জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১১ শিক্ষার্থীকে করা হয়েছে সাময়িক বহিষ্কার। বিশ্ববিদ্যালয়টির এক অফিস আদেশে বলা হয় দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করাসহ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর কারণে তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগে এ বহিষ্কার নিয়ে বইছে সমালোচনার ঝড়। বহিষ্কারাদেশের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ। আর যে কারণে এই শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও বহিষ্কার করা হয়েছে সেটাকে অপরাধ বলাও এক ধরনের অপরাধ বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ।
গত ২৪শে মার্চ মধ্যরাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গেণ্ডারিয়ার ১৬বি/১ দ্বীননাথ সেন রোডস্থ বিল্ডিং বাড়ির ৩য় তলার একটি ফ্ল্যাটের মেস বাসায় অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ১২ জন কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। জানানো হয়, এ সময় তাদের কাছ থেকে একাধিক নিষিদ্ধ ইসলামী বই, শিবির সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র, ল্যাপটপ, মোবাইলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়।
পরবর্তীতে গ্রেপ্তারকৃত সবাইকে আদালতে পাঠানো হলে তাদের ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত। ২০২১ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানার বিস্ফোরক আইনের একটি মামলায় এই শিক্ষার্থীদের আসামি করা হয়।
গ্রেপ্তার হওয়া ১২ জনের সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা হলেন- ২০১৭-১৮ সেশনের (১৩তম ব্যাচ) সংগীত বিভাগের আল-মামুন রিপন, ব্যবস্থাপনা বিভাগের মো. ফাহাদ হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৌহিদুর রহমান, ২০১৮-১৯ সেশনের (১৪তম ব্যাচ) লোক প্রশাসন বিভাগের মো. মেহেদী হাসান (মাহদী), ইতিহাস বিভাগের ইসরাফিল হোসেন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ইব্রাহিম আলী, ২০১৯-২০ সেশনের (১৫তম ব্যাচ) রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেহেদী হাসান ও ওবাইদুল ইসলাম, মনোবিজ্ঞান বিভাগের আবদুর রহমান (অলি), ২০২০-২১ সেশনের (১৬তম ব্যাচ), হিসাববিজ্ঞান বিভাগের রওশন উল ফেরদৌস, বাংলা বিভাগের শ্রাবন ইসলাম রাহাত, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৌহিদুর রহমান।
পরবর্তীতে গত ৩০শে মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে এক আদেশে তাদের সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এতে বলা হয়, শিক্ষার্থীগণ দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করাসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো ও বিভিন্ন স্থানে সরকার বিরোধী স্লোগান দিয়ে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা এবং ২৬শে মার্চ মহান স্বাধীনতা দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধরনের অন্তর্ঘাতমূলক কাজের মাধ্যমে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করায় পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো।
তবে এই অপরাধে বহিষ্কার করাকে অপরাধ বলতেও নারাজ বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কী শিক্ষার্থীদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখবে, না কাস্টমার হিসেবে দেখবে, নাকি দেখবে নিজের সত্ত্বার অংশ হিসেবে?
পত্রিকায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটা বক্তব্য দেখলাম- ‘সার্বভৌমত্ব’ ক্ষতিগ্রস্ত করা, দেশের ‘অনিষ্ট’ করা, সরকার বিরোধী বক্তব্য প্রচার ইত্যাদি অভিযোগে তারা কয়েকজন শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তারা এখন আটক। প্রশাসনের বক্তব্য খুবই অস্পষ্ট।
এই নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের এতো শক্তি যে তারা সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত করছে? সরকার বিরোধী বক্তব্য প্রচার তো কোনো অপরাধ হতে পারে না বরং একে অপরাধ বলা, তার জন্য তাদের শাস্তি দেয়াই তো অপরাধ।
এদিকে শিক্ষা খরচ জোগাড় করতে না পেরে আরেকজন (কুয়েট) বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করলো। শরীয়তপুরের এক স্কুলের ছাত্রী শিক্ষা অব্যাহত রাখার খরচ জোগাড় করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিলো। একে একে এসব ঘটনাই দেখতে হচ্ছে আমাদের। সরকারের তো বটেই শিক্ষক পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনের দায় নাই? অবশ্যই আছে।
৭ই এপ্রিল প্রথম আলোর এক নিবন্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কারাগারে আটক শিক্ষার্থী সাময়িকভাবে বহিষ্কার করার ঘটনার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের প্রখ্যাত অধ্যাপক ও আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের সভাপতি ড. আলী রীয়াজ। তিনি এতে লেখেন, এই ১১ শিক্ষার্থী কারাগারে আছেন কেন? তাদের বিরুদ্ধে ‘সরকার বিরোধী অপতৎপরতা ও আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো’র অভিযোগ এনেছে পুলিশ। কোনো আদালত তাদের ইতিমধ্যে আইনি প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত করেননি, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে এক ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।
