একই অবস্থা পার্ক রোডেরও। সরু এই রোডেও একটি কুরিয়ার সার্ভিস থাকায় দিনে কয়েকবার তাদের ব্যক্তিগত বড় আকারের মালবাহী গাড়ী প্রবেশ করা এবং বের হওয়ার সময় যানজট বেধে যায়। যেটি নিরসন হতে সময় লেগে যায় দীর্ঘক্ষণ।
এদিকে, টিনপট্টি এলাকায় দিনের বেলায় রড সিমেন্ট এবং টিনের ট্রাক থেকে মাল লোড-আনলোড করা হয়। ঐ রাস্তাটি সরু হওয়ায় একটি বৃহৎ আকারের ট্রাক প্রবেশ করলেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। যেটা নিরসনে প্রায় ঘণ্টা সময় লেগে যায়। এভাবে একের পর এক মালবাহী ট্রাক প্রবেশ করায় দিনের পুরোটা সময়ই যানজট লেগে থাকে টিনপট্টি এলাকায়।
এছাড়া, শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথার প্রায় সবগুলো সড়কই ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, অবৈধ পার্কিং, রাস্তার দু’পাশে বসা দোকানপাটের কারণে ভয়াবহ যানজটের কবলে পড়ে যায়। ফলে ব্যস্ত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে কয়েক দফা যানজটে ঘণ্টারও বেশি সময় চলে যায়! এমনকি, ফুটপাত দখল করে বসা দোকানিদের কারণে পায়ে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছাতেও স্বস্তি নেই এই শহরে।
বগুড়া শহরে যানজটের অন্যতম কারণ ব্যাটারিচালিত অবৈধ অটোরিকশা। শহরে অর্ধলাখের বেশি অটোরিকশার অদক্ষ চালকরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা মানছেন না কোনো ট্রাফিক আইন। যত্রতত্রভাবে করছে পার্কিং, রং সাইড, রাইট সাইড এবং কোনো সিগন্যালে তোয়াক্কা নেই তাদের। এর আগে ২০২১ সালের শুরুর দিকে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা শহরের প্রাণকেন্দ্র সাতমাথায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলো। শুধুমাত্র পায়ে চালিত রিকশা সাতমাথায় প্রবেশ করতে পারতো। এতে করে সাতমাথা যানজটমুক্ত থাকলেও শহরে প্রবেশের সড়কগুলোতে যানজটে মারাত্মক আকার সৃষ্টি হতো। পরে এক সময় সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়।
সম্প্রতি কয়েক মাস আগে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নতুন করে শুধুমাত্র চিকন চাকার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা শহরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিলো। এরপর সেই উদ্যোগ লেজেগোবরে হয়ে গেছে। যানজট নিরসনে ট্রাফিক পুলিশ যা করছে তা হলো, শেরপুর রোড চলাচলকারী অটোরিকশাকে পিটিআই মোড় থেকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। পরে অটোগুলো রুট পরিবর্তন করে ঘোড়াপট্টি হয়ে পুনরায় সাতমাথায় প্রবেশ করছে। দত্তবাড়ী রোড থেকে ঘুরিয়ে দেওয়ার পর অটোগুলো কাটনারপাড়া হয়ে থানা মোড় দিয়ে বেরিয়ে সাতমাথা পৌঁছাচ্ছে।
এদিকে, বিকেল হলেই সাতমাথা এলাকায় ভ্রাম্যমাণ ভাজিপুরিসহ বিভিন্ন মুখরোচক খাবার দোকানের পসরা সাজিয়ে বসে পড়েন দোকানিরা। দোকানগুলোকে কেন্দ্র করে লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়। বিশেষ করে শহরের টেম্পল রোড, গালাপট্টিতে বসা এসব দোকানের কারণে পায়ে হেঁটে চলাফেরা করাও রীতিমত অসহনীয় হয়ে ওঠে। এছাড়া কাঁঠালতলা এলাকার রাস্তাটি সবসময় জ্যামে আটকা থাকে রাস্তার দুপাশে বসা দোকানগুলোর কারণে। অভিযোগ আছে, সদর ফাঁড়ি এবং পৌরসভাকে ম্যানেজ করেই এসব ভ্রাম্যমাণ দোকানি তাদের পসরা নিয়ে বসেন। প্রতিদিন বগুড়া পৌরসভার এক নারীকে এসব দোকান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা তুলতে দেখা যায়।
