মেজর আখতার (অব.): মোহাম্মদ আলমগীর কবির নামে বগুড়ার এক যুবক হঠাৎ সেদিন বগুড়া শহরের দেয়ালে, বিদ্যুতের খুঁটিতে সাদা এ-ফোর সাইজের কাগজে একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে দেয়। সে বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে দুই বছর আগে স্নাতকোত্তর শেষ করে প্রত্যাশামাফিক চাকরি না পেয়ে টিউশনি করে দিনাদিপাত করছিল। তার বিজ্ঞাপনটির শিরোনাম ছিল- ‘শুধুমাত্র দুই বেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’। আলমগীর কবির বিজ্ঞাপনে তার পেশা হিসেবে লিখেছিল- ‘বেকার’। প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের গণিত ছাড়া সব বিষয়ে পড়াতে চায়। পড়ানোর বিনিময়ে সে অর্থ চায় না। কেবল সকাল ও দুপুর দুই বেলা ভাত খাওয়ানোর কথা বলেছে। আলমগীরের এ বিজ্ঞাপনে এক ধরনের চমক বা স্টান্টবাজি ছিল যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল। গণমাধ্যমগুলো তার এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়ার কারণ নিয়ে সংবাদও প্রকাশ করেছিল। বিবিসি বাংলাকে এক সাক্ষাৎকারে সে বলেছিল, ‘মূলত খাবারের কষ্ট থেকেই বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এ মুহূর্তে আমার একটি টিউশনি আছে। সেখানে রাতে পড়াই। তারা আগে নাশতা দিত। পরে আমি তাদের বলেছি নাশতার বদলে ভাত খাওয়াতে। কিন্তু রাতে খাবারের সংস্থান হলেও সকাল আর দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা ছিল না।’
আলমগীরের পরিচিতজনেরা ফেসবুকে জানায়, তার পারিবারিক অবস্থা এতটা অসচ্ছল নয়। তার বক্তব্য ছিল চাকরি না পাওয়ার হতাশায় অনেকটা অতিরঞ্জিত। কিন্তু তার মতো এ হতাশা দেশের অসংখ্য তরুণের মাঝে গেড়ে বসেছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করা আলমগীরের দুই বেলা ভাত খাওয়ার বিনিময়ে পড়ানোর বিজ্ঞাপন যখন ভাইরাল হয়েছে, সে সময়ই অর্থমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছেন আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় হবে ৩ হাজার ৮৯ ডলার অর্থাৎ প্রতি ডলার ৮৬ টাকা হিসেবে ২ লাখ ৬৫ হাজার ৬৫০ টাকা মানে মাসিক ২২ হাজার ১৩৮ টাকা। অর্থমন্ত্রী আরও জানান, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে সাড়ে ৭ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে নিঃসন্দেহে এ তথ্য আশা জাগানিয়া। কিন্তু সরকার ঘোষিত মাথাপিছু আয় ও প্রবৃদ্ধিনির্ভর যে উন্নয়ন, দুস্তর অসমতা ও বৈষম্যের যে চিত্র সেখানে আমাদের তরুণদের প্রকৃত অবস্থাটা কী?
বাংলাদেশে সম্পদের অসমতা খুবই প্রকট। বিশ্বে অতিধনী বাড়ার যে সংখ্যা তাতে প্রথম বাংলাদেশ। কিন্তু সম্পদের এ কেন্দ্রীভূতের কারণে তরুণদের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে তেমন কোনো ভূমিকাই রাখতে পারছে না। সম্পদ পাচার বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি অন্যতম প্রধান সমস্যা। জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়নির্ভর যে উন্নয়ন তত্ত্ব তাতে পরিসংখ্যানই আসল, সেখানে বৃহৎ জনগোষ্ঠী অনেকটা গৌণ। সারা দেহকে অপুষ্ট রেখে শুধু মুখের স্বাস্থ্য রক্ষা-উন্নয়নের এ নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি সংকটে পড়েছে তরুণরা। বিশেষ করে সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে বা শিক্ষার ধারার মাঝপথ থেকে যারা ঝরে যাচ্ছে তারা জীবনযুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে। ২০১৭ সালে সর্বশেষ বিবিএস শ্রমশক্তি জরিপে দেখা যায় দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। দেশে প্রতি বছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। এর বাইরে রয়েছে কোটির ওপরে স্বল্প, অর্ধ ও শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চতি তরুণ জনগোষ্ঠী। কিন্তু সে অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার ও পূর্ণ কর্মহীন থেকে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলো থেকে পাস