কফি হাউসের সেই আড্ডাটা

কৃষ্ণা চৌধুরী :১৯৪২ সাল। গান্ধীজীর ডাকে শুরু হয়েছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তরের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আরও কয়েক বছর পর আসতে চলেছে স্বাধীনতা, দেশভাগের ক্ষত আর যন্ত্রণাকে সঙ্গে করে। এমত দুঃসময়ে তৎকালীন কফি বোর্ড কলকাতায় দুটি কফি জয়েন্ট খুলে ফেললেন। একটি চিত্তরঞ্জন এভিনিউ বা তদানীন্তন সেন্ট্রাল এভিনিউতে  কফি হাউস এবং অপরটি বইপাড়ার বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটে এ্যালবার্ট হল কফি হাউস। এই এ্যালবার্ট হলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ব্রাহ্মসমাজের কেশব চন্দ্র সেন।

 

সেটি ১৮৭৬ সালের কথা। তখন এটি ছিল মূলত সভাগৃহ। এই ১৮৭৬ সালেই শ্রদ্ধেয় সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে জন্ম নেয় ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন। যা পরবর্তী কালে ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফারেন্সে উন্নীত হয় এবং অবশেষে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সৃষ্টি হয়। মনে করা হয় এই ঘটনাবলীর সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত ঐতিহাসিক এ্যালবার্ট হল।

ব্রিটিশ আমলে এই স্থানে কফি পান করতে আসতেন সাহেব সুবোর দল অথবা সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত দিশী সাহেবের দলবল। তবে তখন এ্যালবার্ট হলে ছিল হাউস অফ লর্ডস এবং হাউস অফ কমন্স। তিন তলার ব্যালকনি লর্ডদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। লর্ডেরা সম্ভবত অধিক ধনী অথবা উচ্চপদস্থ হতেন। কারণ সেখানে কফি এবং খাদ্যসম্ভার অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তিন তলার আর একটি বিশেষত্ব ছিল। সেখানে কফি আসত কফি পটে। কফি, দুধ, চিনি আলাদা আলাদা পাত্রে আসত। যে যার নিজের পছন্দ অনুযায়ী মিশিয়ে নিতে হত।

 

বলতে নেই যতদূর মনে পড়ে প্রথম প্রথম যখন কফি হাউস যেতাম তখন ওই কফিপটেই কফি আসত। লর্ড না হলেও লেডি ছিলাম তো! হলে কি হয় একটুও পুলকিত হতাম না। কফি পানীয়টাই ছিল না পসন্দ। কফির সঙ্গে টফিও পাওয়া যেত সেই প্রথম যুগ থেকে।

 

১৯৪৭ সাল। স্বাধীন ভারতবর্ষে এ্যালবার্ট হল নাম পাল্টে হল ইণ্ডিয়ান কফি হাউস। আমরা যাকে চিনি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস নামে।
স্বাধীন ভারতে কফি হাউসের আগেকার সাহেবি কৌলীন্য হ্রাস পেয়ে শুরু হল বাঙালির বা বলা ভাল কোলকাতার এক নিজস্ব ঘরানা। একে ঠিক সাংস্কৃতিক পীঠস্থান না বললেও এটি হয়ে উঠল কোলকাতার নতুন সাংস্কৃতিক আড্ডাস্থল। সে যুগের Calcutta University এবং Presidency College এর শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের কফির কাপে তুফান ওড়ানোর নিমিত্ত নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল এই কফি হাউসে। এছাড়া উত্তর ও মধ্য কোলকাতার অন্যান্য কলেজের ছেলেমেয়েরাও কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এলে কফি হাউসে  ঢুঁ মারা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন।

 

