রসুল (সা.)-এর অবমাননা কোনোভাবেই মানা যায় না

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : আজ আমার জন্মদিন। প্রিয় পাঠক! দোয়া করবেন ভালো থেকে যেন মরতে পারি। ৯ জুন ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। আমাদের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার, যা বছর শেষে দাঁড়িয়ে ছিল ১১০০-১২০০ কোটিতে। এটা অনেকটাই গতানুগতিক বাজেট। আর এর থেকে ভালো কিছু করার তেমন সুযোগ কোথায়। তবে জালিয়াতি করে যারা বাইরে টাকা নিয়ে গেছে, হুন্ডিতে পাচার করেছে তাদের টাকা আনার সুযোগ দেওয়া খুব একটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। কোনো অপরাধকে এভাবে রাষ্ট্র আড়াল করতে পারে না।

 

আমার জীবনে মা-মাতৃভূমি এক ও অভিন্ন। রাজনীতিতে এসে দেশকে চেনার পর অন্তরে দেশপ্রেম জাগলে মায়ের মতো মাতৃভূমিকে আপন করে নিয়েছিলাম। আজ মা নেই, কিন্তু মাতৃভূমি আছে। মাতৃভূমির চেয়ে আমার কাছে বড় কোনো সম্পদ নেই। আমার কাছে সবার আগে মাতৃভূমি, তারপর অন্য কিছু। তাই বাংলাদেশের চেয়ে অধিক প্রিয় আমার জীবনে কিছু নেই। দেশের বাইরে যে দেশটির জন্য প্রাণ কাঁদে আমার সব পুঞ্জীভূত ভালোবাসা সেটা হলো ভারত। মহান ভারত আমার স্বাধীনতায় ধাত্রীর দায়িত্ব পালন করেছে। বিশ্বের কত বড় বড় মোড়ল আমাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকার পরও ভারত বসে থাকেনি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সহমর্মিতায় ভারত আমাদের সর্বস্ব দিয়ে সহযোগিতা করেছে। পরে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে তার প্রতিবাদে যে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলেছিলাম সেখানেও ভারত আমাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিল। তাই ভারতের প্রতি আমার বুকভরা ভালোবাসা। বাংলাদেশের পর সবকিছুতেই ভারত আমার প্রিয়। ভারতীয়রা আরও প্রিয়। কিন্তু ভারতের কোনো অন্যায় কখনো মাথা পেতে নিইনি। পিন্ডির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে ভারতের কাছে নতজানু হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করিনি। প্রায় ১৬ বছর নির্বাসনে ছিলাম। ভারতের কত নেতা-উপনেতা- অভিনেতার সঙ্গে ওঠাবসা করেছি কিন্তু বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব, বাংলাদেশকে করায়ত্ত করতে হবে এমন মনোভাব কারও মধ্যে দেখিনি। সেটা প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর বলুন, অটল বিহারি বাজপেয়ি বলুন, মধু লিমাই, জর্জ ফার্নান্ডেজ, বিজু পট্টনায়েক, সুরেন্দ্র মোহন, ভুপেশ দাশগুপ্ত, জাঠনেতা চরণসিং, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, দেশে ফেরার পর মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরসিমা রাও। কাউকে বড় ভাই সুলভ আচরণ করতে দেখিনি। আমি চেয়েছি প্রতিবেশী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ। শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিক তেমন কেউ ছিলেন না যার কাছে যাইনি। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখার্জি, সোমেন মিত্র, নুরুল ইসলাম, অজিত পাজা, সওগত রায় সবাই ছিলেন আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কী যে উচ্চমাত্রার সম্মান দিয়েছেন তা লিখে বোঝানো যাবে না। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, প্রবোধ কুমার সান্যাল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বরুণ সেন, অমিতাভ গুপ্ত, অমিতাভ চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত আরও বহু সাহিত্যিক-সাংবাদিক-নাট্যকারের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। হেমন্ত মুখার্জি, অনুপ ঘোষাল, ভূপেন হাজারিকা আমার শিলিগুঁড়ির বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখার্জি, উৎপলা সেন আরও কত শিল্পীর সামনে বসে গান শুনেছি। কারও মধ্যে দাদাগিরি দেখিনি। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, প্রণব মুখার্জি আমাদের নিয়ে গর্ব করতেন। নিশ্চয় নরেন্দ্র মোদি এখন অনেক বড় নেতা। তিনি এখন ভারতের সর্বজয়ী প্রধানমন্ত্রী। এক দুর্বার জ্ঞান-বুদ্ধি শক্তি-সামর্থ্য না থাকলে সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায় না। দুর্ভাগ্য, আমি যখন ছিলাম তখন তিনি গুজরাটে প্রাদেশিক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খুব বড় নামকরা কেউ ছিলেন না। তাই পরিচয় ছিল না। কিন্তু একজন মানুষের মহান ভারতের সর্বোচ্চ নেতা হতে যে গুণ-মেধা থাকা দরকার, তার কোনো কিছুর কমতি তাঁর মধ্যে আছে তা কখনো মনে করি না। বরং প্রায় ৩০-৩৫ বছর পর তাঁর নেতৃত্বে বিজেপির একক দলীয় সরকার গঠন করার কৃতিত্বকে কোনোমতেই ছোট করে দেখা যায় না। এতসবের পরও তাঁদের দলের কখনো কখনো কিছু কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকান্ড ভাবিয়ে তোলে। অতি