ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

লেগুনার পেছনে এক হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে অন্য হাতে পাশে বা উপড়ে থাপ্পর দিয়ে চলার বা থামার সংকেত দিচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়েই আবার যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াও আদায় করছে। রাকিব হাসান (১২) রাজধানীর মিরপুর-১, দিয়াবাড়ি রুটে কাজ করছে।

 

শুধু রাজধানীর মিরপুর নয়, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, গুলশান, সিপাইবাগ-গোড়ান থেকে গুলিস্তানসহ বিভিন্ন রুটে অনেক শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। যে বয়সে স্কুলের বই আর খেলাধুলায় মেতে থাকার কথা, সে বয়সে বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ কাজ করছে অনেক শিশু।

 

জানা গেছে, বাংলাদেশে শিশুশ্রম বেড়েই চলছে। দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় এখনও  শিশুদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও।  তারা বলছে, দারিদ্র্য, পরিবারের অসচেতনতা ও আইন প্রয়োগের ঘাটতির কারণে শৈশবের উচ্ছ্বলতা হারিয়ে ফেলছে শিশুরা। শিশু শ্রম নিরসন নীতিমালা ও শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরুর পরামর্শ দিয়েছে তারা।

 

শ্রম আইন অনুযায়ী-কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাইবে না বা কাজ করিতে দেওয়া যাইবে না।  কিন্তু সেখানে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ‘শিশু’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ‘কিশোর’ বিবেচনায় কাজে জড়ানোর বৈধতা দেওয়া হয়।

 

শিশু শ্রমিক রাকিব জানায়, তার বাবা নেই। সংসারে অভাবের কারণে কাজ করতে হয়।  সারাদিন পরিশ্রম করে দিনশেষে মায়ের হাতে ৩০০-৩৫০ টাকা তুলে দেয় রাকিব।

গুলিস্তান-হাজারীবাগ রুটে লেগুনা চালকের সহকারী আবুল কাশেম (১১) জানান, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সে সহকারীর কাজ করছেন। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেও আর পড়াতে পারেননি।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী,  বাংলাদেশে এখন সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার।  আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।

 

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ বলেন, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটি পরিবহন খাত। ঝুঁকির মধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম করছে এই শিশুরা।   কঠোর প্রয়োগ করে পুলিশ চাইলে একদিনেই বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ করলে ১০ থেকে ২০ হাজার শিশুশ্রমিক যাবে কোথায়? এ কারণে পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত।

 

শ্রম আইনে বলা হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সীদের কাজে নিয়োগের আগে সে শিশু না কিশোর বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে।  কোনো অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে কাজের কতটুকু সক্ষমতা তার সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকার সময়ে সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করবে। এই কাজে কোনভাবেই শিশু নিয়োগ করা যাবে না। চিকিৎসকের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে কোনো কিশোরকে কোন কারখানায় হালকা কাজে নিয়োগ দিলেও দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না।  সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করানো যাবে না।

 

সমাজবিজ্ঞানী ড. মো জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে দারিদ্র‌্যের হার কমাতে শিশু শ্রম ভূমিকা রাখছে। শিশুরা দোকান এবং কোন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের যথাযথ পরিচর্চার মাধ্যমে যদি কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।

 

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম নিরসনে এনজিওগুলোর নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।  সবার সহযোগিতায় আমরা ২০৩০ সালের আগেই শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারবো।

 

তিনি বলেন, ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ১ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

সূএ:রাইজিংবিডি.কম 

 

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ দুর্গাপূজা এক মণ্ডপে ২০০-র বেশি প্রতিমা-বিগ্রহ! লাখো ভক্তের সমাগমের প্রস্তুতি

» সিটি ব্যাংক ও গার্ডিয়ানের অংশীদারিত্বে প্রথমবারের মত ব্যাংকিং অ্যাপ থেকে ইন্স্যুরেন্স পলিসি কিনতে পারবেন গ্রাহকেরা

» ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিজিটাল বীমা পলিসি ডক্যুমেন্ট প্রদানের সেবা চালু করল মেটলাইফ বাংলাদেশ

» নওগাঁয় মহিলাসহ ৪ ভুয়া পুলিশ আটক

» প্রাইম ব্যাংক ও প্রগ্রেসিভ লাইফ ইন্স্যুরেন্স-এর মধ্যে পেরোল ব্যাংকিং চুক্তি স্বাক্ষর

» ইসির ২ আইন সংস্কার প্রস্তাবের অনুমোদন

» কল্কির সিক্যুয়েল থেকেও বাদ পড়লেন দীপিকা

» সাইফুজ্জামান ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে ‘রেড নোটিশ’ জারির আবেদন

» বাংলাদেশের মানুষ পিআর পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করেছে: টুকু

» বায়তুল মোকাররম এলাকায় ইসলামী আন্দোলনের বিক্ষোভ শুরু

  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুরা

লেগুনার পেছনে এক হাতে রড ধরে দাঁড়িয়ে অন্য হাতে পাশে বা উপড়ে থাপ্পর দিয়ে চলার বা থামার সংকেত দিচ্ছে। পেছনে দাঁড়িয়েই আবার যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়াও আদায় করছে। রাকিব হাসান (১২) রাজধানীর মিরপুর-১, দিয়াবাড়ি রুটে কাজ করছে।

 

