রাত্রিকালীন গণপরিবহনে ডাকাত আতঙ্ক, ঘটছে হত্যাকাণ্ড

২২শে জানুয়ারি ভোর। ঢাকার সাদ্দাম মার্কেট এলাকা থেকে কুতুবখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে মহির উদ্দিন (৫০) নামের এক মাছ ব্যবসায়ী একটি লেগুনায় উঠেন। ওই লেগুনায় চালক, তার সহকারী ছাড়া আরও দু’জন যাত্রী ছিলেন। কিন্তু লেগুনা চালক তাকে কুতুবখালী নামিয়ে না দিয়ে দ্রুত লেগুনা চালিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠে যান। ফ্লাইওভারে ওঠার পর যাত্রী সেজে বসে থাকা ওই দু’জন ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে মহির উদ্দিনের কাছ থেকে ৫ হাজার ৯০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে চলন্ত লেগুনা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মাথায় আঘাত পেয়ে মহির মারা যান। সকালে পথচারীরা মহিরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। খবর পেয়ে পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।

মহিরের ছেলে মর্গে গিয়ে বাবার পরিচয় শনাক্ত করে। অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছে ধারণা করে পুলিশ ওই ধারায় মামলা নেয়। ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক চিকিৎসক তথ্য দেন মহিরের মাথার খুলি ভাঙা। এটি হত্যাকাণ্ড হতে পারে। এরপরই নতুন করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক বিল্লাল আল আজাদ ঘাতক ওই লেগুনা শনাক্তের জন্য নিজেই একটি লেগুনার চালকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন কাজ করে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ঘাতক চারজনকে গ্রেপ্তার করেন। যারা মধ্যরাত থেকে লেগুনা নিয়ে শহরে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করতো। ওইদিন রাতে এই চক্রটি আরও কয়েকজন যাত্রীর কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সবকিছু লুটে নিয়েছে।

 

সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে দেখা দিয়েছে ডাকাত আতঙ্ক। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে দেশের কোথাও না কোথাও গণপরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বাস-লেগুনা ভাড়া করে ডাকাতি করছে সংঘবদ্ধ ডাকাতরা। কোনো কোনো গণপরিবহনে যাত্রীবেশে অবস্থান নিয়ে ডাকাতরা অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ যাত্রীদের ওপর হানা দিচ্ছে। আবার কোথাও ডাকাত দলের সদস্যরা বাস-লেগুনা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে যাত্রী উঠিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছে। চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেয়ার জন্য অনেকেই মৃত্যুবরণ করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রাত হলেই এই ডাকাতরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে ডাকাতিতে নামে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাতরা জেল থেকে জামিনে বের হয়ে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। একবার জেল খাটার পর তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দু’দিনের ব্যবধানে শুধুমাত্র ঢাকা থেকেই তিনটি চক্রের ২২ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছেন। পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব, হাইওয়ে পুলিশ সড়ক মহাসড়কে চলাচলরত গণপরিবহনে ডাকাত আতঙ্ক নিয়ে কাজ করছে। এই সংস্থাগুলো তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি টহল টিম বাড়িয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) হেড কোয়ার্টার্স সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী বছরে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ডাকাতির মামলা হয়েছে মোট ২৩টি। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩টি, মার্চ মাসে ৩টি, এপ্রিল মাসে ১টি, মে মাসে ৪টি, জুন মাসে ৪টি, জুলাই মাসে ১টি, আগস্ট মাসে ১টি, সেপ্টেম্বরে ১টি, অক্টোবরে ৪টি, নভেম্বরে ১টি। ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বর মাসে কোনো ডাকাতির মামলা হয়নি। গত সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ডাকাত দলের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। লালবাগের অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ফজলুর রহমান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি ডাকাতরা বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গণপরিবহনে, মার্কেট এলাকায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জনসমাগম স্থলে ডাকাতি করতো। তাদের আয়ের কোনো বৈধ উৎস না থাকলেও ঢাকা শহরে তারা বিলাসী জীবনযাপন করে। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।

 