মনে করা হয় এই কফি হাউসের ধারণাটা এসেছিল পশ্চিমা দুনিয়ার ক্যাফে কালচার থেকে। কফি হাউসে নিয়মিত আসতেন সেযুগের কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র এবং মঞ্চাভিনেতা। আসতেন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা। আসতেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, অমর্ত্য সেন। তবে নবনীতা দেবসেনের একটা লেখায় পড়লাম যে, তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তিনি কফি হাউসে আড্ডা দেবেন না এই শর্তে। এইসব তথ্য উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত। আগে শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার এনারা নিয়মিত আসতেন চিত্তরঞ্জন এভিনিউ এর কফি হাউসে।

 

উইকিপিডিয়া এবং মোহনা কাঞ্জিলালের লেখা থেকে পাই সৌমিত্র চ্যাটার্জী, অপর্ণা সেন, সুনীল গাঙ্গুলী এনারাও ছিলেন কফি হাউসের নিয়মিত আড্ডাধারী। নীললোহিত নাকি মাঝে মাঝেই কফির পয়সা মেটাতে না পেরে সঙ্গের ছাতাটি জমা রাখতেন। তবে বর্ষাকাল না হলে কি করতেন সেটা অবশ্য জানা নেই। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি কাকা অর্থাৎ অসীম চ্যাটার্জী প্রায়শই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে চলে আসতেন কফি হাউসের টেবিলে। শঙ্খ ঘোষ আসতেন তার কবি বন্ধুদের নিয়ে। তার এক কবি বন্ধু নিশীথ ভড় ছিলেন আমার অফিসের এক দাদা। নিশীথদার কবিতা কখনও সখনও দেশ পত্রিকায় ছাপা হত। আমি তখন কলেজ স্ট্রিটে একটা ব্যাঙ্কে যোগ বিয়োগ করি।
ব্যাঙ্ক ছুটি হওয়ার পর কফি হাউসের টেবিল আলোকিত করা ছিল আমার এই নিশীথ দাদার অবশ্য কর্তব্য।

 

এর অনেক বছর পরে আরেক দাদা কল্যাণ ব্যানার্জী আমাদের ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে আসেন। তিনি কবিতা লিখতেন কিনা জানিনা কিন্তু তাঁর অনেক কবি বন্ধু ছিল এবং তাঁরা নিয়মিত কফি হাউসের আড্ডায় যেতেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের, এখন যাদের সেলিব্রেটি বলা হয়, তেমন কারও সঙ্গে আমার কফি হাউস, বইমেলা বা অন্য কোথাও এক মঞ্চ ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। কফি হাউসে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল না।

 

প্রথম গিয়েছিলাম দিদির সঙ্গে কলেজে ঢোকার আগে আগে। তখন দুচোখে শুধু অপার বিস্ময়, যাই দেখি তাতেই মুগ্ধ। দিদি কফি আর পকোড়া খাইয়েছিল। কফি তখন বিজাতীয় পানীয়। পকোড়াতেই মজেছিলাম। আমাদের বন্ধু বালিকাবধূ জয়শ্রীর নতুন বর অমিতদার সঙ্গে প্রথম আলাপ এই কফি হাউসে। অমিতদা পরিচয় পর্বে আমাদের ট্রীট দিয়েছিলেন কবিরাজী কাটলেট। একবার ভারতবর্ষের দুই প্রান্ত থেকে আমার দুই বন্ধু এসেছিলেন বঙ্গদর্শনে। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দির ও সুন্দরবনের জঙ্গল পরিদর্শনের মাঝে একদিনের বিরতিতে তারা কোলকাতার ঝলক দর্শনে বেরিয়েছিলেন। জয়শ্রী কান্ননের উৎসাহেই আমরা হেদুয়ার স্বামী বিবেকানন্দের বসতবাড়ি থেকে ট্রামে চেপে কফি হাউসে হাজির হলাম।

 

সেই সময়ে কফি হাউস বেশ বিবর্ণ। তাতেও আমার ভিন শহরের বন্ধুরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেটা ২০০৯ সাল। এরপর আর একবার কফি হাউস গিয়েছিলাম ২০১৯সালে। তখন কিন্তু নতুন করে সেজে উঠেছে কোলকাতার প্রথম ক্যাফে।

