ঠিক-বেঠিক

সুলতানা জাকিয়া: মুদি দোকানটা বেশ বড়। নিত্যপণ্যের নানা জিনিস থরে থরে সাজানো । বাজারের ফর্দ মিলিয়ে সব পন্য নেয়া শেষ। থরে থরে সাজানো নানা জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে ইউসুফ মনে করার চেষ্টা করছে আরো কিছূ কেনা বাদ গেল কিনা। অপচনশীল নিত্যপণ্যের বাজার ইউসুফ মাসে একবারই করে। বেতন পাবার পরই মাসকাবারীর বাজারটা সেরে ফেলে। বেতন পেতে দেরি হলে কিংবা নিত্যপণ্য সময়ের আগেই ফুরিয়ে গেলে জিনিস কিনতে হয় বাকিতে।

 

বেশ কিছুক্ষণ মস্তিষ্কের উপর জোর খাটিয়েও লাভের লাভ কিছুই হলো না। ফর্দের বাইরে কোন জিনিস কেনার তাগিদ ইউসুফ অনুভব করতে না পেরে মুদি দোকানদারকে প্রশ্ন করলো,

 

– ভাই, কত হলো?

দোকানদার একে একে সব পণ্যের নাম আর দাম চওডা ফিতার মতো এক ফালি কাগজে লেখা শুরু করেছে । লেখা শেষে সামনে রাখা বড় ক্যালকুলেটরে হিসাব করে জানিয়ে দিল, ‘পাচঁ হাজার’ ।

 

প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই নোটগুলোর অস্তিত্ব টের পেল ইউসুফ । হাতটা বাইরে আনতেই বেরিয়ে এলো কড়কড়ে নতুন হাজার হাজার টাকার কিছু চকচকে নোট । বাইরের আলো পড়তেই নোটগুলোর সৌন্দর্য্য আরো বেড়ে গেলো। নোটগুলো হাতবদলের আগে ইউসুফ ভাবনায় সাগরে দিলো ডুব । এক দৃষ্টিতে নোটগুলোর দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে। অনেক ভেবে একটা হাজার টাকার নোট সরিয়ে রেখে বাকি নোটগুলো মুদি দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মুদি দোকানদারকে অনুরোধ

-চার হাজার টাকা রাখেন। বাকিটা খাতায় লিখে রাখেন।

-আচ্ছা। নোটগুলো ড্রয়ারে রাখতে রাখতে দোকানদারের প্রশ্ন করলো, ‘মাল কি এখন নিয়ে যাবেন?’

-‘না’ মাথা নেড়ে ইউসুফের জবাব । কাঁচা বাজার সেরে যাবার পথে নিয়ে যাবো।

মালগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে দোকানদার বললো, ‘ঠিক আছে’।

 

হাজার টাকার নোটটা পকেটে রাখতে রাখতে ইউসুফের মনে স্মৃতিরা ভিড় জমালো । কত স্মৃতি এই মুদি দোকানটা ঘিরে । তার সাথে এই দোকানের সখ্যতা অনেক দিনের । আগে এই দোকান চালাতো যিনি বয়সের ভারে এখন আর দোকানে আসেন না । তার জায়গায় এসেছে নতুন প্রজন্ম । ছেলেরা দোকান চালাচ্ছে । ব্যবসাটা তারা বেশ ভালো বোঝে। দোকানের নিয়মিত ক্রেতা তো কমেইনি বরং বেড়েছে। হয়তো আরো বাড়বে । এই দোকানের অনেক পুরোনো খদ্দের ইউসুফ । কতদিন বাকিতে জিনিস নিয়েছে! টাকা হাতে এলেই পরিশোধও করেছে। বাকির টাকা নিয়ে কোনদিনও মন্দ কথা হয়নি । টানাটানির সংসারে এই দোকানের বাকিতে নেয়া জিনিসগুলোই তার সংসারের চাকা সচল রেখেছে।

