১৮ বছরেও ভাই হত্যার বিচার পাইনি। বিচারের জন্য আমাদের চাওয়া পাওয়ারও কিছু নেই। এরচেয়ে আমাদের বড় চাওয়া তার সমাধিস্থলে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে কিছু একটা করা হোক। মানুষ সেখানে যাবে, তাকে স্মরণ করবে। এতে কিছুটা হলেও আমরা শান্তি পাবো।
এভাবেই নিজের দুঃখের কথা বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ভাই মঞ্জুর কবির। এতদিনেও বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অমর একুশে বই মেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে দুর্বৃত্তদের হামলায় মারাত্মক আহত হন হুমায়ুন আজাদ। তিনি ২২ দিন ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে এবং ৪৮ দিন ব্যাংককে চিকিৎসাধীন ছিলেন হুমায়ন আজাদ। এরপর ২০০৪ সালের ১২ আগস্ট (জার্মান সময়) তিনি জার্মানির মিউনিখে মারা যান।
হামলার পরদিন তার ভাই মঞ্জুর কবির বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেন। পরবর্তীতে হুমায়ুন আজাদ মারা যাওয়ায় তা হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়। ১৮ বছর ধরে ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার অপেক্ষায় হুমায়ুন আজাদের স্বজনরা। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও মামলাটির বিচার শেষ হয়নি। চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় দিন গুনছেন স্বজনেরা। তবে অতি শিগগিরই মামলার বিচার শেষ হবে এমন আশা করছে রাষ্ট্রপক্ষ।
ঢাকার ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুনের আদালতে মামলা দুটি বিচারাধীন। হত্যা মামলাটি গত ২২ ফেব্রুয়ারি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু ওইদিন তা হয়নি। আদালত আগামি ২ মার্চ যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ ধার্য করেছেন। একই ঘটনার বিস্ফোরক আইনের মামলাটি গত ১৭ জানুয়ারি সাক্ষ্যের জন্য ধার্য ছিল। ওই দিন সাক্ষ্য হয়নি। আদালত আগামি ২৮ মার্চ মামলাটির পরবর্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করেছেন।
মামলা সম্পর্কে হুমায়ুন আজাদের ছোট ভাই মো. মঞ্জুর কবির বলেন, ‘ভাইকে হারানোর ১৮ বছর হয়ে গেলো। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিচার পাইনি। বিচারের আশাও করি না।’
তিনি বলেন, ভাইকে হারিয়েছি, তাকে তো আর ফিরে পাবো না। তার অভাব তো পূরণ হবে না। তাকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা চাই। তবে আশা করবো, প্রকৃত দোষীরা যেন সাজা পায়। যারা নির্দোষ তারা যেন সাজা না পায়।
মঞ্জুর কবির বলেন, হামলার পর আমার ভাই তো মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিল। তখন তিনি জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে হামলার জন্য দায়ী করেছিলেন। কিন্তু তাকে তো মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়নি, আটক করা হয়নি। কি আশা করতে পারি আমরা।
প্রধানমন্ত্রীকে উল্লেখ করে আক্ষেপের সুরে মঞ্জুর কবির বলেন, ‘হুমায়ন আজাদ যখন সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছিলেন। তাকে জাহাঙ্গীর গেইট আটকে দেওয়া হয়। ঢুকতে দেওয়া হয়নি। পরে হেঁটে গিয়ে তাকে দেখে এসেছিলেন।
তিনি বলেন,‘বিচারের জন্য চাওয়া পাওয়ার কিছু আমাদের নেই। এর চেয়ে বড় চাওয়া তার সমাধিস্থলে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে কিছু একটা করা হোক। যাতে তার একটা স্মৃতি থাকে। এর চেয়ে বড় চাওয়ার কিছু আমাদের নেই। মানুষ সেখানে যাবে। তাকে স্মরণ করবে। এটাই আমাদের এখন বড় চাওয়া।
সংশ্লিষ্ট আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিপুল দেবনাথ বলেন, ‘আসামিপক্ষের আইনজীবীদের গাফিলতির কারণে মামলাটির বিচার এতদিনে শেষ হয়নি। তারা মামলার বিচারে বিলম্ব করছেন। তবে হত্যা মামলাটি প্রায় শেষের পর্যায়ে। আশা করি, শিগগিরই মামলাটির রায় ঘোষণা হবে। রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে পরেছে। আশা করছি, তাদের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হবে। এরপর আমরা বিস্ফোরক আইনের মামলায়ও সাক্ষীদের হাজির করে যতদ্রুত সম্ভব মামলাটির বিচার শেষ করবো।
আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদ বলেন, ন্যায় বিচার পাওয়া সকলের অধিকার। মামলাগুলোতে দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ হয়নি। আসামিরা যে হত্যার সাথে জড়িত এমন কিছু সাক্ষ্য প্রমাণে আসেনি। আসামিরা খালাস পাবেন বলে আশা করছেন তিনি।
হুয়ায়ুন আজাদের ওপর হামলায় ঘটনায় তার ভাইয়ের দায়ের করা মামলাটি তদন্ত করে ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর সিআইডির পুলিশ কাজী আবদুল মালেক পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে আদালতে হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি চার্জশিট দাখিল করেন।
২০১২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন আদালত। এ মামলায় মোট ৪১ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আত্মপক্ষ শুনানি শেষে মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের পর্যায়ে রয়েছে। অন্যদিকে বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় ২০০৯ সালের ৭ অক্টোবর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত। মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে। এ মামলায় ৪৯ জন সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ আগামি ২৮ মার্চ পরবর্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্র্তী সাক্ষ্য গ্রহণের তারিখ ধার্য করা হয়েছে।
মামলাটিতে ২০০৭ সালের ১৪ নভেম্বর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান, আতাউর রহমান সানি, নূর মোহাম্মদ সাবু ওরফে শামীম, মিনহাজ ওরফে শফিক, আনোয়ার ওরফে ভাগ্নে শহিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। ২০০৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সিএমএম আদালত শায়খ আব্দুর রহমান ও আতাউর রহমান সানির ঝালকাঠির বিচারক হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড হওয়ায় তাদের অব্যাহতি দিয়ে অপর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন। এরপর মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে বাদী মামলাটির বর্ধিত তদন্তের আবেদন করেন।
২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল সিআইডি পরিদর্শক লুৎফর রহমান পাঁচ আসামির বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার পরিবর্তে হত্যার অভিযোগে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। এরা হলেন- জেএমবির সূরা সদস্য আনোয়ারুল আলম ওরফে ভাগ্নে শহিদ, সালাহউদ্দিন ওরফে সালেহীন, মিজানুর রহমান ওরফে মিনহাজ ওরফে শাওন, রাকিবুল হাসান ওরফে হাফিজ মাহামুদ ও নুর মোহাম্মদ ওরফে সাবু।