রাশিয়া হামলা চালানোর পর থেকে একের পর এক বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় প্রকম্পিক হয়ে উঠছে পূর্ব ইউরোপের দেশ ইউক্রেন। দেশটির অবকাঠামো ভেঙে পড়ার পাশাপাশি বেসামরিক হতাহতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। এছাড়া বাস্তুচ্যুত হচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এমন পরিস্থিতিতে তাই নিজ দেশ ছেড়ে প্রাণভয়ে পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিচ্ছেন সেখানকার সাধারণ বাসিন্দারা।
ইউক্রেন ও পোল্যান্ডের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত হল মেডিকা। ইতোমধ্যে এই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ১ লাখ ১৫ হাজারের বেশি শরণার্থী পোল্যান্ডে আশ্রয় নিয়েছে। পোলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছে, ইউক্রেন থেকে চাইলে যে কেউ তাদের দেশে প্রবেশ করতে পারবে। এমনকি যাদের বৈধ পাসপোর্ট নেই তারাও সেখানে আসতে পারে।
শনিবার পোল্যান্ডের অভ্যন্তরীণ বিষয়ক মন্ত্রণালয় একথা জানিয়েছে। এদিকে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার রুশ হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ লাখ ২০ হাজার মানুষ ইউক্রেন ছেড়েছে।
৪৯ বছর বয়সী হেলেনা পশ্চিম ইউক্রেনের দ্রোহোবিচ থেকে পালিয়ে পোল্যান্ডে এসেছেন। বর্তমানে সেখানে তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের কাছে অবস্থান করছেন। পোল্যান্ডের পোজনানে তার পরিবারের কিছু সদস্য থাকেন। সেখানেই যাবেন তিনি।
২৪ ঘণ্টার সফর শেষে পোল্যান্ডে পৌঁছান হেলেনা। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। তার ভাষায়, পুরো সফরটি তার জন্য ‘নরক যন্ত্রণার’ সমান।
পোল্যান্ডের একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ইউক্রেনের নাগরিক ডেনিস (৩০)। বৃহস্পতিবার যুদ্ধ শুরু হলে তিনি তার মেয়ে ও স্ত্রীকে ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে চলে আসতে বলেন। আর তাই ডেনিস তাদের নিতে ওই দিনই মেডিকা সীমান্ত যান। কিন্তু সেখানে রাতভর অপেক্ষার পরও স্ত্রী সন্তানের দেখা পাননি তিনি।
এদিকে ডেনিসের স্ত্রী সন্তান পোল্যান্ডের দিকে রওনা হলেও তার মা ইউক্রেনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মূলত তিনি তার স্বামী ও অন্য দুই সন্তানের সঙ্গে থাকতেই পোল্যান্ড থেকে ইউক্রেনে যাচ্ছেন। ধারণা করা হচ্ছে, তার স্বামী ও সন্তানরা খুব তাড়াতাড়ি সেনাবাহিনীতে ডাক পেতে চলেছেন।
ডেনিস বলেন, ‘আমার বাবা আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছেন। তাই তিনি ভালো করেই জানেন যুদ্ধ আসলে কি। তিনি তার জীবন সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য উৎসর্গ করতে চেয়েছিলেন। এখন তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের পক্ষে লড়বেন। পুরো পৃথিবী দেখছে রাশিয়া কি করছে। তারা ইতোমধ্যে ক্রিমিয়া, দনবাস ও খারকিভ দখল করেছে।’
ডেনিস বলেন, ‘আমি আমার সন্তান ও স্ত্রীর জীবন নিশ্চিত করতে চাই। এরপর আমিও যুদ্ধে যাব। যদি শত্রুরা আমাদের বাড়িঘর দখলে নিতে চায় তাহলে আমাদেরও উচিত হবে তাদের ওপর আঘাত করা যুদ্ধ করা। আমরা অনেক বছর ধরে এই দেশটিকে (ইউক্রেন) গড়ে তুলেছি। অনেকেই জীবন ভয়ে পালিয়েছে। তবে অনেকে এখনো রয়ে গেছে। সবাই যদি চলে যায় তাহলে আমাদের রক্ষা করবে কে?’
ইয়েলেনা এক বছর আগে বেলারুশ হয়ে পোল্যান্ডে আসেন। তিনি পোল্যান্ড-ইউক্রেন সীমান্তে খোলা আশ্রয় শিবিরে বর্তমানে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যুদ্ধ করতে যেতে চাই। পোল্যান্ডের সীমান্ত রক্ষীরা আমাকে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তবে ইউক্রেনের লোকজন আমাকে আটকে দিয়েছে। বেলারুশের পাসপোর্ট থাকায় তারা আমাকে যেতে দেয়নি।’
ইয়েলেনা বলেন, ‘ওই দেশটির সব ধরনের সাহায্য প্রয়োজন। কাউকে রান্না করতে হবে, কাউকে আহতদের দেখাশোনা করতে হবে। আমি সেখানে পৌঁছাতে দুইবার সীমান্ত পার হওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি।’ এরপরই তিনি যুদ্ধের প্রতিবাদ জানাতে বেলারুশের পাসপোর্ট ছিড়ে ফেলেন এবং এই শরণার্থী শিবেরে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি বলেন, ‘আমার বেলারুশের জন্য আফসোস হচ্ছে। ইউক্রেনকে অবশ্যই এই যুদ্ধ জিততে হবে ‘
সূত্র: আল-জাজিরা