যেভাবে শুরু সেভাবেই শেষ হচ্ছে তারা

 বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক :কিছুদিন আগে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির সাবেক এক শীর্ষ নেতা মেজর আখতারুজ্জামান বলেছেন, বিএনপি এখন আর অস্তিত্বে নেই। তার এ মহামূল্যবান এবং দূরদর্শিতাপূর্ণ উক্তিটিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সবচেয়ে অধিক বাস্তবসম্মত মন্তব্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বিশেষ করে ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর তার দলবল নিয়ে বিএনপি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিএনপিতে এখন সবেধন নীলমণি হিসেবে রয়েছেন শুধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রুহুল কবির রিজভী। এ দুজনই গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের আসামি হিসেবে একজন রয়েছেন হাজতে, অন্যজন পলাতক, তাই বলতে গেলে নিষ্ক্রিয়। রুহুল কবির রিজভী গোপন আশ্রয় থেকে হরতাল-অবরোধের ডাক দিলেও হরতাল-অবরোধের কোনো চিহ্নই পরিলক্ষিত হয় না। প্রতিটি সাধারণ দিনের মতোই সব সড়কে যানজট প্রকাশ্য এবং দৃশ্যমান। তবে বিএনপির বেশ কিছু দুষ্কৃতকারী দলটির ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতায় জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারছে। আর তাদের সঙ্গে রয়েছে দলটির একান্ত দোসর, নির্বাচনে অযোগ্য ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলাম।

 

