মজুদদারি মহাপাপ

মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানি:জনকল্যাণ ও পরম মানবতার ধর্ম ইসলাম। এ ধর্মে দুর্নীতি নেই, শোষণ-নিপীড়ন নেই। নেই ধোঁকা-প্রতারণা, কাউকে মেরে খাওয়ার জঘন্য প্রবণতা। সাম্প্রতিক-কালে ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে এক ধরনের অসাধু কালোবাজারির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ব্যবসার নামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তাদের রয়েছে এসব অনৈতিক কাজের জন্য বহুমুখী ফাঁদ ও বিশাল সিন্ডিকেট। মজুদদারি সিন্ডিকেট হলো গরিব-অসহায়দের তিলে তিলে পিষে পুঁজিপতিদের সম্পদ কুক্ষিগত করার অপকৌশল।

 

বর্তমানকালের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ভয়ংকর এক রূপ মজুদদারি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ক্রেতাদের মধ্যে হাহাকার বিরাজ করে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ ও হতাশা। এর অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংসের বীজ বহন করে। ব্যবসা ও শিল্পের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্র ও জীবন-জীবিকার দ্বারগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ইসলাম এ ধরনের অর্থনৈতিক সব অপকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অবৈধ করেছে মজুদদারি সিন্ডিকেটের আড়ালে থাকা সব ধরনের প্রতারণা ও লোভ-লালসা।

 

মহান প্রভু কোরআনে কারিমে ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি সেখানে (মক্কায়) অন্যায়ভাবে কোনো ধর্মদ্রোহী কাজ (মজুদদারি) করতে চাইবে আমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাব।’ (সুরা হজ, আয়াত ২৫) এ আয়াতে ধর্মদ্রোহী কাজ বলে এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজুদদারি ব্যবসা বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির) মহানবী (সা.) একাধিক হাদিসে মজুদদারি ব্যবসা থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘পাপিষ্ঠ ছাড়া কেউ মজুদদারি করতে পারে না।’ (মুসলিম)

 

অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের সমাজে মজুদদারি সিন্ডিকেটে জড়িত হবে আল্লাহ তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ, আহমদ) অন্য এক হাদিসে তিনি ফরমান, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (আহমদ) কোরআন-সুন্নাহর আলোকে মজুদদারি সিন্ডিকেট সম্পূর্ণ অবৈধ এবং জঘন্য অপরাধ। হানাফি মাজহাবে তা মাকরুহে তাহরিমি বা হারাম সমতুল্য।

 

অন্য সব মাজহাবে মজুদদারি ব্যবসা একটি হারাম কাজ হিসেবে গণ্য হয়। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা খুবই ন্যক্কারজনক প্রতারণা ও অমানবিকতার পরিচায়ক। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম) খলিফা ওমর (রা.) অত্যন্ত কঠোর হাতে মজুদদারি প্রবণতাকে দমন করতেন।

 

ইসলামী শরিয়তের আলোকে নিজের উৎপাদিত পণ্য তার ইচ্ছামতো সময়ে বিক্রি করার অধিকার রাখে। নিজেদের ব্যবহারের প্রয়োজনে এক বছরের খাদ্যসামগ্রী মজুদ করারও অনুমতি আছে। মজুদের কারণে বাজারমূল্যে যদি কোনো প্রভাব না পড়ে অথবা এর কারণে মানুষের কোনো ক্ষতি না হয় বা এসব জিনিসের প্রতি মানুষের চাহিদা না থাকে, এ অবস্থায় মজুদ করার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

 

এছাড়া ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বা অসুবিধার কারণে অনূর্ধ্ব ৪০ দিন পর্যন্ত ব্যবসায়িক পণ্য গুদামজাত থাকতে পারে। অনুরূপভাবে দেশের প্রয়োজনে ও জনগণের স্বার্থে সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা খাদ্যপণ্য মজুদ করতে পারবেন। তবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা অর্জনের লালসায় মজুদদারি কোনো অবস্থাতেই বৈধ হবে না। বরং তা মহাপাপ ও মারাত্মক অপরাধমূলক অপকর্ম হিসেবে গণ্য হবে।

 

চলমান বিশ্বে বাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মজুদদারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন এ কঠিন অবস্থায় ধোঁকা-প্রতারণা পরিহার করে ইসলামী আদর্শে বৈধ ব্যবসার প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়া। আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দিন।

 

লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।

সূত্র:বিডি প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ঘূর্ণিঝড়ে আলফাডাঙ্গার ২২ গ্রাম বিধ্বস্ত

» প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা আগামীকাল

» আইপিইউর এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপের চেয়ারম্যান হলেন স্পিকার

» এক শহরের মধ্যে দুই দেশ

» ইফতারের সময় হয়েছে ভেবে খেলে রোজা শুদ্ধ হবে?

» মশার কামড়ে গায়ে চাকা চাকা দাগ হলে কী করবেন?

