তসলিমা নাসরিন: বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় একজন বিখ্যাত লেখক ধারাবাহিকভাবে লিখছেন বিভিন্ন লেখক সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। আমার সম্পর্কে লিখতে গিয়ে তিনি একের পর এক কাকে আমি বিয়ে করেছি, তার তালিকা দিলেন। তিনি কেন এটিকে এত প্রয়োজনীয় মনে করলেন আমি জানি না। এমন নয় যে তিনি আমার কোনও বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন, নিজের চোখে বিয়ে দেখার অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে এবং এই অভিজ্ঞতার কথা না লিখলে তাঁর আর চলছিল না। তিনি লিখেছেন, কারণ তিনি অন্যের মুখে শুনেছেন বিয়ের কথা। যে তালিকা তিনি দিয়েছেন, সেই তালিকা তো মৌলবাদী এবং নারীবিদ্বেষীর দল প্রতিদিন প্রতিনিয়ত দিচ্ছে। অজানা কোনও তথ্য নয়। আমার সম্পর্কে যে কিছুই জানে না, আমার লেখা একটি বাক্যও যে কোনও দিন পড়েনি, সে অন্তত বিয়ে ক’টা করেছি তা জানে। জানে ঠিক বলা যাবে না, কারণ ঘটা করে বিয়ে আমি কোনও দিনই করিনি। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিত কেউই দেখেনি আমাকে বিয়ে করতে (বা কারও সঙ্গে সংসার করতে)। তারপরও লোকে আমার বিয়ে নিয়ে মেতে থাকে কেন? কারণ, আমি ক’টা বিয়ে করলাম মানে ঠিক ক’টা পুরুষের সঙ্গে শুলাম। লোকের আকর্ষণ ওই শোয়া ব্যাপারটায়। পুরুষ হাজার মেয়ের সঙ্গে শুলেও একটি মেয়ে সারা জীবন একটি পুরুষের সঙ্গে শোবে, এটিই লোকেরা জানে এবং মানে। এটির অন্যথা হতে দেখলে তারা অবাধে বেশ্যা বলে ডাকবে মেয়েদের, তবেই না তারা পুরুষ! বিখ্যাত লেখকটি নিশ্চয়ই বোঝেন, ওইসব দুদিনের বিয়ে, যদি সত্যিই ওগুলোকে বিয়ে বলিই (আইনের চোখে সম্ভবত ওগুলো বিয়ে ছিল না, যেহেতু কাবিন বলে কিছু ছিল না ওসবে), আমার জীবনে নিতান্তই অর্থহীন ছিল। কিন্তু অর্থহীন ব্যাপারটিকে একজন লেখকের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বড় অর্থপূর্ণ করে তুলেছেন। তিনি তাঁর লেখার শুরুতেই বিয়ের তালিকা দিয়ে আমাকে লেখক নয়, বরং যাকে দেখি তাকেই বিয়ে করে ফেলি এমন একটি মাথা-খারাপ মেয়ে হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন। যেন সারা জীবন ধরে আমি অন্য কিছুই করিনি, শুধু বিয়েই করে গিয়েছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোন পরিস্থিতিতে একটি মেয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়, কোন পরিস্থিতিতেই বা তালাক দিতে বাধ্য হয়, তার উল্লেখ কিন্তু তাঁর লেখাটিতে নেই। আমার বিয়ে নিয়ে তাঁর যদি এতই আগ্রহ, এ নিয়ে লেখার আগে তিনি আমার আত্মজীবনী একবার পড়ে নিলেই পারতেন। নাকি ভুলভাল মন্তব্য বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর কারও বেলায় না করা গেলেও আমার বেলায় করলে কোনও সমস্যা নেই, কারণ গত তিরিশ বছর ধরে তো এ-ই হয়ে আসছে! দায়িত্বশীল লেখক হিসেবে তাঁর কি উচিত ছিল না সহমর্মী হওয়া? গড্ডলিকা প্রবাহে না ভাসা? নারীবিদ্বেষীদের ভিড়ে মিশে না যাওয়া?