এর বাইরে বর্তমানে নামসর্বস্ব এ দলটির আর কোনো কর্মকাণ্ডই নেই, যাকে রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া শুধু সাজাপ্রাপ্ত বলেই নয়, বরং স্বাস্থ্যগত কারণেও এখন বলতে গেলে নির্জীব। দ্বিতীয় নেতাও খুনের দায়ে দণ্ডিত হয়ে এখন পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন সুদূর যুক্তরাজ্যে। সেখান থেকেই তিনি এখনো ধ্বংসাত্মক নির্দেশনা পাঠাচ্ছেন বটে কিন্তু সে নির্দেশনা কার্যকর করার লোক এখন অনেক কমে গেছে, শুধু ভাড়াটে সন্ত্রাসী এবং জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই মাঝেমধ্যে সে নির্দেশনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে পালন করছে। দলটি বস্তুত নেতৃত্বের অর্থে মানবশূন্য হয়ে যাওয়ায় তার সেসব নির্দেশনা এখন আর আগের মতো কাজে আসছে না। এতদিন পর্যন্ত ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাহেব বিএনপি-জামায়াতকে সক্রিয় রাখার দায়িত্ব বেশ সফলতার সঙ্গেই পালন করছিলেন। কিন্তু কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরার পর তিনি বলতে গেলে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। দলটির পক্ষে খালেদা জিয়ার এক সময়ের এক কর্মকর্তা, বিএনপি সরকারের আনুকূল্য এবং ফায়দাপ্রাপ্ত, মুশফিকুল ফজল আনসারী ওয়াশিংটনে বসে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র, ম্যাথিউ মিলারের সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করার নামে নিজেই বিভ্রান্তিকর, সত্য বিবর্জিত তথ্য প্রদান করে, মিলার সাহেব থেকে বিএনপিঘেঁষা উত্তর আদায় করে নিতে পারছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে ম্যাথিউ মিলার সাহেবের মধ্যেও দেখা গেল ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন। সেই বিএনপি নিয়োজিত তথাকথিত প্রশ্নকারী আনসারীর কথা শুনে মিলার সাহেব কেবল বিরক্তই হননি বরং তার কাছে থাকা মাইক্রোফোনটিও বন্ধ করে দিয়ে এক কথায় তার গালে চপেটাঘাত করেছিলেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন এসেছে, সম্ভবত ভারত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনি ব্লিঙ্কেনকে পরিষ্কার ভাষায় এ কথা বলার পর যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের চীন ঠেকানো নীতি বাস্তবায়িত করতে ভারত ছাড়া সে দেশটির কোনো গত্যন্তর নেই বিধায় ভারতের কথা যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাহ্য করতে পারে না।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরেই হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল ব্যক্তি, জিয়াউর রহমান ভবিষ্যতে একটি পাকিস্তানপন্থি, ভারতবিরোধী রাজনৈতিক দল সৃষ্টির রূপরেখা তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার জন্য আর সে দলটিই পরবর্তীতে বিএনপি নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল। নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, কট্টর চীনপন্থি (মাও সেতুং এর একান্ত অনুসারী)-সহ যেসব পাকিস্তানপন্থি ঘরানার মানুষগুলো ৭১-এ পরাজিত হয়ে দেশ থেকে পালিয়েছিলেন অথবা দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে অকর্মণ্য জীবন কাটাচ্ছিলেন, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল খলনায়ক জিয়াকে তারা ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে তাঁরই ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়েছিলেন, জিয়াকে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে। সুতরাং হত্যা এবং সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই এবং মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, এমন লোকদের নিয়েই বিএনপি দলের আবির্ভাব ঘটেছিল, যা জিয়ার তথাকথিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় এবং জিয়ার স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে প্রমাণিত। জন্মের পর থেকেই দলটি সেই একই সন্ত্রাসী, জ্বালাও-পোড়াও, অস্ত্রবাজি এবং সন্ত্রাসের নীতিই চালিয়ে যাচ্ছিল। যুগ যুগ ধরে গুণী মনীষীরা বলে আসছেন, যে পথে কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়, সে পথেই তার যাত্রা সমাপ্ত হয়। প্রাচীনকালে ভারতীয় পণ্ডিত চানক্য এবং চীনা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কনফুসিয়াস এ ধরনের কথা বলেছেন। পরবর্তী যুগগুলোতে কার্ল মার্কস, হেগেল, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নাড শ একই ধরনের বাণী প্রচার করেছেন। ইতিহাসেও এ ধরনের উদাহরণের অভাব নেই। জার্মানির নাৎসি দল, ইতালির ফ্যাসিস্ট দল, ফরাসির ১৪তম লুই-এর রাজত্ব, রাশিয়ার জারদের সিংহাসন, ইরানের পাহলবি পরিবারের, স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রাংকোর, পর্তুগালের স্বৈরশাসক এন্টনিও সালাজার এবং এস্টোডো নোভো রেজিম, মিসরের রাজা ফারুক প্রমুখের পতন একই পথে হয়েছিল যে পথে তাদের উত্থান ঘটেছিল। যে ঘোড়ায় চড়ে চেঙ্গিস খান কোটি মানুষ হত্যাযজ্ঞে মেতেছিলেন সেই ঘোড়া থেকে পড়েই তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি জনরোষকে এতই ভয় পেয়েছিলেন যে, কেউ যেন তার কবর চিহ্নিত করে সেখানে অবমাননাকর কিছু করতে না পারে এবং সে জন্যই তার নির্দেশ ছিল কেউ যেন তার কবর চিনতে না পারে। আলেকজান্ডার মাত্র ৩২ বছর বয়সে ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলেই মোটামুটি নিশ্চিত। তার মশাপ্রধান অঞ্চলগুলোতে অভিযান চালানোর কারণেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আরও জানা যায় যে, তিনি মৃত্যুর আগে বেশ কিছু সময় কথা বলতে অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন এক অভিযানকালে গলায় আঘাত পাওয়ার কারণে। বাংলার সর্বকালের ঘৃণিত মীর জাফরের মৃত্যু হয়েছিল কুষ্ঠ রোগে। রবার্ট ক্লাইভ নিজের গলায় নিজের ছুরির আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলেই সে সময়ে বিলেতে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো উল্লেখ করেছে। সে সময়ে ক্লাইভ হতাশা থেকে পরিত্রাণের জন্য আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

 

হত্যা সন্ত্রাস দিয়ে সৃষ্ট বিএনপি দলটির পরিসমাপ্তি ছিল অপরিহার্য। তাই অবশেষে ২০০৩ সালেই দলটির পতনের সূত্রপাত ঘটে। দলের বিভ্রান্তিকর এবং লোভাতুর নেতাদের, বিশেষ করে তারেক জিয়ার ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ের এবং জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে যাওয়ার নীতিতে, নির্বাচন না করে সন্ত্রাসের ওপর ভর করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার কারণে, যা তার পিতা করেছিলেন ৭৫-এর ১৫ আগস্ট, বহু নেতা বিরক্ত হয়ে দল ত্যাগ করে নতুন দল, যেমন তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএফ গঠন করেন।

 

বিএনপির দুজন অতি প্রভাবশালী নেতা, শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপির পতন ঘণ্টা বাজানোর পর আরও বহু নেতা বিএনপির সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেন। দলটির এক অতি ঘনিষ্ঠ সমর্থক জেনারেল সৈয়দ ইবরাহিমও বিএনপিঘেঁষা নীতি পরিহার করেন এই কথা বলে যে, দলটির সন্ত্রাসী নীতি ব্যর্থ হয়েছে।