করা শিক্ষার্থীর ৬৬ শতাংশ অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশই বেকার থাকছে। ২১ শতাংশ শিক্ষার্থী স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে চাকরি পায়। ৭ শতাংশ শিক্ষার্থী এখনো অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতকোত্তর বা কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে কিংবা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ৩ শতাংশ স্ব-উদ্যোগে কিছু করছে। বিবিএস ও বিআইডিএসের জরিপ থেকেই বুঝতে অসুবিধা হয় না সংখ্যাগরিষ্ঠ তরুণদের সামনে ভবিষ্যৎটা পুরোপুরি অনিশ্চিত। আবার সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তি উদ্যোগ মিলিয়ে যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে তা-ও তরুণদের প্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে না। তার ওপর কাজের পরিবেশ, বেতন-ভাতা, কাজের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাও থাকছে না। স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর শেষ করে ১০-১৫ হাজার টাকায় চাকরি করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। হাতে গোনা সরকারি চাকরি, ব্যাংক কিংবা কিছু সেবা খাতের চাকরি ছাড়া অন্য গুলোর সুযোগ-সুবিধার অবস্থা নাজুক। ব্যাংক ও বিভিন্ন সেবা খাতে উচ্চ বেতনের সুযোগ থাকলেও নির্দিষ্ট সময়ের অতিরিক্ত কাজ করিয়ে নেওয়া হয় এবং বিভিন্ন অপরাধ ও অনৈতিক কাজে জড়িয়েও নেওয়া হয়। তার ওপরে চাকরির নিরাপত্তা থাকে না। বেসরকারি নিয়োগকর্তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনুযায়ী চাকরি করতে বাধ্য করা হয়।
এ পরিস্থিতিতে তরুণদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তি মিলছে না। ফলে শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বাড়ছেই। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের তথ্যানুসারে ২০২১ সালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ১০১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। পুরুষ শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যা প্রবণতা বেশি। তার আগের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল যা ভয়ানক ভাবনার বিষয় হিসেবে সমাজে আলোচিত হচ্ছে।। অথচ কী কারণে সম্ভাবনাময় তরুণরা আত্মহত্যা করছে তা নিয়ে সমাজের তেমন ভাবনা নেই বললেই চলে।
অন্যদিকে তরুণদের একটি অংশ মরিয়া হয়ে নিজেদের ভাগ্য বদলের জন্য অবৈধভাবে ইউরোপ পাড়ি দেওয়ার ভয়ংকর পথ বেছে নিচ্ছে। মাত্র কদিন আগে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে ঠান্ডায় জমে মারা যায় সাত তরুণ। এমন ভয়ানক মৃত্যুর খবর কয়েক দিন পরপর গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। এসব সংবাদ পড়ে জনগণ শিউরে উঠছে। কিন্তু এ মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের গত বছরের জুলাইয়ের দেওয়া তথ্যানুযায়ী ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে প্রবেশের তালিকায় শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। ২১ জুলাই পর্যন্ত সমুদ্র পাড়ি দিয়েছে বিভিন্ন দেশের ৪১ হাজার ৭৭৭ জন। এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার আছে বাংলাদেশি। এভাবে মরিয়া হয়ে ইউরোপ যাত্রায় বাংলাদেশের সঙ্গে আছে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান, সিরিয়ার মতো দেশগুলো।