 

কফি হাউস নিয়ে যে বিখ্যাত নস্টালজিক গানে আমরা মজে আছি সেটির সৃষ্টি ১৯৮০সালে। সেই গানের কুশীলবরা, অর্থাৎ গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুরকার সুপর্ণ কান্তি ঘোষ এবং শিল্পী মান্না দে কফি হাউসে যাতায়াত করতেন কিনা আমার জানা নেই। তবে গানটি আমাদের কোলকাতার জীবনে  একটি মাইল ফলক, একটি সময়ের দলিল। সেদিন হোয়াটস অ্যাপে দেখলাম ঢাকার মইদুল সাহেব (কফি হাউস খ্যাত) জীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন। তিনি নাকি মান্না দের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। হোয়াটস অ্যাপ বলেই ‘নাকি’ ব্যবহার করলাম।

গানটির কথা স্মরণ করতে খুব লোভ হচ্ছে-

“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই
আজ আর নেই………………………।।

নিখিলেশ প্যারিসে মইদুল ঢাকাতে
নেই তারা আজ কোন খবরে|
গ্র্যান্ড এর গিটারিস্ট গোয়ানিস ডি সুজা
ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে|
কাকে যেন ভালবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে
পাগলা গারদে আছে রমা রায়
অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যান্সারে
জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়।।

সুজাতাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে
শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তার
হীরে আর জহরতে আগা গোড়া মোড়া সে
গাড়ী বাড়ি সব কিছু দামি তার
আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ সান্যাল
বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকত
আর চোখ ভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে
ডি সুজাটা বসে শুধু থাকতো।।

একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘণ্টা
চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত
কখনো বিষ্ণুদে কখনো যামিনী রায়
এই নিয়ে তর্কটা চলতো
রোদ ঝড় বৃষ্টিতে যেখানেই যে থাকুক
কাজ সেরে ঠিক এসে জুটতাম
চারটেতে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে
সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম।।

কবি কবি চেহারা কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ
মুছে যাবে অমলের নামটা
একটা কবিতা তার কোথাও হলো না ছাপা
পেলো না সে প্রতিভার দামটা
অফিসের সোশ্যালে এমেচার নাটকে
রমা রায় অভিনয় করতো
কাগজের রিপোর্টার মইদুল এসে রোজ
কি লিখেছে তাই শুধু পড়তো।

সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে
সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সেদিনের মালী নেই।
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে
কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে,
কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।

শেষ করলাম আমার কফি হাউস বৃত্তান্ত।

সূূএ:ডেইলি বাংলাদেশ

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ভারতীয়দের জন্য ভিসা সীমিত করলো বাংলাদেশ

» ভারতের অপপ্রচারে ক্ষতি নেই, আমাদের চিকিৎসা ও বাজার সবই আছে : উপদেষ্টা সাখাওয়াত হোসেন

» আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে কোনো আপস নেই : নুর

» দরিদ্র দেশগুলোকে ১০ হাজার কোটি ডলার ঋণ দেবে বিশ্বব্যাংক

» নির্বাচন কমিশনে ৪টি নতুন কমিটি গঠন

» ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক হবে প্রতিবেশীর মতো : সারজিস

» বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকলে যত বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হোক না কেন আমরা জিতবেই.. মাওলানা মামুনুল হক

» ব্র্যাক ব্যাংক-কে ‘বেস্ট ব্যাংকিং পার্টনার অফ দ্যা ইয়ার ২০২৩’ স্বীকৃতি দিয়েছে জেডটিই বাংলাদেশ

» পলাশে নবাগত ইউএনওর সাথে সাংবাদিকদের মতবিনিময় সভা

» অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে বড় বিদ্রোহ হবে: উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