 

বিএনপির ডাকে সাড়া দেওয়া লোকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন যারা বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নেয় তাদের অধিকাংশই জামায়াতের লোক আর ভাড়া করা সন্ত্রাসী। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে বিএনপির দীপশিখা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে। ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়ার পর সে দীপ চিরতরে নিভে যাবে বলেই বিজ্ঞজনদের ধারণা।

 

সন্ত্রাস দমনে বর্তমান সরকারের কঠোর, আপসহীন অবস্থান বিএনপির পরিচালিত সন্ত্রাসী নীতির অবক্ষয় আরও ত্বরান্বিত করেছে। তাদের জনসমর্থন এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুধু বিএনপির বেনিফিশিয়ারিরাই দলে কোনোরকম অবস্থান করছেন। তাই বলতে হয় দিন শেষে সত্যের জয়ই অনিবার্য।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ভারতীয়দের জন্য ভিসা সীমিত করলো বাংলাদেশ

» ভারতের অপপ্রচারে ক্ষতি নেই, আমাদের চিকিৎসা ও বাজার সবই আছে : উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন

» আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে কোনো আপস নেই : নুর

» দরিদ্র দেশগুলোকে ১০ হাজার কোটি ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক

» নির্বাচন কমিশনে ৪টি নতুন কমিটি গঠন

» ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে প্রতিবেশীর মতো : সারজিস

» বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে যত বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হোক না কেন আমরা জিতবেই.. মাওলানা মামুনুল হক

» ব্র্যাক ব্যাংক-কে ‘বেস্ট ব্যাংকিং পার্টনার অফ দ্যা ইয়ার ২০২৩’ স্বীকৃতি দিয়েছে জেডটিই বাংলাদেশ

» পলাশে নবাগত ইউএনওর সাথে সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভা

» অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে বড় বিদ্রোহ হবে: উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

যেভাবে শুরু সেভাবেই শেষ হচ্ছে তারা

 বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক :কিছুদিন আগে দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বিএনপির সাবেক এক শীর্ষ নেতা মেজর আখতারুজ্জামান বলেছেন, বিএনপি এখন আর অস্তিত্বে নেই। তার এ মহামূল্যবান এবং দূরদর্শিতাপূর্ণ উক্তিটিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটের সবচেয়ে অধিক বাস্তবসম্মত মন্তব্য হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। বিশেষ করে ব্যারিস্টার শাজাহান ওমর তার দলবল নিয়ে বিএনপি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বিএনপিতে এখন সবেধন নীলমণি হিসেবে রয়েছেন শুধু মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং রুহুল কবির রিজভী। এ দুজনই গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের আসামি হিসেবে একজন রয়েছেন হাজতে, অন্যজন পলাতক, তাই বলতে গেলে নিষ্ক্রিয়। রুহুল কবির রিজভী গোপন আশ্রয় থেকে হরতাল-অবরোধের ডাক দিলেও হরতাল-অবরোধের কোনো চিহ্নই পরিলক্ষিত হয় না। প্রতিটি সাধারণ দিনের মতোই সব সড়কে যানজট প্রকাশ্য এবং দৃশ্যমান। তবে বিএনপির বেশ কিছু দুষ্কৃতকারী দলটির ঐতিহ্যগত ধারাবাহিকতায় জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে জনজীবন দুর্বিষহ করে তুলতে পারছে। আর তাদের সঙ্গে রয়েছে দলটির একান্ত দোসর, নির্বাচনে অযোগ্য ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতে ইসলাম।

 