অন্যদিকে, অজ্ঞাত কারণে শহরের রাস্তার দু’পাশের ফুটপাত দখল করে দোকান বসলেও জেলা প্রশাসন থেকে সেগুলো উচ্ছেদে নেওয়া হচ্ছে না কোনো উদ্যোগ। বগুড়া সদর থানার অফিসার ইনচার্জ সেলিম রেজা যোগদানের দ্বিতীয় দিন সপ্তপদী মার্কেট এলাকার ফুটপাতে বসা ফলমুলের দোকান সকালে উচ্ছেদ করে দিলেও সন্ধ্যায় তারা পুনরায় তাদের দোকানপাট বসিয়ে বেচাকেনা শুরু করে। এখন পর্যন্ত সেভাবেই চলছে।
বগুড়ার সাবেক পুলিশ সুপার আলী আশরাফ ভূঁঞা যানজট নিরসনে এবং ঝুঁকি হিসেবে সকাল থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত শহরের ভেতর ভারি যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ করেছিলেন। সে সময় নিয়মিত শহরের মাটিডালি এবং বনানী মোড়ে ডিউটি চেকপোস্ট বসানো হতো। ফলে মালবাহী ট্রাক-বাস দিন ও রাতের বেলা চোখে পড়তো কদাচিৎ। ভারি যানবাহনগুলো বাইপাস সড়ক ব্যবহার করতো। তবে গত ক’মাস যাবৎ শহরের ভেতর দিনের বেলা যখন তখন প্রবেশ করছে মালবাহী পিকআপ, ট্রাক, বাস। ফলে অটোরিকশায় ঠাসা শহরে দানবাকৃতির যানবাহন প্রবেশের কারণে যানজটের সৃষ্টি হলে সেটি নিরসন হতে দীর্ঘক্ষণ সময় লেগে যায়।
এছাড়া, রাত ৯টার পর থেকেই উত্তরাঞ্চল থেকে ঢাকা মহাসড়কগামী এবং ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দ্রুতগতির বাস ও ট্রাক মাটিডালি থেকে বাইপাস সড়ক ব্যবহার না করে শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে। ওই সময় প্রায় প্রতিদিনই সাতমাথার পুলিশ বক্সের সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে ট্রাফিক পুলিশকে মালবাহী পিকআপ এবং ট্রাক থামিয়ে কাগজপত্র চেকিং এবং মামলা দিতে দেখা যায়। বড় গাড়ী রাস্তায় দাঁড় করানোর কারণে ঐ সময়ও যানজট সৃষ্টি হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, মামলা দিতেই মাটিডালি এবং বনানী মোড়ে ডিউটি চেকপোস্ট না বসিয়ে তাদেরকে শহরে প্রবেশ করতে দেয় ট্রাফিক পুলিশ। এরপর মালবাহী পিকআপসহ ভারী যানবাহন থামিয়ে বিভিন্ন অজুহাতে দেখিয়ে দর কষাকষি করা হয়। শেষ পর্যন্ত দরে না টিকলে মামলা দিয়ে হাতে কাগজ ধরিয়ে দেওয়া দেয়। এছাড়া, অজ্ঞাত কারণে তাদের মাঝে এক প্রকার প্রতিযোগিতা চলে; কে ক’টা মামলা দিতে পারেন। যে কারণে যানজটে শহরবাসীর নাভিশ্বাস উঠলেও ট্রাফিক পুলিশদের অধিকাংশ সময়ই দেখা যায়, সাতমাথাসহ বিভিন্ন পয়েন্টে চেকপোস্ট বসিয়ে মোটরসাইকেল চালকদের মামলা দিতে।
তবে জেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার গাড়ি যখন শহরের ভেতর দিয়ে চলাচল করে, তখন মুহূর্তের মধ্যেই সড়কের যানজট উধাও করে দেয় ট্রাফিক এবং সদর ফাঁড়ির পুলিশ।
বগুড়ার ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক রফিকুল ইসলাম জানান, শহরে তো কোনো পার্কিংয়ের জায়গা-ই নেই। বগুড়া শহরে তো ‘এখানে গাড়ি পার্কিং করুন’ এরকম তো কোনো স্টিকার নেই। অবৈধ পার্কিং নিয়ে সম্প্রতি যানজট নিরসনে আলোচনা হয়েছে। সেখানে পৌরসভার মেয়রও বলেছেন, সাতমাথা থেকে শুরু করে শহরের কোথাও কোন পার্কিংয়ের জায়গা দিতে পারিনি। আমরা নিজেরাই বলছি সব অবৈধ। এরপর মামলা দিচ্ছি। এছাড়া তো বুদ্ধি নাই।
রাত ৯টায় ঢাকা এবং রংপুর থেকে ভারি যানবাহন শহরের ভেতর দিয়ে প্রবেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, এখনও বনানী এবং মাটিডালি দু’জায়গাতেই আমার চেকপোস্ট আছে। কিন্তু ২০টি পয়েন্ট আছে যেগুলো দিয়ে শহরে গাড়ি ঢুকছে। ২০টি পয়েন্টে তো আর ১ শ’ জন মানুষ রাতের বেলা ডিউটি দিতে পারবো না। আমরা তিন পয়েন্টে দিই কিন্তু বাকি সাবরোড দিয়ে তারা ঢুকে যায়। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের কোথাও এরকম নেই, যে রাতের বেলা ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা বন্ধ করে দেবে যাতে শহরে গাড়ি ঢুকতে না পারে।
