লক্ষ্মীপুরে ৫’শ টন গিগজ মুড়ি হাতে ভাজা হয়, রপ্তানি হয় বিশ্ববাজারেও

অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুরঃ পাঁচশ টন গিগজ মুড়ি হাতে ভাজা হয়।দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় বিশ্ববাজারেও। বিশেষ কিছু ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শেষে হাতে ভাজা গিগজ ধানের চাউলের মুড়ির স্বাদ আর প্রাকৃতিকতার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই সারাদেশে বিখ্যাত। তবে গত কয়েক বছর যাবত ধানের বিলুপ্তি এবং মেশিনের মুড়ির চাপে দেশের বিভিন্ন জেলায় অদৃশ্য হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এ মুড়ি। ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকে গিগজ মুড়ির সাথে পরিচিত নন। ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল ও আফসানা মীম তানহা নামের ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবী এমনটাই।

 

কিন্ত লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি তারা শুধু ধরেই রাখেনি বিশ্ববাজারেও পৌঁছে দিচ্ছে সুস্বাদু এ মুড়ি। লক্ষ্মীপুরের হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি নামে দেশ বিদেশে তৈরি করেছে বিশেষ একটি ব্র্যান্ড।

 

সারাদেশসহ বিদেশের কিছু রাষ্ট্রে অনিয়মিত ভাবেও রপ্তানি হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের গিগজ মুড়ি। জেলায় বছরে উৎপাদন হচ্ছে পাঁচশতাধিক টন মুড়ি । সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে।

 

স্থানীয় ভাবে জানা যায়, হাতে তৈরি গিগজ মুড়ি ও ধান ক্রয় বিক্রয়ের জন্য তৈরি হয়েছে ভিন্ন আড়ত ও হাট। সুস্বাদু আর ঐতিহ্যবাহী এ খাদ্যকে টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারীদের পড়তে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতায়। বিশেষ এ মুড়ির ক্রেতাদের অনেকেই জানেনা বিচিত্র এ পেশা সর্ম্পকে।

 

লক্ষ্মীপুর থানা রোডের হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির আড়তে কথা হয়, স্বরসতী দাস (৪৫) নামের এক নারীর সাথে । রবিবারে হাটের দিন প্রতি কেজি ১৩০ টাকা দরে ৬০ কেজি মুড়ি আড়তে আসা পাইকারের নিকট বিক্রি করেছিলেন তিনি। পরে সে টাকায় আড়ত থেকে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ২২শ টাকা দরে গিগজ ধান ক্রয় করেছিলেন মুড়ির জন্য ।

 

আড়তে ওই সময়ে মেশিনে তৈরি সাধারণ মুড়ি বিক্রি হচ্ছিল প্রতি কেজি ৫০ টাকায়। সাধারণ ধান প্রতি মণ (৪০ কেজি) ৯শ টাকা দরে। স্বরসতী দাস জানান, স্বাদ, ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিকতার কারণে সাধারণ মুড়ির তুলনায় হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি এবং গিগজ ধানের দাম প্রায় তিনগুণ বেশি। তবুও এ মুড়ির ব্যাপক চাহিদা। বাড়ি থেকে আড়তে আনলেই মুড়ি বিক্রি হয়ে যায়। গত ৫ বছর যাবত এ ব্যবসার সাথে জড়িত তিনি। তার পুরো সংসার চলছে হাতে ভাজা মুড়ির আয়ে। স্বরসতী দাসের বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের সমসেরাবাদ।

 

একই গ্রামের জোড়দিঘী নামক এলাকায় প্রায় ৩০ পরিবারের প্রধান পেশা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি উৎপাদন। অত্যন্ত কষ্টকর পেশা হলেও বংশগতভাবে যুগ যুগ ধরে তারা জড়িত এ ব্যবসার সাথে। পুরো গ্রামকে মানুষ গিগজ মুড়ির গ্রাম নামে জানে।

 

গ্রামের বাবুল দাস আবীর আকাশ জার্নালকে জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি ও খই উৎপাদন করেন তিনি। শহরের ওপর জমি কিনে বহুতল বাড়ি করেছেন। কিন্ত আদি পেশা ছাড়েননি। তিনি হাতে ভাজা মুড়িকে ঐতিহ্যবাহী খাদ্য মনে করেন। বাবুল দাসদের সরকার বাড়ীর প্রায় সব পরিবার এ মুড়ির উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িত।

 

