দেশজুড়ে প্রতারণার জাল

ছবি সংগৃহীত

 

বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার আবদুল আলী ফকির গড়ে তুলেছেন একটি প্রতারক চক্র। চক্রটি ভুয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির নামে নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ সাত জেলার ব্যবসায়ীদের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই চক্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলার খোঁজ পায় পুলিশ। এরা প্রতারণার কাজে বিভিন্ন সময় প্রায় অর্ধশত সিম ব্যবহার করেছে। র‌্যাব-৬ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চক্রের হোতা আবদুল আলী ফকিরসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে প্রতারকদের ০১৮৯০-৩৬৮২১৯ ফোন নম্বরে কল দিলে কলার আইডিতে ভেসে ওঠে ‘বিকাশ প্রতারক’ এবং ০১৭৮২-৫১৬৮৪৮ ফোন নম্বরে কল করলে কলার আইডিতে দেখা যায় ‘বাটপাড় দালাল’ নামে সিমটি রেজিস্ট্রেশন করা। দুটি নম্বর একই ব্যক্তির। এদের প্রতারণার ধরন একটু অন্যরকম। কেউ পত্রিকায় জমি বা মূল্যবান জিনিস বিক্রির বিজ্ঞাপন দিলে প্রথমে ক্রেতা সেজে ফোন দেয়। এরপর ওই জমি দেখানো যাবে কি না জানতে চায়। যদি বলা হয় কেয়ারটেকার আছে সে দেখাবে। তখন জমির মালিকের কাছে কেয়ারটেকারের ফোন নম্বর চায়। পরে ওই কেয়ারটেকারকে ফোন করে বলে জায়গাটা দেখার জন্য সে রওনা দিয়েছে, এখন রাস্তায়। চলতি পথে তার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। তার কাছে ক্রেডিট কার্ড আছে কিন্তু কোনো নগদ টাকা নেই। বিকাশে টাকা পাঠালে গাড়ি ঠিক করে এসে টাকা ফেরত দেবে। সরল বিশ্বাসে কেউ টাকা দেওয়ার পরই ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। টাকা না পাঠালে শুরু করে উল্টো গালাগালি। এ ছাড়া আরও নানান কায়দায় প্রতারণা হয়েছে ওই দুটি ফোন নম্বর দিয়ে। গত এক বছরে সারা দেশে অন্তত ১৫১ জন প্রতারককে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, একই ব্যক্তি বারবার প্রতারণা করছে। গ্রেফতারের পর কিছুদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের জড়ায় প্রতারণায়। ৬৪ জেলার মধ্যে নাটোর, মাগুরা আর ফরিদপুরে প্রতারকের সংখ্যা বেশি। নানান কৌশল আর প্রযুক্তিতে চলছে এদের প্রতারণা। আবার অনেক এলাকার সবাই প্রতারক। কোথাও কোথাও মামলা করলে হুমকিতে পড়েন প্রতারিতরা। এভাবে নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো মানুষ। গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে অপরাধীরা। অভিযোগ রয়েছে, প্রতারকদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের এপিএস। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে অসহায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতারণার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী একটি বিশেষ আইন দরকার। যে আইনে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি দেওয়া শুরু হবে। তাহলে অপরাধীরা ভয় পেয়ে প্রতারণা থেকে বিরত থাকবে। তবে অবশ্যই বিদ্যমান আইনটি সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

 