উল্লিখিত এ চিত্রগুলোর বাইরে বাংলাদেশের কর্মের আরেকটি চিত্র রয়েছে। অনেকের কাছেই প্রশ্ন জাগে আসলে কি বাংলাদেশের কর্মের সুযোগ এতটাই নাজুক যে আমাদের তরুণদের চাকরি বা কাজের জন্য আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে বা জীবন বাজি রেখে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে? অনেক তরুণ আছে যারা দুঃসাহসিক কাজ করতে আনন্দ পায় তাদের কথা আলাদা। দেশের গড় মাসিক আয় যেখানে ২২ হাজার টাকার বেশি সেখানে জীবন বাজি রেখে সাগর পাড়ি দেওয়ার তেমন শক্তিশালী কোনো যুক্তি নেই। দেশে কাজের কোনো অভাব নেই। অভাব হলো কর্মক্ষম শ্রমিক বা জনশক্তির। বর্তমানে দেশে যে শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে সেখানে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি তৈরির কোনো সুযোগ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে উচ্চশিক্ষাকে। এ উচ্চশিক্ষাকে লক্ষ্য রেখে শুধু জানার ওপরে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সব শিক্ষার্থীকে যেন শুধু জানতে হবে এবং কে কতটুকু জানে তা নির্ধারণ করার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাবখানা সবাইকে মহাপন্ডিত বানাতে হবে যাতে বিশ্বব্রহ্মান্ডের তাবৎ জ্ঞানে সবাইকে জ্ঞানী হতে হবে। শুধু জানলেই হবে। কাউকেই কিছু করতে হবে না। করার কাজটি সবাই বাড়িতে অথবা যেখানে চাকরি করবে সেখানে গিয়ে করে নেবে। শিক্ষালয় থেকে বেরিয়ে আসা সারা জাতি আজ অঙ্ক বা গণিতে কাঁচা। তারা অঙ্ক করতে পারে না। তারা ভাষা জানে না তা মাতৃভাষা হোক বা প্রভুর ভাষা হোক বা ‘সৃষ্টিকর্তার ভাষা’ হোক বা অন্য যে কোনো ভাষা হোক। কোনো ভাষায় শুদ্ধ করে লিখতে বা পরিষ্কার করে বলতে পারে না! শিক্ষাব্যবস্থায় হাতে-কলমে শিক্ষার যেমন কোনো সুযোগ নেই তেমনি সৃজনশীল শিক্ষার সুযোগ থেকেও শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত। আগে বাপ-দাদার কাছ থেকে কৃষিকাজ শিখতে, নৌকার হাল ধরতে, হালচাষ করতে, গরুর গাড়ি চালাতে, ঘর বানাতে, গাছ কাটতে শিখতে পারত। এখন দাদা নেই, বাবা বৃদ্ধ তাই শেখানোর কেউ নেই। স্কুল-কলেজে এগুলো শেখানোর কেউ নেই। মা-দাদির কাছে মেয়েরা রান্নাবান্না, ঘর গোছানো, বাড়িঘর সামলানো, শিশু প্রতিপালন, ভাই-বোনদের দেখাশোনা ও পরিচর্যা করা শিখত কিন্তু সেই সুযোগ এখন কোথায় পাবে আজকের ছেলেমেয়েরা! আজকে সবাই বলছে দেশের অন্যতম সমস্যা বেকারত্ব অথচ দেশে প্রচন্ড কর্মক্ষম কৃষিশ্রমিকের অভাব। বর্তমান আধুনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর কৃষিকাজে কর্মক্ষম স্বল্প শিক্ষিত কৃষিশ্রমিকের প্রচন্ড অভাব। পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের কৃষিকাজে কায়িক পরিশ্রম করতে প্রচন্ড অনীহা। কৃষি মৌসুমে দৈনিক কৃষি মজুরি ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা হয়ে যায় তা-ও আবার কাজের সময় ৫-৬ ঘণ্টায় নেমে আসে। তার পরও শ্রমিক পাওয়া যায় না। গ্রাম পর্যায়ে ২০ লক্ষাধিক এসএসসি ও এইচএসসি পর্যায়ের ছাত্রছাত্রী আছে যারা অনায়াসে ধান রোপণ ও কাটার কাজ করে ওই টাকা সহজেই আয় করতে পারে। কিন্তু আমাদের সূর্যসন্তানরা সে কাজ করতে কখনই উৎসাহিত হয় না। আমাদের পড়ুয়া শিক্ষিতরা নিজেরা কায়িক পরিশ্রম করতে চায় না, আমরা সকাল-বিকাল পার্কে ব্যায়াম করব কিন্তু কায়িক পরিশ্রম করতে আমাদের ইগোতে বাধে, তাই আমাদের সন্তানরাও কায়িক কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করে।
আজ দেশে কাজের লোকের প্রচুর অভাব। যেমন আমাদের দরকার লাখ লাখ কৃষিশ্রমিক তেমনি দরকার দক্ষ ড্রাইভার, কারণ আমাদের রয়েছে বিশাল সড়ক ও জনপথ এবং পরিবহন নেটওয়ার্ক। শহর, বন্দর, নগর, ঘাট, মাঠ, বাজার ও দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে হাজার হাজার হোটেল-রেস্টুরেন্ট, চা-মিষ্টির দোকান যেখানে অজস্র বাবুর্চি ও মিষ্টির কারিগর দরকার। আমাদের প্রয়োজন দক্ষ নার্স ও ওষুধের দোকান চালানোর জন্য ফার্মাসিস্ট। এখন প্রায় ঘরে ঘরে রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগ, গড়ে উঠছে বিদ্যুচ্চালিত কলকারখানা, রাস্তায় নেমেছে হাইব্রিড যানবাহন, তাই দরকার হাজার হাজার বিদ্যুৎকর্মী। দরকার পশু চিকিৎসক ও তার সহকারী। দরকার কলকারখানার জন্য স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিক। তেমনি দরকার সৈনিক, পুলিশ, নিরাপত্তাকর্মী। দরকার মসজিদে আজান দেওয়ার জন্য মুয়াজ্জিন। দরকার গ্রাম প্রতিরক্ষাকর্মী, দরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানের অধস্তন কর্মচারী, নৈশপ্রহরী। দরকার স্বল্পশিক্ষিত কম্পিউটার অপারেটর, ব্যাংকের নগদ গ্রহণ ও প্রদানকারী, বাস ও ট্রেনের টিকিট বিক্রেতা, পরীক্ষা ও গ্রহণকারী।
