিছু বলার বা করার প্রশ্নই আসে না। সেই ইংরেজি প্রবাদবাক্যটা এসব ব্যাপারে সবাই মেনে চলে : ‘ফুলস্ রাশ ইন হোয়্যার অ্যাঞ্জেলস্ ফিয়ার টু ট্রেড’ (‘দেবদূতেরা যেখানে পা বাড়াতে সাহস পায় না, সেখানে বোকারাই দ্রুত ছুটে যায়’।)

 

কেন জানি আজকাল আমার মনে হয় মানুষের মন থেকে প্রেম-প্রীতি-ভালোবাসার মতো সুকুমার বৃত্তিগুলো ধীরে ধীরে লোপ পাচ্ছে। তা না হলে যে মানুষটি গণজমায়েতে বা মিছিলে গুলি মেরে মানুষ হত্যা করে দিব্যি নির্বিকার থাকতে পারে, রাতে বাড়ি ফিরে নাওয়া-খাওয়া সেরে আয়েশ করে সোফায় হেলান দিয়ে বসে প্রিয় টিভি সিরিয়াল দেখতে পারে বৌ-বাচ্চা নিয়ে, কোলে বসা শিশুটিকে আদরে আদরে ভাসিয়ে দিতে পারে, সে কীভাবে এ রকম ভাবলেশহীন থাকতে পারে? যেন একটু আগে সে গুলি মেরে আরেক মা-বাবার স্বপ্নের ধনকে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে নেয়নি—যেন ওটা ছিল ডেঙ্গু রোগের জীবাণুবাহক একটি মশা। যেন ওটাকে ধ্বংস করে বিরাট এক পুণ্যের কাজ করেছে সে। আর তার নিয়ন্ত্রক হাজার হাজার অপকর্মের বোঝা মাথায় নিয়ে, ১৭ কোটি মানুষকে ‘শোকসাগরে ভাসিয়ে’, হেলিকপ্টারে চড়ে ‘বাই বাই টা টা’ জানিয়ে পগারপার হয়ে গেলেন। একবারও এই ‘মূঢ় ম্লান মূক মুখের’ মানুষগুলোর কথা ভেবে দেখলেন না। এমনকি তাঁর অগণিত হুকুমবরদারের কথাও না।

 

একবিংশ শতাব্দীর সিকি ভাগ পার করে এসে আমরা, এই গ্রহের মানুষেরা, কোথায় হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে পরস্পর পরস্পরকে কাছে টেনে নেব ভালোবাসার বন্ধনে তা না, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’, এবং তার ‘নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’ থেকে মুক্তির জন্য আকুল প্রার্থনা করে গেছেন (‘শান্ত হে, মুক্ত হে, হে অনন্ত পুণ্য,/করুণাঘন, ধরণীতল কর কলঙ্কশূন্য’) তাই আমাদের ললাটলিখন হয়ে রইল। আর কবিগুরুর সমসাময়িক আমাদের লালমনিরহাটের কবি শেখ ফজলুল করিম বলে গেছেন : ‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক কে বলে তা বহুদূর/মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক মানুষেই সুরাসুর। রিপুর তাড়নে যখনি মোদের বিবেক পায় গো লয়/আত্মগ্লানির নরক-অনলে তখনই পুড়িতে হয়।’… আর তারপরই কবি তাঁর অমর বাণী উচ্চারণ করেছেন এই ভাবে : ‘প্রীতি ও প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মিলি যবে পরস্পরে/স্বর্গ আসিয়া দাঁড়ায় তখন আমাদের কুঁড়েঘরে’।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি

[email protected]    সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com