সিগন্যালে সিগন্যালে হিজড়া ভিক্ষুক আতঙ্কিত যাত্রীরা

ঢাকার বিভিন্ন সিগন্যালে দাঁড়িয়ে হিজড়া সদস্যদের ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। রাজধানীর প্রায় সব সিগন্যালে গাড়ি থামলেই তারা হামলে পড়ছে। এ অবস্থায় আতঙ্কিত যাত্রীরা। কেন রাস্তায় ভিক্ষায় নেমেছে তারা? এ নিয়ে কথা হয় রাজধানীর বিজয় সরণি, বাংলামোটর ও কাকরাইলের মোড়ে ভিক্ষা করতে আসা কয়েকজন হিজড়ার সঙ্গে। তাদের একজন নন্দিনী। তার স্বপ্ন ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেস্তে যায় ১২ বছর বয়সে। তখন তিনি শারীরিক পরিবর্তন উপলব্ধি করেন।

পরে বিষয়টি মাকে জানান। তখন পরিবারের সকলে বিষয়টি জানতে পারে। মা-বাবার আদর না কমলেও কটূক্তি ও কটুদৃষ্টির শিকার হতে হয় অন্যদের কাছ থেকে। ভাইবোন, সহপাঠী ও বন্ধুরা তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ বছর বয়সে ঘর ছাড়তে হয় নন্দিনীর।

নন্দিনী বলেন, প্রথমে আমার নিজ জেলা ফরিদপুরে শিশুদের নাচিয়ে কিছু বকশিশ নিতাম। আর দোকানপাট থেকে কিছু টাকা উঠাতাম। কিন্তু দিন দিন হিজড়ার সংখ্যা বাড়ছিল। এ জন্য ফরিদপুরে আগের মতো টাকা উঠাতে পারতাম না। তখন আমরা কয়েকজন মিলে ঢাকায় চলে আসি। আমি ৫ বছর ধরে ঢাকায় আছি। প্রথমে বিভিন্ন অফিসে ও বাসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা উঠাতাম। কিন্তু তারা এখন আর সেভাবে টাকা দিতে চায় না। বিভিন্ন অফিসে গেলেও সেভাবে সাড়া পাওয়া যায় না। জোর করলেও বেশি টাকা দেয় না। এ জন্য আমরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছি।

বিজয় সরণির মোড়ে ভিক্ষা করতে আসা হিজড়া রিনা খান হচ্ছে তার পরিবারের প্রথম সন্তান। বাবা-মায়ের সবচেয়ে আদরের মেয়ে ছিলেন। কিন্তু সেই আদর বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয়নি সমাজ। মা-বাবার কাছ থেকে তাকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপরই স্বেচ্ছায় বাসা থেকে চলে আসেন। দুই ভাই ও এক বোনের কারও সঙ্গেই তার আর যোগাযোগ নেই। কেউ খোঁজও রাখে না রিনার। রিনা খান বলেন, করোনার আগে আমাদের রাস্তায় টাকা উঠানো লাগতো না। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে রাস্তার সিগন্যালে টাকা উঠাতে হচ্ছে। কারণ অফিসে গেলে এখন আর কেউ টাকা দিতে চায় না। সবাই সমস্যার কথা বলে। কেউ আবার জোর করে তাড়িয়ে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকেও আমাদেরকে কোনো সাহায্য করা হয় না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের এটা ছাড়া উপায় নেই।

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ভিক্ষা করতে আসা শিলা বলেন, ভিক্ষা করতে আমার ইচ্ছে হয় না। একটা মানুষ তখনই ভিক্ষা করে, যখন তার করার আর কিছু থাকে না। আমাদেরকে যদি সহায়তা দেয়া হতো তাহলে আমরা ভিক্ষা করতাম না। শুধু বিজয় সরণি ও কাকরাইল মোড় নয়। মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক থেকে শুরু করে ঢাকার বিভিন্ন সিগন্যালে এখন হিজড়াদের উৎপাত বাড়ছে। সিগন্যালে রিকশা, গাড়ি থামলেই দল বেঁধে হিজড়া সদস্যরা গিয়ে হাত পাতে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করার কাজ করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ ছাড়া তাদের শিক্ষা সহায়তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের সাতটি জেলার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বাজেটে ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তাদের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ গিয়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরেরও একই পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

অধিদপ্তর বলছে, পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়ানো ও কর্মক্ষমদের আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে সমাজের মূলধারায় ফেরানোর কাজও চলছে। যারা যে কাজে আগ্রহী তাদের ৫০ দিন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ৫০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বয়স্ক ভাতা বা বিশেষ ভাতা বাবত মাসিক ৬শ’ টাকা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাদেরকে বিনা সুদে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» অনেক সচিব এখনও নাশকতার চেষ্টা করছেন: রিজভী

» জাতিসংঘে বাংলাদেশের গণঅভ্যুত্থানের কথা তুলে ধরবেন ড. ইউনূস

» শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচারের আওতায় আনতে হবে : এ্যানি

» ইসলামপুরে বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা শিবির উদ্বোধন

» অতিরিক্ত তেল-মসলাদার খাবার খেলে শরীরে যা ঘটে

» বিএনপির ত্রাণ তহবিলে এখনও ৭ কোটি টাকা জমা রয়েছে : ডা. জাহিদ

» ট্রাকের ধাক্কায় ব্যাটারিচালিত অটো রিকশার দুই যাত্রী নিহত

» বসতবাড়িতে ঢুকে তিনজনকে কুপিয়ে জখম

» উপদেষ্টা নাহিদ সারাদেশে যে মামলা হয়েছে, এর অনেকগুলোই গ্রহণযোগ্য নয়

» আমরা কারও ওপর অন্যায়-অত্যাচার করবো না:সেলিমা রহমান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সিগন্যালে সিগন্যালে হিজড়া ভিক্ষুক আতঙ্কিত যাত্রীরা