» মাটিভর্তি ট্রাকের ধাক্কায় অটোভ্যান দুমড়ে-মুচড়ে চালক নিহত

» ২ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে বুলডোজার দিয়ে বালুচাপা দিলো ইসরায়েল

» বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিয়েছিল: ওবায়দুল কাদের

» চেক প্রতারণার মামলা ইভ্যালির রাসেল-শামিমার বিচার শুরু, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

মজুদদারি মহাপাপ

মুফতি রফিকুল ইসলাম আল মাদানি:জনকল্যাণ ও পরম মানবতার ধর্ম ইসলাম। এ ধর্মে দুর্নীতি নেই, শোষণ-নিপীড়ন নেই। নেই ধোঁকা-প্রতারণা, কাউকে মেরে খাওয়ার জঘন্য প্রবণতা। সাম্প্রতিক-কালে ব্যবসা-বাণিজ্যের আড়ালে এক ধরনের অসাধু কালোবাজারির অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ব্যবসার নামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মজুদ করে তারা বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। তাদের রয়েছে এসব অনৈতিক কাজের জন্য বহুমুখী ফাঁদ ও বিশাল সিন্ডিকেট। মজুদদারি সিন্ডিকেট হলো গরিব-অসহায়দের তিলে তিলে পিষে পুঁজিপতিদের সম্পদ কুক্ষিগত করার অপকৌশল।

 

বর্তমানকালের অর্থনৈতিক দুর্নীতির ভয়ংকর এক রূপ মজুদদারি সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের কারণে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পায়। ক্রেতাদের মধ্যে হাহাকার বিরাজ করে। সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। জনজীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ ও হতাশা। এর অভ্যন্তরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংসের বীজ বহন করে। ব্যবসা ও শিল্পের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়। সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্র ও জীবন-জীবিকার দ্বারগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ইসলাম এ ধরনের অর্থনৈতিক সব অপকর্ম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। অবৈধ করেছে মজুদদারি সিন্ডিকেটের আড়ালে থাকা সব ধরনের প্রতারণা ও লোভ-লালসা।

 

মহান প্রভু কোরআনে কারিমে ঘোষণা করেন, ‘যে ব্যক্তি সেখানে (মক্কায়) অন্যায়ভাবে কোনো ধর্মদ্রোহী কাজ (মজুদদারি) করতে চাইবে আমি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আস্বাদন করাব।’ (সুরা হজ, আয়াত ২৫) এ আয়াতে ধর্মদ্রোহী কাজ বলে এক ব্যাখ্যা অনুযায়ী মজুদদারি ব্যবসা বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির) মহানবী (সা.) একাধিক হাদিসে মজুদদারি ব্যবসা থেকে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেন, ‘পাপিষ্ঠ ছাড়া কেউ মজুদদারি করতে পারে না।’ (মুসলিম)

 

অন্য হাদিসে তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের সমাজে মজুদদারি সিন্ডিকেটে জড়িত হবে আল্লাহ তার ওপর মহামারি ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।’ (ইবনে মাজাহ, আহমদ) অন্য এক হাদিসে তিনি ফরমান, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিন পর্যন্ত খাদ্যশস্য মজুদ রাখে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে বেরিয়ে যায়।’ (আহমদ) কোরআন-সুন্নাহর আলোকে মজুদদারি সিন্ডিকেট সম্পূর্ণ অবৈধ এবং জঘন্য অপরাধ। হানাফি মাজহাবে তা মাকরুহে তাহরিমি বা হারাম সমতুল্য।

 

অন্য সব মাজহাবে মজুদদারি ব্যবসা একটি হারাম কাজ হিসেবে গণ্য হয়। সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটা খুবই ন্যক্কারজনক প্রতারণা ও অমানবিকতার পরিচায়ক। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয় সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়।’ (মুসলিম) খলিফা ওমর (রা.) অত্যন্ত কঠোর হাতে মজুদদারি প্রবণতাকে দমন করতেন।

 

ইসলামী শরিয়তের আলোকে নিজের উৎপাদিত পণ্য তার ইচ্ছামতো সময়ে বিক্রি করার অধিকার রাখে। নিজেদের ব্যবহারের প্রয়োজনে এক বছরের খাদ্যসামগ্রী মজুদ করারও অনুমতি আছে। মজুদের কারণে বাজারমূল্যে যদি কোনো প্রভাব না পড়ে অথবা এর কারণে মানুষের কোনো ক্ষতি না হয় বা এসব জিনিসের প্রতি মানুষের চাহিদা না থাকে, এ অবস্থায় মজুদ করার ক্ষেত্রে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।

 

এছাড়া ব্যবসায়িক প্রয়োজনে বা অসুবিধার কারণে অনূর্ধ্ব ৪০ দিন পর্যন্ত ব্যবসায়িক পণ্য গুদামজাত থাকতে পারে। অনুরূপভাবে দেশের প্রয়োজনে ও জনগণের স্বার্থে সরকার অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা খাদ্যপণ্য মজুদ করতে পারবেন। তবে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মুনাফা অর্জনের লালসায় মজুদদারি কোনো অবস্থাতেই বৈধ হবে না। বরং তা মহাপাপ ও মারাত্মক অপরাধমূলক অপকর্ম হিসেবে গণ্য হবে।

 

চলমান বিশ্বে বাজারের অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে মজুদদারি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা খুব প্রয়োজন। প্রয়োজন এ কঠিন অবস্থায় ধোঁকা-প্রতারণা পরিহার করে ইসলামী আদর্শে বৈধ ব্যবসার প্রতি অনুপ্রাণিত হওয়া। আল্লাহ সবাইকে তৌফিক দিন।

 

লেখক : গবেষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা, ঢাকা।

সূত্র:বিডি প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com