হানিফ ফ্লাইওভারের ঘটনার দু’দিন আগে ২০শে জানুয়ারি টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শফিকুল ইসলাম টাঙ্গাইল যাবার উদ্দেশে ঢাকা থেকে আরকেআর পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। এ সময় সঙ্গে তার একজন বন্ধুও ছিলেন। তারা উত্তরা পশ্চিম থানার আব্দুল্লাহপুর পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাই নবাবগঞ্জগামী ওই বাসে ওঠেন। বাসে ওঠা মাত্রই ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে দুই হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। নির্যাতন করে চিকিৎসকের সঙ্গে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন, বিকাশে থাকা টাকা, এটিএম কার্ড দিয়ে ব্যাংকে থাকা টাকা নিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যায়। এ ঘটনায় ডিবি তেজগাঁও বিভাগ একটি ডাকাত চক্রের ৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি আরেকটি ডাকাত চক্রের আরও ৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।

২০২০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর রাতে বাসা থেকে কাওরান বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে কাওলা ফুটওভার ব্রিজের ঢাকাগামী মহাসড়কে এসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন সবজি বিক্রেতা আপন মিয়া ও নজরুল ইসলাম। এ সময় একটি পিকআপ ভ্যানের চালক ও সহকারী কাওরান বাজার বলে ডেকে ডেকে যাত্রী উঠাচ্ছিল। রাতের বেলা গণপরিবহন না থাকায় নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা কম খরচে এভাবেই বিভিন্ন গন্তব্যে যান। আপন মিয়া ও নজরুল মিয়াও ওই পিকআপে ওঠেন। পিকআপে আগে থেকেই আরও কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। তারা দু’জন পিকআপ ভ্যানের পেছনের অংশে ওঠা মাত্রই যাত্রা শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর পিকআপের পিছনে আগে থেকে বসে থাকা দু’জন যাত্রী তাদের বুকে চাকু ধরে এবং মুহূর্তের মধ্যে পিকআপের সামনে সিটে বসে থাকা সজল পিছনে চলে আসে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় এবং আপন মিয়াকে ধাক্কা মারে পিকআপ থেকে ফেলে দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর আপনের সঙ্গী নজরুলকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। নজরুল প্রাণে বাঁচলেও আপন মিয়া রাস্তায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ এ ঘটনায় ওই সময় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। যারা সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের সদস্য ছিল। তারা সপ্তাহে ৪-৫ দিন ডাকাতির জন্য বের হতো এবং একদিনে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটাতো। ডাকাতি করাই তাদের পেশা। মধ্যরাতে পিকআপ ভ্যানে যাত্রীদের তুলে ডাকাতি করে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিতো।

বিদায়ী বছরের ৩১শে আগস্ট রাত ৮টায় হানিফ পরিবহনের একটি বাস ঢাকার গাবতলী থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ওই বাসে সাভারের নবীনগর থেকে ডাকাত দলের ৬ সদস্য ওঠেন। রাত আড়াইটার দিকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর বিটিসি মোড়ে চালককে ছুরিকাঘাত করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাতরা। ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন বাসের চালক  মনজুর হোসেন। ডাকাতরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের কাছে থাকা মূল্যবান সবকিছু লুটে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় জড়িত ৬ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার কেএম হাফিজ আক্তার সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, টাঙ্গাইলের চিকিৎসক যে চক্রের কাছে ডাকাতির শিকার হয়েছেন তারা প্রথমে বাস ভাড়া করে। তারপর টার্গেট করে যাত্রী উঠিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-মুখ বেঁধে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নির্জন স্থানে নামিয়ে দেয়। চক্রটি ঢাকার সাভার, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে একইভাবে ডাকাতি করে। তাদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ডাকাতির শিকার হলে অবশ্যই ভুক্তভোগীকে মামলা করতে হবে। বাসে ডাকাতির শিকার হলে বাসটি যে এলাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করবে এবং বাসটিযে এলাকায় যাত্রা শেষ করবে সেসব এলাকার যেকোনো থানায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কেএম আজাদ  বলেন, গণপরিবহনে ডাকাতির ঘটনায় মাঠ পর্যায়ে র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ঘটনা ঘটার পর আমরা বিষয়টিকে খুব জোরালোভাবে দেখছি। যারা এ ধরনের ঘটনায় জড়িত তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। যাতে করে এমন ঘটনা আর না ঘটে। তিনি বলেন, কিছু চক্রকে যদি গ্রেপ্তার করা যায় তবে আর কেউ ডাকাতি করার সাহস পাবে না। এজন্য আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ফেরত যাবে মিয়ানমারের ২৮৫ সেনা, ফিরবে ১৫০ বাংলাদেশি

» ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী তিন যুবক নিহত

» কৃষক লীগকে শহরে আটকে না রেখে গ্রামে নিয়ে যাওয়া ভালো: কাদের

» গণভবনের শাক-সবজি কৃষক লীগ নেতাদের উপহার দিলেন শেখ হাসিনা

» হাওরে কৃষকদের বোরো ধানের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ করা হবে: কৃষিমন্ত্রী

» বাসচাপায় সিএনজি যাত্রী নিহত

» ‌‌‘বিনা কারণে কারাগার এখন বিএনপি নেতাকর্মীদের স্থায়ী ঠিকানা’

» রাজধানীর শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে

» বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা রাজনৈতিক নয়: প্রধানমন্ত্রী

» রাজধানীর শিশু হাসপাতালের ভবনে আগুন

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

রাত্রিকালীন গণপরিবহনে ডাকাত আতঙ্ক, ঘটছে হত্যাকাণ্ড

২২শে জানুয়ারি ভোর। ঢাকার সাদ্দাম মার্কেট এলাকা থেকে কুতুবখালী যাওয়ার উদ্দেশ্যে মহির উদ্দিন (৫০) নামের এক মাছ ব্যবসায়ী একটি লেগুনায় উঠেন। ওই লেগুনায় চালক, তার সহকারী ছাড়া আরও দু’জন যাত্রী ছিলেন। কিন্তু লেগুনা চালক তাকে কুতুবখালী নামিয়ে না দিয়ে দ্রুত লেগুনা চালিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে উঠে যান। ফ্লাইওভারে ওঠার পর যাত্রী সেজে বসে থাকা ওই দু’জন ধারালো অস্ত্র ঠেকিয়ে মহির উদ্দিনের কাছ থেকে ৫ হাজার ৯০০ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাকে চলন্ত লেগুনা থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। মাথায় আঘাত পেয়ে মহির মারা যান। সকালে পথচারীরা মহিরকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠায়। খবর পেয়ে পুলিশ তার মরদেহ উদ্ধার করে।

মহিরের ছেলে মর্গে গিয়ে বাবার পরিচয় শনাক্ত করে। অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েছে ধারণা করে পুলিশ ওই ধারায় মামলা নেয়। ময়নাতদন্ত শেষে ফরেনসিক চিকিৎসক তথ্য দেন মহিরের মাথার খুলি ভাঙা। এটি হত্যাকাণ্ড হতে পারে। এরপরই নতুন করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যাত্রাবাড়ী থানার উপ-পরিদর্শক বিল্লাল আল আজাদ ঘাতক ওই লেগুনা শনাক্তের জন্য নিজেই একটি লেগুনার চালকের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন কাজ করে তিনি এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ঘাতক চারজনকে গ্রেপ্তার করেন। যারা মধ্যরাত থেকে লেগুনা নিয়ে শহরে ঘুরে ঘুরে ডাকাতি করতো। ওইদিন রাতে এই চক্রটি আরও কয়েকজন যাত্রীর কাছ থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সবকিছু লুটে নিয়েছে।

 