সম্প্রতি মুসলিম জাহানের প্রাণ আমাদের অন্তরাত্মা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র নূপুর শর্মার নিন্দনীয় বক্তব্য এবং সেই বক্তব্যকে আরেক পন্ডিত নবীন জিন্দালের সমর্থন খুবই দুর্ভাগ্যজনক। জানি না, নূপুর শর্মা কত বড় পন্ডিত, কী তাঁর জানাশোনা। কেন তাঁকে মুসলমানদের প্রাণবায়ু নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করতে হবে। আমাদের মহানবী (সা.) তো কটূক্তির পাত্র নন। তিনি নবী হওয়ার আগেই সাধারণ মানুষ হিসেবে যে নজির স্থাপন করেছেন তার তুলনা বিশ্বদরবারে নেই। তিনি নবী হওয়ার আগে আল-আমিন হয়েছিলেন। আল-আমিন অর্থ বিশ্বাসী। তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি, কারও কষ্টের কারণ হননি। তিনি ১২টি বিয়ে করেছিলেন তাঁর জন্য নয়, সমাজে উদাহরণ সৃষ্টির জন্য, মুসলমানদের জীবন পরিচালনায় উদাহরণ সৃষ্টিতে সহায়তার জন্য। সেখানে কোনো কপটতা ছিল না। বিবি আয়েশা (রা.) ছিলেন তাঁর একমাত্র কুমারী স্ত্রী। নবী করিম (সা.)-এর একনিষ্ঠ হজরত আবু বকর (রা.)-এর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে তিনি বিবি আয়েশাকে ঘরে এনেছিলেন। নবী করিম (সা.) যে কোনো যুদ্ধে সব সময় স্ত্রীদের নিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য, আহত যোদ্ধাদের সঠিকভাবে সেবা-শুশ্রƒষা করায় মুসলিম নারীদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। নবী করিম (সা.) এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে বিবি আয়েশা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিলেন। সে সময় বিশ্রাম করা কাফেলা উঠে চলে গিয়েছিল। বিবি আয়েশা সেখানেই পড়েছিলেন। রসুল (সা.) তাঁর বিশ্রাম নেওয়া কাফেলার স্থান ত্যাগ করলে কোনো কিছু পড়ে আছে কি না বা কেউ রয়ে গেল কি না এর খোঁজ করতে লোক পাঠাতেন। সেবারও পাঠিয়েছিলেন। বিশ্রামস্থলে রসুল (সা.)-এর দূত কাপড়ে ঢাকা উপুড় হয়ে পড়ে থাকা এক নারীকে দেখতে পান। পরে বুঝতে পারেন তিনি বিবি আয়েশা। তাঁকে উটে তুলে মদিনায় নিয়ে আসেন। এ নিয়ে নানা কথা হয়। একসময় বিবি আয়েশা বাপের বাড়ি চলে যান। রটনা রটতেই থাকে। একসময় আল্লাহর তরফ থেকে এ ঘটনা নিয়ে সুরা নাজিল হয়। জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে রসুল (সা.)-কে জানানো হয় বিবি আয়েশা নিষ্পাপ নিষ্কলুষ। তাদের এই মন কষাকষির অবসান হওয়া উচিত। রসুল (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)-এর বাড়ি গিয়ে বিবি আয়েশাকে জানান সব মেঘ কেটে গেছে। রসুল (সা.)-এর কথায় হজরত আবু বকর (রা.) এবং তাঁর স্ত্রী বিবি আয়েশাকে রসুল (সা.)-কে কৃতজ্ঞতা জানাতে বলেন। তখন বিবি আয়েশা বাবা-মাকে বলেন, কেন আমি রসুল (সা.)-কে কৃতজ্ঞতা জানাব। তিনি আমার জন্য কী করেছেন? তিনি তো আমার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াননি, আমার জন্য কিছুই করেননি। কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে, শুকরিয়া জানাতে হলে সেটা জানাব আমার দয়াল প্রভু মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের প্রতি। তিনি আমার বিপদে সাহায্য করেছেন। সমালোচনা করা সোজা কিন্তু নিগূঢ়ে পৌঁছা অত সহজ নয়। আমি ভারতে প্রায় ১৬ বছর থেকেছি। গয়া-কাশি-বৃন্দাবন-মথুরা-তারকেশ্বর এমনকি নবদ্বীপ কোথাও বাদ রাখিনি। আজমিরে হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে কতবার পৃথিবীর একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির পুষ্করে গিয়েছি। পুষ্করে কত পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে কখনো তেমন কোনো ধর্মভেদ দেখিনি। আর্চারিয়া বিনোয়াভাবের আশ্রমে গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে তিন ঘণ্টার ওপর কথা বলেছি, খাবার খেয়েছি। তিনি ইসলাম সম্পর্কে আমাকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন এর আগে সে জ্ঞানের কানাকড়িও আমার ছিল না। আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল সম্পর্কে তাঁর যে অগাধ জ্ঞানের পরিধি যাতে অনেক মুসলমান পন্ডিতকে ডুবে মরতে হবে। রাম রহিমের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন এর আগে কখনো শুনিনি। চৈতন্য মহাপ্রভুর ধাম নবদ্বীপে তাঁর আশ্রমে অনেক সময় কাটিয়েছি। তাতে তাদের ধর্মের কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয়নি। কাশিতে গিয়েছিলাম মহাপ্রভু বুদ্ধের মন্দিরে, কেউ বাধা দেয়নি। চরম উত্তেজনার সময় বাবরি মসজিদে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখেছি হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে কাজ করছে। হিন্দু মুচি জুতা সেলাই করছে, মুসলমান দর্জি করছে কাপড় সেলাই। তাদের মধ্যে কোনো মারামারি, কাটাকাটি নেই। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মা সারদার ধাম দক্ষিণেশ্বরে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। সেখানকার পুরোহিতের সে যে কি অসাধারণ জ্ঞান! হিন্দুশাস্ত্র, মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে সে যে কি পান্ডিত্য ভাবাই যায় না। তাই অবাক হয়ে যাই নূপুর শর্মার কথাবার্তায়। এত সাহস কোথা থেকে পান, নাকি কোনো সাড়া জাগানো ফেমাস হওয়ার কৌশল হিসেবে মুসলমানদের এমন অসম্মান করতে পয়গম্বরের প্রতি এমন কটূক্তি করেছেন। দীর্ঘ সময় নূপুর শর্মা বিজেপি করে এত দূর এসেছেন। এত দিন যদি তিনি বিজেপির কথা বলে থাকেন তাহলে হুট করে তো আর নতুন কথা বলেননি, বিজেপির কথাই বলেছেন। বিজেপি ভারত জয় করার বহু আগে মুসলমানরা ভারত জয় করেছিল। শত শত বছর মহান ভারতে মুসলমানদের শাসন চলেছে। ভারতে তেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ করে খুব বেশি মুসলমান বানানো হয়নি। হাজার হাজার লাখো দরিদ্র হিন্দু যখন দেখেছে মুসলমান রাজা-বাদশাহ-আমির-ফকির এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে, ঈদে কোলাকুলি করে, একসঙ্গে বসে খাবার খায় তখন তারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা স্বেচ্ছায় আত্মিক তাগিদে মুসলমান হয়েছে। নির্বাসিত জীবনে আমি মাঝেমধ্যেই বিহারের কদমকুয়ায় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের বাড়ি যেতাম। আমাদের দেশে যেমন সাদা-কালোর ভেদাভেদ বোঝা যায় না, আমরা বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ বুঝতে পারি না। কারণ বাংলাদেশে রঙের অথবা জাতের তেমন ভেদাভেদ নেই। ইউরোপে গেলে রঙের, ভারতে গেলে জাতের ভেদাভেদ বোঝা যায়। আমি একবার পাটনায় গান্ধী ভবনে ছিলাম। বিকালে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। একটা পানির পাইপে কল ছিল না। তাই অনবরত পানি পড়ছিল। হঠাৎ দেখি একজন দরিদ্র মানুষ সেখানে পানি নেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা ঘটি অনেকদূর থেকে ধরছে আবার সরে যাচ্ছে। প্রায় ১০ মিনিট লোকটিকে লক্ষ্য করছিলাম। যে বেগে পানি পড়ছিল তার ঘটি ভরতে ১০-১৫ সেকেন্ড লাগার কথা সেখানে ১০ মিনিটেও সে ঘটি ভরতে পারেনি। প্রায় ৬-৭ ফুট উঁচু থেকে না হলেও ১০ ফুট দূরে গিয়ে পানি পড়ছিল। সেখানে মাটির কাছেও সে লোকটি ঘটি ধরতে সাহস পাচ্ছিল না। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে লোকটি থতমত খেয়ে যায়। বলে, ‘থোরা পানি লেয়ে গা’। বলেছিলাম, লে লি জিয়ে। ‘নেহি সাহাব, হাম ছোটা জাত হ্যায়। পানি খারাপ হো যায়েগা। হামকো ছুঁয়ে গা নেহি।’ ঘটি নিয়ে পানি ভরে দিলাম। লোকটিকে বাগানে ঘাসের ওপর বসিয়ে আমি জোড়াসীন করে তার সামনে বসেছিলাম। লোকটি বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল। তার পানির কেন দরকার জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, ‘হাম দ্বারভাঙা ছে আয়া। ঘরমে লেরকি বিমার হ্যায়। কুছ পয়সেকে লিয়ে আয়াথা। লেকিন মিলা নেহি। ঘরছে থোরা কুছ ছাতু লে আয়া। ওহি খানেকে লিয়ে পানিকা জরুরত থা।’ লোকটি যখন টোপলা থেকে ছাতু বের করে একটু একটু করে খাচ্ছিল তখন আমার বড় মজা লাগছিল। আমাদের দেশে নারকেল দিয়ে চিড়া পাড় দিলে যেমন হয় প্রায় তেমনি। লোকটি যখন খাচ্ছিল আমার খুব ভালো লাগছিল। বলেছিলাম, হামে বি থোরা দি জিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ‘আপ লি জিয়ে। আপনা হাতছে লি জিয়ে।’ আবার বলেছিলাম, নেহি আপ দি জিয়ে। ‘নেহি বাবুজি, মেরা হাতছে নেহি। হামারা হাতছে দেনেছে ঝুটা হো যায়েগা।’ অনেক পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত আমার হাতে একদলা ছাতু তুলে দিয়েছিল। বেশ ভালো, সুস্বাদু। গরিবরা সাধারণ জিনিস খায়, কিন্তু বেস্বাদ খায় না। সুস্বাদু খাবার খায়। খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে উঠে যাবার পথে তাকে আমি পকেট থেকে কয়েকটা কড়কড়ে নোট দিয়েছিলাম। লোকটি টাকাটা নিয়ে একটু দূর গিয়েই ঘুরে এসে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেছিল, ‘সাহাব, আপতো গলতি নেহি কিয়া। আপকা জরুর গলতি হুয়া। আপকা জরুর গলতি হুয়া সাহাব।’ আমি যতই বলি আমি গলতি করিনি। যা দেওয়ার জেনে শুনে দিয়েছি। সে ততই বলে ‘নেহি সাহাব, আপকা জরুর গলতি হুয়া।’ অনেক বলে কয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। বলেছিলাম মেয়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে। ওইদিন দুপুরেই জয়প্রকাশজির সঙ্গে খাবার খেয়েছিলাম। রাতে বর্ধমান ফিরব তাই জয়প্রকাশজির দেওয়া হাজার দশেক টাকা পকেটে রেখে বাকিটা ব্যাগে রেখেছিলাম। তখন ভারতে ৫০০ টাকার থেকে বড় নোট ছিল না। আমি তাকে ৮-১০টি নোট দিয়েছি ভুল হতে যাবে কেন। ২০০ টাকা বেতনে বিহার বিধানসভার পিয়নের চাকরি করে। অত টাকা ভুল করে দিইনি তো। তাই বারবার বলছিল। আমি দেখেছি বিহার-উত্তর প্রদেশ-মধ্য প্রদেশ-রাজস্থানে মৃত্যুর সময়ও ব্রাহ্মণরা নিম্ন জাতের লোকের হাতে পানি পান করে না। এত জাতপাতের ভেদাভেদ।