স্থানীয় ভাবে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের পৌরসভার সমসেরাবাদ, উত্তর মজুপুর, বেঁড়িরমাথা, কমলনগর উপজেলার করুণানগর, দক্ষিণ গ্রাম, উত্তর গ্রাম, চর জালিয়া, রামগতি উপজেলার চর ডাক্তার এবং রঘুনাথপুর হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির জন্য বিখ্যাত। এ ৮টি গ্রামের শতাধিক পরিবারের হাজার মানুষের প্রধান জীবিকা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি।

 

ওই পরিবারদের প্রত্যেক সদস্যই রাতদিনের বেশির ভাগ সময় গিগজ ধান সিদ্ধ করা, শুকানো, চাল ভাঙ্গানো, মুড়ি ভাজা, আড়ত কিংবা দোকানে গিয়ে মুড়ি বিক্রি ও ধান ক্রয়ের মতো কাজের সাথে জড়িত।

 

বৃহস্পতি এবং রবিবার লক্ষ্মীপুর শহরের থানা সড়কের আড়তে হাতে ভাজা মুড়ির হাট বসে। এসময় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ও মুড়ি বিক্রেতারা আসে। সকাল ৯টা থেকে রাত পর্যন্ত মুড়ি ক্রয় বিক্রয় চলে। নির্মল দাসের আড়ত, ক্ষিতিশ বাবুর আড়ত এবং গুপি ভান্ডার জেলার হাতে ভাজা মুড়ির বড় আড়ত। দেশের বিভিন্ন জেলায় এখান থেকে মুড়ি যায়।

 

আড়তদার স্বদেশ দাস জানান, প্রতিহাটের দিন কমপক্ষে ৫-৬ টন এবং বছরে গড়ে ৫শ টনের বেশি গিগজ মুড়ি ক্রয় বিক্রয় হয়। আড়ত ছাড়াও বিভিন্ন দোকানীরা উৎপাদনকারীদের থেকে সরাসরিও মুড়ি কিনে থাকেন।

 

আড়তদার নির্মল দাস জানান, মাঝে মাঝে কয়েকজন ঢাকার রপ্তানীকারক মালেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকাতে লক্ষ্মীপুরের মুড়ি রপ্তানী করেন। এ অঞ্চলের প্রবাসীরা বিদেশ যাওয়ার সময় প্রায় ৫-১০ কেজি গিগজ মুড়ি সঙ্গে নিয়ে যান বলেও জানান তিনি।

 

অঞ্জনা দাস নামের এক নারী জানায়, ধান থেকে চাউল তৈরি এবং মুড়ি ভাজা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি একটি জটিল কাজ। সে কারণে অনেকে এখন পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।

 

উৎপাদনকারীরা জানান, হাতে ভাজা মুড়িতে লবণ পানি ছাড়া অন্য কোন পদার্থ দেয়া যায় না, লাড়কী ছাড়া গ্যাসের আগুনেও এ মুড়ি ভাজা যায় না। বাজারে পাওয়া কোন চাউলেও এ মুড়ি তৈরি করা যায় না।

 

উৎপাদনকারীরা জানান, মুড়ি ভাজার লোকেদের প্রধান সমস্যা পূজিঁর অভাবে বছরের শুরুতে ধান মজুদ করতে না পারা। সেজন্য এ কুটির শিল্প বেঁচে রাখতে তারা আড়তদার এবং এনজিও ঋণে আবদ্ধ থাকে। স্বল্প সুদে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পায় না তারা।

 

অন্য দিকে বৃষ্টির সময় মুড়ির ধান শুকাতে তাদের বড় কষ্ট। বৃষ্টির সময় মুড়ির ধান শুকাতে জন্য সরকারি সহায়তায় এয়ার ড্রাইয়ার পেতে চেয়েছেন, উৎপাদনকারীরা।

কলেজ শিক্ষক মোঃ আক্তার হোসেন জানান, রমজানের ইফতারী মুড়ি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। মেশিনের তৈরি মুড়ির চাউল মেশিনে তৈরি করা হয়। ভাজার সময় বিষাক্ত হাইড্রোজ এবং ইউরিয়া সার মিশ্রিত করা হয়। কিন্ত হাতে ভাজা মুড়িতে সে রকম কিছু মেশানো সম্ভব হয় না। সে কারণে গিগজ মুড়ি শতভাগ নিরাপদ এবং ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক। শীতের মোলা এবং বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে সকাল-সন্ধ্যার কমন নাস্তা ছোলা মুড়ি খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য।

 

