লোভনীয় অফার দিয়ে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে লাপাত্তা হওয়া ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ওরফে সাদ্দাম ও প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। চক্রটি তিন দফায় ৯ হাজারের বেশি গ্রাহককে আকৃষ্ট করে হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা। পণ্য বা টাকা ফেরত না দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির এমডি মশিউর রহমান ধানমন্ডিতে কেনেন তিন কোটি টাকার ফ্ল্যাট। চড়তেন ৬০ লাখ টাকার গাড়িতে। প্রতি মাসে কর্মীদের বেতন দিতেন ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। গতকাল দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব’র মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব’র আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা জানান।
তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন অনলাইন বিজনেস, ই-কমার্স এবং ডিজিটাল ব্যবসায়িক কারসাজির মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করার বেশকিছু অভিযোগ পেয়েছে র্যাব। ২০২২ সালের ১৮ই মার্চ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে এক ভুক্তভোগী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং পরিচালকসহ মোট নয়জনের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এছাড়া আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ রয়েছে।
তারা জানায়, প্রতিষ্ঠানের এমডি এবং ডিরেক্টরের সঙ্গে একাধিকবার ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে তারা এ সংক্রান্ত বিষয়ে মানববন্ধন করেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, গত রাতে র্যাব-২ এবং র্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে ফরিদপুর হতে প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আকাশ নীলের এমডি মশিউর রহমান ওরফে সাদ্দাম এবং পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে ফরিদপুর ও রাজধানী ঢাকা হতে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে ২টি মোবাইল ফোন, ২টি ল্যাপটপ এবং ১টি প্রাইভেটকার উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার বিভিন্ন বিষয়াদি ও কৌশল সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে।
জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, মশিউরের মাথায় অনলাইনে ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া এলে অ্যামাজন, আলীবাবার মতো অনলাইনে ব্যবসা করার ইচ্ছা হয়। এরপর ২০১৯ সালে আকাশ নীল কোম্পানি নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেইজ তৈরি করে এবং ট্রেড লাইসেন্স গ্রহণ করে। প্রথমে তারা রাজধানীর কাঁঠাল বাগান এলাকায় একটি অফিস চালু করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করে। তবে করোনার কারণে তার ব্যবসা সচল রাখতে পারেনি। সে ২০১৯ সাল থেকে ২০২১ এর মে মাস পর্যন্ত ব্যবসা না করার কারণে তার যে পুঁজি দিয়ে অফিস সাজিয়ে ছিল তাতে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পরবর্তীতে সে মানুষের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে বেশি মুনাফার লোভ দেখিয়ে টাকা নিয়ে তার কোম্পানিকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে কাঁঠাল বাগান থেকে পান্থপথে স্থানান্তরিত করে। তার লিমিটেড কোম্পানি ছিল পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসা। তার নিজের নামে ৭৭%, বোনের নামে ১০%, মায়ের নামে ৮% এবং তার স্ত্রীর নামে ৫% শেয়ার রেখেছিল। তার এই ব্যবসায় সে ছিল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মা ছিলেন চেয়ারম্যান এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু ইফতেখারুজ্জামান রনি ছিল ডিরেক্টর। পরবর্তীতে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন মোটরসাইকেলের অফার দিয়ে যখন রমরমা ব্যবসা শুরু করেছিল তখন সে এই ধরনের ব্যবসা দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে মোটরসাইকেল ভিত্তিক অফারে ব্যবসা দিয়ে পুনরায় তারা যাত্রা শুরু করে। গ্রাহকদের আকৃষ্ট হওয়ার মূল কারণ ছিল স্বল্পমূল্যে বা ডিসকাউন্টে প্রতিটি মোটরসাইকেলে সর্বোচ্চ ৩০% পর্যন্ত মূল্য ছাড় দিয়ে থাকেন। এই ডিসকাউন্টের জন্যই সাধারণত গ্রাহকরা আকৃষ্ট হতো এবং গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপ মেইনটেন করতো। গ্রুপে সে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করার জন্য বিভিন্ন সময়ে আশার বাণী, লোভনীয় অফার এবং মোটিভেশনাল বক্তব্য প্রদান করতো।
র্যাব আরও বলে, গ্রেপ্তারকৃতরা প্রথম ক্যাম্পেইন করেছিল গত মে মাসে যাতে ৩০% ছাড়ে ২ মাসের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে ২ শতাধিক, পরবর্তী ক্যাম্পেইনে গত জুলাই মাসে ২৫% ডিসকাউন্টে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তায় ১ হাজারের অধিক ও গত আগস্ট মাসে ৩য় ক্যাম্পেইনে ২৩% ছাড়ে ২৫ দিনের মধ্যে সরবরাহের আশ্বাসে ৯ হাজারের অধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পায়। মোটরসাইকেলের পাশাপাশি লোভনীয় ছাড়ে মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স পণ্য, গৃহস্থালির অন্যান্য পণ্য বিক্রি নিয়েও অফার প্রদান করেছিল। গত সেপ্টেম্বরে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা তার প্রদানকৃত অর্থ ফেরত চাইতে থাকে। গ্রাহকদের চাপ বাড়ায় গত নভেম্বরে গ্রেপ্তারকৃত মশিউর অফিস বন্ধ করে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, তার ব্যবসার মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ইলেক্ট্রনিক পাওয়ার ব্যাংক, হেডফোন, মোবাইল এবং মোটরসাইকেল ছিল। তার সাপ্লাই দেওয়ার সিস্টেম ছিল ডিলার থেকে নগদ টাকায় মালামাল ক্রয় করে সরাসরি তার নিজের অফিসে নিয়ে আসতো। তার প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কোনো গোডাউন ছিলনা। অফিস থেকে বিভিন্নভাবে কুরিয়ার সাভির্সের মাধ্যমে গ্রাহকের কাছে পণ্য পৌঁছে দেওয়া হতো। গ্রাহকদের টাকাগুলো সরাসরি তার ব্যাংকের একাউন্টে জমা হতো এবং সেখান থেকে তা উত্তোলন করতো। অন্যান্য ই-কমার্স ব্যবসার মতো গেটওয়ে সিস্টেম থাকলেও সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হতো। ই-কমার্স নীতিমালার কারণে পণ্য ডেলিভারি না হলে টাকা গেটওয়েতে আটকে থাকার কারণে সেসব টাকা গ্রাহকদের রিফান্ড করা হতো। সরাসরি ব্যাংক একাউন্টে প্রদানকৃত অর্থ নিয়ে তারা প্রতারণা করতো।
জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, উক্ত প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী নিয়োগ ছিল। যাদের মাসিক ৪-৫ লাখ টাকা বেতন দেয়া হতো। তারা কোম্পানির অর্থে ধানমন্ডিতে একটি ফ্ল্যাট আছে যার বর্তমান মূল্য ৩ কোটি টাকা, ২টি দামি গাড়ি একটি প্রিয়াশ ও একটি সিএইচআর ব্যবহার করেন। এছাড়া কোম্পানির প্রায় ৪টি টাটা পিকআপ রয়েছে। বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে দেনা প্রায় ৩০ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে তার ৪টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সংস্থার সূত্রে প্রকাশিত বিপুল পরিমাণ দায়ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের প্রেক্ষিতে গ্রেপ্তারকৃতরা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। সূএ: মানবজমিন