বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো নেপালেও নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির কারণে সীমাহীন কষ্টে জীবনযাপন করছে দেশটির সাধারণ জনগণ। করোনা মহামারী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক পরিসরে গত দুই বছরে খাদ্যপণ্যের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার আঁচ লেগেছে দেশটির অর্থনীতিতেও।
আগামী দিনে নেপালের পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে, তার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনা মহামারী শুরুর আগে দেশটিতে এক লিটার সূর্যমূখী তেল বিক্রি হতো ১৬০ রুপিতে। বর্তমানে তা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে প্রায় তিনশ রুপি।
দেশটির ভোক্তা সংগঠনগুলোর হিসাব মতে, নেপালে বেশ কিছু খাদ্য পণ্যের দাম গত এক বছরে ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৩৭ বছর বয়সী পামফা খত্রী রাজধানী কাঠমান্ডুর একজন সবজি বিক্রেতা। পরিবারসহ কাঠমান্ডুর কাছে ভক্তপুর জেলায় থাকেন। তার সঙ্গে কথা হয় প্রতিবেদকের।
প্রতিদিন ভোর ৩টায় ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। সে সময় আশেপাশের খামার থেকে শাক-সবজি কিনতে বের হন। প্রতিদিন ৩০ কেজির বেশি সবুজ শাক ভর্তি ঝুড়ি গণপরিবহনে করে শহরে নিয়ে আসেন। সেগুলো বিক্রি করে তার দৈনিক আয় হয় আড়াই হাজার রুপির মত।
বিবিসির প্রতিনিধির কাছে খত্রী বলেন,‘‘আমার স্বামী কাজ করে না। তাই পুরো পরিবার আমার উপর নির্ভরশীল। আমার দুই ছেলের স্কুলের খরচও আমাকে দিতে হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং পরিবহন খরচ বাড়ছে, জীবন ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছে।’’
নেপালের মোট জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। স্থলবেষ্টিত দেশটির অবস্থান ভারত আর চীনের মাঝখানে। জ্বালানিসহ প্রায় সমস্ত প্রয়োজনীয় জিনিস আমদানির জন্য তাদের ভারতের ওপর বেশিরভাগ নির্ভর করতে হয়।
দেশটির আমদানি ব্যয় বাড়ার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যণ্ত সাত মাসে ১৬ শতাংশ কমে ৯৫৯ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।
খাদ্য ও জ্বালানির মত প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে নেপালকে অবশ্যই প্রয়োজনীয় ডলার জমা রাখতে হবে। এ কারণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে দেশটির সরকার। বর্তমানে গাড়ি, প্রসাধনী ও সোনার মতো পণ্য, যেগুলো অপরিহার্য নয়, সেসব আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রতি বছর রাস্তায় শত শত নতুন যানবাহন যুক্ত হওয়ায় জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা কমানোর চেষ্টা করছে সরকার।
পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবহার কমাতে প্রতি সপ্তাহের শনিবার একদিন ছুটির পরিবর্তে দুই দিন ছুটি ঘোষণার পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন নেপালের যোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী জ্ঞানেন্দ্র বাহাদুর কারকি।
এ ছাড়া, ব্যক্তিগত যানবাহনের চলাচল কমাতে নতুন নিয়ম চালুর কথাও ভাবা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, জোড় ও বেজোড় নম্বর প্লেটের গাড়ি ভিন্ন ভিন্ন দিনে চলার নিয়ম করলে জ্বালানি সাশ্রয় হতে পারে।
নেপালের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আয় আসে রেমিটেন্স থেকে। দেশটির ৩৫ লাখ মানুষ মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণপূর্ব এশিয়া ও ভারতে কাজ করেন। ২০২০ সালে প্রবাসীরা ৮০০ কোটি ডলার পাঠিয়েছে, যা মোট জিডিপির এক-চতুর্থাংশের বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, সেদিকে নজর রাখতে বাধ্য হচ্ছে নেপালি কর্মকর্তারা। কিন্তু দাম বৃদ্ধির বিপরীতে আয় কমায় দেশটির অনেকেই একটি অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন।
দেশটির অর্থনীতিবিদ ড. পোশ রাজ পাণ্ডে বলেছেন, এই রেমিটেন্স নেপালের গ্রামীণ পরিবারগুলোর সহায়তার প্রধান চাবিকাঠি। মহামারী ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সময় তাদের সংকট মোকাবিলায় সাহায্য করেছিল।
‘‘মহামারীতে লকডাউনের কারণে বহু মানুষ চাকরি হারিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। ফলে সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অতিরিক্ত প্রায় ১২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।’’