সৎ ও অকুতোভয় বিরোধী দলের আজ বড়ই অভাব

নূরে আলম সিদ্দিকী: সহনশীলতাই গণতন্ত্রকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য প্রাচুর্য বৈভব সবটুকুই সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতার ওপর নির্ভরশীল। সমালোচনা নেই, পর্যালোচনাও নেই, রাজপথে মিছিলের মুখরিত কলরব নেই, জনসভার মাঠগুলো নির্জন শ্মশানের মতো খাঁখাঁ করে। রাজনৈতিক বিরোধী দল মুমূর্ষু রোগীর মতো ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকে, এমনই এক ধূসর জগতের বিদর্ভ নগরে গণতন্ত্রের অনুসন্ধান করা নিতান্তই বোকামি। দুঃখজনক হলেও বাস্তব, যে দেশটি পঞ্চাশ দশক থেকে ষাট দশকের পুরোটাই মৌলিক অধিকারের অনুসন্ধানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্যাপৃত ছিল, সেই দেশটি আজ কেন জানি না, নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ শ্মশানের মতো। এখানে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই, রাজনীতির সুঘ্রাণেরও বড়ই অভাব। এহেন অবস্থায় যে কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এবং দুঃসহ যন্ত্রণার নির্দয় দহনে তিলে তিলে দগ্ধীভূত হবেন- এটাই নিতান্ত স্বাভাবিক। আজকে বাংলাদেশের রাজনীতির যে অবস্থা বিদ্যমান, তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের চঞ্চল প্রবহমান স্রোতস্বিনী এই উদ্গত বঙ্গভূমি আজ এতটাই অচঞ্চল, স্থবির ও নিস্পৃহ যে, এখানে গণতন্ত্রের প্রদীপ্ত সূর্যের আলো ছড়ানোর প্রত্যাশা অনেকটাই তামাশা মাত্র। বাতি নিভিয়ে ফেলা জলসাঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমোট শ্বাসরুদ্ধকর একটি পরিবেশই আজ বাংলাদেশে বিদ্যমান। অথচ গোটা পঞ্চাশের দশক এ জাতি একটা উদগ্র বাসনা নিয়ে তার বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ বিকাশ ব্যাপ্তি ও প্রতিষ্ঠার ব্যাকুলতায় নিমগ্ন ছিল।

 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তদানীন্তন পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয় সত্তার বিকাশ তো দূরে থাক, তার আঙ্গিকের ক্যানভাসটিকেও দুমড়ে-মুচড়ে ফেলার পাশবিক খেলায় যখন পাকিস্তানের উদগ্র শাসকগোষ্ঠী উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, তখন এই বাঙালি মায়ের দুরন্ত দামাল ছেলেরা উদ্গত উদ্ধত চিত্তে বজ্রনির্ঘোষে গর্জে উঠে বলেছিল- এই বাংলা আমার মাতৃভূমি, এই বাংলা আমার মায়ের ভাষা। ভাষা ও মাটির আকর্ষণে বাঙালি জাতিসত্তার আবির মেখে সেদিনের সোনার ছেলেরা যে দিগন্তবিস্তৃত পথে পরিক্রমণ শুরু করেছিলেন, সেই দিগন্তবিস্তৃত পথপরিক্রমণের শেষপ্রান্তে এসে ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত অবয়বে স্বাধীনতার সূর্যকে আলিঙ্গন করলেন। ১৯৪৮ সালে যে পথপরিক্রমণের শুরু, একাত্তরে সেই হালভাঙা তরণীর নাবিকেরা বিদর্ভ নগরের একটি সমুজ্জ্বল সৈকতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাকে সগর্বে আলিঙ্গন করল, সূর্যত হলো। গণতন্ত্রের জন্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতির জন্য আত্মবিকাশের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে জাতি অকাতরে বুকনিঃসৃত রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সেই জাতি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের এই গোধূলিলগ্নে নিঃশেষিত প্রাণের মতো নিঃশব্দ কেন? এই নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ বাংলাদেশকে দেখে সত্তরোর্ধ্ব যেকোনো প্রবীণই আজ নবীনদের কাছে অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশের তপ্ত-তাজা প্রাণের কলতান ও আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গমালার সেই উদ্ধত উচ্ছ্বাস আজ কোথায়? আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত সেই বাংলাদেশ আজ নিস্তব্ধ মৃতপ্রায় কেন?দেশে আজ যে থমথমে নিস্তব্ধ ও নিষ্প্রাণ অবস্থা বিরাজমান, এ অবস্থা অবলোকনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে এটি অকল্যাণকর এবং দুরূহ ও দুর্বিষহ সংকটের অশনিসংকেত।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক চর্চাবিবর্জিত ও সৎ, সক্রিয়, সৃজনশীল বিরোধী দলের মহাসংকটে নিপতিত। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ তো বটেই, রাজনৈতিকভাবেও অনেকটা ভারসাম্যহীন। বিএনপির নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দাবিটি যদিও অমূলক নয়, তবু রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, রাজনীতির দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পরিক্রমণ করে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে আরোহণ করেননি। বেগম জিয়া একজন সৌন্দর্যপিয়াসী, রূপচর্চা-পটীয়সী ক্ষমতাশ্রয়ী সৌভাগ্যবতী মহিলা। সম্ভবত ভাগ্যই তাঁর স্কন্ধের বোঝা বয়ে বেড়িয়েছে এবং কালক্রমে তাঁকে সৌভাগ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করিয়েছে। বন্ধুর ও দুর্গম পথ তাঁকে তেমন পাড়ি দিতে হয়নি। একবার তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন বটে, তবে সেটাও ‘প্রাসাদবন্দি’। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে কখনই তাঁর জীবন রাজনৈতিক চর্চার পরিমন্ডলে আবর্তিত ছিল না। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা জিয়াউর রহমানের অকালমৃত্যুর বেদনাবিধুর পরিস্থিতিতে বিএনপির সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ বেগম খালেদা জিয়ার হাতে ক্ষমতার আলোকবর্তিকাটি তুলে দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তার রেশ ধরেই বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণ করেন, কোনো ক্লান্তিকর অভিযাত্রায় অংশ না নিয়েই।

