নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ

গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি পুরুষ, আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। আজ ১ জুন এই আলোকিত মানুষটির ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী৷ 

 

১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ১৯৩৫ সালে তিনি ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক ইত্তেহাদ-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাক-এ রূপান্তরিত হয়। মানিক মিয়ার সম্পাদনায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর কারাভোগ করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছদ্মনামে পত্রিকায় নিয়মিত রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতেন।

‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তুলেছিলেন মানিক মিয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার।

 

মানিক মিয়া ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সৎ ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তাকে মানুষের অধিকারের কথা বলতে হয়েছে। তিনি যেমন বাংলা সাংবাদিকতা জগতে পথপ্রদর্শক, তেমন রাজনীতিতেও।

মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ছবি: সংগৃহীত

মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ছবি: সংগৃহীত

রাজনৈতিক জগতে তিনি ছিলেন হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। ঘনিষ্ঠ ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল মানিক মিয়ার।

 

দৈনিক ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবস্থান এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ইত্তেফাক মানুষের মুক্তির পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে। মানিক মিয়া ছিলেন তার কান্ডারি।

 

বঙ্গবন্ধু ‘আমার মানিক ভাই’ শিরোনামে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘…আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাইর প্রভাব যে কত গভীর, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। ১৯৪৩ সাল থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দু’ভাই একসাথে জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করেছি।…একটা বিষয়ে আমরা উভয়ই একমত ছিলাম এবং তা হল, বাংলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ভিন্ন বাঙ্গালীর মুক্তি নেই, এ বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। আর ছিল না বলেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও দু’জন দু’ফ্রন্টে থেকে কাজ করেছি। আমি কাজ করেছি মাঠে-ময়দানে আর মানিক ভাই তার ক্ষুরধার লেখনীর সাহাঘ্যে।’

 

সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১ জুন তিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ইন্তেকাল করেন।

তথ্য সহায়তা: দৈনিক ইত্তেফাক

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা এক মণ্ডপে ২০০-র বেশি প্রতিমা-বিগ্রহ! লাখো ভক্তের সমাগমের প্রস্তুতি

» সিটি ব্যাংক ও গার্ডিয়ানের অংশীদারিত্বে প্রথমবারের মত ব্যাংকিং অ্যাপ থেকে ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনতে পারবেন গ্রাহকেরা

» ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিজিটাল বীমা পলিসি ডক্যুমেন্ট প্রদানের সেবা চালু করল মেটলাইফ বাংলাদেশ

» নওগাঁয় মহিলাসহ ৪ ভুয়া পুলিশ আটক

» প্রাইম ব্যাংক ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স-এর মধ্যে পেরোল ব্যাংকিং চুক্তি স্বাক্ষর

» ইসির ২ আইন সংস্কার প্রস্তাবের অনুমোদন

» কল্কির সিক্যুয়েল থেকেও বাদ পড়লেন দীপিকা

» সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিশ’ জারির আবেদন

» বাংলাদেশের মানুষ পিআর পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করেছে: টুকু

» বায়তুল মোকাররম এলাকায় ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ শুরু

  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

নির্ভীক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যুবার্ষিকী আজ

গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ ছিলেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তিনি। প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে বদলে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি পুরুষ, আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। আজ ১ জুন এই আলোকিত মানুষটির ৪৫তম মৃত্যুবার্ষিকী৷ 

 

১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। ১৯৩৫ সালে তিনি ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দৈনিক ইত্তেহাদ-এর পরিচালনা পরিষদের সেক্রেটারি হিসেবে যোগ দেন। ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাক-এ রূপান্তরিত হয়। মানিক মিয়ার সম্পাদনায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর কারাভোগ করেন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি ছদ্মনামে পত্রিকায় নিয়মিত রাজনৈতিক নিবন্ধ লিখতেন।

‘রাজনৈতিক ধোঁকাবাজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তুলেছিলেন মানিক মিয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে তিনি কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার।

 

মানিক মিয়া ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সৎ ও নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তাকে মানুষের অধিকারের কথা বলতে হয়েছে। তিনি যেমন বাংলা সাংবাদিকতা জগতে পথপ্রদর্শক, তেমন রাজনীতিতেও।

মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ছবি: সংগৃহীত

মানিক মিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ছবি: সংগৃহীত

রাজনৈতিক জগতে তিনি ছিলেন হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। ঘনিষ্ঠ ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল মানিক মিয়ার।

 

দৈনিক ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার অবস্থান এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। ইত্তেফাক মানুষের মুক্তির পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে। মানিক মিয়া ছিলেন তার কান্ডারি।

 

বঙ্গবন্ধু ‘আমার মানিক ভাই’ শিরোনামে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘…আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাইর প্রভাব যে কত গভীর, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। ১৯৪৩ সাল থেকে তার সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দু’ভাই একসাথে জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করেছি।…একটা বিষয়ে আমরা উভয়ই একমত ছিলাম এবং তা হল, বাংলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ভিন্ন বাঙ্গালীর মুক্তি নেই, এ বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। আর ছিল না বলেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও দু’জন দু’ফ্রন্টে থেকে কাজ করেছি। আমি কাজ করেছি মাঠে-ময়দানে আর মানিক ভাই তার ক্ষুরধার লেখনীর সাহাঘ্যে।’

 

সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ১ জুন তিনি পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে ইন্তেকাল করেন।

তথ্য সহায়তা: দৈনিক ইত্তেফাক

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Design & Developed BY ThemesBazar.Com