এর বাইরে বর্তমানে নামসর্বস্ব এ দলটির আর কোনো কর্মকাণ্ডই নেই, যাকে রাজনৈতিক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বর্ণনা করা যায়। দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া শুধু সাজাপ্রাপ্ত বলেই নয়, বরং স্বাস্থ্যগত কারণেও এখন বলতে গেলে নির্জীব। দ্বিতীয় নেতাও খুনের দায়ে দণ্ডিত হয়ে এখন পলাতক জীবন কাটাচ্ছেন সুদূর যুক্তরাজ্যে। সেখান থেকেই তিনি এখনো ধ্বংসাত্মক নির্দেশনা পাঠাচ্ছেন বটে কিন্তু সে নির্দেশনা কার্যকর করার লোক এখন অনেক কমে গেছে, শুধু ভাড়াটে সন্ত্রাসী এবং জামায়াতের নেতা-কর্মীরাই মাঝেমধ্যে সে নির্দেশনা লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে পালন করছে। দলটি বস্তুত নেতৃত্বের অর্থে মানবশূন্য হয়ে যাওয়ায় তার সেসব নির্দেশনা এখন আর আগের মতো কাজে আসছে না। এতদিন পর্যন্ত ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সাহেব বিএনপি-জামায়াতকে সক্রিয় রাখার দায়িত্ব বেশ সফলতার সঙ্গেই পালন করছিলেন। কিন্তু কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরার পর তিনি বলতে গেলে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। দলটির পক্ষে খালেদা জিয়ার এক সময়ের এক কর্মকর্তা, বিএনপি সরকারের আনুকূল্য এবং ফায়দাপ্রাপ্ত, মুশফিকুল ফজল আনসারী ওয়াশিংটনে বসে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র, ম্যাথিউ মিলারের সংবাদ ব্রিফিংয়ে প্রশ্ন করার নামে নিজেই বিভ্রান্তিকর, সত্য বিবর্জিত তথ্য প্রদান করে, মিলার সাহেব থেকে বিএনপিঘেঁষা উত্তর আদায় করে নিতে পারছিলেন। কিন্তু গত সপ্তাহে ম্যাথিউ মিলার সাহেবের মধ্যেও দেখা গেল ১৮০ ডিগ্রি পরিবর্তন। সেই বিএনপি নিয়োজিত তথাকথিত প্রশ্নকারী আনসারীর কথা শুনে মিলার সাহেব কেবল বিরক্তই হননি বরং তার কাছে থাকা মাইক্রোফোনটিও বন্ধ করে দিয়ে এক কথায় তার গালে চপেটাঘাত করেছিলেন। এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের নির্বাচনের বিষয়ে মার্কিন নীতিতে পরিবর্তন এসেছে, সম্ভবত ভারত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্তনি ব্লিঙ্কেনকে পরিষ্কার ভাষায় এ কথা বলার পর যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো আন্তর্জাতিক আইনের খেলাপ। এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে যুক্তরাষ্ট্রের চীন ঠেকানো নীতি বাস্তবায়িত করতে ভারত ছাড়া সে দেশটির কোনো গত্যন্তর নেই বিধায় ভারতের কথা যুক্তরাষ্ট্র অগ্রাহ্য করতে পারে না।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরেই হত্যা ষড়যন্ত্রের মূল ব্যক্তি, জিয়াউর রহমান ভবিষ্যতে একটি পাকিস্তানপন্থি, ভারতবিরোধী রাজনৈতিক দল সৃষ্টির রূপরেখা তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানে পরিণত করার জন্য আর সে দলটিই পরবর্তীতে বিএনপি নামে আত্মপ্রকাশ করেছিল। নেজামে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, কট্টর চীনপন্থি (মাও সেতুং এর একান্ত অনুসারী)-সহ যেসব পাকিস্তানপন্থি ঘরানার মানুষগুলো ৭১-এ পরাজিত হয়ে দেশ থেকে পালিয়েছিলেন অথবা দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে অকর্মণ্য জীবন কাটাচ্ছিলেন, ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মূল খলনায়ক জিয়াকে তারা ত্রাণকর্তা হিসেবে পেয়ে তাঁরই ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়েছিলেন, জিয়াকে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে। সুতরাং হত্যা এবং সন্ত্রাসের মধ্য দিয়েই এবং মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি, এমন লোকদের নিয়েই বিএনপি দলের আবির্ভাব ঘটেছিল, যা জিয়ার তথাকথিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিচয় এবং জিয়ার স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে প্রমাণিত। জন্মের পর থেকেই দলটি সেই একই সন্ত্রাসী, জ্বালাও-পোড়াও, অস্ত্রবাজি এবং সন্ত্রাসের নীতিই চালিয়ে যাচ্ছিল। যুগ যুগ ধরে গুণী মনীষীরা বলে আসছেন, যে পথে কোনো ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর যাত্রা শুরু হয়, সে পথেই তার যাত্রা সমাপ্ত হয়। প্রাচীনকালে ভারতীয় পণ্ডিত চানক্য এবং চীনা ভবিষ্যৎদ্রষ্টা কনফুসিয়াস এ ধরনের কথা বলেছেন। পরবর্তী যুগগুলোতে কার্ল মার্কস, হেগেল, বার্ট্রান্ড রাসেল, বার্নাড শ একই ধরনের বাণী প্রচার করেছেন। ইতিহাসেও এ ধরনের উদাহরণের অভাব নেই। জার্মানির নাৎসি দল, ইতালির ফ্যাসিস্ট দল, ফরাসির ১৪তম লুই-এর রাজত্ব, রাশিয়ার জারদের সিংহাসন, ইরানের পাহলবি পরিবারের, স্পেনের স্বৈরশাসক ফ্রাংকোর, পর্তুগালের স্বৈরশাসক এন্টনিও সালাজার এবং এস্টোডো নোভো রেজিম, মিসরের রাজা ফারুক প্রমুখের পতন একই পথে হয়েছিল যে পথে তাদের উত্থান ঘটেছিল। যে ঘোড়ায় চড়ে চেঙ্গিস খান কোটি মানুষ হত্যাযজ্ঞে মেতেছিলেন সেই ঘোড়া থেকে পড়েই তার মৃত্যু হয়েছিল। মৃত্যুর আগে তিনি জনরোষকে এতই ভয় পেয়েছিলেন যে, কেউ যেন তার কবর চিহ্নিত করে সেখানে অবমাননাকর কিছু করতে না পারে এবং সে জন্যই তার নির্দেশ ছিল কেউ যেন তার কবর চিনতে না পারে। আলেকজান্ডার মাত্র ৩২ বছর বয়সে ম্যালেরিয়া রোগে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলেই মোটামুটি নিশ্চিত। তার মশাপ্রধান অঞ্চলগুলোতে অভিযান চালানোর কারণেই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আরও জানা যায় যে, তিনি মৃত্যুর আগে বেশ কিছু সময় কথা বলতে অক্ষম হয়ে গিয়েছিলেন এক অভিযানকালে গলায় আঘাত পাওয়ার কারণে। বাংলার সর্বকালের ঘৃণিত মীর জাফরের মৃত্যু হয়েছিল কুষ্ঠ রোগে। রবার্ট ক্লাইভ নিজের গলায় নিজের ছুরির আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন বলেই সে সময়ে বিলেতে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলো উল্লেখ করেছে। সে সময়ে ক্লাইভ হতাশা থেকে পরিত্রাণের জন্য আফিমে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন।