 

অন্যদিকে শেখ হাসিনা শৈশব থেকেই দেখে আসছেন পিতার দুর্গম রাজনৈতিক পথচলা। এক ক্লান্ত নাবিকের মতো বিদর্ভ নগর পাড়ি দিয়ে তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক অভিযাত্রায় পথ হেঁটেছেন, সব নির্যাতন-নিগ্রহ মোকাবিলা করে স্বীয় আদর্শ ও লক্ষ্যের পানে অবিচল থেকেছেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর সেই নেতৃত্বকে আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে জাতিকে একটি মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। এর জন্য কত বন্ধুর পথ তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে, দিনের পর দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় কাটাতে হয়েছে, কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। এই সবকিছুকে প্রত্যক্ষ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বেড়ে উঠেছেন।

 

ফলে শৈশব থেকেই তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের নির্যাতন ও নিগ্রহের আগুনে পোড়-খাওয়া একটি ঝলসে যাওয়া রাজনৈতিক সত্তা। বাবা কারারুদ্ধ, মা ঢাকা শহরের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতেন একটি বাড়ি ভাড়া পাওয়ার জন্য- এই ক্লান্তিকর প্রচেষ্টারও নির্বাক সাক্ষী হতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তারপর ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস ও বীভৎস সর্বস্ব হারানোর অতুলনীয় বিয়োগান্ত ঘটনার মর্মন্তুদ যাতনার শিকার হতে হয় তাঁকে। ভাগ্যিস, তখন শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাসহ তাঁর স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। তা না হলে শহীদের তালিকায় তাঁদেরও নাম অন্তর্ভুক্ত হতো। শেখ হাসিনার ক্ষমতাকালীন আজকে যে নিন্ডিদ্র নিস্তব্ধতায় বাংলাদেশ অবস্থান করছে, এটা আপাত নিরুপদ্রব মনে হলেও, মোটেও আশঙ্কাবিমুক্ত নয়। কারণ, স্বাভাবিক রাজনীতির গতিধারা বন্ধ থাকলে অস্বাভাবিক রাজনীতির স্রোতধারা পথ খুঁজে নেয়। বিরোধী দল-বিবর্জিত আজকের রাজনীতির যে অভিশাপ এবং তার প্রতিক্রিয়ার যে ফলশ্রুতি, সেটি কারও জন্য কখনই শুভকর হয় না। পরিবারহারা শেখ হাসিনার এবং বৈধব্যের যন্ত্রণায় কাতর খালেদা জিয়ার জীবনালেখ্য তারই প্রমাণ বহন করে।

 

রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর জীবনসায়াহ্নে এসে আমার বিদগ্ধ সত্তাকে একটা অস্বস্তির জানান দেয় এই যে, বিরোধী দল-বিবর্জিত ও রাজনৈতিক চর্চা ছাড়া একটি দেশ যেকোনো আশঙ্কার গর্ভে নিপতিত হতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আজকে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক শাসিত। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি অসাম্প্রদায়িক ভারতের জাতীয় সত্তাকে অনেকটাই ম্লান ও বিবর্ণ করে তুলেছে কিন্তু বহুদলীয় রাজনীতির প্রথাকে বিলুপ্ত করতে পারেনি। বিজেপির সাম্প্রদায়িক কালো মেঘ গণতন্ত্রের সূর্য¯œাত ভারতকে অনাদি অনন্তকালের জন্য অন্ধকার অমানিশায় নিমজ্জিত রাখতে পারবে না। কারণ, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবিশ্রান্ত ধারায় সম্মুখের দিকে ধেয়ে চলে। কিন্তু এই বাংলাদেশে পথের বাঁকে বাঁকে অজস্র অগণিত ব্যারিকেড তৈরি হয়। এ ব্যারিকেডগুলো লঙ্ঘন করে এগিয়ে যেতে হয় এবং বাঙালি জাতি তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতা অর্জন করে বন্ধুর পথ অতিক্রমের মধ্য দিয়ে। আজ যখন বাংলাদেশকে নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ ও নিস্পৃহ দেখি, তখনই ভয় হয়, আশঙ্কা জাগে- গণতন্ত্রের পথিক কি আবার পথ হারাবে?

 

একটি জাতীয় জীবনের রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকবেই, পথগুলো দুর্গম হবেই। সেই পথগুলোকে চলার উপযোগী করার দায়িত্ব দল-মত-নির্বিশেষে সবার। গণতন্ত্রের জন্য একান্ত আবশ্যক সৎ, অকুতোভয় ও দেশপ্রেমে অভিষিক্ত একটি সৃজনশীল বিরোধী দলের। বিরোধী দল-বিবর্জিত কোনো রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক পন্থা বা বিধি-ব্যবস্থা চলতে পারে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জাতীয় বিপর্যয় নেমে আসে। মহামতি অ্যারিস্টটল যথার্থই বলেছেন- ‘গণতন্ত্রের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে। তবু অন্য যে কোনো ধারার সরকারের চাইতে গণতান্ত্রিক ধারার সরকারই সর্বোৎকৃষ্ট।’ এবং এই গণতান্ত্রিক ধারার সরকারও দুই ভাগে বিভাজিত। একটি রাষ্ট্রপতি ধরনের সরকার, আরেকটি সংসদীয় ধরনের সরকার। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নমুখী দেশের জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রই প্রণিধানযোগ্য। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রে যৌথ নেতৃত্ব ও তা জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার রাখে। ভারতের দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে এ দুটি সত্তাই সমুজ্জ্বল, প্রজ্বলিত ও প্রতিভাত। সেখানে কোনো শক্তি এমনকি বিজেপিও গণতন্ত্রের প্রদীপ্ত সূর্যকে চিরদিনের মতো আচ্ছাদিত করতে পারে না। কিন্তু বড় বিচিত্র এই বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতি প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এক ব্যক্তির শাসনের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। গণতন্ত্রের জন্য দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও একসময় সবার অজান্তেই কেমন করে যেন ব্যক্তিশাসনের অভিশপ্ত ধারা শুরু হয়ে যায়। ব্যক্তিশাসনের কালো মেঘ গণতন্ত্রের অনিরুদ্ধ সূর্যকে কেমন করে যেন বারবার অবরুদ্ধ করে ফেলে।

 

আমাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচনকালীন প্রচার-প্রচারণায় উভয়ের বক্তব্যই ছিল পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসৃত। বসন্তের ¯িœগ্ধ সমীরণের মতো একটা অদ্ভুত আমেজমাখা কী সুন্দর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুই দলের দুই প্রার্থীই সৃজনশীল পরিবেশে দায়িত্বশীলভাবে নির্বাচনটি মোকাবিলা করছিলেন। এ যেন পাশ্চাত্য দেশের সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের মতোই প্রবহমান ছিল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দুই প্রার্থীর যে বক্তব্য বিবৃতি আমরা শুনছিলাম, তাতে মনে হচ্ছিল- এ নির্বাচনটি আমাদের স্বস্তির সৈকতে নিয়ে দাঁড় করাবে। কিন্তু আমাদের পোড়া-কপাল, নির্বাচন-উত্তরকালে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম সাহেব তাঁর সহনশীলতার শেষ রক্ষায় কেন জানি একটুখানি বিবর্ণ হয়ে গেলেন। বিদেশে নির্বাচনের মতো পরাজিত প্রার্থীই সর্বপ্রথম বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাবেন এবং বিজয়ীর গঠনমূলক কর্মকান্ডে সব ধরনের নিঃশর্ত সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করবেন। তৈমূর সাহেব সরাসরি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন না, তবু কেন্দ্রের অনেক নেতাসহ নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তাঁকে সমর্থন জুগিয়ে সেøাগানে মিছিলে নারায়ণগঞ্জকে মুখরিত ও প্রকম্পিত করে নির্বাচনটি উৎসবমুখর করে তুলেছিলেন। ফল ঘোষণার শেষ ক্ষণ অবধি তৈমূর আলম খন্দকার খুবই ইতিবাচক ভূমিকায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে পরাজয়ের পর পুরোপুরি গণেশ উল্টে না গেলেও তাঁর বক্তব্য অনেকটাই নেতিবাচক ও স্ববিরোধী ছিল। তবু মন্দের ভালো, আশার আলো ও সম্ভাবনার দিক-নিদর্শন এই যে, নির্বাচন চলাকালীন থেকে শেষ পর্যন্ত যে ধৈর্য ও সংযম উভয় প্রার্থী ও প্রার্থীদের স্ব স্ব রাজনৈতিক দল এবং সার্বিকভাবে নারায়ণগঞ্জবাসী ধারণ করেছেন, তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর ও আশাজাগানিয়া। বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন দুটি এ থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা গ্রহণ করবে- জাতির এটিই আকাক্সক্ষা। এটি ইতিহাসসিদ্ধ যে, নারায়ণগঞ্জ গণতন্ত্রের প্রসূতিকাগার। অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনের প্রভূত পরিচর্যা করেছে নারায়ণগঞ্জবাসী। ঢাকার মনু মিয়া ও অন্যান্য শহীদের সঙ্গে কয়েকজন শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের মাটি।

 

এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে জাজ্ব¡ল্যমান দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপিত করল, তা সমগ্র জাতির সামনে গণতান্ত্রিক বেদিমূলকে প্রতিষ্ঠায় যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করল, এ দেশের গণতান্ত্রিক অর্জনে তা একটি বিশেষ মাইলফলক।

 

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বিডিএস বাস্তবায়িত হলে ম্যাপ সংযুক্ত মালিকানা ভিত্তিক খতিয়ান চালু করা সম্ভব হবে – ভূমিমন্ত্রী

» বিএটি বাংলাদেশের ৫১তম এজিএম অনুষ্ঠিত

» ইসলামপুরে কৃষকরা পেল উন্নত মানের বীজ

» ভিআইপিবি অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সাথে ব্র্যাক ব্যাংকের কাস্টোডিয়াল সার্ভিস চুক্তি

» এপেক্স ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিস্ট কাউন্সিল”এর বাংলাদেশ চ্যাপ্টারের কমিটি গঠিত

» ২ লাখ টাকার ফ্যামিলি ট্রিপের সেরা ঈদ অফার দিচ্ছে রিয়েলমি

» ঘূর্ণিঝড়ে আলফাডাঙ্গার ২২ গ্রাম বিধ্বস্ত

» প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা আগামীকাল

» আইপিইউর এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের চেয়ারম্যান হলেন স্পিকার

» এক শহরের মধ্যে দুই দেশ

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সৎ ও অকুতোভয় বিরোধী দলের আজ বড়ই অভাব

