পূর্ব-পশ্চিমের মিলন অসম্ভব

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) :ইংরেজ কবি রুডিয়ার্ড কিপলিং ১৮৮৯ সালে একটা অসাধারণ সাড়া জাগানিয়া কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির নাম- ‘ব্যালাড অব ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’। কবিতার প্রথম দুটি লাইন, ‘ইস্ট ইজ ইস্ট, অ্যান্ড ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট অ্যান্ড নেভার দ্য টোয়েন শ্যাল মিট’। পূর্ব-পশ্চিম সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, দুয়ের মিলন কখনো হবে না। মিলন না হলেও দুই পক্ষই যদি সমান গৌরব ও বীরত্বের অধিকারী হয়, তাহলে সহাবস্থান সম্ভব, এটাই কবিতার মর্মার্থ।  রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কবিতার মতোই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত জাতীয় ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারার মিলন বিগত ৪৭ বছরে কখনো হয়নি। সব সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ৪৭ বছর ধরে সমান্তরালভাবে দুই বিপরীতমুখী রাজনীতি বাংলাদেশে চললেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাতাবরণ কখনো তৈরি হয়নি। রুডিয়ার্ড কিপলিং কবিতায় বলেছেন, বিপরীতমুখী হলেও দুই পক্ষ যদি সমান গৌরব ও বীরত্বের অধিকারী হয় তাহলে মিলন না হলেও সহাবস্থান সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির বেলায় গৌরব ও বীরত্বে দুই বড় পক্ষের ব্যবধান এতই বেশি যে, একটি পক্ষ হীনতা ও হিংসাত্মক পথ বেছে নেওয়া ছাড়া অন্য ইতিবাচক কোনো পথ ও পন্থা বের করতে সক্ষম হয়নি। প্রথমে বিএনপির কথা বলি। দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের নামেই বিএনপি এখনো রাজনীতি করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পথ ধরেই জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আরোহণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে পদার্পণ। এক সময়ে তিনি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও হিংসা ও ভায়োলেন্সের রাজনীতিকে বন্ধ করার কোনো চেষ্টা করেননি, বরং তার বহু কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে হিংসা এবং ভায়োলেন্সের রাজনীতি আরও প্রসারিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। জিয়াউর রহমান খুবই বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক একাত্তরের পরাজিত দেশি ও বিদেশি গোষ্ঠী এবং তিনি নিজেও হয়তো জানতেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আর আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে এবং তাতে তিনিও ফেঁসে যাবেন; একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে পাকিস্তানি স্টাইলের রাষ্ট্র বানানো কখনো সম্ভব হবে না। সুতরাং তাকে হিংসাত্মক রাজনীতির পথই বেছে নিতে হয়েছে। কথায় আছে কারও সাহায্য নিয়ে ঘোড়ায় চড়া যায়, কিন্তু ঘোড়ার পীঠ থেকে নিজের ইচ্ছায় নামা যায় না, উভয় সংকট। ঘোড়াকে পোষ মানানো যায় না, বরং সুযোগ পেলেই ঘোড়া সোয়ারীকে ফেলে দিয়ে পদপিষ্ট করে। জিয়াউর রহমানের ভাগ্যে সেটাই ঘটেছে, যা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হিংসাত্মক ঘটনা। হিংসা আরও হিংসার জন্ম দেয়। ক্ষমতার মোহ বড়ই অন্ধ। মানুষ চিরন্তন সত্যকে উপেক্ষা করে, ভুলে যায়। জিয়াউর রহমান সেই পথেই হেঁটেছেন। আত্মস্বীকৃত, স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যাতে বিচার না হয় তার জন্য মীর জাফর মোশতাকের দায়মুক্তি আইনকে তিনি রাষ্ট্রের পবিত্র দলিল সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের দূতাবাসে খুনিদের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। তাহলে কী ঘটল। হিংসাত্মক রাজনীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এবং খুনি অপরাধীদের উৎসাহিত করার এর চেয়ে বড় ঘটনা আর কী হতে পারে। কোনো অজুহাতেই হত্যাকারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে, আইন করে দায়মুক্তি দেওয়ার নজির মানব সভ্যতার ইতিহাসে নেই। আইনের ফাঁকফোকর এবং আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কিছু হয়, সেটি অন্য কথা। অনেক হত্যার বিচার হয় না, হয়নি। এ রকম ঘটনা সব সরকারের সময়ই ঘটেছে, যা অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে, আইন করে হত্যাকারীকে রেহাই শুধু নয়, তাদের পুরস্কৃত করার ঘটনা নজিরবিহীন। জিয়াউর রহমানের বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি নতুন গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন। গণতন্ত্রের আগে বহুদলীয় কথাটি জুড়ে দিলেন, যেমন আইয়ুব খান গণতন্ত্রের আগে জুড়ে দিয়েছিলেন মৌলিক শব্দটি। গণতন্ত্র, গণতন্ত্রই। এর কোনো প্রিফিক্স ও সাফিক্স হয় না, কোথাও নেই। গণতন্ত্রের সূতিকাগার পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশে বহু দল ছিল এবং এখনো আছে। কোথাও বহুদলীয় কথাটির প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশে এটা প্রয়োজন হলো কেন। আইয়ুব খান কেন মৌলিক শব্দটি গণতন্ত্রের আগে জুড়ে দিয়েছিলেন সেটি বাঙালি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বহুদলীয় শব্দটি জুড়ে দেওয়ার অন্তর্নিহিত গোপন লক্ষ্য ছিল, একাত্তরের পরাজিত ও বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে নিষিদ্ধ জামায়াত ও মুসলিম লীগের রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটানো সেটা ঘটেছে। জামায়াত মুসলিম লীগ একাত্তরের স্বঘোষিত ঘাতক, গণহত্যাকারী ও ধর্ষণকারী। তাদের রাজনৈতিক পুনরুত্থানের