ফরিদপুরের মধুখালী : মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামে ৬২ প্রতারককে চিহ্নিত করে সিআইডি। ওই গ্রামটি সম্পর্কে আশপাশ এলাকার বাসিন্দাদের ভাষ্য, আগে যাদের ছাপরা ঘর ছিল, সেখানে আজ পাকা দালান। তিন বেলা যাদের ভাত জুটত না, সেসব লোক বাজারে যায় ৩-৪ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে। চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো পরিশ্রমের আয়ে এমন পরিবর্তন হয়নি। মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে তারা। জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ডুমাইনের পশ্চিমপাড়া গ্রামে প্রতারক চক্রের সদস্য সংখ্যা ৭৭। পাশের ডুমাইন গ্রাম মিলে এ সংখ্যা ৯৫। আশপাশের গ্রাম ও এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে চক্রের সদস্যরা। সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইমের এসআই এমদাদুল কবিরের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডুমাইনের পশ্চিমপাড়ার শাহারুপ শেখের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগে মধুখালী থানায় দুটি মামলা থাকার তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ময়নাল শেখ, রতন শেখ, ওবায়দুল কাজী, সাগর কাজী, তপন শেখ, মেহেদী হাসান, মিঠুন শেখ, মিলন শেখ, আশরাফুল শেখ, ইলিয়াস শেখ, রিপন শেখ ও আবদুল কাদের শেখের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মামলাগুলো সব ডিজিটাল প্রতারণার। ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মধুখালীর পশ্চিমপাড়া গ্রামের ৬২ প্রতারকের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা বের করে সিআইডি। গত বছরের ২৮ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এসআই এমদাদুল কবির বলেন, মধুখালীর ডুমাইনের পশ্চিমপাড়ার ৬২ জন ডিজিটাল প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তার মধ্যে আটজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের জবানবন্দিতে মোট ৬৪ জনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।

 

নাটোরের লালপুর আর রাজশাহীর বাঘা : ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা হয়। এরপর তদন্তে নেমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম-দক্ষিণ বিভাগ অভিযান চালায় নাটোরে। ১ মার্চ সোহাগ, রিপন ইসলাম, সোহেল রানা ও লিটন আলী নামে চারজনকে গ্রেফতার করে। ডিবি জানায়, এরা মোবাইল ফোন হার্ডওয়্যার অ্যান্ড সফটওয়্যার ফিক্সিংয়ের কাজ খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে। নারীকণ্ঠে কথা বলার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতে তারা। প্রতারণায় টার্গেট করে অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ইমো ব্যবহারকারী মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের। নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমারিয়া ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দুড়দুড়িয়া গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। নাটোর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুর রহমান বলেন, বিলমারিয়ার প্রতারকরা মূলত হ্যাকার গ্রুপ। এদের বাড়ি লালপুরে কিন্তু এরা সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতারণা করে। তবে দেশের যে কোনো স্থানে তাদের নামে মামলা হলে মামলার রিকুইজিশনে গ্রেফতার করা যায়। এতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

 

যা আছে ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্য বিশ্লেষণে : সারা দেশে গ্রেফতার আসামিদের ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা থানা কিংবা আদালত থেকে সংগ্রহ করে থাকে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। ফরেনসিক ল্যাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তাদের ডাটা ব্যাংকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্য জমা হয়েছে। এসবের মধ্যে ঢাকায় যেসব ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের ৬০ শতাংশই এক অপরাধে বারবার জড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রতারণা, চুরি, মাদক কিংবা ছিনতাইয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যায়, জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধ করে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রথাগত পদ্ধতিতে (ম্যানুয়াল) আঙুলের ছাপের তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। পরে অটোমেটিক ফিঙ্গার আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে আসামিদের আঙুলের ছাপের সংরক্ষণ শুরু হয়। ১০ হাজারের বেশি আসামির আঙুলের ছাপ ডাটা ব্যাংকে থাকা ছাপের সঙ্গে একাধিকবার মিলেছে। এ মিলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তারা বারবার গ্রেফতার হচ্ছে।

কী আছে আইনে : সাধারণত প্রতারণার ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা অনেক বেশি প্রচলিত। এ ধারায় শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর। পাশাপাশি অর্থদণ্ডেরও বিধান আছে।

 

দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় বলা আছে : কোনো ব্যক্তি যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তার কাছ থেকে কোনো কিছু আদায় করে সেটা ওই ব্যক্তির সম্মতি সাপেক্ষে হলেও প্রতারণা হবে। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনেও প্রতারণার ঘটনায় মামলা করার সুযোগ রয়েছে। কারণ এ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে প্রতারণাও রয়েছে। এ আইনে সম্পদ ক্রোকসহ কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সারা দেশে হাজারো প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও মানি লন্ডারিং আইনে মামলার সংখ্যা খুবই কম। মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার তদন্তের ক্ষমতা পুলিশের একমাত্র সংস্থা সিআইডির। সংস্থাটির সূত্র বলছেন, শুধু প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে শতাধিক।

 

প্রতারকদের আরেক গ্রাম : মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ ও মহেশপুর নামে দুটি গ্রামের ১৩৫ প্রতারকের ব্যাপারে তথ্য পায় পুলিশ। এরা গ্রামে বসেই বিকাশের মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে। পুলিশ বলছে, ২০২১ সালের ১ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড ও হালিশহর এলাকার শতাধিক বিকাশ গ্রাহক প্রতারণার শিকার হন। একের পর এক অভিযোগের পর তদন্তে নেমেই মাগুরার ওই দুটি গ্রামের খোঁজ পাওয়া যায়। সেখানে তদন্তসংশ্লিষ্টরা গিয়ে দেখে, গোয়ালদহ ও মহেশপুর গ্রামে পুকুরপাড়ে বা পাটের ক্ষেতে মাচার মতো কিছু টংঘর আছে। অধিকাংশ যুবকই সেই টংঘরে আড্ডা দেয়। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। তারা সেখানে বসেই একের পর এক মানুষকে বিকাশ বা রকেটের কর্মকর্তা সেজে ফোন করে। এরপর গ্রাহকদের কাছ থেকে পিন কোড হাতিয়ে নেয়। দুটি গ্রামে এমন সাত-আটটি চক্র রয়েছে। শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদুল গনি এই প্রতিবেদককে বলেন, অনলাইনের কারণে প্রতারণা একসময় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, প্রশাসনের তৎপরতায় এখন তা কিছুটা কমেছে। এখন ওই দুই গ্রাম অনেকটা পুলিশ পাহারায় থাকে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, সামাজিক সমস্যাও বাড়বে। কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতারণার মতো অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা রাজনৈতিক নয়: প্রধানমন্ত্রী

» রাজধানীর শিশু হাসপাতালের ভবনে আগুন

» শনিবার ২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

» মাদক বিক্রি ও সেবন করার অপরাধে ১০ জন গ্রেফতার

» ‘জীবনে অনেক ভুল করেছি’—হঠাৎ কী হলো পরিণীতির?

» ‘মুস্তাফিজকে কেন পুরো আইপিএল খেলতে দিচ্ছে না বাংলাদেশ’

» কমেছে সবজির দাম, চড়া মাছের বাজার

» বিশেষ অভিযান চালিয়ে মাদকবিরোধী অভিযানে বিক্রি ও সেবনের অপরাধে ২৭ জন গ্রেপ্তার

» জাতীয় পতাকার নকশাকার শিব নারায়ণ দাসের মৃত্যু

» যে যায় সবুজ অরণ্যে

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

দেশজুড়ে প্রতারণার জাল

ছবি সংগৃহীত

 

বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার আবদুল আলী ফকির গড়ে তুলেছেন একটি প্রতারক চক্র। চক্রটি ভুয়া ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলে কয়লাসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রির নামে নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাটসহ সাত জেলার ব্যবসায়ীদের থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ওই চক্রের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ১১টি মামলার খোঁজ পায় পুলিশ। এরা প্রতারণার কাজে বিভিন্ন সময় প্রায় অর্ধশত সিম ব্যবহার করেছে। র‌্যাব-৬ গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে চক্রের হোতা আবদুল আলী ফকিরসহ তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। এদিকে প্রতারকদের ০১৮৯০-৩৬৮২১৯ ফোন নম্বরে কল দিলে কলার আইডিতে ভেসে ওঠে ‘বিকাশ প্রতারক’ এবং ০১৭৮২-৫১৬৮৪৮ ফোন নম্বরে কল করলে কলার আইডিতে দেখা যায় ‘বাটপাড় দালাল’ নামে সিমটি রেজিস্ট্রেশন করা। দুটি নম্বর একই ব্যক্তির। এদের প্রতারণার ধরন একটু অন্যরকম। কেউ পত্রিকায় জমি বা মূল্যবান জিনিস বিক্রির বিজ্ঞাপন দিলে প্রথমে ক্রেতা সেজে ফোন দেয়। এরপর ওই জমি দেখানো যাবে কি না জানতে চায়। যদি বলা হয় কেয়ারটেকার আছে সে দেখাবে। তখন জমির মালিকের কাছে কেয়ারটেকারের ফোন নম্বর চায়। পরে ওই কেয়ারটেকারকে ফোন করে বলে জায়গাটা দেখার জন্য সে রওনা দিয়েছে, এখন রাস্তায়। চলতি পথে তার গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে। তার কাছে ক্রেডিট কার্ড আছে কিন্তু কোনো নগদ টাকা নেই। বিকাশে টাকা পাঠালে গাড়ি ঠিক করে এসে টাকা ফেরত দেবে। সরল বিশ্বাসে কেউ টাকা দেওয়ার পরই ফোনটি বন্ধ হয়ে যায়। টাকা না পাঠালে শুরু করে উল্টো গালাগালি। এ ছাড়া আরও নানান কায়দায় প্রতারণা হয়েছে ওই দুটি ফোন নম্বর দিয়ে। গত এক বছরে সারা দেশে অন্তত ১৫১ জন প্রতারককে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, একই ব্যক্তি বারবার প্রতারণা করছে। গ্রেফতারের পর কিছুদিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে এসে ফের জড়ায় প্রতারণায়। ৬৪ জেলার মধ্যে নাটোর, মাগুরা আর ফরিদপুরে প্রতারকের সংখ্যা বেশি। নানান কৌশল আর প্রযুক্তিতে চলছে এদের প্রতারণা। আবার অনেক এলাকার সবাই প্রতারক। কোথাও কোথাও মামলা করলে হুমকিতে পড়েন প্রতারিতরা। এভাবে নিঃস্ব হচ্ছে হাজারো মানুষ। গ্রেফতার হলেও আইনের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে অপরাধীরা। অভিযোগ রয়েছে, প্রতারকদের আশ্রয়দাতা রাজনৈতিক দলের নেতা, মন্ত্রী-এমপিদের এপিএস। যে কারণে অনেক ক্ষেত্রে অসহায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এস এম আশরাফুল ইসলাম বলেন, প্রতারণার ক্ষেত্রে সময়োপযোগী একটি বিশেষ আইন দরকার। যে আইনে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে শাস্তি দেওয়া শুরু হবে। তাহলে অপরাধীরা ভয় পেয়ে প্রতারণা থেকে বিরত থাকবে। তবে অবশ্যই বিদ্যমান আইনটি সময়োপযোগী করার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।

 