মাছের বাজারটা সব সময়ই স্যাতস্যাতে । নানা রকম মাছের পসরা বসেছে আজ । মাছ বাজারে কেউ ঢুকলেই ক্রেতা আকর্ষণের প্রতিযোগিতা চলে । নিজের ঝুড়ির মাছ বিক্রির জন্য নানা প্রলোভনও দেওয়া হয় । বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছোট বড় নানাজাতের মাছে পরিপূর্ণ। এই বাজারে মাছ খুব তাজা পাওয়া যায়। তাই এখানেই মাছ কিনতে ইউসুফ খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাজারের এক কোণায়এক লোক বসেছে ছোট মাছ নিয়ে। পাতলা শরীর । মাথায় অল্প অল্প সাদা চুল । মুখে পান । পরনে আধ ময়লা লুঙ্গি । কোমরে বাধা গামছা । সামনে রাখা পাতিলের উপরের ট্রেতে কেজি চারেক মাছ রয়েছে। একটা মাছ পরীক্ষা করে ইউসুফ বুঝলো এই ভরদুপুরেও এগুলো এখনো তাজা। দাম জিজ্ঞেস করতেই চোখ তার কপালে। দামটা অনেক বেশি…. -এতো দাম কেন?

-২-

-ঘাটে আজ মাছের দর বেশি। যেদিন কম থাকে সেদিন কম দামেই বেচি।

-দুইশত টাকায় আধা কেজি দেন।

-না । পঞ্চাশ টাকা আরো বাড়াইয়া দেন।

-না না । যে দাম বললাম সেই দামে দেন।

-না। দিমার পারুম না ।

– তাহলে চলে যাবো?

-গেলে তো আর কিছু করার নেই।

 

দামে বনাবনি না হওয়ায় ফিরে চললো ইউসুফ । দামটা বেশি হলেও তাজা মাছগুলো তাকে বেশ টানছে। পকেটে রাখা হাজার টাকার নোটটা স্পর্শ করে ভাবছে , ভাবনা কি? এই হাজার টাকার নোটটা তো আছেই।

ফিরে এলো মাছ বিক্রতার কাছে । তরুণ ক্রেতা দাড়িয়ে । বিক্রেতা মাছের ওজন করতে ব্যস্ত । এক হাতে মাছ নিয়ে একটা হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেলো তরুণটি। বিক্রেতা নানাভাবে নোটটি পরীক্ষা করার পর ভাংতি টাকা ফেরত দিলো তরুণ ক্রেতাকে । হাসি দিয়ে তরুণটি টাকাগুলো ফেরত নিয়ে চললো আপন পথে ।

ইউসুফকে দেখেই মাছ বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলো,

-মাছ দিমু?

-হু। আধা কেজি।

 

মাছ বিক্রেতা মাছের ওজন করছে । আর ইউসুফের করছে ভয় । অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে কি হবে? অপমান সহ্য করতে পারবো তো? আচ্ছা ওরা কি আমাকে মারবে? নানা প্রশ্ন তার মনে।

-ভাংতি দিয়েন। বড় নোট ছাড়া কোন টাকা আমার কাছে না।

মাছ বিক্রেতার কথায় স্বম্বিত ফিরলো ইউসুফের । বুক পকেটে হাতড়ে বের করলো চারটি একশ টাকার নোট। দাম মিটিয়ে হাঁফ ছেড়ে মাছ নিয়ে চললো নিজের গন্তব্যে।

একটু দূরেই । ভ্যান গাড়িতে ডিম বিক্রি চলছে । নানা বয়সের মানুষ ডিম বাছাই করছে। নিজ নিজ প্রয়োজন আর পছন্দমতো ডিম বাছাইয়ের পর ভ্যানে বসা দশ বারো বছরের ছোট ছেলেটির আবার তা গুনে দেখছে । সব টিকটাক থাকলেই ডিমের দাম নিচ্ছে । কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে এ দৃশ্য দেখার পর নানা বুদ্ধি ইউসুফের মাথায় উকিঁ দিতে শুরু করেছে।

টানাটানির সংসারে হাজার টাকার নোটটার যথেষ্ট মূল্য আছে। অন্যের শঠতা কিংবা তার অসাবধানতা। কারণ যাই হোক নোটটি এখন তার । অনেকবার অনেকভাবে ব্যবহার করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা নিয়ে কাছের মানুষগুলো কত হাসাহাসি করেছে , এখনো করছে , হয়তো ভবিষ্যতেও করবে । স্ত্রী প্রতিবারই বাজারে আসার সময় নোটটা পকেটে দিয়ে দেয়। কিন্তু নোটটা তাকে ছেড়ে যেতেই চায় না । কতবার কতভাবে বিদায় করার ফন্দি এটেছে । সবই ব্যর্থ । অর্থ হাত বদল হবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু হাজার টাকার এই নোটটাকে হাতবদল করাই যাচ্ছে না।