বিখ্যাত লেখকটিকে যদি আজ আর্থার মিলার সম্পর্কে লিখতে বলা হয়, তবে তিনি তাঁর বইগুলো পড়বেন, তারপর তাঁর লেখা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি লেখা লিখবেন। তিনি কিন্তু একের পর এক আর্থার যে বিয়ে করেছেন, সেসবের দীর্ঘ বর্ণনা করবেন না। কেন করবেন না? আর্থার মিলার পুরুষ, সে কারণে করবেন না। পুরুষ-লেখক ক’টা বিয়ে করলেন, কজনের সঙ্গে শুলেন, তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদি তিনি চিত্রপরিচালক মার্টিন স্করসেসে বা জেমস ক্যামেরন সম্পর্কে লেখেন, তিনি তাঁদের ছবিগুলো দেখে তারপর সে সবের ওপর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। স্করসেসে বা ক্যামেরন পাঁচটি করে বিয়ে করেছেন, এটি তাঁর কাছে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য বিষয় হবে না। একই রকম তিনি যদি সমরেশ বসুকে নিয়ে লেখেন, তাঁর লেখার বিষয় হবে তাঁর লেখা, তাঁর বিয়ে নয়। যদি হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে লেখেন, তিনি তাঁর লেখা উপন্যাস বা তাঁর নাটক নিয়ে লিখবেন। যদি তাঁর বিয়ের ব্যাপারটি কোনও কারণে উল্লেখ করেনই, তাঁকে মোটেও হেয় করার জন্য বা তাঁকে নিয়ে তামাশা করার জন্য উল্লেখ করবেন না। বরং হুমায়ূন আহমেদ মানুষ হিসেবে কত মহান, কত গুণী, তা বলবেন। ক’দিন হুমায়ূন আহমেদ কাকে নিয়ে কোথায় গিয়েছেন, কাকে আবার টুপ করে বিয়ে করে ফেলেছেন, এগুলো প্রধান বিষয় হবে না তাঁর লেখার। আমাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে সবচেয়ে মুখ্য করেছেন আমার বিয়ে, সবচেয়ে গৌণ করেছেন আমার লেখালেখি। আমার লেখা ৪৫টি বইয়ের একটিও পড়ে দেখার প্রয়োজন তিনি মনে করেননি। আমি যে মানুষ হিসেবে উদার, বিনয়ী, বন্ধুবৎসল, আমার সেন্স অব হিউমার ভালো, আমার লেখার ক্ষমতা ভালো, আমি সৎ এবং সাহসী, আমি বিপ্লবী, সংগ্রামী, আপোসহীন, এসব তাঁর চোখে পড়েনি। চোখে পড়েনি সমাজের মেয়েরা যে আমার লেখা পড়ে জেগে উঠেছে, সচেতন হয়েছে, সেসবের কিছুই। পুরুষ-লেখক হলে এসব চোখে পড়ে। কারণ পুরুষ-লেখকরা তো লেখক, যৌনাঙ্গ নয়।
সত্যি কথা বলতে, বাংলাদেশের পুরুষরা অধিকাংশই পুরুষতান্ত্রিক এবং নারীবিদ্বেষী। আমরা মনে করি পুরুষ-সাহিত্যিক, পুরুষ-শিল্পী, পুরুষ-বুদ্ধিজীবী সমতা এবং সততায় বিশ্বাস করেন। কিন্তু বারবার আহত হই যখন দেখি তাঁরাও আর সবার মতো একই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা বহন করে চলেছেন। শিল্পী-সাহিত্যিকদেরই তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কথা, ন্যায়ের পক্ষে, নীতির পক্ষে আপোসহীন দাঁড়ানোর কথা। তাঁদেরই তো বিশ্বাস করার কথা নারীর সমানাধিকারে, মানবাধিকারে, কিন্তু তাঁরাই যদি নারীকে কটাক্ষ করেন, তখন ভরসা করার জন্য সমাজে বেশি কেউ অবশিষ্ট থাকে না। যে তিনজন পুরুষের নাম আমার নামের সঙ্গে বহুকাল থেকে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে, ওই পুরুষদের সঙ্গে আমি জীবনের খুবই নগণ্য সময় কাটিয়েছি। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে লোকে, একটি কবিতা বা একটি গান পছন্দ হলো, তাতেই এই প্রশংসা। কেউ কিন্তু বলে না, রুদ্রর যে প্রায় প্রতিরাতে মদ না হলে এবং টানবাজার বা বাণিয়াশান্তার মেয়েদের সঙ্গে যৌনসম্পর্ক না হলে চলতো না। নাঈমুল ইসলাম খান সম্পর্কে লিখতে গেলে সকলেই বিশদ বর্ণনা করে সম্পাদনার জগতে সে যে এক বিশাল বিপ্লব করেছিল, সেই কথা। কেউ কিন্তু বলে না সে যে তিনটে বিয়ে করেছিল। মিনার মাহমুদকে নিয়ে লিখতে গেলে সকলে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকার প্রশংসা করবে, কেউ কিন্তু উল্লেখ করবে না তাঁর তিন বিয়ের কথা, এবং তাঁর মদ্যপ অবস্থায় মেয়েদের শারীরিক নির্যাতন করার কথা। এদের আমি যা প্রশংসা করেছি, তা আমার লেখা থেকে আলগোছে উঠিয়ে লোকে আজও তা উল্লেখ করে সত্যকথন হিসেবে, কিন্তু এদের কুকীর্তি নিয়ে আমি যা সমালোচনা করেছি, তা বরাবরই দেখেও দেখেনি কেউ। কারণ কী? কারণ ওই একটিই, পুরুষের যদি সামান্যও গুণ থাকে, সে পুরুষ বীর পুরুষ। তাদের সমালোচনা করা অন্যায়। আর আমার যদি হাজারও গুণ থাকে, আমি বীর নারী নই। আমি যেহেতু সমাজের নিয়ম ভেঙেছি, এক স্বামীর সঙ্গে লাথিগুঁতো খেয়ে, শারীরিক মানসিক নির্যাতন সয়ে, স্বামী সেবা করে, সন্তান উৎপাদন করে আজীবন সংসার করিনি, আমি মন্দ। মন্দ নারীকে মৌলবাদিরা হেনস্থা করছে, সরকার নির্যাতন করছে, তাতে কূপমণ্ডূকরা বগল বাজিয়ে খুশিতে নাচছে। শুধু কূপমণ্ডূকরা নয়, যা জানা ছিল না, তা হলো, অধিকাংশ শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীও নাচেন। তাঁরা প্রকাশ্যে নাচেন না বলে ভেবে নিই, তাঁরা বুঝি অপ্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু ভুল ভাঙে যখন তাঁদের মুখ থেকে ফিনকি দিয়ে আচমকা অবজ্ঞা বেরিয়ে আসে।
বাংলাদেশের যে মেয়েই শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত, লেখে বা ছবি আঁকে বা অভিনয় করে, তাঁদের চিরকালই মেয়েমানুষ হিসেবে বিচার করেছে তাঁদের পুরুষ-সহকর্মীরা। তাঁদের মৃত্যু না হলে, বা তাঁরা বৃদ্ধা না হলে তাঁদের নিয়ে তামাশা করতে কেউ ছাড়ে না। বাসে ট্রেনে রাস্তা ঘাটে, ঘরে বাইরে, অফিসে বাজারে নারীরা যেমন প্রতিনিয়ত হেনস্থা হচ্ছে, শিল্প সাহিত্যের তথাকথিত পূতপবিত্র সভ্য আঙিনাতেও নারীরা প্রতিনিয়ত হেনস্থা হচ্ছে। রাস্তার অশিক্ষিত মূর্খ বখাটে লম্পটের সঙ্গে চরিত্রের দিক দিয়ে অধিকাংশ পুরুষ-শিল্পী সাহিত্যিকের খুব একটা তফাৎ করা যায় না। তফাৎ একটিই, অশিক্ষিতদের কুকর্ম চোখে দেখা যায়, আর শিক্ষিতদের কুকর্ম বেশির ভাগই আড়ালে থাকে।
সমতার আর সমানাধিকারের জন্য, মৃত্যুর হুমকি সত্ত্বেও, যেভাবে জীবনভর লড়াই করেছি, ব্যানিং আর সেন্সরশিপের শিকার হয়ে যেভাবে নির্ভয়ে লিখে গিয়েছি, যেভাবে আদর্শ থেকে একচুলও বিচ্যুতি হয়নি, আমি যদি পুরুষ হতাম, এতদিনে যতগুলো পুরস্কার আছে দেশে, পেতাম। পুরুষ নই বলে পুরস্কার জোটেনি, তিরস্কার জুটেছে। সমাজের প্রতিটি পুরুষতান্ত্রিক প্রথা গত চল্লিশ বছরেরও বেশি যাবৎ ভাঙার পরও, পিঠে সে কারণে ইটপাটকেল এসে পড়লেও, সারা গায়ে কালশিরে দাগ পড়ে গেলেও, চার লাখ কট্টরবাদী জড়ো হয়ে আমার ফাঁসি দিতে মরিয়া হয়ে গেলেও, আমার মাথার দাম প্রকাশ্যে ঘোষণা হলেও, আমার নামের আগে বলা হয় আমি ‘বিতর্কিত এবং সমালোচিত লেখক’। আর একটি প্রথাও যে পুরুষ-লেখক ভাঙেননি, তাঁকে গর্ব করে পুরুষ-মুক্তচিন্তকরা নাম দিয়েছে ‘প্রথাবিরোধী লেখক’।
আমি লক্ষ্য করেছি, আমার লেখা পড়ে বোধ বুদ্ধি বাড়লেও, সচেতনতা বাড়লেও, আমার নামটি উল্লেখ করতে অনেকে দ্বিধা বোধ করে, বদলে কোনও পুরুষ লেখকের নাম বলে তাঁর প্রশংসা করে। কারণ পুরুষ-লেখকেরা যতই চরিত্রহীন হোক, সমাজে গ্রহণযোগ্য। আর যে নারী-লেখক পুরুষতান্ত্রিক এবং ধর্মতান্ত্রিক নিয়ম না মানার স্পর্ধা দেখিয়েছে, এতটুকু ভয় না পেয়ে যে নারী-লেখক অনড় দাঁড়িয়ে আছে তার আদর্শ উঁচু করে, আগুনে যে দগ্ধ হয়নি বরং ইস্পাত হয়েছে, তার চরিত্র যতই ভালো হোক, সে সমাজে ব্রাত্য।
এই সমাজ থেকে মাঝে মধ্যে যে সুবিচার আশা করি, জানি, তা নিতান্তই বালখিল্যতা।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা। সূএ:বাংলাদেশ প্রতিদিন