ফরিদপুরের মধুখালী : মধুখালী উপজেলার ডুমাইন ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামে ৬২ প্রতারককে চিহ্নিত করে সিআইডি। ওই গ্রামটি সম্পর্কে আশপাশ এলাকার বাসিন্দাদের ভাষ্য, আগে যাদের ছাপরা ঘর ছিল, সেখানে আজ পাকা দালান। তিন বেলা যাদের ভাত জুটত না, সেসব লোক বাজারে যায় ৩-৪ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে। চাকরি, ব্যবসা বা অন্য কোনো পরিশ্রমের আয়ে এমন পরিবর্তন হয়নি। মানুষকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অল্প সময়ের ব্যবধানেই অর্থবিত্তের মালিক হয়েছে তারা। জেলা পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ডুমাইনের পশ্চিমপাড়া গ্রামে প্রতারক চক্রের সদস্য সংখ্যা ৭৭। পাশের ডুমাইন গ্রাম মিলে এ সংখ্যা ৯৫। আশপাশের গ্রাম ও এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে চক্রের সদস্যরা। সিআইডির সিরিয়াস ক্রাইমের এসআই এমদাদুল কবিরের তদন্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, ডুমাইনের পশ্চিমপাড়ার শাহারুপ শেখের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রতারণার অভিযোগে মধুখালী থানায় দুটি মামলা থাকার তথ্য মিলেছে। এ ছাড়া ময়নাল শেখ, রতন শেখ, ওবায়দুল কাজী, সাগর কাজী, তপন শেখ, মেহেদী হাসান, মিঠুন শেখ, মিলন শেখ, আশরাফুল শেখ, ইলিয়াস শেখ, রিপন শেখ ও আবদুল কাদের শেখের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। মামলাগুলো সব ডিজিটাল প্রতারণার। ২০১৮ সাল থেকে গত মার্চ পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে। ২০২১ সালে রাজধানীর শাহজাহানপুর থানার একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে মধুখালীর পশ্চিমপাড়া গ্রামের ৬২ প্রতারকের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা বের করে সিআইডি। গত বছরের ২৮ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এসআই এমদাদুল কবির বলেন, মধুখালীর ডুমাইনের পশ্চিমপাড়ার ৬২ জন ডিজিটাল প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। তার মধ্যে আটজন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। তাদের জবানবন্দিতে মোট ৬৪ জনের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া যায়।

 

নাটোরের লালপুর আর রাজশাহীর বাঘা : ২৬ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর হাজারীবাগ থানায় একটি মামলা হয়। এরপর তদন্তে নেমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম-দক্ষিণ বিভাগ অভিযান চালায় নাটোরে। ১ মার্চ সোহাগ, রিপন ইসলাম, সোহেল রানা ও লিটন আলী নামে চারজনকে গ্রেফতার করে। ডিবি জানায়, এরা মোবাইল ফোন হার্ডওয়্যার অ্যান্ড সফটওয়্যার ফিক্সিংয়ের কাজ খুব ভালোভাবে রপ্ত করেছে। নারীকণ্ঠে কথা বলার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতে তারা। প্রতারণায় টার্গেট করে অনলাইন যোগাযোগমাধ্যম ইমো ব্যবহারকারী মধ্যপ্রাচ্য প্রবাসীদের। নাটোরের লালপুর উপজেলার বিলমারিয়া ও রাজশাহীর বাঘা উপজেলার দুড়দুড়িয়া গ্রামের ৮০ ভাগ মানুষই প্রতারণার সঙ্গে জড়িত। নাটোর জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) সাইফুর রহমান বলেন, বিলমারিয়ার প্রতারকরা মূলত হ্যাকার গ্রুপ। এদের বাড়ি লালপুরে কিন্তু এরা সারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রতারণা করে। তবে দেশের যে কোনো স্থানে তাদের নামে মামলা হলে মামলার রিকুইজিশনে গ্রেফতার করা যায়। এতে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

 

যা আছে ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্য বিশ্লেষণে : সারা দেশে গ্রেফতার আসামিদের ফিঙ্গারপ্রিন্টের নমুনা থানা কিংবা আদালত থেকে সংগ্রহ করে থাকে সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ। ফরেনসিক ল্যাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত তাদের ডাটা ব্যাংকে ২ লাখ ৪৩ হাজার ফিঙ্গারপ্রিন্টের তথ্য জমা হয়েছে। এসবের মধ্যে ঢাকায় যেসব ব্যক্তির ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের ৬০ শতাংশই এক অপরাধে বারবার জড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রতারণা, চুরি, মাদক কিংবা ছিনতাইয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে যায়, জামিনে বেরিয়ে আবার অপরাধ করে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রথাগত পদ্ধতিতে (ম্যানুয়াল) আঙুলের ছাপের তথ্য সংরক্ষণ করা হতো। পরে অটোমেটিক ফিঙ্গার আইডেনটিফিকেশন সিস্টেম সফটওয়্যারের মাধ্যমে আসামিদের আঙুলের ছাপের সংরক্ষণ শুরু হয়। ১০ হাজারের বেশি আসামির আঙুলের ছাপ ডাটা ব্যাংকে থাকা ছাপের সঙ্গে একাধিকবার মিলেছে। এ মিলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে তারা বারবার গ্রেফতার হচ্ছে।