ভ্যান গাড়িটার সামনে গিয়ে ইউসুফ ডিম বাছাইয়ে লেগে গেল ,

-কয় হালি নিবেন? ছোট বিক্রেতা পাতলা পলিথিনের ব্যাগ দিতে দিতে প্রশ্ন করলো ।

-এক ডজন । ডিম বাছতে বাছতে ইউসুফ জবাব ।

 

এক ডজন ডিম বাছাই শেষে অত্যন্ত দৃয়তার সাথে হাজার টাকা নোটটি ক্ষুদে বিক্রেতার দিকে বাড়িয়ে দিলো। নোটটা রেখে গুনে গুনে বাকি টাকা ফেরত দেবার সময় ইউসুফ সস্নেহে ছোট বিক্রেতাকে বললো, ‘ ১০০ টাকা কম দিও’ । -৩-

-কেন? ছোট বিক্রেতার অবাক প্রশ্ন। এত ছোট বয়সে কাজ করছো। এটা তোমার বকশিশ।

টাকা ফেরত পাবার পর ইউসুফ অবাক।

-একশ টাকা বেশি রাখলে না কেন?

-দোয়া করবেন । তাতেই চলবো । ছোট বিক্রেতার স্বনির্ভর উত্তর।

 

ডিম, মাছ নিয়ে ইউসুফ ফিরলো সেই মুদি দোকানে । পরিচিত মিনতির মাথায় সব বাজার চাপিয়ে চলছে নিজ গন্তব্যে ।

মনের ভেতর কেমন খচ খচ করছে । ছোট বিক্রেতার বড় উত্তর তার পুরো মাথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিরে এলো আবার ভ্যান গাড়িটার কাছে । ভ্যানের সামনে ভিড় বেড়েছে। ছোট বিক্রেতার অনেক ক্রেতা । এখন সে অনেক ব্যস্ত। ব্যস্ততা কমে এলে ইউসুফ কাছে এগিয়ে কিছু নোট বাড়িয়ে দিলো,

-এই নাও এক ডজন ডিমের দাম। আমার হাজার টাকার নোটটা ফেরত দাও।

ছেলেটা কোন প্রশ্ন না করেই হাজার টাকা নোটটা দিলো ফিরিয়ে ।

ভ্যান গাড়ি থেকে একটু দূরে…. অলস রিকশাওয়ালা বসে বসে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে । শরবত বিক্রেতা বসে আছে ত্রেতার আশায় । পাশের ছোট দোকানটিতে ডুবো তেলে সিংগারা ভাজা হচ্ছে । কিছু কিছু পথচারী গরম গরম সিংগারা কিনছে ।

আর ইউসুফ ? হাজার টাকার নোটাটা উল্টে পাল্টে বারবার দেখছে । কিভাবে সে ভুল করলো ? কেন ঠকে গেলো? হাজারো প্রশ্নেরা তার মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে । অবশেষে……

হাজার টাকার নোটাটা কুচি কুচি করে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলছে, ‘আমার র্নিবুদ্ধিতা, আমার অক্ষমতা আমারই থাক । যা ক্ষতি হবার তা আমারই হোক অন্য কারো না হোক’ । ছুড়ে দেওয়া নোটের কুচি কুচি টুকরোগুলো মাটির বুক স্পর্শ করার আগেই প্রসন্ন চিত্তে বাড়ির পথে পা বাড়ালো ইউসুফ ।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা হাজার টাকার নোটের কুচিগুলো বিস্মিত হয়ে দেখছে অনেকগুলো চোখ । দোকানদার, রিকশাওয়ালা, শরবত বিক্রেতা, পথচারী । একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ানো ইউসুফকে দেখিয়ে তারা একযোগে বললো, ‘পাগল’।

সূএ:পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচনে মিশা-ডিপজল পরিষদের জয়জয়কার