ঢাকার বিভিন্ন সিগন্যালে দাঁড়িয়ে হিজড়া সদস্যদের ভিক্ষা করতে দেখা গেছে। রাজধানীর প্রায় সব সিগন্যালে গাড়ি থামলেই তারা হামলে পড়ছে। এ অবস্থায় আতঙ্কিত যাত্রীরা। কেন রাস্তায় ভিক্ষায় নেমেছে তারা? এ নিয়ে কথা হয় রাজধানীর বিজয় সরণি, বাংলামোটর ও কাকরাইলের মোড়ে ভিক্ষা করতে আসা কয়েকজন হিজড়ার সঙ্গে। তাদের একজন নন্দিনী। তার স্বপ্ন ছিল মানুষের জন্য কিছু করার। কিন্তু সেই স্বপ্ন ভেস্তে যায় ১২ বছর বয়সে। তখন তিনি শারীরিক পরিবর্তন উপলব্ধি করেন।

পরে বিষয়টি মাকে জানান। তখন পরিবারের সকলে বিষয়টি জানতে পারে। মা-বাবার আদর না কমলেও কটূক্তি ও কটুদৃষ্টির শিকার হতে হয় অন্যদের কাছ থেকে। ভাইবোন, সহপাঠী ও বন্ধুরা তার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দেয়। এমন পরিস্থিতিতে ১৫ বছর বয়সে ঘর ছাড়তে হয় নন্দিনীর।

নন্দিনী বলেন, প্রথমে আমার নিজ জেলা ফরিদপুরে শিশুদের নাচিয়ে কিছু বকশিশ নিতাম। আর দোকানপাট থেকে কিছু টাকা উঠাতাম। কিন্তু দিন দিন হিজড়ার সংখ্যা বাড়ছিল। এ জন্য ফরিদপুরে আগের মতো টাকা উঠাতে পারতাম না। তখন আমরা কয়েকজন মিলে ঢাকায় চলে আসি। আমি ৫ বছর ধরে ঢাকায় আছি। প্রথমে বিভিন্ন অফিসে ও বাসে থাকা যাত্রীদের কাছ থেকে টাকা উঠাতাম। কিন্তু তারা এখন আর সেভাবে টাকা দিতে চায় না। বিভিন্ন অফিসে গেলেও সেভাবে সাড়া পাওয়া যায় না। জোর করলেও বেশি টাকা দেয় না। এ জন্য আমরা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছি।

বিজয় সরণির মোড়ে ভিক্ষা করতে আসা হিজড়া রিনা খান হচ্ছে তার পরিবারের প্রথম সন্তান। বাবা-মায়ের সবচেয়ে আদরের মেয়ে ছিলেন। কিন্তু সেই আদর বেশিদিন স্থায়ী হতে দেয়নি সমাজ। মা-বাবার কাছ থেকে তাকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এরপরই স্বেচ্ছায় বাসা থেকে চলে আসেন। দুই ভাই ও এক বোনের কারও সঙ্গেই তার আর যোগাযোগ নেই। কেউ খোঁজও রাখে না রিনার। রিনা খান বলেন, করোনার আগে আমাদের রাস্তায় টাকা উঠানো লাগতো না। কিন্তু করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে রাস্তার সিগন্যালে টাকা উঠাতে হচ্ছে। কারণ অফিসে গেলে এখন আর কেউ টাকা দিতে চায় না। সবাই সমস্যার কথা বলে। কেউ আবার জোর করে তাড়িয়ে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকেও আমাদেরকে কোনো সাহায্য করা হয় না। এমন পরিস্থিতিতে আমাদের এটা ছাড়া উপায় নেই।

রাজধানীর কাকরাইল মোড়ে ভিক্ষা করতে আসা শিলা বলেন, ভিক্ষা করতে আমার ইচ্ছে হয় না। একটা মানুষ তখনই ভিক্ষা করে, যখন তার করার আর কিছু থাকে না। আমাদেরকে যদি সহায়তা দেয়া হতো তাহলে আমরা ভিক্ষা করতাম না। শুধু বিজয় সরণি ও কাকরাইল মোড় নয়। মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক থেকে শুরু করে ঢাকার বিভিন্ন সিগন্যালে এখন হিজড়াদের উৎপাত বাড়ছে। সিগন্যালে রিকশা, গাড়ি থামলেই দল বেঁধে হিজড়া সদস্যরা গিয়ে হাত পাতে।

সমাজসেবা অধিদপ্তর বলছে, বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মূলধারায় এনে দেশের সার্বিক উন্নয়নে তাদের সম্পৃক্ত করার কাজ করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে তাদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি দেয়া হয়। এ ছাড়া তাদের শিক্ষা সহায়তার পাশাপাশি কর্মসংস্থান, প্রশিক্ষণ, ভাতা, আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো দেশের সাতটি জেলার তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বাজেটে ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তাদের জন্য সর্বোচ্চ বরাদ্দ গিয়ে দাঁড়ায় ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরেরও একই পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।

অধিদপ্তর বলছে, পিছিয়ে পড়া এই জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়ানো ও কর্মক্ষমদের আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে সমাজের মূলধারায় ফেরানোর কাজও চলছে। যারা যে কাজে আগ্রহী তাদের ৫০ দিন বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রদান ও প্রশিক্ষণ শেষে প্রত্যেককে ১০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ৫০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বয়স্ক ভাতা বা বিশেষ ভাতা বাবত মাসিক ৬শ’ টাকা প্রদান করা হচ্ছে। এ ছাড়া তাদেরকে বিনা সুদে ঋণ প্রদান করা হচ্ছে। সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com