সাম্প্রতিক সময়ে গণপরিবহনে দেখা দিয়েছে ডাকাত আতঙ্ক। প্রায়ই শোনা যাচ্ছে দেশের কোথাও না কোথাও গণপরিবহনে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। বাস-লেগুনা ভাড়া করে ডাকাতি করছে সংঘবদ্ধ ডাকাতরা। কোনো কোনো গণপরিবহনে যাত্রীবেশে অবস্থান নিয়ে ডাকাতরা অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে সাধারণ যাত্রীদের ওপর হানা দিচ্ছে। আবার কোথাও ডাকাত দলের সদস্যরা বাস-লেগুনা নিয়ে পরিকল্পিতভাবে যাত্রী উঠিয়ে সর্বস্ব লুটে নিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিচ্ছে। চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দেয়ার জন্য অনেকেই মৃত্যুবরণ করছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রাত হলেই এই ডাকাতরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। দেশি-বিদেশি অস্ত্র নিয়ে ডাকাতিতে নামে। বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হওয়া ডাকাতরা জেল থেকে জামিনে বের হয়ে নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করছে। একবার জেল খাটার পর তারা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ দু’দিনের ব্যবধানে শুধুমাত্র ঢাকা থেকেই তিনটি চক্রের ২২ জন ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছেন। পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, র‌্যাব, হাইওয়ে পুলিশ সড়ক মহাসড়কে চলাচলরত গণপরিবহনে ডাকাত আতঙ্ক নিয়ে কাজ করছে। এই সংস্থাগুলো তাদের গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি টহল টিম বাড়িয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) হেড কোয়ার্টার্স সূত্রে জানা গেছে, বিদায়ী বছরে ডিএমপির বিভিন্ন থানায় ডাকাতির মামলা হয়েছে মোট ২৩টি। এরমধ্যে জানুয়ারি মাসে ৩টি, মার্চ মাসে ৩টি, এপ্রিল মাসে ১টি, মে মাসে ৪টি, জুন মাসে ৪টি, জুলাই মাসে ১টি, আগস্ট মাসে ১টি, সেপ্টেম্বরে ১টি, অক্টোবরে ৪টি, নভেম্বরে ১টি। ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বর মাসে কোনো ডাকাতির মামলা হয়নি। গত সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানা এলাকায় ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ডাকাত দলের ৬ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগ। লালবাগের অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিমের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. ফজলুর রহমান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পেরেছি ডাকাতরা বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে গণপরিবহনে, মার্কেট এলাকায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের জনসমাগম স্থলে ডাকাতি করতো। তাদের আয়ের কোনো বৈধ উৎস না থাকলেও ঢাকা শহরে তারা বিলাসী জীবনযাপন করে। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় তাদের বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়েছে।

 

হানিফ ফ্লাইওভারের ঘটনার দু’দিন আগে ২০শে জানুয়ারি টাঙ্গাইলের ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) শফিকুল ইসলাম টাঙ্গাইল যাবার উদ্দেশে ঢাকা থেকে আরকেআর পরিবহনের একটি বাসে ওঠেন। এ সময় সঙ্গে তার একজন বন্ধুও ছিলেন। তারা উত্তরা পশ্চিম থানার আব্দুল্লাহপুর পেট্রোল পাম্পের সামনে থেকে ঢাকা-রাজশাহী-চাঁপাই নবাবগঞ্জগামী ওই বাসে ওঠেন। বাসে ওঠা মাত্রই ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাকে দুই হাত ও চোখ বেঁধে ফেলে। নির্যাতন করে চিকিৎসকের সঙ্গে নগদ টাকা, মোবাইল ফোন, বিকাশে থাকা টাকা, এটিএম কার্ড দিয়ে ব্যাংকে থাকা টাকা নিয়ে তাকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে যায়। এ ঘটনায় ডিবি তেজগাঁও বিভাগ একটি ডাকাত চক্রের ৮ জন সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে। পাশাপাশি আরেকটি ডাকাত চক্রের আরও ৮ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে।