সুযোগ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে হিংসাত্মক রাজনীতিকে উৎসাহিত করার চরম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা। সুতরাং জামায়াত-মুসলিম লীগের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে হিংসা ও হত্যার রাজনীতির পথ আরও প্রসারিত হয়। অনেকে বলেন, সে সময়ে বহুদলীয় রাজনীতির ফলে আওয়ামী লীগও রাজনীতি করার সুযোগ পায়। কথাটি অর্ধ সত্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ, যার সঙ্গে জাতির পিতার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দলকে সামরিক শাসকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাজনীতি করা ছিল চরম অপমানজনক। আওয়ামী লীগকে অপমান ও অপদস্থ করাই ছিল লক্ষ্য। জামায়াতের মতো ঘাতক, হত্যাকারী ও মুসলিম লীগের মতো চরম, সাম্প্রদায়িক দলের পুনরুত্থান ঘটিয়ে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল মাসল, মানি আর ধর্মীয় উন্মাদনা, এই তিন শক্তির সম্মেলনের সামনে অসাম্প্রদায়িক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত, আওয়ামী লীগ আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা এবং ঢাকার জেলের ভিতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার তদন্ত ও বিচারের কোনো উদ্যোগই জিয়াউর রহমানের সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে নেওয়া হয়নি। তাতে কী হিংসাত্মক রাজনীতি উৎসাহিত হলো, নাকি প্রশমিত হলো। কী বলবেন? সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্র ও জাতীয় পর্যায়ে এমন কি গৌরবগাথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-যা যুগ যুগ ধরে স্মরণে রাখার মতো। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলেন, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বহুদলীয় কথাটির বিভ্রান্তিমূলকতা ও অসারতার কথা সামান্য করে একটু আগে উল্লেখ করেছি। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে বিএনপি দুবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। তাদের শাসনামলে এমন কোনো বড় অর্জন কি সম্ভব হয়েছে, যেটিকে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক বলা যায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ এবং একই বছর ১ এপ্রিল ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতের অসমী বিদ্রোহীদের জন্য পাচারের চেষ্টা যে তখনকার জামায়াত-বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে সে কথা রাষ্ট্রের আদালতই বলেছেন। বিএনপি তখন এমন ন্যক্কারজনক হিংসাত্মক ঘটনার দিকে না গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজ ভিন্ন হতে পারত। বিএনপির কথায় ক্ষান্ত দিয়ে এখন আওয়ামী লীগের কথায় আসি। ৭৩ বছরের পুরনো একটি দলের ইতিহাসে উত্থান-পতন, ঝড়-তুফান, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই আছে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ঠেকাতে পারেনি। এই ব্যর্থতার পরিণতি বাংলাদেশের মানুষকে এখনো বহন করতে হচ্ছে। এই ব্যর্থতার শিক্ষা আজকের আওয়ামী লীগ কতখানি ধারণ করে সে প্রশ্নটি প্রায়শই এখন মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। তবে সব কিছু পেরিয়ে সেই কথাটাই মানুষের সামনে আসে যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামে সব জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এত বড় গৌরবের অধিকারী রাজনৈতিক দল বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধের সবকিছু বীরত্বে ভরা। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের সূর্য সন্তানরা অর্জন করেছে। স্বাধীনতার মাত্র ৯ মাসের মাথায় অসাধারণ ও বিশ্বনন্দিত একটি সংবিধান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন ১৯৭৫ সালে। আওয়ামী লীগ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যে পড়ে গেল। কিন্তু ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে আওয়ামী লীগ পুনর্জন্ম লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান না ঘটলে সামরিক শাসনের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করা যেত না। এরশাদের পরে হয়তো অন্য কেউ আসতেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, ভারতের সঙ্গে সব অমীমাংসিত স্থলসীমান্ত রেখার মীমাংসা এবং মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি; এই প্রত্যেকটি ঘটনা রাষ্ট্রের গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক এবং সেগুলোর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রয়েছে। ওপরে উল্লিখিত এরকম একটি অর্জনও অন্য কোনো দলের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার জন্য নতুন গৌরবোজ্জ্বল সোনালি পালকের মতো শত বছর ধরে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক হয়ে থাকবে পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করতে চেয়েছেন, এই বিষাক্ত রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যার বড় উদাহরণ জাতির পিতাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার তিনি সাধারণ আদালতের ওপর অর্পণ করেছেন। অথচ এই বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনে কোনো বাধা ছিল না। তাহলে দ্রুত বিচার সম্পন্ন হতো। শেখ হাসিনা জানতেন বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং খুনিদের সবাই বিএনপির মিত্র ও সুবিধাভোগী। তাই ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সাধারণ আদালতে অর্পণের মাধ্যমে সবাইকে বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে চান।