নূরে আলম সিদ্দিকী: সহনশীলতাই গণতন্ত্রকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য প্রাচুর্য বৈভব সবটুকুই সহিষ্ণুতা বা সহনশীলতার ওপর নির্ভরশীল। সমালোচনা নেই, পর্যালোচনাও নেই, রাজপথে মিছিলের মুখরিত কলরব নেই, জনসভার মাঠগুলো নির্জন শ্মশানের মতো খাঁখাঁ করে। রাজনৈতিক বিরোধী দল মুমূর্ষু রোগীর মতো ইনটেনসিভ কেয়ারে থাকে, এমনই এক ধূসর জগতের বিদর্ভ নগরে গণতন্ত্রের অনুসন্ধান করা নিতান্তই বোকামি। দুঃখজনক হলেও বাস্তব, যে দেশটি পঞ্চাশ দশক থেকে ষাট দশকের পুরোটাই মৌলিক অধিকারের অনুসন্ধানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ব্যাপৃত ছিল, সেই দেশটি আজ কেন জানি না, নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ শ্মশানের মতো। এখানে কোনো প্রাণের স্পন্দন নেই, রাজনীতির সুঘ্রাণেরও বড়ই অভাব। এহেন অবস্থায় যে কোনো দেশপ্রেমিক নাগরিক উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত এবং দুঃসহ যন্ত্রণার নির্দয় দহনে তিলে তিলে দগ্ধীভূত হবেন- এটাই নিতান্ত স্বাভাবিক। আজকে বাংলাদেশের রাজনীতির যে অবস্থা বিদ্যমান, তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না, সমগ্র এশিয়ার মধ্যে রাজনৈতিক আন্দোলনের চঞ্চল প্রবহমান স্রোতস্বিনী এই উদ্গত বঙ্গভূমি আজ এতটাই অচঞ্চল, স্থবির ও নিস্পৃহ যে, এখানে গণতন্ত্রের প্রদীপ্ত সূর্যের আলো ছড়ানোর প্রত্যাশা অনেকটাই তামাশা মাত্র। বাতি নিভিয়ে ফেলা জলসাঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন গুমোট শ্বাসরুদ্ধকর একটি পরিবেশই আজ বাংলাদেশে বিদ্যমান। অথচ গোটা পঞ্চাশের দশক এ জাতি একটা উদগ্র বাসনা নিয়ে তার বাঙালি জাতিসত্তার উন্মেষ বিকাশ ব্যাপ্তি ও প্রতিষ্ঠার ব্যাকুলতায় নিমগ্ন ছিল।

 

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত তদানীন্তন পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয় সত্তার বিকাশ তো দূরে থাক, তার আঙ্গিকের ক্যানভাসটিকেও দুমড়ে-মুচড়ে ফেলার পাশবিক খেলায় যখন পাকিস্তানের উদগ্র শাসকগোষ্ঠী উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলেন, তখন এই বাঙালি মায়ের দুরন্ত দামাল ছেলেরা উদ্গত উদ্ধত চিত্তে বজ্রনির্ঘোষে গর্জে উঠে বলেছিল- এই বাংলা আমার মাতৃভূমি, এই বাংলা আমার মায়ের ভাষা। ভাষা ও মাটির আকর্ষণে বাঙালি জাতিসত্তার আবির মেখে সেদিনের সোনার ছেলেরা যে দিগন্তবিস্তৃত পথে পরিক্রমণ শুরু করেছিলেন, সেই দিগন্তবিস্তৃত পথপরিক্রমণের শেষপ্রান্তে এসে ১৯৭১ সালে রক্তাক্ত অবয়বে স্বাধীনতার সূর্যকে আলিঙ্গন করলেন। ১৯৪৮ সালে যে পথপরিক্রমণের শুরু, একাত্তরে সেই হালভাঙা তরণীর নাবিকেরা বিদর্ভ নগরের একটি সমুজ্জ্বল সৈকতে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতাকে সগর্বে আলিঙ্গন করল, সূর্যত হলো। গণতন্ত্রের জন্য, বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বীকৃতির জন্য আত্মবিকাশের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে জাতি অকাতরে বুকনিঃসৃত রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, সেই জাতি স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের এই গোধূলিলগ্নে নিঃশেষিত প্রাণের মতো নিঃশব্দ কেন? এই নীরব, নিথর, নিস্তব্ধ বাংলাদেশকে দেখে সত্তরোর্ধ্ব যেকোনো প্রবীণই আজ নবীনদের কাছে অবশ্যই প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশের তপ্ত-তাজা প্রাণের কলতান ও আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গমালার সেই উদ্ধত উচ্ছ্বাস আজ কোথায়? আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত সেই বাংলাদেশ আজ নিস্তব্ধ মৃতপ্রায় কেন?দেশে আজ যে থমথমে নিস্তব্ধ ও নিষ্প্রাণ অবস্থা বিরাজমান, এ অবস্থা অবলোকনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কোনো কারণ নেই। রাজনৈতিক আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে এটি অকল্যাণকর এবং দুরূহ ও দুর্বিষহ সংকটের অশনিসংকেত।