কফি হাউসের সেই আড্ডাটা

কৃষ্ণা চৌধুরী :১৯৪২ সাল। গান্ধীজীর ডাকে শুরু হয়েছে ভারত ছাড়ো আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। মনুষ্যসৃষ্ট মন্বন্তরের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আরও কয়েক বছর পর আসতে চলেছে স্বাধীনতা, দেশভাগের ক্ষত আর যন্ত্রণাকে সঙ্গে করে। এমত দুঃসময়ে তৎকালীন কফি বোর্ড কলকাতায় দুটি কফি জয়েন্ট খুলে ফেললেন। একটি চিত্তরঞ্জন এভিনিউ বা তদানীন্তন সেন্ট্রাল এভিনিউতে  কফি হাউস এবং অপরটি বইপাড়ার বঙ্কিম চ্যাটার্জী স্ট্রীটে এ্যালবার্ট হল কফি হাউস। এই এ্যালবার্ট হলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ ব্রাহ্মসমাজের কেশব চন্দ্র সেন।

 

সেটি ১৮৭৬ সালের কথা। তখন এটি ছিল মূলত সভাগৃহ। এই ১৮৭৬ সালেই শ্রদ্ধেয় সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে জন্ম নেয় ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন। যা পরবর্তী কালে ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কনফারেন্সে উন্নীত হয় এবং অবশেষে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস সৃষ্টি হয়। মনে করা হয় এই ঘটনাবলীর সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত ঐতিহাসিক এ্যালবার্ট হল।

ব্রিটিশ আমলে এই স্থানে কফি পান করতে আসতেন সাহেব সুবোর দল অথবা সাহেবি কেতায় অভ্যস্ত দিশী সাহেবের দলবল। তবে তখন এ্যালবার্ট হলে ছিল হাউস অফ লর্ডস এবং হাউস অফ কমন্স। তিন তলার ব্যালকনি লর্ডদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। লর্ডেরা সম্ভবত অধিক ধনী অথবা উচ্চপদস্থ হতেন। কারণ সেখানে কফি এবং খাদ্যসম্ভার অধিকতর ব্যয়সাপেক্ষ ছিল। তিন তলার আর একটি বিশেষত্ব ছিল। সেখানে কফি আসত কফি পটে। কফি, দুধ, চিনি আলাদা আলাদা পাত্রে আসত। যে যার নিজের পছন্দ অনুযায়ী মিশিয়ে নিতে হত।

 

বলতে নেই যতদূর মনে পড়ে প্রথম প্রথম যখন কফি হাউস যেতাম তখন ওই কফিপটেই কফি আসত। লর্ড না হলেও লেডি ছিলাম তো! হলে কি হয় একটুও পুলকিত হতাম না। কফি পানীয়টাই ছিল না পসন্দ। কফির সঙ্গে টফিও পাওয়া যেত সেই প্রথম যুগ থেকে।

 

১৯৪৭ সাল। স্বাধীন ভারতবর্ষে এ্যালবার্ট হল নাম পাল্টে হল ইণ্ডিয়ান কফি হাউস। আমরা যাকে চিনি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস নামে।
স্বাধীন ভারতে কফি হাউসের আগেকার সাহেবি কৌলীন্য হ্রাস পেয়ে শুরু হল বাঙালির বা বলা ভাল কোলকাতার এক নিজস্ব ঘরানা। একে ঠিক সাংস্কৃতিক পীঠস্থান না বললেও এটি হয়ে উঠল কোলকাতার নতুন সাংস্কৃতিক আড্ডাস্থল। সে যুগের Calcutta University এবং Presidency College এর শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের কফির কাপে তুফান ওড়ানোর নিমিত্ত নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল এই কফি হাউসে। এছাড়া উত্তর ও মধ্য কোলকাতার অন্যান্য কলেজের ছেলেমেয়েরাও কলেজ স্ট্রিট পাড়ায় এলে কফি হাউসে  ঢুঁ মারা অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন।

 

মনে করা হয় এই কফি হাউসের ধারণাটা এসেছিল পশ্চিমা দুনিয়ার ক্যাফে কালচার থেকে। কফি হাউসে নিয়মিত আসতেন সেযুগের কবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার, চলচ্চিত্র এবং মঞ্চাভিনেতা। আসতেন ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিত্বরা। আসতেন সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, উৎপল দত্ত, অমর্ত্য সেন। তবে নবনীতা দেবসেনের একটা লেখায় পড়লাম যে, তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল তিনি কফি হাউসে আড্ডা দেবেন না এই শর্তে। এইসব তথ্য উইকিপিডিয়া থেকে সংগৃহীত। আগে শুনেছিলাম সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার এনারা নিয়মিত আসতেন চিত্তরঞ্জন এভিনিউ এর কফি হাউসে।

 

উইকিপিডিয়া এবং মোহনা কাঞ্জিলালের লেখা থেকে পাই সৌমিত্র চ্যাটার্জী, অপর্ণা সেন, সুনীল গাঙ্গুলী এনারাও ছিলেন কফি হাউসের নিয়মিত আড্ডাধারী। নীললোহিত নাকি মাঝে মাঝেই কফির পয়সা মেটাতে না পেরে সঙ্গের ছাতাটি জমা রাখতেন। তবে বর্ষাকাল না হলে কি করতেন সেটা অবশ্য জানা নেই। প্রত্যক্ষদর্শীর কাছে শুনেছি কাকা অর্থাৎ অসীম চ্যাটার্জী প্রায়শই প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে চলে আসতেন কফি হাউসের টেবিলে। শঙ্খ ঘোষ আসতেন তার কবি বন্ধুদের নিয়ে। তার এক কবি বন্ধু নিশীথ ভড় ছিলেন আমার অফিসের এক দাদা। নিশীথদার কবিতা কখনও সখনও দেশ পত্রিকায় ছাপা হত। আমি তখন কলেজ স্ট্রিটে একটা ব্যাঙ্কে যোগ বিয়োগ করি।
ব্যাঙ্ক ছুটি হওয়ার পর কফি হাউসের টেবিল আলোকিত করা ছিল আমার এই নিশীথ দাদার অবশ্য কর্তব্য।

 

এর অনেক বছর পরে আরেক দাদা কল্যাণ ব্যানার্জী আমাদের ব্রাঞ্চে বদলি হয়ে আসেন। তিনি কবিতা লিখতেন কিনা জানিনা কিন্তু তাঁর অনেক কবি বন্ধু ছিল এবং তাঁরা নিয়মিত কফি হাউসের আড্ডায় যেতেন। বিখ্যাত ব্যক্তিদের, এখন যাদের সেলিব্রেটি বলা হয়, তেমন কারও সঙ্গে আমার কফি হাউস, বইমেলা বা অন্য কোথাও এক মঞ্চ ছাড়া দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। কফি হাউসে আমার নিয়মিত যাতায়াত ছিল না।

 

প্রথম গিয়েছিলাম দিদির সঙ্গে কলেজে ঢোকার আগে আগে। তখন দুচোখে শুধু অপার বিস্ময়, যাই দেখি তাতেই মুগ্ধ। দিদি কফি আর পকোড়া খাইয়েছিল। কফি তখন বিজাতীয় পানীয়। পকোড়াতেই মজেছিলাম। আমাদের বন্ধু বালিকাবধূ জয়শ্রীর নতুন বর অমিতদার সঙ্গে প্রথম আলাপ এই কফি হাউসে। অমিতদা পরিচয় পর্বে আমাদের ট্রীট দিয়েছিলেন কবিরাজী কাটলেট। একবার ভারতবর্ষের দুই প্রান্ত থেকে আমার দুই বন্ধু এসেছিলেন বঙ্গদর্শনে। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দির ও সুন্দরবনের জঙ্গল পরিদর্শনের মাঝে একদিনের বিরতিতে তারা কোলকাতার ঝলক দর্শনে বেরিয়েছিলেন। জয়শ্রী কান্ননের উৎসাহেই আমরা হেদুয়ার স্বামী বিবেকানন্দের বসতবাড়ি থেকে ট্রামে চেপে কফি হাউসে হাজির হলাম।