» পাগলা মসজিদের ৯ দানবাক্সে এবার মিললো ২৭ বস্তা টাকা, চলছে গণনা

» স্বামী হত্যা মামলায় পরকীয়া প্রেমিকসহ স্ত্রী গ্রেফতার

» গাঁজাসহ যুবক গ্রেফতার

» বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপের ফাইনাল আজ

» আজ শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকা-মার্কেট বন্ধ

» ফেরত যাবে মিয়ানমারের ২৮৫ সেনা, ফিরবে ১৫০ বাংলাদেশি

» ট্রাকচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী তিন যুবক নিহত

» কৃষক লীগকে শহরে আটকে না রেখে গ্রামে নিয়ে যাওয়া ভালো: কাদের

» গণভবনের শাক-সবজি কৃষক লীগ নেতাদের উপহার দিলেন শেখ হাসিনা

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ঠিক-বেঠিক

সুলতানা জাকিয়া: মুদি দোকানটা বেশ বড়। নিত্যপণ্যের নানা জিনিস থরে থরে সাজানো । বাজারের ফর্দ মিলিয়ে সব পন্য নেয়া শেষ। থরে থরে সাজানো নানা জিনিসগুলোর দিকে তাকিয়ে ইউসুফ মনে করার চেষ্টা করছে আরো কিছূ কেনা বাদ গেল কিনা। অপচনশীল নিত্যপণ্যের বাজার ইউসুফ মাসে একবারই করে। বেতন পাবার পরই মাসকাবারীর বাজারটা সেরে ফেলে। বেতন পেতে দেরি হলে কিংবা নিত্যপণ্য সময়ের আগেই ফুরিয়ে গেলে জিনিস কিনতে হয় বাকিতে।

 

বেশ কিছুক্ষণ মস্তিষ্কের উপর জোর খাটিয়েও লাভের লাভ কিছুই হলো না। ফর্দের বাইরে কোন জিনিস কেনার তাগিদ ইউসুফ অনুভব করতে না পেরে মুদি দোকানদারকে প্রশ্ন করলো,

 

– ভাই, কত হলো?

দোকানদার একে একে সব পণ্যের নাম আর দাম চওডা ফিতার মতো এক ফালি কাগজে লেখা শুরু করেছে । লেখা শেষে সামনে রাখা বড় ক্যালকুলেটরে হিসাব করে জানিয়ে দিল, ‘পাচঁ হাজার’ ।

 

প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই নোটগুলোর অস্তিত্ব টের পেল ইউসুফ । হাতটা বাইরে আনতেই বেরিয়ে এলো কড়কড়ে নতুন হাজার হাজার টাকার কিছু চকচকে নোট । বাইরের আলো পড়তেই নোটগুলোর সৌন্দর্য্য আরো বেড়ে গেলো। নোটগুলো হাতবদলের আগে ইউসুফ ভাবনায় সাগরে দিলো ডুব । এক দৃষ্টিতে নোটগুলোর দিকে তাকিয়ে মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখছে। অনেক ভেবে একটা হাজার টাকার নোট সরিয়ে রেখে বাকি নোটগুলো মুদি দোকানদারের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মুদি দোকানদারকে অনুরোধ

-চার হাজার টাকা রাখেন। বাকিটা খাতায় লিখে রাখেন।

-আচ্ছা। নোটগুলো ড্রয়ারে রাখতে রাখতে দোকানদারের প্রশ্ন করলো, ‘মাল কি এখন নিয়ে যাবেন?’

-‘না’ মাথা নেড়ে ইউসুফের জবাব । কাঁচা বাজার সেরে যাবার পথে নিয়ে যাবো।

মালগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে দোকানদার বললো, ‘ঠিক আছে’।

 

হাজার টাকার নোটটা পকেটে রাখতে রাখতে ইউসুফের মনে স্মৃতিরা ভিড় জমালো । কত স্মৃতি এই মুদি দোকানটা ঘিরে । তার সাথে এই দোকানের সখ্যতা অনেক দিনের । আগে এই দোকান চালাতো যিনি বয়সের ভারে এখন আর দোকানে আসেন না । তার জায়গায় এসেছে নতুন প্রজন্ম । ছেলেরা দোকান চালাচ্ছে । ব্যবসাটা তারা বেশ ভালো বোঝে। দোকানের নিয়মিত ক্রেতা তো কমেইনি বরং বেড়েছে। হয়তো আরো বাড়বে । এই দোকানের অনেক পুরোনো খদ্দের ইউসুফ । কতদিন বাকিতে জিনিস নিয়েছে! টাকা হাতে এলেই পরিশোধও করেছে। বাকির টাকা নিয়ে কোনদিনও মন্দ কথা হয়নি । টানাটানির সংসারে এই দোকানের বাকিতে নেয়া জিনিসগুলোই তার সংসারের চাকা সচল রেখেছে।