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক চর্চাবিবর্জিত ও সৎ, সক্রিয়, সৃজনশীল বিরোধী দলের মহাসংকটে নিপতিত। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া শারীরিকভাবে অসুস্থ তো বটেই, রাজনৈতিকভাবেও অনেকটা ভারসাম্যহীন। বিএনপির নেতৃবৃন্দ দাবি করেন, তিনি তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। দাবিটি যদিও অমূলক নয়, তবু রাজনৈতিক বিশ্লেষণে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, রাজনীতির দীর্ঘ ও দুর্গম পথ পরিক্রমণ করে বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসনে আরোহণ করেননি। বেগম জিয়া একজন সৌন্দর্যপিয়াসী, রূপচর্চা-পটীয়সী ক্ষমতাশ্রয়ী সৌভাগ্যবতী মহিলা। সম্ভবত ভাগ্যই তাঁর স্কন্ধের বোঝা বয়ে বেড়িয়েছে এবং কালক্রমে তাঁকে সৌভাগ্যের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করিয়েছে। বন্ধুর ও দুর্গম পথ তাঁকে তেমন পাড়ি দিতে হয়নি। একবার তিনি কারারুদ্ধ ছিলেন বটে, তবে সেটাও ‘প্রাসাদবন্দি’। শৈশব, কৈশোর ও যৌবনে কখনই তাঁর জীবন রাজনৈতিক চর্চার পরিমন্ডলে আবর্তিত ছিল না। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা জিয়াউর রহমানের অকালমৃত্যুর বেদনাবিধুর পরিস্থিতিতে বিএনপির সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ বেগম খালেদা জিয়ার হাতে ক্ষমতার আলোকবর্তিকাটি তুলে দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তার রেশ ধরেই বেগম খালেদা জিয়া ক্ষমতার সিংহাসনে আরোহণ করেন, কোনো ক্লান্তিকর অভিযাত্রায় অংশ না নিয়েই।

 

অন্যদিকে শেখ হাসিনা শৈশব থেকেই দেখে আসছেন পিতার দুর্গম রাজনৈতিক পথচলা। এক ক্লান্ত নাবিকের মতো বিদর্ভ নগর পাড়ি দিয়ে তাঁর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে রাজনৈতিক অভিযাত্রায় পথ হেঁটেছেন, সব নির্যাতন-নিগ্রহ মোকাবিলা করে স্বীয় আদর্শ ও লক্ষ্যের পানে অবিচল থেকেছেন। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর সেই নেতৃত্বকে আপন স্কন্ধে তুলে নিয়ে ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে বাঙালির মুক্তির আকাক্সক্ষাকে জাগ্রত করে জাতিকে একটি মোহনায় এনে দাঁড় করিয়েছেন। এর জন্য কত বন্ধুর পথ তাঁকে পাড়ি দিতে হয়েছে, দিনের পর দিন পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কারারুদ্ধ অবস্থায় কাটাতে হয়েছে, কতবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। এই সবকিছুকে প্রত্যক্ষ করেই বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বেড়ে উঠেছেন।

 

ফলে শৈশব থেকেই তিনি রাজনৈতিক আন্দোলনের নির্যাতন ও নিগ্রহের আগুনে পোড়-খাওয়া একটি ঝলসে যাওয়া রাজনৈতিক সত্তা। বাবা কারারুদ্ধ, মা ঢাকা শহরের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতেন একটি বাড়ি ভাড়া পাওয়ার জন্য- এই ক্লান্তিকর প্রচেষ্টারও নির্বাক সাক্ষী হতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। তারপর ১৫ আগস্টের সেই নৃশংস ও বীভৎস সর্বস্ব হারানোর অতুলনীয় বিয়োগান্ত ঘটনার মর্মন্তুদ যাতনার শিকার হতে হয় তাঁকে। ভাগ্যিস, তখন শেখ হাসিনা ছোট বোন শেখ রেহানাসহ তাঁর স্বামীর কর্মস্থল পশ্চিম জার্মানিতে অবস্থান করছিলেন। তা না হলে শহীদের তালিকায় তাঁদেরও নাম অন্তর্ভুক্ত হতো। শেখ হাসিনার ক্ষমতাকালীন আজকে যে নিন্ডিদ্র নিস্তব্ধতায় বাংলাদেশ অবস্থান করছে, এটা আপাত নিরুপদ্রব মনে হলেও, মোটেও আশঙ্কাবিমুক্ত নয়। কারণ, স্বাভাবিক রাজনীতির গতিধারা বন্ধ থাকলে অস্বাভাবিক রাজনীতির স্রোতধারা পথ খুঁজে নেয়। বিরোধী দল-বিবর্জিত আজকের রাজনীতির যে অভিশাপ এবং তার প্রতিক্রিয়ার যে ফলশ্রুতি, সেটি কারও জন্য কখনই শুভকর হয় না। পরিবারহারা শেখ হাসিনার এবং বৈধব্যের যন্ত্রণায় কাতর খালেদা জিয়ার জীবনালেখ্য তারই প্রমাণ বহন করে।