তিনি বলেন, ঢাকার ভেতর দিয়েও রাত ১০টার পরে সমস্ত গাড়ি চলছে। এরপরেও বাইপাস সড়ক আছে, সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি। রাত ১০টা থেকে ঐ পয়েন্টগুলোতে চেকপোস্ট বসানো হয়। এটা এসপি স্যারের অর্ডার।
তিনি আরো বলেন, গত মাসে একদিনে সর্বোচ্চ ১৮০টি মামলা আমরা করেছি। এছাড়া গত মাসে ১ হাজার ৯৪০টি মামলা দেওয়া হয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই মোটরসাইকেল ছিলো। যেখান ৭৯ লাখ টাকার বেশি রাজস্ব আদায় করা হয়েছে। গত মাসে সর্বোচ্চ মামলা দেওয়ায় আমরা রেঞ্জ সেরা হয়েছি।
বগুড়া পৌরসভার মেয়র রেজাউল করিম বাদশা জানান, ব্যাটারিচালিত রিকশা এগুলোতে তো সরকারের অনুমতি নেই। এরপরেও প্রতিদিনই অসংখ্য নতুন রিকশা রাস্তায় নামছে। ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে শহরে যানজটে অস্থির হয়ে যাচ্ছি আমরা। আলোচনার মাধ্যমে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বিক্রি তো কিছু বন্ধ করতেই হবে। এগুলো তো বন্ধ করা হচ্ছে না। যার কারণে যানজটও বাড়ছে। ‘আমাদের কাছে হিসাব আছে, শহরে ৫০ হাজারও অধিক অটোরিকশা চলাচল করছে। আমরা প্রশাসনকে বলছি। এরপরেও কেন এগুলো ধরছে না, বুঝছি না।
এদিকে, রাস্তা দখল করে বসা দোকানপাট থেকে পৌরসভার লোক দ্বারা টাকা উঠানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যে টাকা উঠায় তাকে ধরুন। ধরে আমাদেরকে দিন।
বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সালাহ্উদ্দিন আহমেদ জানান, যানজট নিরসনে অতি সম্প্রতি আমাদের একটি মিটিং হয়েছে। ওই মিটিংয়ে সবার সম্মতিক্রমে আমাকে আহ্বায়ক করে পৌরসভার মেয়র, ট্রাফিক পরিদর্শক, প্রেসক্লাবের একজন প্রতিনিধিসহ ১১ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসক মহোদয়। এই কমিটি এক মাসের মধ্যে একটি সুপারিশ প্রণয়ন করবে। সেই সুপারিশের ভিত্তিতে যানজট নিরসনে যা যা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তা নেওয়া হবে।
বগুড়া পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্ত্তী জানান, যানজট নিরসনে সম্প্রতি আমাদের আলোচনা হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে আমাদের কাজটি হবে, ফুটপাতগুলোকে মুক্ত করা। প্রতি সন্ধ্যায় বিভিন্ন জায়গায় কিন্তু অভিযান চালানো হচ্ছে। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিজেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সেখানে আরো ম্যাজিস্ট্রেট তার সাথে থাকছেন। আমাদের পুলিশসহ বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন ফোর্স কাজ করছে তাদের সাথে। তবে অভিযান চলাকালীন যেটা হয়, ঐ সময় দোকানপাট গুটিয়ে তারা চলে যায়। অভিযান শেষে কিন্তু তারা আবার ফিরে আসার চেষ্টা করে। আমাদের সদর ফাঁড়ি এবং থানা মিলে কিন্তু চেষ্টা করছি।
তিনি আরো জানান, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তেই হোক ফুটপাতগুলোকে মুক্ত করতে হবে। আমাদের কমিটি কাজ করছে। আশা করছি এক মাসের মধ্যে রূপরেখা হবে। বিশেষ করে থ্রি হুইলারগুলোকে কন্ট্রোল করা এবং শহরে নির্দিষ্ট সময়সীমার আগে যে বাসগুলো শহরে ঢুকে যায় সেগুলো কন্ট্রোল করা এবং দুটো বাইপাস আছে, সেগুলোকে সচল করা। এগুলো আমরা করতে যাচ্ছি। এগুলো যদি আমরা করতে পারি তাহলে আশা করছি যানজট সহনীয় পর্যায়ে আসবে। সূএ:রাইজিংবিডি.কম