মাছের বাজারটা সব সময়ই স্যাতস্যাতে । নানা রকম মাছের পসরা বসেছে আজ । মাছ বাজারে কেউ ঢুকলেই ক্রেতা আকর্ষণের প্রতিযোগিতা চলে । নিজের ঝুড়ির মাছ বিক্রির জন্য নানা প্রলোভনও দেওয়া হয় । বাজারের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত ছোট বড় নানাজাতের মাছে পরিপূর্ণ। এই বাজারে মাছ খুব তাজা পাওয়া যায়। তাই এখানেই মাছ কিনতে ইউসুফ খুব সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। বাজারের এক কোণায়এক লোক বসেছে ছোট মাছ নিয়ে। পাতলা শরীর । মাথায় অল্প অল্প সাদা চুল । মুখে পান । পরনে আধ ময়লা লুঙ্গি । কোমরে বাধা গামছা । সামনে রাখা পাতিলের উপরের ট্রেতে কেজি চারেক মাছ রয়েছে। একটা মাছ পরীক্ষা করে ইউসুফ বুঝলো এই ভরদুপুরেও এগুলো এখনো তাজা। দাম জিজ্ঞেস করতেই চোখ তার কপালে। দামটা অনেক বেশি…. -এতো দাম কেন?

-২-

-ঘাটে আজ মাছের দর বেশি। যেদিন কম থাকে সেদিন কম দামেই বেচি।

-দুইশত টাকায় আধা কেজি দেন।

-না । পঞ্চাশ টাকা আরো বাড়াইয়া দেন।

-না না । যে দাম বললাম সেই দামে দেন।

-না। দিমার পারুম না ।

– তাহলে চলে যাবো?

-গেলে তো আর কিছু করার নেই।

 

দামে বনাবনি না হওয়ায় ফিরে চললো ইউসুফ । দামটা বেশি হলেও তাজা মাছগুলো তাকে বেশ টানছে। পকেটে রাখা হাজার টাকার নোটটা স্পর্শ করে ভাবছে , ভাবনা কি? এই হাজার টাকার নোটটা তো আছেই।

ফিরে এলো মাছ বিক্রতার কাছে । তরুণ ক্রেতা দাড়িয়ে । বিক্রেতা মাছের ওজন করতে ব্যস্ত । এক হাতে মাছ নিয়ে একটা হাজার টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দেলো তরুণটি। বিক্রেতা নানাভাবে নোটটি পরীক্ষা করার পর ভাংতি টাকা ফেরত দিলো তরুণ ক্রেতাকে । হাসি দিয়ে তরুণটি টাকাগুলো ফেরত নিয়ে চললো আপন পথে ।

ইউসুফকে দেখেই মাছ বিক্রেতা জিজ্ঞেস করলো,

-মাছ দিমু?

-হু। আধা কেজি।

 

মাছ বিক্রেতা মাছের ওজন করছে । আর ইউসুফের করছে ভয় । অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটলে কি হবে? অপমান সহ্য করতে পারবো তো? আচ্ছা ওরা কি আমাকে মারবে? নানা প্রশ্ন তার মনে।

-ভাংতি দিয়েন। বড় নোট ছাড়া কোন টাকা আমার কাছে না।

মাছ বিক্রেতার কথায় স্বম্বিত ফিরলো ইউসুফের । বুক পকেটে হাতড়ে বের করলো চারটি একশ টাকার নোট। দাম মিটিয়ে হাঁফ ছেড়ে মাছ নিয়ে চললো নিজের গন্তব্যে।

একটু দূরেই । ভ্যান গাড়িতে ডিম বিক্রি চলছে । নানা বয়সের মানুষ ডিম বাছাই করছে। নিজ নিজ প্রয়োজন আর পছন্দমতো ডিম বাছাইয়ের পর ভ্যানে বসা দশ বারো বছরের ছোট ছেলেটির আবার তা গুনে দেখছে । সব টিকটাক থাকলেই ডিমের দাম নিচ্ছে । কিছুক্ষণ দাড়িয়ে দাড়িয়ে এ দৃশ্য দেখার পর নানা বুদ্ধি ইউসুফের মাথায় উকিঁ দিতে শুরু করেছে।