এমন আরও অনেক কাজ আছে যার জন্য উচ্চশিক্ষার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশেই লাখ লাখ বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে যে কাজগুলো দেশের শ্রমিকরা অনায়াসে করতে পারত যদি উচ্চশিক্ষায় সময় নষ্ট না করে তাদের কারিগরি দক্ষ শ্রমিক বানানো যেত। দেশের তাবৎ অদক্ষ ও দক্ষ শ্রমিক কায়িক শ্রম ও তার সঙ্গে হাতে-কলমে শিক্ষা নিয়ে দক্ষ শ্রমিক হতে পারত। তাদের অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা হলেই যথেষ্ট ছিল। এইচএসসি হলো উচ্চশিক্ষার প্রবেশপথ। যারা ভালোভাবে এইচএসসি পাস করতে পারবে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ও যোগ্যতা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার পথ বেছে নেবে। যারা ভালোভাবে এইচএসসি পাস করতে পারবে না তারাও তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী পেশা বেছে নেবে। এইচএসসি পর্যায়ে প্রথমবার ভালো ফল করতে না পারলে তাকে আরও দুবার সুযোগ দেওয়া যেতে পারে কিন্তু খারাপ ও নিম্নমানের ফলধারীকে উচ্চশিক্ষার জন্য জীবনের মূল্যবান সময় নষ্ট করে হতাশার মধ্যে ফেলানো যাবে না। তাহলে তথাকথিত উচ্চশিক্ষিত হয়ে ভাতের জন্য ছাত্র পড়াতে বিজ্ঞাপন দিয়ে সস্তা সেন্টিমেন্ট তৈরি করবে!
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাকে সর্বজনীন করতে হবে এবং কোনো ধরনের পরীক্ষা ছাড়া ১৪ বছরের কম বয়সী সব কিশোর ও কিশোরকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা দিতে হবে যেখানে শুধু বাংলা, গণিত, ধর্মের মৌলিক বিষয়, বাংলাদেশ ও প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞানের ভিত তৈরি করে দেবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর ছয় মাসের একটি কোর্স করিয়ে ৪০০ মানের লিখিত পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে যেখানে পাস করার জন্য ৫০% ভাগ নম্বর পেতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর বলা হবে। নবম শ্রেণি থেকে চার বছর মেয়াদি মাধ্যমিক স্তর বলা হবে। যারা ৫০% ভাগ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হবে তারাই মাধ্যমিক স্তরে ভর্তি হতে পারবে। প্রাথমিক স্তরে সর্বনিম্ন বয়স হতে হবে ছয় বছর। যারা অষ্টম শ্রেণি বা প্রাথমিক স্তর উত্তীর্ণ হতে পারবে না তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় খরচ ও ব্যবস্থাপনায় দুই বছর মেয়াদি কর্মশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
চার বছর মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনাকালে সাড়ে তিন বছর পড়াশোনা শেষ করার পর তারা যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে। যারা উত্তীর্ণ হবে তাদের ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী গ্রেডিং করে সনদ দেওয়া হবে। যারা উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি পরীক্ষা দেবে না তাদের জন্য চার বছরের পুরো কোর্স সমাপ্ত হওয়ার পর তিন মাসের সময় দিয়ে মাধ্যমিক সনদ পরীক্ষা হবে এবং যারা পাস করবে তাদের যথারীতি গ্রেডিং করে সনদ দেওয়া হবে। তবে যারা ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে প্রথম বছর ভর্তি হতে পারবে না তারা পরপর আর দুবার ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবে।
যারা চার বছর মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনা করে পরীক্ষা দিতে চাইবে না তারা প্রতি বছরের শ্রেণি পরীক্ষা এবং প্রতি বছরের শ্রেণিতে ন্যূনতম ৮৫% ভাগ উপস্থিতির প্রমাণ থাকলে মাধ্যমিক স্তর সমাপ্ত করেছে বলে তাদের সনদ দেওয়া যেতে পারে। এ সনদও শিক্ষাসনদ বলে গণ্য হতে পারবে।
উপরোল্লিখিত বক্তব্যটি একান্তভাবেই আমার ব্যক্তিগত ধারণাপত্র যা নিয়ে সকল পর্যায়ে আলোচনা হতে পারে।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন