দেলোয়ার হোসেন লাইফ, বড়াইগ্রাম- : দেশের উত্তরাঞ্চলে বইছে শীতের আগমনী বার্তা, তাইতো নাটোরের বড়াইগ্রামে খেজুর গাছ প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করেছেন মৌসুমী গাছিরা। শীতকাল এলেই বাড়ে খেজুর গাছের কদর। এই সময় গ্রামীণ জনপদে খেজুর গাছকে ঘিরে শুরু হয় জীবিকা নির্বাহের উৎসব ,তাই খেজুর রস সংগ্রহের প্রস্তুতি হিসেবে গাছের ডাল ও শাখা-প্রশাখা কেটে পরিষ্কার করছেন গাছিরা।
বড়াইগ্রাম ও লালপুরের মধুবৃক্ষ খেজুরের গাছ একটি অন্যতম সম্পদ। শীত মৌসুমের শুরুতেই এই উপজেলাগুলোর বিভিন্ন বাজারে বিক্রি হয় সুস্বাদু খেজুরের পাটালি গুড়। মধুবৃক্ষ খেজুরের রস, ঝোলা গুড় ও পাটালি উৎপাদনে বড়াইগ্রাম ও লালপুর উপজেলার খ্যাতি দেশ জুড়ে। এ অঞ্চলের খেজুর গুড়ের পাটালি রাজশাহী, ঢাকা, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ হয়ে থাকে। অযত্ন অবহেলায় বেড়ে উঠা খেজুরের গাছের কদর এখন অনেক বেশি। সকাল থেকে শুরু হয় খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ। আর কিছুদিন পর এসব গাছ থেকে শুরু হবে লালচে রঙের মিষ্টি রস সংগ্রহের পালা। তাই গাছের মাথা পরিচর্যা ও রস সংগ্রহকে ঘিরে এই জনপদের শুরু হয়েছে কর্মচাঞ্চল্য।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, পাশাপাশি দুই উপজেলাজুড়ে সড়ক, রেললাইনের দুই ধার, জমির আইল, বাড়ির আঙিনাসহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে আছে প্রায় তিন লক্ষাধিক খেজুর গাছ, প্রতি গাছ থেকে মৌসুমে প্রায় ২০ থেকে ২৫ কেজি গুড় উৎপাদন করা হয়। এবছর উপজেলায় গুড় সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার মেট্রিক টন। এই অঞ্চলে শীত মৌসুমে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার পরিবার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খেজুর গাছের ওপর নির্ভরশীল। খেজুরের গাছ ফসলের কোনো ক্ষতি করে না। তাই এ গাছের জন্য বাড়তি কোনো খরচ করতে হয় না। ঝোপ, জঙ্গলে কোনো যত্ন ছাড়াই বেড়ে ওঠে খেজুরের গাছ। শুধুমাত্র শীত মৌসুমে নিয়মিত পরিষ্কার করে রস সংগ্রহ করা হয়।
সরেজমিনে উপজেলার ভবানীপুর , আটঘরিয়া, রামাগাড়ি, বাড়িওয়ালি ফার্ম, লালপুর উপজেলার কদিম চিলান,দুয়ারিয়া, ওয়ালিয়া, লালপুর, গোপালপুর, সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, খেজুরগাছ পরিচর্যা করতে বেশ ব্যস্ত মৌসুমী গাছিরা। খেজুরগাছের কাঁটাযুক্ত ডাল কেটে নতুন কাঠ সাদা অংশ বের করছেন তাঁরা। এ অঞ্চলে খেজুর গুড়ের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে সারাদেশে , তাই অনেক গাছি জমির আইল, পতিত ও অনাবাদি জমিতে নতুন করে খেজুর চারা রোপন করছেন।
ভবানীপুর গ্রামের গাছি রাশেদুল ও আকবর মোল্লা জানান, খেজুরগাছের কাঠ পরিষ্কার করে চেঁছে ১০ দিন শুকাতে হয়। এরপর কিছু অংশ বিশেষ পদ্ধতিতে কেটে তার সাথে মাটির হাঁড়ি বসানোর জন্য বাঁশের তৈরি কাঠি লাগানো হয়। গাছ থেকে রস বের করার জন্য প্রতিদিন কাঠের কিছু অংশ চেঁছে ফেলতে হয়। একাধারে তিন দিন শুকানোর পর আবার রস সংগ্রহ করা হয় । শুকনা কাঠির রস খেতে খুবই সুমিষ্ট।
লালপুরের আরেক গাছি চামটিয়া গ্রামের জাহাঙ্গীর জানান, তিনি প্রায় ৪০ বছর যাবত খেজুরের রস সংগ্রহ ও পাটালি গুড় উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এবছর তিনি ৮০টি গাছ বিভিন্ন জনের থেকে লীজ নিয়েছেন, প্রতিটি গাছ এক মৌসুমের জন্য ৪০০টাকা অথবা ৩কেজি গুড়ের বিনিময়ে তিনি খাজনা নিয়েছেন, তিনি বলেন, একজন গাছি শীত মৌসুমের ৩ মাসে একটি গাছ থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কেজি গুড় সংগ্রহ করেন।
লালপুর উপজেলা কৃষি অফিসার প্রীতম কুমার হোড় বলেন, খেজুর গাছ এই উপজেলার অন্যতম সম্পদ, বাদুড় থেকে খেজুরের রসের মাধ্যমে সংক্রমিত নিপা ভাইরাস প্রতিরোধে গাছের পাত্র ঢেকে রেখে নিরাপদ রস ও গুড় উৎপাদনে কৃষি বিভাগ নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার সজীব আর মারুফ জানান, প্রতিবছর গুড় মৌসুমে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে ভেজাল খেজুরের গুড় উৎপাদন করে। মৌসুমের প্রথম থেকেই নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে ভেজাল গুড় উৎপাদনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বড়াইগ্রাম উপজেলা নির্বাহী অফিসার লায়লা জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, পাশাপাশি দুইটি উপজেলার মধ্যে বড়াইগ্রামের বনপাড়া একটি বৃহৎ গুড়ের হাট, গুড় মৌসুমে গাছি এবং ব্যবসায়ীদের যেকোনো ধরনের সিন্ডিকেট এবং ভেজাল উৎপাদন রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ইতিমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে, গাছি এবং ব্যবসায়ীদের সচেতনতামূলক প্রচারণা করা হচ্ছে। আমরা চাই উত্তরবঙ্গের সুমিষ্ট খেজুর গুড়ের সুনাম সারা দেশের ছড়িয়ে পড়ুক।