টানাটানির সংসারে হাজার টাকার নোটটার যথেষ্ট মূল্য আছে। অন্যের শঠতা কিংবা তার অসাবধানতা। কারণ যাই হোক নোটটি এখন তার । অনেকবার অনেকভাবে ব্যবহার করতে চেয়েও ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা নিয়ে কাছের মানুষগুলো কত হাসাহাসি করেছে , এখনো করছে , হয়তো ভবিষ্যতেও করবে । স্ত্রী প্রতিবারই বাজারে আসার সময় নোটটা পকেটে দিয়ে দেয়। কিন্তু নোটটা তাকে ছেড়ে যেতেই চায় না । কতবার কতভাবে বিদায় করার ফন্দি এটেছে । সবই ব্যর্থ । অর্থ হাত বদল হবে- এটাই নিয়ম। কিন্তু হাজার টাকার এই নোটটাকে হাতবদল করাই যাচ্ছে না।

ভ্যান গাড়িটার সামনে গিয়ে ইউসুফ ডিম বাছাইয়ে লেগে গেল ,

-কয় হালি নিবেন? ছোট বিক্রেতা পাতলা পলিথিনের ব্যাগ দিতে দিতে প্রশ্ন করলো ।

-এক ডজন । ডিম বাছতে বাছতে ইউসুফ জবাব ।

 

এক ডজন ডিম বাছাই শেষে অত্যন্ত দৃয়তার সাথে হাজার টাকা নোটটি ক্ষুদে বিক্রেতার দিকে বাড়িয়ে দিলো। নোটটা রেখে গুনে গুনে বাকি টাকা ফেরত দেবার সময় ইউসুফ সস্নেহে ছোট বিক্রেতাকে বললো, ‘ ১০০ টাকা কম দিও’ । -৩-

-কেন? ছোট বিক্রেতার অবাক প্রশ্ন। এত ছোট বয়সে কাজ করছো। এটা তোমার বকশিশ।

টাকা ফেরত পাবার পর ইউসুফ অবাক।

-একশ টাকা বেশি রাখলে না কেন?

-দোয়া করবেন । তাতেই চলবো । ছোট বিক্রেতার স্বনির্ভর উত্তর।

 

ডিম, মাছ নিয়ে ইউসুফ ফিরলো সেই মুদি দোকানে । পরিচিত মিনতির মাথায় সব বাজার চাপিয়ে চলছে নিজ গন্তব্যে ।

মনের ভেতর কেমন খচ খচ করছে । ছোট বিক্রেতার বড় উত্তর তার পুরো মাথায় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ফিরে এলো আবার ভ্যান গাড়িটার কাছে । ভ্যানের সামনে ভিড় বেড়েছে। ছোট বিক্রেতার অনেক ক্রেতা । এখন সে অনেক ব্যস্ত। ব্যস্ততা কমে এলে ইউসুফ কাছে এগিয়ে কিছু নোট বাড়িয়ে দিলো,

-এই নাও এক ডজন ডিমের দাম। আমার হাজার টাকার নোটটা ফেরত দাও।

ছেলেটা কোন প্রশ্ন না করেই হাজার টাকা নোটটা দিলো ফিরিয়ে ।

ভ্যান গাড়ি থেকে একটু দূরে…. অলস রিকশাওয়ালা বসে বসে সিগারেটে সুখ টান দিচ্ছে । শরবত বিক্রেতা বসে আছে ত্রেতার আশায় । পাশের ছোট দোকানটিতে ডুবো তেলে সিংগারা ভাজা হচ্ছে । কিছু কিছু পথচারী গরম গরম সিংগারা কিনছে ।

আর ইউসুফ ? হাজার টাকার নোটাটা উল্টে পাল্টে বারবার দেখছে । কিভাবে সে ভুল করলো ? কেন ঠকে গেলো? হাজারো প্রশ্নেরা তার মনে ঘুরে বেড়াচ্ছে । অবশেষে……

হাজার টাকার নোটাটা কুচি কুচি করে আকাশের দিকে ছুড়ে দিতে দিতে বিড়বিড় করে বলছে, ‘আমার র্নিবুদ্ধিতা, আমার অক্ষমতা আমারই থাক । যা ক্ষতি হবার তা আমারই হোক অন্য কারো না হোক’ । ছুড়ে দেওয়া নোটের কুচি কুচি টুকরোগুলো মাটির বুক স্পর্শ করার আগেই প্রসন্ন চিত্তে বাড়ির পথে পা বাড়ালো ইউসুফ ।

ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা হাজার টাকার নোটের কুচিগুলো বিস্মিত হয়ে দেখছে অনেকগুলো চোখ । দোকানদার, রিকশাওয়ালা, শরবত বিক্রেতা, পথচারী । একে অন্যের দিকে তাকিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ানো ইউসুফকে দেখিয়ে তারা একযোগে বললো, ‘পাগল’।

সূএ:পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com