 

রক্তাক্ত স্বাধীনতাযুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পর জীবনসায়াহ্নে এসে আমার বিদগ্ধ সত্তাকে একটা অস্বস্তির জানান দেয় এই যে, বিরোধী দল-বিবর্জিত ও রাজনৈতিক চর্চা ছাড়া একটি দেশ যেকোনো আশঙ্কার গর্ভে নিপতিত হতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত আজকে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি কর্তৃক শাসিত। সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি অসাম্প্রদায়িক ভারতের জাতীয় সত্তাকে অনেকটাই ম্লান ও বিবর্ণ করে তুলেছে কিন্তু বহুদলীয় রাজনীতির প্রথাকে বিলুপ্ত করতে পারেনি। বিজেপির সাম্প্রদায়িক কালো মেঘ গণতন্ত্রের সূর্য¯œাত ভারতকে অনাদি অনন্তকালের জন্য অন্ধকার অমানিশায় নিমজ্জিত রাখতে পারবে না। কারণ, বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অবিশ্রান্ত ধারায় সম্মুখের দিকে ধেয়ে চলে। কিন্তু এই বাংলাদেশে পথের বাঁকে বাঁকে অজস্র অগণিত ব্যারিকেড তৈরি হয়। এ ব্যারিকেডগুলো লঙ্ঘন করে এগিয়ে যেতে হয় এবং বাঙালি জাতি তার বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতা অর্জন করে বন্ধুর পথ অতিক্রমের মধ্য দিয়ে। আজ যখন বাংলাদেশকে নিস্তব্ধ, নিষ্প্রাণ ও নিস্পৃহ দেখি, তখনই ভয় হয়, আশঙ্কা জাগে- গণতন্ত্রের পথিক কি আবার পথ হারাবে?

 

একটি জাতীয় জীবনের রাজনীতিতে উত্থান-পতন থাকবেই, পথগুলো দুর্গম হবেই। সেই পথগুলোকে চলার উপযোগী করার দায়িত্ব দল-মত-নির্বিশেষে সবার। গণতন্ত্রের জন্য একান্ত আবশ্যক সৎ, অকুতোভয় ও দেশপ্রেমে অভিষিক্ত একটি সৃজনশীল বিরোধী দলের। বিরোধী দল-বিবর্জিত কোনো রাষ্ট্রেই গণতান্ত্রিক পন্থা বা বিধি-ব্যবস্থা চলতে পারে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে যথাসময়ে যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে জাতীয় বিপর্যয় নেমে আসে। মহামতি অ্যারিস্টটল যথার্থই বলেছেন- ‘গণতন্ত্রের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি রয়েছে। তবু অন্য যে কোনো ধারার সরকারের চাইতে গণতান্ত্রিক ধারার সরকারই সর্বোৎকৃষ্ট।’ এবং এই গণতান্ত্রিক ধারার সরকারও দুই ভাগে বিভাজিত। একটি রাষ্ট্রপতি ধরনের সরকার, আরেকটি সংসদীয় ধরনের সরকার। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নমুখী দেশের জন্য সংসদীয় গণতন্ত্রই প্রণিধানযোগ্য। কারণ, সংসদীয় গণতন্ত্রে যৌথ নেতৃত্ব ও তা জনগণের কাছে দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার রাখে। ভারতের দীর্ঘদিনের রাজনীতিতে এ দুটি সত্তাই সমুজ্জ্বল, প্রজ্বলিত ও প্রতিভাত। সেখানে কোনো শক্তি এমনকি বিজেপিও গণতন্ত্রের প্রদীপ্ত সূর্যকে চিরদিনের মতো আচ্ছাদিত করতে পারে না। কিন্তু বড় বিচিত্র এই বাংলাদেশ। দীর্ঘদিন সংসদীয় গণতন্ত্রের রাজনীতি প্রচলিত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ এক ব্যক্তির শাসনের অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসতে পারল না। গণতন্ত্রের জন্য দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েও একসময় সবার অজান্তেই কেমন করে যেন ব্যক্তিশাসনের অভিশপ্ত ধারা শুরু হয়ে যায়। ব্যক্তিশাসনের কালো মেঘ গণতন্ত্রের অনিরুদ্ধ সূর্যকে কেমন করে যেন বারবার অবরুদ্ধ করে ফেলে।