 

তারপরও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে কিন্তু বিএনপি আবার প্রতিহিংসা ও ভায়োলেন্সের পথ বেছে নেয়। গত প্রায় সাড়ে ১৩ বছর একটানা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। বিএনপি অভিযোগ করছে সরকার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দিয়েছে, রাজনীতি করতে দিচ্ছে না, ইত্যাদি। বিএনপির এই অভিযোগের কতখানি সত্য আর কতখানি অসত্য তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণসহ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের সিটিং এমপি শামস কিবরিয়া, খুলনার মুনজুরুল ইমাম, টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার, নাটোরের মমতাজউদ্দিন; এসব জনপ্রিয় নেতাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেরকম একটি ঘটনা বিগত সাড়ে ১৩ বছরে ঘটেনি। কিন্তু দুয়েকটি চাঞ্চল্যকর অরাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার, দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও সরকার করতে পারেনি। এ দায় সরকারকে বহন করতে হবে। কিন্তু কাউকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি, ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি, সবাই জানেন, কোনো কিছুই নিরঙ্কুশ নয়, তুলনামূলক। বিএনপি এখনো ভায়োলেন্সের পথে হাঁটছে। সুযোগ পেলে তারা রাস্তায় সাধারণ মানুষের গাড়িতে আগুন দেয়। এই কয়েক দিন আগে ছাত্রদলের মিছিল থেকে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। অর্থাৎ সরাসরি অস্ত্রের রাজনীতি ও হত্যার হুমকি। আরেকটি জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। দুই বড় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথা হয়তো অনেকে বলবেন। কিন্তু কার সঙ্গে কার সমঝোতা হবে; ভায়োলেন্সের পথ আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ একবিন্দুতে এসে সহাবস্থান দুষ্কর কাজ। বিগত দিনে সমঝোতার চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। কারণ, পূর্ব-পশ্চিমের মতো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং গৌরব ও বীরত্বগাথায় একদল প্রায় শূন্য, আরেক দল পর্বতসম উচ্চতায়।  সুতরাং মিলন-সমঝোতা অথবা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংকট। তবে বিবর্তনের ধারায় একদিন হিংসা ও ভায়োলেন্সের রাজনীতি প্রত্যাখ্যাত হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন     

[email protected]

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বাংলাদেশ-কাতারের মধ্যে ১০ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই

» মেহজাবীন ও সিয়ামের দ্বন্দ্ব!