 

আবার মহামানবের দেশ ভারত। এত মানবিক গুণের সমাহার সেখানে যা বলার মতো নয়। সারা দুনিয়া নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালের এই জঘন্য বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছে, ধিক্কার দিচ্ছে, ভারতের কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে নিন্দা করছে। এই প্রথম পেয়ারা নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে কটূক্তির জন্য সারা আরব দুনিয়া রুখে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় যারা আরব দেশে চাকরি-বাকরি করে তাদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ আরব দেশের আজকের এ উন্নয়নে ভারতীয় মানুষের বা ভারতীয়দের শ্রম-ঘাম একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। এবার আরব দেশগুলো ভারতীয় পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ বুঝতে পারছি না বাংলাদেশ কেন চুপচাপ, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত কেন কোনো কথা বলছে না। আমি আর কী করতে পারি। গত সপ্তাহ থেকে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বর্জন করেছি। প্রায় সময়ই জি বাংলায় কয়েকটি প্রিয় সিরিয়াল দেখতাম। তার মধ্যে পিলু, গৌরী ও উমা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। করোনার শুরুতে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক ভ- সাহেদের কারণে চ্যানেল আই ও আরটিভি দেখা বাদ দিয়েছিলাম। কারণ চ্যানেল আই, আরটিভি ও আরও কয়েকটি চ্যানেল টকশোয় ডেকে সাহেদকে পাতে তুলেছিল। চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর আমার খুবই প্রিয়, ছোটবোন শুশুর সঙ্গে পড়ত। যখন যেখানে দেখা হয়েছে সেখানেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছে। তবু তার চ্যানেল বর্জন করেছি। চ্যানেল আইয়ের ‘তৃতীয় মাত্রা’য় আমার কথা কেটে দিয়েছিল। সেজন্য ১২-১৫ বছরে চ্যানেল আইয়ের ত্রিসীমানায় যাইনি। তাই বাড়িতে সবাইকে বলেছি, যতক্ষণ এর সুরাহা না হচ্ছে, যারা নবী করিম (সা.)-এর সম্মানহানি করেছে তাদের আইনানুগ বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতীয় কোনো জিনিসপত্র ব্যবহার করতে বারণ করেছি। সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি, সরকারপ্রধান যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, যাঁর তাহাজ্জুদের নামাজ বাদ পড়ে না তাঁর মহানবীর অবমাননা মুখ বুজে সহ্য করা উচিত নয়। তা করলে বরং তাঁরই ক্ষতি হবে। ভারতকে কীসের ভয়, ভয় করব আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলকে।লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com    সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অ্যাকশনে গেলে আরও রক্তপাত হতো : যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা

» জাতি ক্রান্তি লগ্নে, ভালো নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই: ইসি সানাউল্লাহ

» ৫০ হাজার ইয়াবাসহ রোহিঙ্গা গ্রেফতার

» ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের আদেশের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা

» ৭ কলেজের মঙ্গলবারের পরীক্ষা স্থগিত

» অটোরিকশা চালকদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করার আহ্বান

» আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা

» সাংবাদিকতায় বস্তুনিষ্ঠতা বজায় রাখা জরুরি : তারেক রহমান

» অতিরিক্ত দেনমোহর দাবি: ছেলের হাতে বাবা খুন

» অস্ত্রসহ ১৪ ডাকাত গ্রেফতার

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

রসুল (সা.)-এর অবমাননা কোনোভাবেই মানা যায় না

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : আজ আমার জন্মদিন। প্রিয় পাঠক! দোয়া করবেন ভালো থেকে যেন মরতে পারি। ৯ জুন ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট পেশ করা হয়েছে। আমাদের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার, যা বছর শেষে দাঁড়িয়ে ছিল ১১০০-১২০০ কোটিতে। এটা অনেকটাই গতানুগতিক বাজেট। আর এর থেকে ভালো কিছু করার তেমন সুযোগ কোথায়। তবে জালিয়াতি করে যারা বাইরে টাকা নিয়ে গেছে, হুন্ডিতে পাচার করেছে তাদের টাকা আনার সুযোগ দেওয়া খুব একটা যুক্তিযুক্ত হয়নি। কোনো অপরাধকে এভাবে রাষ্ট্র আড়াল করতে পারে না।