 

আমাদের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপির তৈমূর আলম খন্দকার। নির্বাচনকালীন প্রচার-প্রচারণায় উভয়ের বক্তব্যই ছিল পরিশীলিত, পরিমার্জিত ও গণতান্ত্রিক আদর্শ অনুসৃত। বসন্তের ¯িœগ্ধ সমীরণের মতো একটা অদ্ভুত আমেজমাখা কী সুন্দর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দুই দলের দুই প্রার্থীই সৃজনশীল পরিবেশে দায়িত্বশীলভাবে নির্বাচনটি মোকাবিলা করছিলেন। এ যেন পাশ্চাত্য দেশের সুস্থ গণতান্ত্রিক পরিবেশের মতোই প্রবহমান ছিল। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার প্রায় শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দুই প্রার্থীর যে বক্তব্য বিবৃতি আমরা শুনছিলাম, তাতে মনে হচ্ছিল- এ নির্বাচনটি আমাদের স্বস্তির সৈকতে নিয়ে দাঁড় করাবে। কিন্তু আমাদের পোড়া-কপাল, নির্বাচন-উত্তরকালে অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম সাহেব তাঁর সহনশীলতার শেষ রক্ষায় কেন জানি একটুখানি বিবর্ণ হয়ে গেলেন। বিদেশে নির্বাচনের মতো পরাজিত প্রার্থীই সর্বপ্রথম বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানাবেন এবং বিজয়ীর গঠনমূলক কর্মকান্ডে সব ধরনের নিঃশর্ত সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করবেন। তৈমূর সাহেব সরাসরি বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ছিলেন না, তবু কেন্দ্রের অনেক নেতাসহ নারায়ণগঞ্জ বিএনপির সর্বস্তরের নেতা-কর্মী তাঁকে সমর্থন জুগিয়ে সেøাগানে মিছিলে নারায়ণগঞ্জকে মুখরিত ও প্রকম্পিত করে নির্বাচনটি উৎসবমুখর করে তুলেছিলেন। ফল ঘোষণার শেষ ক্ষণ অবধি তৈমূর আলম খন্দকার খুবই ইতিবাচক ভূমিকায় অবস্থান করছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে পরাজয়ের পর পুরোপুরি গণেশ উল্টে না গেলেও তাঁর বক্তব্য অনেকটাই নেতিবাচক ও স্ববিরোধী ছিল। তবু মন্দের ভালো, আশার আলো ও সম্ভাবনার দিক-নিদর্শন এই যে, নির্বাচন চলাকালীন থেকে শেষ পর্যন্ত যে ধৈর্য ও সংযম উভয় প্রার্থী ও প্রার্থীদের স্ব স্ব রাজনৈতিক দল এবং সার্বিকভাবে নারায়ণগঞ্জবাসী ধারণ করেছেন, তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর ও আশাজাগানিয়া। বৃহত্তর রাজনৈতিক সংগঠন দুটি এ থেকে কিছুটা হলেও শিক্ষা গ্রহণ করবে- জাতির এটিই আকাক্সক্ষা। এটি ইতিহাসসিদ্ধ যে, নারায়ণগঞ্জ গণতন্ত্রের প্রসূতিকাগার। অনেক রাজনৈতিক আন্দোলন এবং ছয় দফা আন্দোলনের প্রভূত পরিচর্যা করেছে নারায়ণগঞ্জবাসী। ঢাকার মনু মিয়া ও অন্যান্য শহীদের সঙ্গে কয়েকজন শহীদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল নারায়ণগঞ্জের মাটি।

 

এবারের স্থানীয় সরকার নির্বাচন যে জাজ্ব¡ল্যমান দৃষ্টান্ত প্রতিস্থাপিত করল, তা সমগ্র জাতির সামনে গণতান্ত্রিক বেদিমূলকে প্রতিষ্ঠায় যে পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করল, এ দেশের গণতান্ত্রিক অর্জনে তা একটি বিশেষ মাইলফলক।

 

লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com