» মাইক্রোবাসের ধাক্কায় রিকশাচালক যুবক নিহত

» বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের অপতৎপরতা সফল হবে না: নানক

» আগামীকাল ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

» পারিবারিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে স্ত্রীকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে স্বামী গ্রেফতার

» আওয়ামী লীগের যৌথসভা আজ

» বিশেষ অভিযান চালিয়ে মাদকবিরোধী অভিযানে বিক্রি ও সেবনের অপরাধে ৩০জন গ্রেপ্তার

» তুমিই পৃথিবী!

» প্রথমবার সালমানের বিপরীতে কিয়ারা

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

পূর্ব-পশ্চিমের মিলন অসম্ভব

মেজর জেনারেল মোহাম্মাদ আলী শিকদার (অব.) :ইংরেজ কবি রুডিয়ার্ড কিপলিং ১৮৮৯ সালে একটা অসাধারণ সাড়া জাগানিয়া কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটির নাম- ‘ব্যালাড অব ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট’। কবিতার প্রথম দুটি লাইন, ‘ইস্ট ইজ ইস্ট, অ্যান্ড ওয়েস্ট ইজ ওয়েস্ট অ্যান্ড নেভার দ্য টোয়েন শ্যাল মিট’। পূর্ব-পশ্চিম সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী, দুয়ের মিলন কখনো হবে না। মিলন না হলেও দুই পক্ষই যদি সমান গৌরব ও বীরত্বের অধিকারী হয়, তাহলে সহাবস্থান সম্ভব, এটাই কবিতার মর্মার্থ।  রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের কবিতার মতোই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে সংঘটিত জাতীয় ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী প্রধান দুটি রাজনৈতিক ধারার মিলন বিগত ৪৭ বছরে কখনো হয়নি। সব সমঝোতার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, ৪৭ বছর ধরে সমান্তরালভাবে দুই বিপরীতমুখী রাজনীতি বাংলাদেশে চললেও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের বাতাবরণ কখনো তৈরি হয়নি। রুডিয়ার্ড কিপলিং কবিতায় বলেছেন, বিপরীতমুখী হলেও দুই পক্ষ যদি সমান গৌরব ও বীরত্বের অধিকারী হয় তাহলে মিলন না হলেও সহাবস্থান সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির বেলায় গৌরব ও বীরত্বে দুই বড় পক্ষের ব্যবধান এতই বেশি যে, একটি পক্ষ হীনতা ও হিংসাত্মক পথ বেছে নেওয়া ছাড়া অন্য ইতিবাচক কোনো পথ ও পন্থা বের করতে সক্ষম হয়নি। প্রথমে বিএনপির কথা বলি। দলের প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমানের নামেই বিএনপি এখনো রাজনীতি করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পথ ধরেই জিয়াউর রহমানের ক্ষমতায় আরোহণ এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে পদার্পণ। এক সময়ে তিনি রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয়েও হিংসা ও ভায়োলেন্সের রাজনীতিকে বন্ধ করার কোনো চেষ্টা করেননি, বরং তার বহু কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে হিংসা এবং ভায়োলেন্সের রাজনীতি আরও প্রসারিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে। জিয়াউর রহমান খুবই বিচক্ষণ ও বুদ্ধিমান মানুষ ছিলেন। তার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষক একাত্তরের পরাজিত দেশি ও বিদেশি গোষ্ঠী এবং তিনি নিজেও হয়তো জানতেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান কিছুতেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। আর আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান ঘটলে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে এবং তাতে তিনিও ফেঁসে যাবেন; একই সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে পাকিস্তানি স্টাইলের রাষ্ট্র বানানো কখনো সম্ভব হবে না। সুতরাং তাকে হিংসাত্মক রাজনীতির পথই বেছে নিতে হয়েছে। কথায় আছে কারও সাহায্য নিয়ে ঘোড়ায় চড়া যায়, কিন্তু ঘোড়ার পীঠ থেকে নিজের ইচ্ছায় নামা যায় না, উভয় সংকট। ঘোড়াকে পোষ মানানো যায় না, বরং সুযোগ পেলেই ঘোড়া সোয়ারীকে ফেলে দিয়ে পদপিষ্ট করে। জিয়াউর রহমানের ভাগ্যে সেটাই ঘটেছে, যা ছিল অত্যন্ত মর্মান্তিক ও হিংসাত্মক ঘটনা। হিংসা আরও হিংসার জন্ম দেয়। ক্ষমতার মোহ বড়ই অন্ধ। মানুষ চিরন্তন সত্যকে উপেক্ষা করে, ভুলে যায়। জিয়াউর রহমান সেই পথেই হেঁটেছেন। আত্মস্বীকৃত, স্বঘোষিত বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যাতে বিচার না হয় তার জন্য মীর জাফর মোশতাকের দায়মুক্তি আইনকে তিনি রাষ্ট্রের পবিত্র দলিল সংবিধানে সন্নিবেশিত করেছেন। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের দূতাবাসে খুনিদের চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছেন। তাহলে কী ঘটল। হিংসাত্মক রাজনীতিকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া এবং খুনি অপরাধীদের উৎসাহিত করার এর চেয়ে বড় ঘটনা আর কী হতে পারে। কোনো অজুহাতেই হত্যাকারীকে আনুষ্ঠানিকভাবে, আইন করে দায়মুক্তি দেওয়ার নজির মানব সভ্যতার ইতিহাসে নেই। আইনের ফাঁকফোকর এবং আইনের অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেক কিছু হয়, সেটি অন্য কথা। অনেক হত্যার বিচার হয় না, হয়নি। এ রকম ঘটনা সব সরকারের সময়ই ঘটেছে, যা অপ্রত্যাশিত ও অগ্রহণযোগ্য। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে, আইন করে হত্যাকারীকে রেহাই শুধু নয়, তাদের পুরস্কৃত করার ঘটনা নজিরবিহীন। জিয়াউর রহমানের বিচক্ষণতা ও বুদ্ধিমত্তার কথা একটু আগেই উল্লেখ করেছি। তিনি নতুন গণতন্ত্র আবিষ্কার করলেন। গণতন্ত্রের আগে বহুদলীয় কথাটি জুড়ে দিলেন, যেমন আইয়ুব খান গণতন্ত্রের আগে জুড়ে দিয়েছিলেন মৌলিক শব্দটি। গণতন্ত্র, গণতন্ত্রই। এর কোনো প্রিফিক্স ও সাফিক্স হয় না, কোথাও নেই। গণতন্ত্রের সূতিকাগার পশ্চিমা বিশ্বের সব দেশে বহু দল ছিল এবং এখনো আছে। কোথাও বহুদলীয় কথাটির প্রয়োজন হয়নি। বাংলাদেশে এটা প্রয়োজন হলো কেন। আইয়ুব খান কেন মৌলিক শব্দটি গণতন্ত্রের আগে জুড়ে দিয়েছিলেন সেটি বাঙালি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বহুদলীয় শব্দটি জুড়ে দেওয়ার অন্তর্নিহিত গোপন লক্ষ্য ছিল, একাত্তরের পরাজিত ও বাহাত্তরের সংবিধানের মাধ্যমে নিষিদ্ধ জামায়াত ও মুসলিম লীগের রাজনীতির পুনরুত্থান ঘটানো সেটা ঘটেছে। জামায়াত মুসলিম লীগ একাত্তরের স্বঘোষিত ঘাতক, গণহত্যাকারী ও ধর্ষণকারী। তাদের রাজনৈতিক পুনরুত্থানের সুযোগ দেওয়ার অর্থই হচ্ছে হিংসাত্মক রাজনীতিকে উৎসাহিত করার চরম দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা। সুতরাং জামায়াত-মুসলিম লীগের পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে হিংসা ও হত্যার রাজনীতির পথ আরও প্রসারিত হয়। অনেকে বলেন, সে সময়ে বহুদলীয় রাজনীতির ফলে আওয়ামী লীগও রাজনীতি করার সুযোগ পায়। কথাটি অর্ধ সত্য। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন জন্ম নেওয়া আওয়ামী লীগ, যার সঙ্গে জাতির পিতার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যে দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দলকে সামরিক শাসকের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে রাজনীতি করা ছিল চরম অপমানজনক। আওয়ামী লীগকে অপমান ও অপদস্থ করাই ছিল লক্ষ্য। জামায়াতের মতো ঘাতক, হত্যাকারী ও মুসলিম লীগের মতো চরম, সাম্প্রদায়িক দলের পুনরুত্থান ঘটিয়ে পঁচাত্তরের ষড়যন্ত্রকারীরা ভেবেছিল মাসল, মানি আর ধর্মীয় উন্মাদনা, এই তিন শক্তির সম্মেলনের সামনে অসাম্প্রদায়িক ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে অভ্যস্ত, আওয়ামী লীগ আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা এবং ঢাকার জেলের ভিতরে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার তদন্ত ও বিচারের কোনো উদ্যোগই জিয়াউর রহমানের সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে নেওয়া হয়নি। তাতে কী হিংসাত্মক রাজনীতি উৎসাহিত হলো, নাকি প্রশমিত হলো। কী বলবেন? সাড়ে পাঁচ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্র ও জাতীয় পর্যায়ে এমন কি গৌরবগাথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে-যা যুগ যুগ ধরে স্মরণে রাখার মতো। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বলেন, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তক। এটাই সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। বহুদলীয় কথাটির বিভ্রান্তিমূলকতা ও অসারতার কথা সামান্য করে একটু আগে উল্লেখ করেছি। জিয়াউর রহমানের অবর্তমানে বিএনপি দুবার রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে। তাদের শাসনামলে এমন কোনো বড় অর্জন কি সম্ভব হয়েছে, যেটিকে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক বলা যায়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণ এবং একই বছর ১ এপ্রিল ১০ ট্রাক অস্ত্র ভারতের অসমী বিদ্রোহীদের জন্য পাচারের চেষ্টা যে তখনকার জামায়াত-বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে সে কথা রাষ্ট্রের আদালতই বলেছেন। বিএনপি তখন এমন ন্যক্কারজনক হিংসাত্মক ঘটনার দিকে না গেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি আজ ভিন্ন হতে পারত। বিএনপির কথায় ক্ষান্ত দিয়ে এখন আওয়ামী লীগের কথায় আসি। ৭৩ বছরের পুরনো একটি দলের ইতিহাসে উত্থান-পতন, ঝড়-তুফান, সাফল্য-ব্যর্থতা সবই আছে। আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ঠেকাতে পারেনি। এই ব্যর্থতার পরিণতি বাংলাদেশের মানুষকে এখনো বহন করতে হচ্ছে। এই ব্যর্থতার শিক্ষা আজকের আওয়ামী লীগ কতখানি ধারণ করে সে প্রশ্নটি প্রায়শই এখন মানুষের মুখে মুখে শোনা যায়। তবে সব কিছু পেরিয়ে সেই কথাটাই মানুষের সামনে আসে যে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ২৩ বছরের সংগ্রামে সব জাতীয় গৌরবোজ্জ্বল মাইলফলক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই মাত্র ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এত বড় গৌরবের অধিকারী রাজনৈতিক দল বিশ্বের সমসাময়িক ইতিহাসে দ্বিতীয়টি নেই। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ, সেই যুদ্ধের সবকিছু বীরত্বে ভরা। বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের সূর্য সন্তানরা অর্জন করেছে। স্বাধীনতার মাত্র ৯ মাসের মাথায় অসাধারণ ও বিশ্বনন্দিত একটি সংবিধান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে তৈরি হয়েছে। বঙ্গবন্ধু নিহত হলেন ১৯৭৫ সালে। আওয়ামী লীগ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্যে পড়ে গেল। কিন্তু ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার হাত ধরে আওয়ামী লীগ পুনর্জন্ম লাভ করে। শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং আওয়ামী লীগের পুনরুত্থান না ঘটলে সামরিক শাসনের কবল থেকে দেশকে উদ্ধার করা যেত না। এরশাদের পরে হয়তো অন্য কেউ আসতেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি, ছিটমহল বিনিময়, ভারতের সঙ্গে সব অমীমাংসিত স্থলসীমান্ত রেখার মীমাংসা এবং মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে সমুদ্র সীমানার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি; এই প্রত্যেকটি ঘটনা রাষ্ট্রের গৌরব ও মর্যাদার প্রতীক এবং সেগুলোর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব রয়েছে। ওপরে উল্লিখিত এরকম একটি অর্জনও অন্য কোনো দলের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার জন্য নতুন গৌরবোজ্জ্বল সোনালি পালকের মতো শত বছর ধরে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরবের প্রতীক হয়ে থাকবে পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনা প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করতে চেয়েছেন, এই বিষাক্ত রাজনীতি থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছেন। যার বড় উদাহরণ জাতির পিতাকে যারা হত্যা করেছে তাদের বিচার তিনি সাধারণ আদালতের ওপর অর্পণ করেছেন। অথচ এই বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনে কোনো বাধা ছিল না। তাহলে দ্রুত বিচার সম্পন্ন হতো। শেখ হাসিনা জানতেন বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে এবং খুনিদের সবাই বিএনপির মিত্র ও সুবিধাভোগী। তাই ১৯৯৬ সালে প্রথমবার ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সাধারণ আদালতে অর্পণের মাধ্যমে সবাইকে বার্তা দিতে চেয়েছেন তিনি। প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করতে চান।

