ট্যাক্সিচালক থেকে সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান

মোহাম্মদপুরের ‘মোশারফ’ বাহিনীর মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ ওরফে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফ ও তার ৫ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

 

র‍্যাব বলছে, ভোলা থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে কাজের জন্য ঢাকায় আসে মোশাররফ। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি চালাতো। এরপর জড়িয়ে পরে অপরাধ কর্মকাণ্ডে। অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশারফ গ্রুপের সদস্যরা। এবং একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের সন্ত্রাসী দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে তারা বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা করে।

 

শনিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মো. মোশারফ ওরফে লম্বু মোশারফকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে। তার ৫ জন সহযোগী হলো- মো. বিল্লাল ওরফে মো. বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল (৩০) মো. মোহন ওরফে বাইক মোহন (৩১) সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু (৪৪) মো. রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল(৩৩), মো. সুমন মিয়া ওরফে সুমন হোসেন (৩০)।

 

অভিযানের সময় ১টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৩টি বড় ছোরা, ২টি চাপাতি, ২টি চাকু, ১টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি দা, ১টি ফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড ১টি গ্রীল কাটার, ১টি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, ৫টি মোবাইল এবং নগদ অর্থ জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

 

গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, গ্রেপ্তাররা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও তার আশপাশের আমিনবাজার, তুরাগ, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতো। তাদের সন্ত্রাসী দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। লম্বু মোশারফ এর নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এসব এলাকায় জমি দখল, হাউজিং- এ চাঁদাবাজি, নৌপথে চাঁদাবাজি, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত। লম্বু মোশারফের নির্দেশে তার সহযোগীরা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করতো।

 

এছাড়াও লম্বু মোশারফ ও তার সহযোগীরা সাভার ও তুরাগ এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটার মালিকের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করত। তারা মোহাম্মদপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা বিভিন্ন হাউজিং এলাকায় নির্মানাধীন ভবন, নতুন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জমি দখলের নামে চাঁদাবাজি করত। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে লম্বু মোশারফের বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করত, চাঁদা না পেলে তার বাহিনীর সদস্যরা রাতের আধারে নিরাপত্তা কর্মীকে মারধর করে ট্রলার/অন্যান্য বাহনে নির্মাণ কাজের উপকরণাদি জোর করেই নিয়ে যেত।

 

তিনি বলেন, জমি দখল, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা দেশী ও বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দ্বারা সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাত। গাংচিল বাহিনী রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে এক অজানা ভয় ও আতঙ্কের নাম ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাঁধা প্রদান করলে তারা বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা করে।

 

র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশারফ গ্রুপের সদস্যরা একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত। তারা অধিকাংশ সময় নদীর কাছে আস্তানা গড়ে তুলে এবং নদী পথে ডাবল ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ব্যবহার করে যাতায়াত করত। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র, অপহরণসহ বিভিন্ন মামলার তথ্য পাওয়া যায় বলেও জানায় র‍্যাব।

মোশারফের বিভিন্ন নামের কারণ

গ্রেপ্তার মোশারফ হোসেন সম্পর্কে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, সে ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে কাজের জন্য ঢাকায় আসে। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি চালাতো। পরবর্তীতে সে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ২০০০ সালে রাজধানী কাফরুল থানাধীন এলাকায় ছিনতাই এর মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে, গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনার এর মাধ্যমে সে গাংচিল বাহিনীতে প্রবেশ করে এবং পর্যায়ক্রমে সে আনার এর অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হয়।

 

র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, ২০১৭ সালে আনার এর মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনী বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়। এর মধ্যে মূল অংশের নেতৃত্ব প্রদান করত তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড গ্রেপ্তার লম্বু মোশারফ। উচ্চতায় লম্বা হওয়ায় সে ‘লম্বু মোশারফ’ এবং মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সময় ভূক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে ‘গলাকাটা মোশারফ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

 