পরবর্তীতে ১২ই এপ্রিল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ ক্রাইম রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করেন গ্রেপ্তার হওয়া শিক্ষার্থীদের পরিবার। ১২ জন শিক্ষার্থীর পক্ষে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন মেহেদীর মা নুরজাহান বেগম।
তিনি বলেন, মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, এইসব শিক্ষার্থীরা দ্রব্যমূল্য কমানোর দাবিতে আয়োজিত এক মিছিলে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে এবং এই সংক্রান্ত প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন করে রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেছেন এবং দেশের আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর কাজে লিপ্ত ছিলেন। শুধু তাই নয়, এরপর তাদের আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে ২০২১ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ী থানার বিস্ফোরক আইনের আরেকটি মামলায়। অথচ এই সময়ে করোনায় বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকায় আমাদের সন্তানরা গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। গ্রেপ্তার হওয়া ১২ শিক্ষার্থীর মধ্যে চারজন চলতি বছরের মার্চে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। গত ৮ই মার্চ ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে যুক্ত হতে এইসব শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ জীবনে প্রথম ঢাকায় এসেছেন। তাহলে এইসব শিক্ষার্থীরা ঢাকায় না এসেও কীভাবে ঢাকায় ঘটা একটা মামলার আসামি হন? ২০২১ সালে আমাদের অনেক সন্তান ঢাকায় ছিলেন না। তারা ঢাকায় এসেছেন মাত্র ২০ দিন। তাহলে কেন এক বছর আগের মামলায় তাদের যুক্ত করা হলো?
তিনি আরও বলেন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের জন্য কোনো আবাসিক হল নেই। যার কারণে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ভাড়া মেসে থাকছেন। সেখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ যদি বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সন্তানদের জন্য হলের ব্যবস্থা করতে পারতো তাহলে আমাদের এইদিন দেখতে হতো না। অথচ দেখেন যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় এইসব শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর কথা সেখানে তারা বিমাতাসূলভ আচরণ করে ১১ শিক্ষার্থীকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই আচরণে খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমরা জানতে চাই কোন আইনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাদের বহিষ্কার করা হয়েছে? পুলিশের মিথ্যা মামলা আমলে নিয়ে যদি বিশ্ববিদ্যালয়ও শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করে তাহলে শিক্ষার্থীরা কার কাছে যাবে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোস্তফা কামাল বলেন, এই ঘটনায় একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা জামিনে আসলে বহিষ্কার আদেশ প্রত্যাহার করা হবে। আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে ধারা আছে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং স্বাধীনতা দিবস বানচালের যে বিষয় এই বিষয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ আছে সেজন্য সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিষয়ে ইতিবাচক। যদি তারা জামিন নিয়ে আসে তাহলে বহিষ্কারের বিষয়ে চিন্তা করা হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, মামলাতো বিভিন্ন কারণে হতে পারে। কেউ ধরেন গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে গেছে জায়গা জমি নিয়ে ঝামেলা আছে সেখানেও তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে। সেই কারণে নিশ্চিয়ই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেবে সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আইন সেই আইন অনুযায়ী হবে।
তিনি আরও বলেন, যেহেতু এই শিক্ষার্থীদের বিষয়ে মামলা চলমান তাই এই শিক্ষার্থীদের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারবে না। তাদের বিরুদ্ধে একটা মামলা হয়েছে সেই কারণে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিয়ে ওরাই যদি শাস্তিটা দিয়ে দেয় তাহলেতো আদালতের জন্য কিছু বাকি রাখলো না। নিজেরাই দিয়ে দিলো। সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। ঘটনা আদৌ সত্য কিনা। সেটার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা হতে পারে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নেবে যেহেতু এগুলো জনগণের টাকায় চলে আমরা বিষয়গুলোকে প্রশ্রয় দিতে পারছি না তারপর বহিষ্কার করবে। সেসব কোনোকিছু না করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে না। শুধু মামলা হওয়াটাতো অপরাধ না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনেও এটা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেবার মতো অপরাধ না। সূএ:মানবজমিন