 

আমার জীবনে মা-মাতৃভূমি এক ও অভিন্ন। রাজনীতিতে এসে দেশকে চেনার পর অন্তরে দেশপ্রেম জাগলে মায়ের মতো মাতৃভূমিকে আপন করে নিয়েছিলাম। আজ মা নেই, কিন্তু মাতৃভূমি আছে। মাতৃভূমির চেয়ে আমার কাছে বড় কোনো সম্পদ নেই। আমার কাছে সবার আগে মাতৃভূমি, তারপর অন্য কিছু। তাই বাংলাদেশের চেয়ে অধিক প্রিয় আমার জীবনে কিছু নেই। দেশের বাইরে যে দেশটির জন্য প্রাণ কাঁদে আমার সব পুঞ্জীভূত ভালোবাসা সেটা হলো ভারত। মহান ভারত আমার স্বাধীনতায় ধাত্রীর দায়িত্ব পালন করেছে। বিশ্বের কত বড় বড় মোড়ল আমাদের বিরুদ্ধে সক্রিয় থাকার পরও ভারত বসে থাকেনি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সহমর্মিতায় ভারত আমাদের সর্বস্ব দিয়ে সহযোগিতা করেছে। পরে ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হলে তার প্রতিবাদে যে প্রতিরোধযুদ্ধ গড়ে তুলেছিলাম সেখানেও ভারত আমাদের সর্বতোভাবে সহযোগিতা করেছিল। তাই ভারতের প্রতি আমার বুকভরা ভালোবাসা। বাংলাদেশের পর সবকিছুতেই ভারত আমার প্রিয়। ভারতীয়রা আরও প্রিয়। কিন্তু ভারতের কোনো অন্যায় কখনো মাথা পেতে নিইনি। পিন্ডির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে ভারতের কাছে নতজানু হওয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করিনি। প্রায় ১৬ বছর নির্বাসনে ছিলাম। ভারতের কত নেতা-উপনেতা- অভিনেতার সঙ্গে ওঠাবসা করেছি কিন্তু বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব, বাংলাদেশকে করায়ত্ত করতে হবে এমন মনোভাব কারও মধ্যে দেখিনি। সেটা প্রধানমন্ত্রী চন্দ্র শেখর বলুন, অটল বিহারি বাজপেয়ি বলুন, মধু লিমাই, জর্জ ফার্নান্ডেজ, বিজু পট্টনায়েক, সুরেন্দ্র মোহন, ভুপেশ দাশগুপ্ত, জাঠনেতা চরণসিং, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু, ইন্দিরা গান্ধী, মোরারজি দেশাই, দেশে ফেরার পর মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন নরসিমা রাও। কাউকে বড় ভাই সুলভ আচরণ করতে দেখিনি। আমি চেয়েছি প্রতিবেশী হিসেবে মর্যাদাপূর্ণ আচরণ। শিল্পী-সাহিত্যিক-রাজনীতিক তেমন কেউ ছিলেন না যার কাছে যাইনি। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখার্জি, সোমেন মিত্র, নুরুল ইসলাম, অজিত পাজা, সওগত রায় সবাই ছিলেন আমাদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কী যে উচ্চমাত্রার সম্মান দিয়েছেন তা লিখে বোঝানো যাবে না। সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায়, মনোজ বসু, প্রবোধ কুমার সান্যাল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বরুণ সেন, অমিতাভ গুপ্ত, অমিতাভ চৌধুরী, সত্যজিৎ রায়, সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত আরও বহু সাহিত্যিক-সাংবাদিক-নাট্যকারের সঙ্গে ওঠাবসা করেছি। হেমন্ত মুখার্জি, অনুপ ঘোষাল, ভূপেন হাজারিকা আমার শিলিগুঁড়ির বাড়িতে রাত কাটিয়েছেন। সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, সন্ধ্যা মুখার্জি, উৎপলা সেন আরও কত শিল্পীর সামনে বসে গান শুনেছি। কারও মধ্যে দাদাগিরি দেখিনি। সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ, প্রণব মুখার্জি আমাদের নিয়ে গর্ব করতেন। নিশ্চয় নরেন্দ্র মোদি এখন অনেক বড় নেতা। তিনি এখন ভারতের সর্বজয়ী প্রধানমন্ত্রী। এক দুর্বার জ্ঞান-বুদ্ধি শক্তি-সামর্থ্য না থাকলে সাধারণ ঘর থেকে উঠে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়া যায় না। দুর্ভাগ্য, আমি যখন ছিলাম তখন তিনি গুজরাটে প্রাদেশিক রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। খুব বড় নামকরা কেউ ছিলেন না। তাই পরিচয় ছিল না। কিন্তু একজন মানুষের মহান ভারতের সর্বোচ্চ নেতা হতে যে গুণ-মেধা থাকা দরকার, তার কোনো কিছুর কমতি তাঁর মধ্যে আছে তা কখনো মনে করি না। বরং প্রায় ৩০-৩৫ বছর পর তাঁর নেতৃত্বে বিজেপির একক দলীয় সরকার গঠন করার কৃতিত্বকে কোনোমতেই ছোট করে দেখা যায় না। এতসবের পরও তাঁদের দলের কখনো কখনো কিছু কিছু অপরিণামদর্শী কর্মকান্ড ভাবিয়ে তোলে। অতি সম্প্রতি মুসলিম জাহানের প্রাণ আমাদের অন্তরাত্মা হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে ভারতীয় জনতা পার্টির মুখপাত্র নূপুর শর্মার নিন্দনীয় বক্তব্য এবং সেই বক্তব্যকে আরেক পন্ডিত নবীন জিন্দালের সমর্থন খুবই দুর্ভাগ্যজনক। জানি না, নূপুর শর্মা কত বড় পন্ডিত, কী তাঁর জানাশোনা। কেন তাঁকে মুসলমানদের প্রাণবায়ু নবী করিম (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করতে হবে। আমাদের মহানবী (সা.) তো কটূক্তির পাত্র নন। তিনি নবী হওয়ার আগেই সাধারণ মানুষ হিসেবে যে নজির স্থাপন করেছেন তার তুলনা বিশ্বদরবারে নেই। তিনি নবী হওয়ার আগে আল-আমিন হয়েছিলেন। আল-আমিন অর্থ বিশ্বাসী। তিনি কখনো মিথ্যা বলেননি, কারও কষ্টের কারণ হননি। তিনি ১২টি বিয়ে করেছিলেন তাঁর জন্য নয়, সমাজে উদাহরণ সৃষ্টির জন্য, মুসলমানদের জীবন পরিচালনায় উদাহরণ সৃষ্টিতে সহায়তার জন্য। সেখানে কোনো কপটতা ছিল না। বিবি আয়েশা (রা.) ছিলেন তাঁর একমাত্র কুমারী স্ত্রী। নবী করিম (সা.)