২০২০ সালের ২৮শে ডিসেম্বর রাতে বাসা থেকে কাওরান বাজারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে কাওলা ফুটওভার ব্রিজের ঢাকাগামী মহাসড়কে এসে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিলেন সবজি বিক্রেতা আপন মিয়া ও নজরুল ইসলাম। এ সময় একটি পিকআপ ভ্যানের চালক ও সহকারী কাওরান বাজার বলে ডেকে ডেকে যাত্রী উঠাচ্ছিল। রাতের বেলা গণপরিবহন না থাকায় নিম্ন শ্রেণির মানুষেরা কম খরচে এভাবেই বিভিন্ন গন্তব্যে যান। আপন মিয়া ও নজরুল মিয়াও ওই পিকআপে ওঠেন। পিকআপে আগে থেকেই আরও কয়েকজন যাত্রী ছিলেন। তারা দু’জন পিকআপ ভ্যানের পেছনের অংশে ওঠা মাত্রই যাত্রা শুরু করে। কিছুদূর যাওয়ার পর পিকআপের পিছনে আগে থেকে বসে থাকা দু’জন যাত্রী তাদের বুকে চাকু ধরে এবং মুহূর্তের মধ্যে পিকআপের সামনে সিটে বসে থাকা সজল পিছনে চলে আসে। ভয়-ভীতি দেখিয়ে তাদের কাছে থাকা টাকা ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয় এবং আপন মিয়াকে ধাক্কা মারে পিকআপ থেকে ফেলে দেয়। কিছুদূর যাওয়ার পর আপনের সঙ্গী নজরুলকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। নজরুল প্রাণে বাঁচলেও আপন মিয়া রাস্তায় আঘাত পেয়ে মৃত্যুবরণ করেন। গোয়েন্দা পুলিশের গুলশান বিভাগ এ ঘটনায় ওই সময় চারজনকে গ্রেপ্তার করেছিল। যারা সংঘবদ্ধ ডাকাত চক্রের সদস্য ছিল। তারা সপ্তাহে ৪-৫ দিন ডাকাতির জন্য বের হতো এবং একদিনে একাধিক ডাকাতির ঘটনা ঘটাতো। ডাকাতি করাই তাদের পেশা। মধ্যরাতে পিকআপ ভ্যানে যাত্রীদের তুলে ডাকাতি করে চলন্ত গাড়ি থেকে ফেলে দিতো।

বিদায়ী বছরের ৩১শে আগস্ট রাত ৮টায় হানিফ পরিবহনের একটি বাস ঢাকার গাবতলী থেকে পঞ্চগড়ের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ওই বাসে সাভারের নবীনগর থেকে ডাকাত দলের ৬ সদস্য ওঠেন। রাত আড়াইটার দিকে গাইবান্ধার পলাশবাড়ীর বিটিসি মোড়ে চালককে ছুরিকাঘাত করে বাসের নিয়ন্ত্রণ নেয় ডাকাতরা। ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন বাসের চালক  মনজুর হোসেন। ডাকাতরা নিয়ন্ত্রণ নিয়ে যাত্রীদের কাছে থাকা মূল্যবান সবকিছু লুটে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় জড়িত ৬ ডাকাতকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার কেএম হাফিজ আক্তার সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, টাঙ্গাইলের চিকিৎসক যে চক্রের কাছে ডাকাতির শিকার হয়েছেন তারা প্রথমে বাস ভাড়া করে। তারপর টার্গেট করে যাত্রী উঠিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হাত-মুখ বেঁধে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে তাদের নির্জন স্থানে নামিয়ে দেয়। চক্রটি ঢাকার সাভার, টাঙ্গাইল ও গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে একইভাবে ডাকাতি করে। তাদের নামে দেশের বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। ডাকাতির শিকার হলে অবশ্যই ভুক্তভোগীকে মামলা করতে হবে। বাসে ডাকাতির শিকার হলে বাসটি যে এলাকা দিয়ে যাত্রা শুরু করবে এবং বাসটিযে এলাকায় যাত্রা শেষ করবে সেসব এলাকার যেকোনো থানায় ভুক্তভোগীরা মামলা করতে পারবেন।

র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র‌্যাব) অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কেএম আজাদ  বলেন, গণপরিবহনে ডাকাতির ঘটনায় মাঠ পর্যায়ে র‌্যাবের বিভিন্ন ইউনিট কাজ করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু ঘটনা ঘটার পর আমরা বিষয়টিকে খুব জোরালোভাবে দেখছি। যারা এ ধরনের ঘটনায় জড়িত তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা হবে। যাতে করে এমন ঘটনা আর না ঘটে। তিনি বলেন, কিছু চক্রকে যদি গ্রেপ্তার করা যায় তবে আর কেউ ডাকাতি করার সাহস পাবে না। এজন্য আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com