শুধু রাজধানীর মিরপুর নয়, ফার্মগেট, ধানমন্ডি, গুলশান, সিপাইবাগ-গোড়ান থেকে গুলিস্তানসহ বিভিন্ন রুটে অনেক শিশু বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। যে বয়সে স্কুলের বই আর খেলাধুলায় মেতে থাকার কথা, সে বয়সে বিভিন্ন ঝুকিপূর্ণ কাজ করছে অনেক শিশু।

 

জানা গেছে, বাংলাদেশে শিশুশ্রম বেড়েই চলছে। দেশের বিভিন্ন কলকারখানা, বাসাবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ সব জায়গায় এখনও  শিশুদের নিয়োগ দেওয়া হয়। শিশুশ্রম বন্ধে কঠোর আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছে বিভিন্ন এনজিও।  তারা বলছে, দারিদ্র্য, পরিবারের অসচেতনতা ও আইন প্রয়োগের ঘাটতির কারণে শৈশবের উচ্ছ্বলতা হারিয়ে ফেলছে শিশুরা। শিশু শ্রম নিরসন নীতিমালা ও শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন এবং দীর্ঘমেয়াদে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া শুরুর পরামর্শ দিয়েছে তারা।

 

শ্রম আইন অনুযায়ী-কোনো পেশায় বা প্রতিষ্ঠানে কোনো শিশুকে নিয়োগ করা যাইবে না বা কাজ করিতে দেওয়া যাইবে না।  কিন্তু সেখানে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ‘শিশু’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করে ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের ‘কিশোর’ বিবেচনায় কাজে জড়ানোর বৈধতা দেওয়া হয়।

 

শিশু শ্রমিক রাকিব জানায়, তার বাবা নেই। সংসারে অভাবের কারণে কাজ করতে হয়।  সারাদিন পরিশ্রম করে দিনশেষে মায়ের হাতে ৩০০-৩৫০ টাকা তুলে দেয় রাকিব।

গুলিস্তান-হাজারীবাগ রুটে লেগুনা চালকের সহকারী আবুল কাশেম (১১) জানান, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে সে সহকারীর কাজ করছেন। বাবা-মা অনেক চেষ্টা করেও আর পড়াতে পারেননি।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা ২০১৩ অনুযায়ী,  বাংলাদেশে এখন সাড়ে ৩৪ লাখ শিশু কর্মরত রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৭ লাখ শিশু রয়েছে, যাদের কাজ শিশুশ্রমের আওতায় পড়েছে। বাকি শিশুদের কাজ অনুমোদনযোগ্য। কর্মরত শিশুদের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত আছে ১২ লাখ ৮০ হাজার।  আর ২ লাখ ৬০ হাজার শিশু অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। তাদের কাজের বৈশিষ্ট্য জীবন ও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ হুমকিস্বরূপ।

 

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের পরিচালক আব্দুস শহীদ মাহমুদ বলেন, শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজের একটি পরিবহন খাত। ঝুঁকির মধ্যে থেকে কঠোর পরিশ্রম করছে এই শিশুরা।   কঠোর প্রয়োগ করে পুলিশ চাইলে একদিনেই বন্ধ করে দিতে পারে। কিন্তু হঠাৎ বন্ধ করলে ১০ থেকে ২০ হাজার শিশুশ্রমিক যাবে কোথায়? এ কারণে পুনর্বাসনের কার্যক্রম হাতে নেওয়া উচিত।

 

শ্রম আইনে বলা হয়েছে, কোন প্রতিষ্ঠানে অল্প বয়সীদের কাজে নিয়োগের আগে সে শিশু না কিশোর বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে জন্মনিবন্ধন সনদ, স্কুল সার্টিফিকেট বা রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের প্রত্যয়নপত্রের ভিত্তিতে।  কোনো অভিভাবক তার কিশোর ছেলেকে কাজের জন্য অনুরোধ করলে একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসক কিশোরকে পরীক্ষা করে কাজের কতটুকু সক্ষমতা তার সিদ্ধান্ত দেবেন। সরকার সময়ে সময়ে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা ঘোষণা করবে। এই কাজে কোনভাবেই শিশু নিয়োগ করা যাবে না। চিকিৎসকের সার্টিফিকেটের ভিত্তিতে কোনো কিশোরকে কোন কারখানায় হালকা কাজে নিয়োগ দিলেও দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না।  সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টার মধ্যবর্তী সময়ে কাজ করানো যাবে না।

 

সমাজবিজ্ঞানী ড. মো জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দেশে দারিদ্র‌্যের হার কমাতে শিশু শ্রম ভূমিকা রাখছে। শিশুরা দোকান এবং কোন প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কাজ করছে। নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় কিংবা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় দরিদ্র শিশু শ্রমিকদের যথাযথ পরিচর্চার মাধ্যমে যদি কারিগরি শিক্ষায় দক্ষ করে গড়ে তুলতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে।

 

শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম নিরসনে এনজিওগুলোর নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে।  সবার সহযোগিতায় আমরা ২০৩০ সালের আগেই শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে পারবো।

 

তিনি বলেন, ২৮৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসন প্রকল্পের চতুর্থ পর্যায়ে ১ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে আনতে তাদের উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

সূএ:রাইজিংবিডি.কম 

 

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

Design & Developed BY ThemesBazar.Com