 

তারপরও ২০০১ সালে ক্ষমতায় এসে কিন্তু বিএনপি আবার প্রতিহিংসা ও ভায়োলেন্সের পথ বেছে নেয়। গত প্রায় সাড়ে ১৩ বছর একটানা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে। বিএনপি অভিযোগ করছে সরকার প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে শত শত মিথ্যা মামলা দিয়েছে, রাজনীতি করতে দিচ্ছে না, ইত্যাদি। বিএনপির এই অভিযোগের কতখানি সত্য আর কতখানি অসত্য তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড আক্রমণসহ বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি আওয়ামী লীগের সিটিং এমপি শামস কিবরিয়া, খুলনার মুনজুরুল ইমাম, টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার, নাটোরের মমতাজউদ্দিন; এসব জনপ্রিয় নেতাকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে সেরকম একটি ঘটনা বিগত সাড়ে ১৩ বছরে ঘটেনি। কিন্তু দুয়েকটি চাঞ্চল্যকর অরাজনৈতিক হত্যাকান্ডের বিচার, দীর্ঘদিন পার হয়ে গেলেও সরকার করতে পারেনি। এ দায় সরকারকে বহন করতে হবে। কিন্তু কাউকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়নি, ঘটনাকে ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়নি, সবাই জানেন, কোনো কিছুই নিরঙ্কুশ নয়, তুলনামূলক। বিএনপি এখনো ভায়োলেন্সের পথে হাঁটছে। সুযোগ পেলে তারা রাস্তায় সাধারণ মানুষের গাড়িতে আগুন দেয়। এই কয়েক দিন আগে ছাত্রদলের মিছিল থেকে স্লোগান দেওয়া হয়েছে, পঁচাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার। অর্থাৎ সরাসরি অস্ত্রের রাজনীতি ও হত্যার হুমকি। আরেকটি জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে। রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়বে, সেটাই স্বাভাবিক। দুই বড় পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথা হয়তো অনেকে বলবেন। কিন্তু কার সঙ্গে কার সমঝোতা হবে; ভায়োলেন্সের পথ আর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ একবিন্দুতে এসে সহাবস্থান দুষ্কর কাজ। বিগত দিনে সমঝোতার চেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। কারণ, পূর্ব-পশ্চিমের মতো সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী দুই বড় দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং গৌরব ও বীরত্বগাথায় একদল প্রায় শূন্য, আরেক দল পর্বতসম উচ্চতায়।  সুতরাং মিলন-সমঝোতা অথবা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় সংকট। তবে বিবর্তনের ধারায় একদিন হিংসা ও ভায়োলেন্সের রাজনীতি প্রত্যাখ্যাত হবে।

লেখক : রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন     

[email protected]

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com