কী আছে আইনে : সাধারণত প্রতারণার ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৪২০ ধারায় মামলা অনেক বেশি প্রচলিত। এ ধারায় শাস্তি সর্বোচ্চ সাত বছর। পাশাপাশি অর্থদণ্ডেরও বিধান আছে।

 

দণ্ডবিধির ৪১৫ ধারায় বলা আছে : কোনো ব্যক্তি যদি অসৎ উদ্দেশ্যে কারও ওপর প্রভাব বিস্তার করে, তার কাছ থেকে কোনো কিছু আদায় করে সেটা ওই ব্যক্তির সম্মতি সাপেক্ষে হলেও প্রতারণা হবে। এ ছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনেও প্রতারণার ঘটনায় মামলা করার সুযোগ রয়েছে। কারণ এ আইনের ২৭টি সম্পৃক্ত অপরাধের মধ্যে প্রতারণাও রয়েছে। এ আইনে সম্পদ ক্রোকসহ কঠিন শাস্তির কথা উল্লেখ রয়েছে। তবে সারা দেশে হাজারো প্রতারণার ঘটনা ঘটলেও মানি লন্ডারিং আইনে মামলার সংখ্যা খুবই কম। মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার তদন্তের ক্ষমতা পুলিশের একমাত্র সংস্থা সিআইডির। সংস্থাটির সূত্র বলছেন, শুধু প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হয়েছে শতাধিক।

 

প্রতারকদের আরেক গ্রাম : মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার গোয়ালদহ ও মহেশপুর নামে দুটি গ্রামের ১৩৫ প্রতারকের ব্যাপারে তথ্য পায় পুলিশ। এরা গ্রামে বসেই বিকাশের মাধ্যমে দেশজুড়ে প্রতারণার জাল বিস্তার করেছে। পুলিশ বলছে, ২০২১ সালের ১ থেকে ৮ জুন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড ও হালিশহর এলাকার শতাধিক বিকাশ গ্রাহক প্রতারণার শিকার হন। একের পর এক অভিযোগের পর তদন্তে নেমেই মাগুরার ওই দুটি গ্রামের খোঁজ পাওয়া যায়। সেখানে তদন্তসংশ্লিষ্টরা গিয়ে দেখে, গোয়ালদহ ও মহেশপুর গ্রামে পুকুরপাড়ে বা পাটের ক্ষেতে মাচার মতো কিছু টংঘর আছে। অধিকাংশ যুবকই সেই টংঘরে আড্ডা দেয়। যাদের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছর। তারা সেখানে বসেই একের পর এক মানুষকে বিকাশ বা রকেটের কর্মকর্তা সেজে ফোন করে। এরপর গ্রাহকদের কাছ থেকে পিন কোড হাতিয়ে নেয়। দুটি গ্রামে এমন সাত-আটটি চক্র রয়েছে। শ্রীপুর উপজেলা চেয়ারম্যান মিয়া মাহমুদুল গনি এই প্রতিবেদককে বলেন, অনলাইনের কারণে প্রতারণা একসময় ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল, প্রশাসনের তৎপরতায় এখন তা কিছুটা কমেছে। এখন ওই দুই গ্রাম অনেকটা পুলিশ পাহারায় থাকে। সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, মানুষের সংখ্যা যত বাড়বে, সামাজিক সমস্যাও বাড়বে। কর্মসংস্থানের সীমাবদ্ধতার কারণে প্রতারণার মতো অপরাধ বাড়ার অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।  সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com