 

হত্যা সন্ত্রাস দিয়ে সৃষ্ট বিএনপি দলটির পরিসমাপ্তি ছিল অপরিহার্য। তাই অবশেষে ২০০৩ সালেই দলটির পতনের সূত্রপাত ঘটে। দলের বিভ্রান্তিকর এবং লোভাতুর নেতাদের, বিশেষ করে তারেক জিয়ার ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ের এবং জ্বালাও-পোড়াও চালিয়ে যাওয়ার নীতিতে, নির্বাচন না করে সন্ত্রাসের ওপর ভর করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার কারণে, যা তার পিতা করেছিলেন ৭৫-এর ১৫ আগস্ট, বহু নেতা বিরক্ত হয়ে দল ত্যাগ করে নতুন দল, যেমন তৃণমূল বিএনপি এবং বিএনএফ গঠন করেন।

 

বিএনপির দুজন অতি প্রভাবশালী নেতা, শমসের মবিন চৌধুরী এবং তৈমূর আলম খন্দকার বিএনপির পতন ঘণ্টা বাজানোর পর আরও বহু নেতা বিএনপির সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ করেন। দলটির এক অতি ঘনিষ্ঠ সমর্থক জেনারেল সৈয়দ ইবরাহিমও বিএনপিঘেঁষা নীতি পরিহার করেন এই কথা বলে যে, দলটির সন্ত্রাসী নীতি ব্যর্থ হয়েছে।

 

বিএনপির ডাকে সাড়া দেওয়া লোকের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এখন যারা বিএনপির কর্মসূচিতে অংশ নেয় তাদের অধিকাংশই জামায়াতের লোক আর ভাড়া করা সন্ত্রাসী। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে বিএনপির দীপশিখা ততই ক্ষীণ হয়ে আসছে। ২০২৪-এর ৭ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়ার পর সে দীপ চিরতরে নিভে যাবে বলেই বিজ্ঞজনদের ধারণা।

 

সন্ত্রাস দমনে বর্তমান সরকারের কঠোর, আপসহীন অবস্থান বিএনপির পরিচালিত সন্ত্রাসী নীতির অবক্ষয় আরও ত্বরান্বিত করেছে। তাদের জনসমর্থন এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। শুধু বিএনপির বেনিফিশিয়ারিরাই দলে কোনোরকম অবস্থান করছেন। তাই বলতে হয় দিন শেষে সত্যের জয়ই অনিবার্য।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি।
সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com