-এর একনিষ্ঠ হজরত আবু বকর (রা.)-এর ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে তিনি বিবি আয়েশাকে ঘরে এনেছিলেন। নবী করিম (সা.) যে কোনো যুদ্ধে সব সময় স্ত্রীদের নিয়ে যেতেন। উদ্দেশ্য, আহত যোদ্ধাদের সঠিকভাবে সেবা-শুশ্রƒষা করায় মুসলিম নারীদের উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। নবী করিম (সা.) এক যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে বিবি আয়েশা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়েছিলেন। সে সময় বিশ্রাম করা কাফেলা উঠে চলে গিয়েছিল। বিবি আয়েশা সেখানেই পড়েছিলেন। রসুল (সা.) তাঁর বিশ্রাম নেওয়া কাফেলার স্থান ত্যাগ করলে কোনো কিছু পড়ে আছে কি না বা কেউ রয়ে গেল কি না এর খোঁজ করতে লোক পাঠাতেন। সেবারও পাঠিয়েছিলেন। বিশ্রামস্থলে রসুল (সা.)-এর দূত কাপড়ে ঢাকা উপুড় হয়ে পড়ে থাকা এক নারীকে দেখতে পান। পরে বুঝতে পারেন তিনি বিবি আয়েশা। তাঁকে উটে তুলে মদিনায় নিয়ে আসেন। এ নিয়ে নানা কথা হয়। একসময় বিবি আয়েশা বাপের বাড়ি চলে যান। রটনা রটতেই থাকে। একসময় আল্লাহর তরফ থেকে এ ঘটনা নিয়ে সুরা নাজিল হয়। জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে রসুল (সা.)-কে জানানো হয় বিবি আয়েশা নিষ্পাপ নিষ্কলুষ। তাদের এই মন কষাকষির অবসান হওয়া উচিত। রসুল (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)-এর বাড়ি গিয়ে বিবি আয়েশাকে জানান সব মেঘ কেটে গেছে। রসুল (সা.)-এর কথায় হজরত আবু বকর (রা.) এবং তাঁর স্ত্রী বিবি আয়েশাকে রসুল (সা.)-কে কৃতজ্ঞতা জানাতে বলেন। তখন বিবি আয়েশা বাবা-মাকে বলেন, কেন আমি রসুল (সা.)-কে কৃতজ্ঞতা জানাব। তিনি আমার জন্য কী করেছেন? তিনি তো আমার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়াননি, আমার জন্য কিছুই করেননি। কৃতজ্ঞতা জানাতে হলে, শুকরিয়া জানাতে হলে সেটা জানাব আমার দয়াল প্রভু মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিনের প্রতি। তিনি আমার বিপদে সাহায্য করেছেন। সমালোচনা করা সোজা কিন্তু নিগূঢ়ে পৌঁছা অত সহজ নয়। আমি ভারতে প্রায় ১৬ বছর থেকেছি। গয়া-কাশি-বৃন্দাবন-মথুরা-তারকেশ্বর এমনকি নবদ্বীপ কোথাও বাদ রাখিনি। আজমিরে হজরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি (রহ.)-এর মাজার জিয়ারত করে কতবার পৃথিবীর একমাত্র ব্রহ্মা মন্দির পুষ্করে গিয়েছি। পুষ্করে কত পুরোহিতের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে কখনো তেমন কোনো ধর্মভেদ দেখিনি। আর্চারিয়া বিনোয়াভাবের আশ্রমে গিয়েছিলাম। তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে তিন ঘণ্টার ওপর কথা বলেছি, খাবার খেয়েছি। তিনি ইসলাম সম্পর্কে আমাকে যে জ্ঞান দিয়েছিলেন এর আগে সে জ্ঞানের কানাকড়িও আমার ছিল না। আল্লাহ এবং আল্লাহর রসুল সম্পর্কে তাঁর যে অগাধ জ্ঞানের পরিধি যাতে অনেক মুসলমান পন্ডিতকে ডুবে মরতে হবে। রাম রহিমের যে বর্ণনা দিয়েছিলেন এর আগে কখনো শুনিনি। চৈতন্য মহাপ্রভুর ধাম নবদ্বীপে তাঁর আশ্রমে অনেক সময় কাটিয়েছি। তাতে তাদের ধর্মের কোনো ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয়নি। কাশিতে গিয়েছিলাম মহাপ্রভু বুদ্ধের মন্দিরে, কেউ বাধা দেয়নি। চরম উত্তেজনার সময় বাবরি মসজিদে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখেছি হিন্দু-মুসলমান একসঙ্গে কাজ করছে। হিন্দু মুচি জুতা সেলাই করছে, মুসলমান দর্জি করছে কাপড় সেলাই। তাদের মধ্যে কোনো মারামারি, কাটাকাটি নেই। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ও মা সারদার ধাম দক্ষিণেশ্বরে বেশ কয়েকবার গিয়েছি। সেখানকার পুরোহিতের সে যে কি অসাধারণ জ্ঞান! হিন্দুশাস্ত্র, মুসলিম-খ্রিস্টান-বৌদ্ধ-ইহুদি ধর্ম সম্পর্কে সে যে কি পান্ডিত্য ভাবাই যায় না। তাই অবাক হয়ে যাই নূপুর শর্মার কথাবার্তায়। এত সাহস কোথা থেকে পান, নাকি কোনো সাড়া জাগানো ফেমাস হওয়ার কৌশল হিসেবে মুসলমানদের এমন অসম্মান করতে পয়গম্বরের প্রতি এমন কটূক্তি করেছেন। দীর্ঘ সময় নূপুর শর্মা বিজেপি করে এত দূর এসেছেন। এত দিন যদি তিনি বিজেপির কথা বলে থাকেন তাহলে হুট করে তো আর নতুন কথা বলেননি, বিজেপির কথাই বলেছেন। বিজেপি ভারত জয় করার বহু আগে মুসলমানরা ভারত জয় করেছিল। শত শত বছর মহান ভারতে মুসলমানদের শাসন চলেছে। ভারতে তেমন যুদ্ধ-বিগ্রহ করে খুব বেশি মুসলমান বানানো হয়নি। হাজার হাজার লাখো দরিদ্র হিন্দু যখন দেখেছে মুসলমান রাজা-বাদশাহ-আমির-ফকির এক কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ে, ঈদে কোলাকুলি করে, একসঙ্গে বসে খাবার খায় তখন তারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিম্নবর্ণের হিন্দুরা স্বেচ্ছায় আত্মিক তাগিদে মুসলমান হয়েছে। নির্বাসিত জীবনে আমি মাঝেমধ্যেই বিহারের কদমকুয়ায় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের বাড়ি যেতাম। আমাদের দেশে যেমন সাদা-কালোর ভেদাভেদ বোঝা যায় না, আমরা বাংলাদেশের মানুষ অনেকটা উচ্চবর্ণ আর নিম্নবর্ণের ভেদাভেদ বুঝতে পারি না। কারণ বাংলাদেশে রঙের অথবা জাতের তেমন ভেদাভেদ নেই। ইউরোপে গেলে রঙের, ভারতে গেলে জাতের ভেদাভেদ বোঝা যায়। আমি একবার পাটনায় গান্ধী ভবনে ছিলাম। বিকালে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। একটা পানির পাইপে কল ছিল না। তাই অনবরত পানি পড়ছিল। হঠাৎ দেখি একজন দরিদ্র মানুষ সেখানে পানি নেওয়ার জন্য ছোট্ট একটা ঘটি অনেকদূর থেকে ধরছে আবার সরে যাচ্ছে। প্রায় ১০ মিনিট লোকটিকে লক্ষ্য করছিলাম। যে বেগে পানি পড়ছিল তার ঘটি ভরতে ১০-১৫ সেকেন্ড লাগার কথা সেখানে ১০ মিনিটেও সে ঘটি ভরতে পারেনি। প্রায় ৬-৭ ফুট উঁচু থেকে না হলেও ১০ ফুট দূরে গিয়ে পানি পড়ছিল। সেখানে মাটির কাছেও সে লোকটি ঘটি ধরতে সাহস পাচ্ছিল না। আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে লোকটি থতমত খেয়ে যায়। বলে, ‘থোরা পানি লেয়ে গা’। বলেছিলাম, লে লি জিয়ে। ‘নেহি সাহাব, হাম ছোটা জাত হ্যায়। পানি খারাপ হো যায়েগা। হামকো ছুঁয়ে গা নেহি।’ ঘটি নিয়ে পানি ভরে দিলাম। লোকটিকে বাগানে ঘাসের ওপর বসিয়ে আমি জোড়াসীন করে তার সামনে বসেছিলাম। লোকটি বেশ অস্বস্তিতে পড়েছিল। তার পানির কেন দরকার জিজ্ঞেস করলে বলেছিল, ‘হাম দ্বারভাঙা ছে আয়া। ঘরমে লেরকি বিমার হ্যায়। কুছ পয়সেকে লিয়ে আয়াথা। লেকিন মিলা নেহি। ঘরছে থোরা কুছ ছাতু লে আয়া। ওহি খানেকে লিয়ে পানিকা জরুরত থা।’ লোকটি যখন টোপলা থেকে ছাতু বের করে একটু একটু করে খাচ্ছিল তখন আমার বড় মজা লাগছিল। আমাদের দেশে নারকেল দিয়ে চিড়া পাড় দিলে যেমন হয় প্রায় তেমনি। লোকটি যখন খাচ্ছিল আমার খুব ভালো লাগছিল। বলেছিলাম, হামে বি থোরা দি জিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল, ‘আপ লি জিয়ে। আপনা হাতছে লি জিয়ে।’ আবার বলেছিলাম, নেহি আপ দি জিয়ে। ‘নেহি বাবুজি, মেরা হাতছে নেহি। হামারা হাতছে দেনেছে ঝুটা হো যায়েগা।’ অনেক পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত আমার হাতে একদলা ছাতু তুলে দিয়েছিল। বেশ ভালো, সুস্বাদু। গরিবরা সাধারণ জিনিস খায়, কিন্তু বেস্বাদ খায় না। সুস্বাদু খাবার খায়। খাওয়া শেষ করে পানি খেয়ে উঠে যাবার পথে তাকে আমি পকেট থেকে কয়েকটা কড়কড়ে নোট দিয়েছিলাম। লোকটি টাকাটা নিয়ে একটু দূর গিয়েই ঘুরে এসে বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলেছিল, ‘সাহাব, আপতো গলতি নেহি কিয়া। আপকা জরুর গলতি হুয়া। আপকা জরুর গলতি হুয়া সাহাব।’ আমি যতই বলি আমি গলতি করিনি। যা দেওয়ার জেনে শুনে দিয়েছি। সে ততই বলে ‘নেহি সাহাব, আপকা জরুর গলতি হুয়া।’ অনেক বলে কয়ে তাকে বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। বলেছিলাম মেয়ের জন্য ওষুধ কিনে নিয়ে যেতে। ওইদিন দুপুরেই জয়প্রকাশজির সঙ্গে খাবার খেয়েছিলাম। রাতে বর্ধমান ফিরব তাই জয়প্রকাশজির দেওয়া হাজার দশেক টাকা পকেটে রেখে বাকিটা ব্যাগে রেখেছিলাম। তখন ভারতে ৫০০ টাকার থেকে বড় নোট ছিল না। আমি তাকে ৮-১০টি নোট দিয়েছি ভুল হতে যাবে কেন। ২০০ টাকা বেতনে বিহার বিধানসভার পিয়নের চাকরি করে। অত টাকা ভুল করে দিইনি তো। তাই বারবার বলছিল। আমি দেখেছি বিহার-উত্তর প্রদেশ-মধ্য প্রদেশ-রাজস্থানে মৃত্যুর সময়ও ব্রাহ্মণরা নিম্ন জাতের লোকের হাতে পানি পান করে না। এত জাতপাতের ভেদাভেদ।