 

সেই সময়ে কফি হাউস বেশ বিবর্ণ। তাতেও আমার ভিন শহরের বন্ধুরা মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেটা ২০০৯ সাল। এরপর আর একবার কফি হাউস গিয়েছিলাম ২০১৯সালে। তখন কিন্তু নতুন করে সেজে উঠেছে কোলকাতার প্রথম ক্যাফে।

 

কফি হাউস নিয়ে যে বিখ্যাত নস্টালজিক গানে আমরা মজে আছি সেটির সৃষ্টি ১৯৮০সালে। সেই গানের কুশীলবরা, অর্থাৎ গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, সুরকার সুপর্ণ কান্তি ঘোষ এবং শিল্পী মান্না দে কফি হাউসে যাতায়াত করতেন কিনা আমার জানা নেই। তবে গানটি আমাদের কোলকাতার জীবনে  একটি মাইল ফলক, একটি সময়ের দলিল। সেদিন হোয়াটস অ্যাপে দেখলাম ঢাকার মইদুল সাহেব (কফি হাউস খ্যাত) জীবন থেকে ছুটি নিয়েছেন। তিনি নাকি মান্না দের বিশেষ বন্ধু ছিলেন। হোয়াটস অ্যাপ বলেই ‘নাকি’ ব্যবহার করলাম।

গানটির কথা স্মরণ করতে খুব লোভ হচ্ছে-

“কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই
কোথায় হারিয়ে গেল সোনালী বিকেল গুলো সেই
আজ আর নেই………………………।।

নিখিলেশ প্যারিসে মইদুল ঢাকাতে
নেই তারা আজ কোন খবরে|
গ্র্যান্ড এর গিটারিস্ট গোয়ানিস ডি সুজা
ঘুমিয়ে আছে যে আজ কবরে|
কাকে যেন ভালবেসে আঘাত পেয়ে যে শেষে
পাগলা গারদে আছে রমা রায়
অমলটা ধুঁকছে দুরন্ত ক্যান্সারে
জীবন করেনি তাকে ক্ষমা হায়।।

সুজাতাই আজ শুধু সবচেয়ে সুখে আছে
শুনেছি তো লাখপতি স্বামী তার
হীরে আর জহরতে আগা গোড়া মোড়া সে
গাড়ী বাড়ি সব কিছু দামি তার
আর্ট কলেজের ছেলে নিখিলেশ সান্যাল
বিজ্ঞাপনের ছবি আঁকত
আর চোখ ভরা কথা নিয়ে নির্বাক শ্রোতা হয়ে
ডি সুজাটা বসে শুধু থাকতো।।

একটা টেবিলে সেই তিন চার ঘণ্টা
চারমিনার ঠোঁটে জ্বলত
কখনো বিষ্ণুদে কখনো যামিনী রায়
এই নিয়ে তর্কটা চলতো
রোদ ঝড় বৃষ্টিতে যেখানেই যে থাকুক
কাজ সেরে ঠিক এসে জুটতাম
চারটেতে শুরু করে জমিয়ে আড্ডা মেরে
সাড়ে সাতটায় ঠিক উঠতাম।।

কবি কবি চেহারা কাঁধেতে ঝোলানো ব্যাগ
মুছে যাবে অমলের নামটা
একটা কবিতা তার কোথাও হলো না ছাপা
পেলো না সে প্রতিভার দামটা
অফিসের সোশ্যালে এমেচার নাটকে
রমা রায় অভিনয় করতো
কাগজের রিপোর্টার মইদুল এসে রোজ
কি লিখেছে তাই শুধু পড়তো।

সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে
সাতটা পেয়ালা আজো খালি নেই
একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি
শুধু সেই সেদিনের মালী নেই।
কত স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে
কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়
কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে,
কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়।

শেষ করলাম আমার কফি হাউস বৃত্তান্ত।

সূূএ:ডেইলি বাংলাদেশ

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com