হাতে ভাজা মুড়ি ব্যবসায়ীদের আর্থিক সংকট নিয়ে কথা হয়, সোনালী ব্যাংক লক্ষ্মীপুরের প্রধান শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার) মোঃ শামছুল ইসলামের সাথে । তিনি জানান-হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। সোনালী ব্যাংক থেকে কুটির শিল্পে ঋণ নিতে হলে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন। কিন্ত মুড়ি উৎপাদনকারীরা ট্রেড লাইসেন্স না দিতে পারলে তাদেরকে সহযোগিতা করা সম্ভব না।

 

কিন্ত ইসলামী ব্যাংক লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার ম্যানেজার মোঃ সানা উল্লাহ জানান,ঐতিহ্যবাহী গিগজ মুড়ি শিল্পকে রক্ষার জন্য ইসলামী ব্যাংক সহজ শর্তে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যেমে ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ দিতে পারে।

 

অন্যদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের প্রধান তথ্যকর্মকর্তা ফয়সল হাসান জানান,তিনি নিজেও লক্ষ্মীপুর ব্র্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির এক নিয়মিত ক্রেতা। ঐতিহ্যবাহী গিগজ মুড়িকে বাঁচিয়ে রাখতে কৃষক পর্যায়ে গিগজ ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ঋণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে এ সম্প্রদায়ের পাশে থাকার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানাবেন বলেও জানান তিনি।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ফের সড়ক অবরোধ

» ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায় ভারত

» থাইল্যান্ডে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী

» ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু

» রাবির ভর্তির বিভাগ পছন্দক্রম ফরম পূরণের তারিখ ঘোষণা

» শুভ জন্মদিন ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’

» মন্ত্রী-এমপির স্বজন যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেনি, সময়মতো ব্যবস্থা: কাদের

» তিতাসের অভিযানে ৭৬টি গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন

» ট্রাক ও ট্রাক্টরের সংঘর্ষে দুইজন নিহত

» আখাউড়া স্থলবন্দরে আমদানি-রফতানি বন্ধ

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

লক্ষ্মীপুরে ৫’শ টন গিগজ মুড়ি হাতে ভাজা হয়, রপ্তানি হয় বিশ্ববাজারেও

অ আ আবীর আকাশ, লক্ষ্মীপুরঃ পাঁচশ টন গিগজ মুড়ি হাতে ভাজা হয়।দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হয় বিশ্ববাজারেও। বিশেষ কিছু ধারাবাহিক প্রক্রিয়া শেষে হাতে ভাজা গিগজ ধানের চাউলের মুড়ির স্বাদ আর প্রাকৃতিকতার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই সারাদেশে বিখ্যাত। তবে গত কয়েক বছর যাবত ধানের বিলুপ্তি এবং মেশিনের মুড়ির চাপে দেশের বিভিন্ন জেলায় অদৃশ্য হয়ে গেছে ঐতিহ্যবাহী এ মুড়ি। ফলে বর্তমান প্রজন্মের অনেকে গিগজ মুড়ির সাথে পরিচিত নন। ইমতিয়াজ আহমেদ বুলবুল ও আফসানা মীম তানহা নামের ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবী এমনটাই।

 

কিন্ত লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক পরিবার হাতে ভাজা মুড়ি উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে। ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি তারা শুধু ধরেই রাখেনি বিশ্ববাজারেও পৌঁছে দিচ্ছে সুস্বাদু এ মুড়ি। লক্ষ্মীপুরের হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি নামে দেশ বিদেশে তৈরি করেছে বিশেষ একটি ব্র্যান্ড।

 

সারাদেশসহ বিদেশের কিছু রাষ্ট্রে অনিয়মিত ভাবেও রপ্তানি হচ্ছে লক্ষ্মীপুরের গিগজ মুড়ি। জেলায় বছরে উৎপাদন হচ্ছে পাঁচশতাধিক টন মুড়ি । সংশ্লিষ্ট উৎপাদনকারী, ব্যবসায়ী এবং স্থানীয়দের সাথে কথা বলে এসব জানা গেছে।

 

স্থানীয় ভাবে জানা যায়, হাতে তৈরি গিগজ মুড়ি ও ধান ক্রয় বিক্রয়ের জন্য তৈরি হয়েছে ভিন্ন আড়ত ও হাট। সুস্বাদু আর ঐতিহ্যবাহী এ খাদ্যকে টিকিয়ে রাখতে উৎপাদনকারীদের পড়তে হচ্ছে নানা প্রতিকূলতায়। বিশেষ এ মুড়ির ক্রেতাদের অনেকেই জানেনা বিচিত্র এ পেশা সর্ম্পকে।

 