 

আবার মহামানবের দেশ ভারত। এত মানবিক গুণের সমাহার সেখানে যা বলার মতো নয়। সারা দুনিয়া নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দালের এই জঘন্য বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাচ্ছে, ধিক্কার দিচ্ছে, ভারতের কোটি কোটি হিন্দু-মুসলমান মিলিতভাবে নিন্দা করছে। এই প্রথম পেয়ারা নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সম্পর্কে কটূক্তির জন্য সারা আরব দুনিয়া রুখে দাঁড়িয়েছে। ভারতীয় পণ্য বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতীয় যারা আরব দেশে চাকরি-বাকরি করে তাদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ আরব দেশের আজকের এ উন্নয়নে ভারতীয় মানুষের বা ভারতীয়দের শ্রম-ঘাম একেবারে উপেক্ষা করা যায় না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ পণ্য বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন। এবার আরব দেশগুলো ভারতীয় পণ্য বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অথচ বুঝতে পারছি না বাংলাদেশ কেন চুপচাপ, বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত কেন কোনো কথা বলছে না। আমি আর কী করতে পারি। গত সপ্তাহ থেকে ভারতীয় টিভি চ্যানেল বর্জন করেছি। প্রায় সময়ই জি বাংলায় কয়েকটি প্রিয় সিরিয়াল দেখতাম। তার মধ্যে পিলু, গৌরী ও উমা ছিল খুবই আকর্ষণীয়। করোনার শুরুতে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক ভ- সাহেদের কারণে চ্যানেল আই ও আরটিভি দেখা বাদ দিয়েছিলাম। কারণ চ্যানেল আই, আরটিভি ও আরও কয়েকটি চ্যানেল টকশোয় ডেকে সাহেদকে পাতে তুলেছিল। চ্যানেল আইয়ের ফরিদুর রেজা সাগর আমার খুবই প্রিয়, ছোটবোন শুশুর সঙ্গে পড়ত। যখন যেখানে দেখা হয়েছে সেখানেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করেছে। তবু তার চ্যানেল বর্জন করেছি। চ্যানেল আইয়ের ‘তৃতীয় মাত্রা’য় আমার কথা কেটে দিয়েছিল। সেজন্য ১২-১৫ বছরে চ্যানেল আইয়ের ত্রিসীমানায় যাইনি। তাই বাড়িতে সবাইকে বলেছি, যতক্ষণ এর সুরাহা না হচ্ছে, যারা নবী করিম (সা.)-এর সম্মানহানি করেছে তাদের আইনানুগ বিচার হওয়ার আগ পর্যন্ত ভারতীয় কোনো জিনিসপত্র ব্যবহার করতে বারণ করেছি। সরকারের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি, সরকারপ্রধান যিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, যাঁর তাহাজ্জুদের নামাজ বাদ পড়ে না তাঁর মহানবীর অবমাননা মুখ বুজে সহ্য করা উচিত নয়। তা করলে বরং তাঁরই ক্ষতি হবে। ভারতকে কীসের ভয়, ভয় করব আল্লাহ ও আল্লাহর রসুলকে।লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com    সূএ : বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com