চাঁদপুরের সদর উপজেলার ১০নং লক্ষীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খানকে সবাই চেনেন বালুখেকো সেলিম নামে। অবৈধ বালু উত্তোলন করেই বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সেলিম খান প্রথম আলোচনায় আসেন ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের সময়। ওই অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের সঙ্গে ক্যাসিনো ব্যবসায় তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সামনে আসে। এছাড়া ক্যাসিনোকাণ্ডে জড়িতদের তালিকাতেও উঠে আসে তার নাম।
২০১৯ সালে গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগে চাঁদপুরে অভিযান চালায় দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিম। সেখানে গৃহহীনদের কাছ থেকে প্রতিটি ঘর বরাদ্দ বাবদ ২০ হাজার টাকা করে ঘুষ নেয়ার প্রাথমিক সত্যতা পায় দুদক। সে বছরই ৩১ অক্টোবর কমিশন সেলিম খানের অবৈধ সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০২০ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সেলিম খান, তার স্ত্রী শাহানা বেগম ও তাদের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের সম্পদ বিবরণী দাখিল করার নির্দেশ দেয় রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি প্রতিরোধী সংস্থা দুদক। ওই তলবের প্রেক্ষিতে সেলিম খান দুদকে যে সম্পদ বিবরণী দাখিল করেন সেখানে তার মোট আয় দেখানো হয় ৬২ লাখ টাকা।
তবে সেলিমের সম্পদের অনুসন্ধান ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, দুদকের কাছে সেলিমের যে সম্পদের তথ্য রয়েছে তা প্রায় ১৫ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া নামে-বেনামে তার বেশ কিছু সম্পদের তথ্যও রয়েছে দুদকের কাছে, সেসবের মূল্য এখন পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারেনি সংস্থাটি।
এছাড়া সেলিমের দৃশ্যমান যেসব সম্পদের খোঁজ দুদকের কাছে রয়েছে তার মধ্যে রাজধানীর কাকরাইলে চারতলা একটি বাড়ি, একটি ফ্ল্যাট, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় একটি ১০ তলা বাড়ি, চাঁদপুরে ৪ দশমিক ২১ একর কৃষি ও অকৃষি জমি।
তার ব্যবহৃত গাড়ি, আসবাবপত্র ও স্বর্ণালঙ্কারের মূল্য ধরা হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা।
বালুকে যেভাবে হীরা করে তুলেছেন সেলিম!
এক সময় ঢাকায় এসে করেছেন হকারি, ছিলেন রিকশা শ্রমিক। গত এক যুগে নদী ড্রেজিং ও বালুমহালের ব্যবসার মাধ্যমে রাতারাতি হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন চাঁদপুরের চেয়ারম্যান সেলিম খান। আর লিয়াজোঁ করেন দেশের শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে।
স্থানীয় একটি সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরের বিভিন্ন নদীতে সেলিম খান শতাধিক ড্রেজিং মেশিন পরিচালনা করেন। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনকে তিনি নিজ ক্ষমতায় অনেকটা বৈধ করে তুলেছেন। বালু উত্তোলনে দেননা রাজস্ব, নেননা অনুমতি। গত ১০ বছরে শুধু বালু উত্তোলন করে তিনি আয় করেছেন তিন হাজার কোটি টাকা।
খোঁদ চাঁদুপুরের জেলা প্রশাসকই ব্যর্থ হচ্ছেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কারণ তার অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়টিকে স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রীও বৈধ বলছেন। আর বিভিন্ন সময়ে বালু তুলতে অন্তত ১৫টি ডিও লেটার দিয়েছেন মন্ত্রী নিজেই। তবে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ এই বালু উত্তোলনকে অবিজ্ঞানসম্মত ও অবৈধ বলছেন দীর্ঘদিন ধরে।
ইতিমধ্যে সেজেছেন মিডিয়া মোগল!
সেলিম খান একজন সাধারণ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান হলেও দেশে মিডিয়াও নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। এরই মধ্যে দেশে প্রথম সারির একটি আইপি টিভির লাইসেন্সও বাগিয়ে নিয়েছেন। সরকার গত বছর যে কয়টি আইপি টিভির অনুমোদন দিয়েছে তার মধ্যে একটি সেলিম খানের মালিকানাধীন শাপলা মিডিয়ার ‘ভয়েজ টিভি’।
একটি টিভি চ্যানেল ছাড়াও সিনেমা নির্মাণ করার জন্য ২০১৮ সালে শাপলা মিডিয়া ও সম্প্রতি চেয়ারম্যান সিন্ডিকেট নামে দুটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা ও পরিবেশনা প্রতিষ্ঠান গড়েছেন সেলিম।
শাপলা মিডিয়া প্রতিষ্ঠার সময় প্রতিষ্ঠানটি থেকে ১০০টির বেশি সিনেমা তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এরই মধ্যে বিগ বাজেটের প্রায় ২৫টির বেশি ছবিতে অর্থ লগ্নিও করেন সেলিম, যার মধ্যে ‘শাহেনশাহ’, বিদ্রোহী, ‘আমি নেতা হবো’ ক্যাপ্টেন খানের মতো বিগ বাজেটের ছবিও রয়েছে। প্রতিটি সিনেমার বাজেট এক কোটি থেকে দুই কোটি টাকা হলেও সিনেমায় লগ্নির অর্ধেক টাকাও তুলে আনতে পারেনি সেলিমের শাপলা মিডিয়া।
সরকারি কোষাগারে ১৩ কোটি টাকা দিতে চান সেলিম!
অবৈধ বালুমহাল ব্যবসার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে সেলিম সম্প্রতি নিজে থেকেই বালু উত্তোলন বাবদ ১৩ কোটি ৭১ লাখ টাকা রাজস্ব দেয়ার জন্য আবেদন করেন।
চাঁদপুরের বিআইডব্লিউটিএ’র একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘গত আট বছরে অন্তত তিন হাজার কোটি টাকার বালু উত্তোলন করেছেন সেলিম খান, যার বৈধ রাজস্ব আসবে অন্তত ৩০০ কোটি টাকা।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এখন তিনি তড়িঘড়ি করে কেন রাজস্ব দিতে চাইছেন, বিষয়টি আমরা বুঝতে পারছি না। জেলা প্রশাসক কিংবা বিআইডব্লিউটিএ যেখানে তাকে বালু উত্তোলনের অনুমোদনই দেয়নি সেখানে তিনি অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করেছেন এবং এখন যেচে রাজস্ব দিতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।’
দুদকের তলবেও সাড়া দেননি সেলিম?
সেলিম খানের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করছেন দুদকের সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান খান। দুদকের তলবে সাড়া না দেয়ার বিষয়টি ঢাকাটাইমস নিশ্চিত করেন তিনি। তলবের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সেলিম খানকে দুদক থেকে তলব করা হয়েছিল তিনি হাজির হননি।
এই কর্মকর্তা তদন্তের বিষয়ে আর কিছু বলতেই রাজি হননি। তবে তদন্ত সংশ্লিষ্ট অন্য একটি সূত্র ঢাকাটাইমসকে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সেলিম ও তার চার ব্যবসায়িক সহযোগীকে দুদক তলব করেছিল, তারা কেউ হাজির হয়নি।
সেলিমের হাজির না হওয়ার বিষয়ে জানতে দুদক সচিব মাহবুব খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে সংস্থাটির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তিনি (সেলিম) চাইলে না আসতে পারেন, সেই ক্ষেত্রে দুদক তার গতিতেই চলবে।’ সূএ:ঢাকাটাইমস