লক্ষ্মীপুর থানা রোডের হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির আড়তে কথা হয়, স্বরসতী দাস (৪৫) নামের এক নারীর সাথে । রবিবারে হাটের দিন প্রতি কেজি ১৩০ টাকা দরে ৬০ কেজি মুড়ি আড়তে আসা পাইকারের নিকট বিক্রি করেছিলেন তিনি। পরে সে টাকায় আড়ত থেকে প্রতি মণ (৪০ কেজি) ২২শ টাকা দরে গিগজ ধান ক্রয় করেছিলেন মুড়ির জন্য ।

 

আড়তে ওই সময়ে মেশিনে তৈরি সাধারণ মুড়ি বিক্রি হচ্ছিল প্রতি কেজি ৫০ টাকায়। সাধারণ ধান প্রতি মণ (৪০ কেজি) ৯শ টাকা দরে। স্বরসতী দাস জানান, স্বাদ, ঐতিহ্য আর প্রাকৃতিকতার কারণে সাধারণ মুড়ির তুলনায় হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি এবং গিগজ ধানের দাম প্রায় তিনগুণ বেশি। তবুও এ মুড়ির ব্যাপক চাহিদা। বাড়ি থেকে আড়তে আনলেই মুড়ি বিক্রি হয়ে যায়। গত ৫ বছর যাবত এ ব্যবসার সাথে জড়িত তিনি। তার পুরো সংসার চলছে হাতে ভাজা মুড়ির আয়ে। স্বরসতী দাসের বাড়ি লক্ষ্মীপুর পৌর শহরের সমসেরাবাদ।

 

একই গ্রামের জোড়দিঘী নামক এলাকায় প্রায় ৩০ পরিবারের প্রধান পেশা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি উৎপাদন। অত্যন্ত কষ্টকর পেশা হলেও বংশগতভাবে যুগ যুগ ধরে তারা জড়িত এ ব্যবসার সাথে। পুরো গ্রামকে মানুষ গিগজ মুড়ির গ্রাম নামে জানে।

 

গ্রামের বাবুল দাস আবীর আকাশ জার্নালকে জানান, দীর্ঘ ৩০ বছর যাবত হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি ও খই উৎপাদন করেন তিনি। শহরের ওপর জমি কিনে বহুতল বাড়ি করেছেন। কিন্ত আদি পেশা ছাড়েননি। তিনি হাতে ভাজা মুড়িকে ঐতিহ্যবাহী খাদ্য মনে করেন। বাবুল দাসদের সরকার বাড়ীর প্রায় সব পরিবার এ মুড়ির উৎপাদন ও ব্যবসার সাথে জড়িত।

 

স্থানীয় ভাবে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলা শহরের পৌরসভার সমসেরাবাদ, উত্তর মজুপুর, বেঁড়িরমাথা, কমলনগর উপজেলার করুণানগর, দক্ষিণ গ্রাম, উত্তর গ্রাম, চর জালিয়া, রামগতি উপজেলার চর ডাক্তার এবং রঘুনাথপুর হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির জন্য বিখ্যাত। এ ৮টি গ্রামের শতাধিক পরিবারের হাজার মানুষের প্রধান জীবিকা হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি।

 

ওই পরিবারদের প্রত্যেক সদস্যই রাতদিনের বেশির ভাগ সময় গিগজ ধান সিদ্ধ করা, শুকানো, চাল ভাঙ্গানো, মুড়ি ভাজা, আড়ত কিংবা দোকানে গিয়ে মুড়ি বিক্রি ও ধান ক্রয়ের মতো কাজের সাথে জড়িত।

 

বৃহস্পতি এবং রবিবার লক্ষ্মীপুর শহরের থানা সড়কের আড়তে হাতে ভাজা মুড়ির হাট বসে। এসময় জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ও মুড়ি বিক্রেতারা আসে। সকাল ৯টা থেকে রাত পর্যন্ত মুড়ি ক্রয় বিক্রয় চলে। নির্মল দাসের আড়ত, ক্ষিতিশ বাবুর আড়ত এবং গুপি ভান্ডার জেলার হাতে ভাজা মুড়ির বড় আড়ত। দেশের বিভিন্ন জেলায় এখান থেকে মুড়ি যায়।

 

আড়তদার স্বদেশ দাস জানান, প্রতিহাটের দিন কমপক্ষে ৫-৬ টন এবং বছরে গড়ে ৫শ টনের বেশি গিগজ মুড়ি ক্রয় বিক্রয় হয়। আড়ত ছাড়াও বিভিন্ন দোকানীরা উৎপাদনকারীদের থেকে সরাসরিও মুড়ি কিনে থাকেন।

 

আড়তদার নির্মল দাস জানান, মাঝে মাঝে কয়েকজন ঢাকার রপ্তানীকারক মালেশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ এবং আমেরিকাতে লক্ষ্মীপুরের মুড়ি রপ্তানী করেন। এ অঞ্চলের প্রবাসীরা বিদেশ যাওয়ার সময় প্রায় ৫-১০ কেজি গিগজ মুড়ি সঙ্গে নিয়ে যান বলেও জানান তিনি।

 

অঞ্জনা দাস নামের এক নারী জানায়, ধান থেকে চাউল তৈরি এবং মুড়ি ভাজা পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি একটি জটিল কাজ। সে কারণে অনেকে এখন পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।

 

উৎপাদনকারীরা জানান, হাতে ভাজা মুড়িতে লবণ পানি ছাড়া অন্য কোন পদার্থ দেয়া যায় না, লাড়কী ছাড়া গ্যাসের আগুনেও এ মুড়ি ভাজা যায় না। বাজারে পাওয়া কোন চাউলেও এ মুড়ি তৈরি করা যায় না।

 

উৎপাদনকারীরা জানান, মুড়ি ভাজার লোকেদের প্রধান সমস্যা পূজিঁর অভাবে বছরের শুরুতে ধান মজুদ করতে না পারা। সেজন্য এ কুটির শিল্প বেঁচে রাখতে তারা আড়তদার এবং এনজিও ঋণে আবদ্ধ থাকে। স্বল্প সুদে কোন ব্যাংক থেকে ঋণ পায় না তারা।

 

অন্য দিকে বৃষ্টির সময় মুড়ির ধান শুকাতে তাদের বড় কষ্ট। বৃষ্টির সময় মুড়ির ধান শুকাতে জন্য সরকারি সহায়তায় এয়ার ড্রাইয়ার পেতে চেয়েছেন, উৎপাদনকারীরা।

কলেজ শিক্ষক মোঃ আক্তার হোসেন জানান, রমজানের ইফতারী মুড়ি ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। মেশিনের তৈরি মুড়ির চাউল মেশিনে তৈরি করা হয়। ভাজার সময় বিষাক্ত হাইড্রোজ এবং ইউরিয়া সার মিশ্রিত করা হয়। কিন্ত হাতে ভাজা মুড়িতে সে রকম কিছু মেশানো সম্ভব হয় না। সে কারণে গিগজ মুড়ি শতভাগ নিরাপদ এবং ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের প্রতীক। শীতের মোলা এবং বাসাবাড়ি ও অফিস আদালতে সকাল-সন্ধ্যার কমন নাস্তা ছোলা মুড়ি খুবই জনপ্রিয় একটি খাদ্য।

 

হাতে ভাজা মুড়ি ব্যবসায়ীদের আর্থিক সংকট নিয়ে কথা হয়, সোনালী ব্যাংক লক্ষ্মীপুরের প্রধান শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার (ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার) মোঃ শামছুল ইসলামের সাথে । তিনি জানান-হাতে ভাজা গিগজ মুড়ি একটি ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প। সোনালী ব্যাংক থেকে কুটির শিল্পে ঋণ নিতে হলে ট্রেড লাইসেন্স প্রয়োজন। কিন্ত মুড়ি উৎপাদনকারীরা ট্রেড লাইসেন্স না দিতে পারলে তাদেরকে সহযোগিতা করা সম্ভব না।

 

কিন্ত ইসলামী ব্যাংক লক্ষ্মীপুর জেলা শাখার ম্যানেজার মোঃ সানা উল্লাহ জানান,ঐতিহ্যবাহী গিগজ মুড়ি শিল্পকে রক্ষার জন্য ইসলামী ব্যাংক সহজ শর্তে পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যেমে ৩০ হাজার থেকে ৩ লাখ টাকা ঋণ দিতে পারে।

 

অন্যদিকে সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের প্রধান তথ্যকর্মকর্তা ফয়সল হাসান জানান,তিনি নিজেও লক্ষ্মীপুর ব্র্যান্ডের ঐতিহ্যবাহী হাতে ভাজা গিগজ মুড়ির এক নিয়মিত ক্রেতা। ঐতিহ্যবাহী গিগজ মুড়িকে বাঁচিয়ে রাখতে কৃষক পর্যায়ে গিগজ ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যাংক ঋণসহ প্রয়োজনীয় সহায়তা নিয়ে এ সম্প্রদায়ের পাশে থাকার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগে জানাবেন বলেও জানান তিনি।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com