গ্রেপ্তার লম্বু মোশারফ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকা তুরাগ, আমিনবাজার, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, ভূমিদখলসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সে বিভিন্ন সময়ে মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, কাফরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকত। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশ অ্যাসল্টসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির অধিক মামলা রয়েছে।

যেভাবে নাম হলো চোরা বিল্লাল

খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল ২০০৬ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে পরিবারের সাথে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে সে গার্মেন্টসে চাকুরী ও বিভিন্ন গাড়ীর হেলপার হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় লম্বু মোশারফের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত হয়। সে লম্বু মোশারফের নির্দেশে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভূমি দখল, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাসহ বিভিন্ন সস্ত্রাসী কার্যক্রম করত। সে কারণে ‘চোরা বিল্লাল’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

যেভাবে নাম হলো বাইক মোহন

তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার মোহন ওরফে বাইক মোহন লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী। সে ২০১০ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। সে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি, রাইড শেয়ারিং এর মাধ্যমে মোটরবাইক চালানোর কাজ করত। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেয়। চাঁদা আদায়সহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার সময় লম্বু মোশারফ মোহনের বাইকে চলাচল করত বলে সে বাইক মোহন হিসেবে পরিচিত।

 

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তার সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু লম্বু মোশারফের অন্যতম প্রধান সহযোগী। আগে সাবু মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের সাথে যোগ দেয়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বিভিন্ন ট্রলার, জাহাজ চলাচলের সময় এবং রুট তার নখদর্পনে থাকার কারণে সে জলদস্যু সাবু হিসেবে পরিচিতি পায়। লম্বু মোশারফের নির্দেশে সে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও অপহরণের সাথে জড়িত ছিল।

 

গ্রেপ্তার রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল এরফে ট্রলার রুবেল সম্পর্কে র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, লম্বু মোশারফের গ্রুপের অন্যতম সদস্য। সে ২০০৬ সাল থেকে ট্রলার/নৌকা চালিয়ে জীবন- জাপন শুরু করে। ২০১৮ সালে লম্বু মোশারফের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে সে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি/ডাকাতির সময়ে সে নৌকা বা ট্রলার চালনা করত বলে ট্রলার রুবেল হিসেবে পরিচিত৷

 

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, মো. সুমন মিয়ার জন্ম ঢাকার বাবুবাজার এলাকায়। সে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি ও ডিসের লাইনে চাকরি করত। ২০২০ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরির সময় লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেয়। লম্বু মোশারফ এর নির্দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক সংগ্রহ ও মাদক পৌঁছে দেয়ার কাজ করত বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ২টি মামলা রয়েছে৷

 

গ্রেপ্তার প্রত্যেকেই বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার জেল খেটেছে ও তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় এলাধিক মামলা রয়েছে বলেও জানান র‍্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন ।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» চিনির উৎপাদন বৃদ্ধি সময়ের দাবি- ধর্মমন্ত্রী

» কৃষি জমি রক্ষায় ভূমি জোনিং ও সুরক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত পর্যায়ে – ভূমিমন্ত্রী

» ইসলামপুরে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী উদ্বোধন

» বেসিস নির্বাচনে ওয়ান টিমের প্যানেল ঘোষণা

» জয়পুরহাটে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শন -২০২৪

» বোতলজাত সয়াবিনের দাম বাড়ল, কমল খোলা তেলের

» নানার বাড়িতে শিশুকে গলা কেটে হত্যার অভিযোগে ১জন আটক

» নির্বাচন সুষ্ঠু করতে সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ইসি আলমগীর

» অপপ্রচার রোধে ভারতের সহযোগিতা চাইলো বাংলাদেশ

» উপজেলা নির্বাচনে নেতাদের হস্তক্ষেপ বন্ধে কঠোর নির্দেশনা আ.লীগের : কাদের

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

ট্যাক্সিচালক থেকে সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান

মোহাম্মদপুরের ‘মোশারফ’ বাহিনীর মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ ওরফে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফ ও তার ৫ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

 

র‍্যাব বলছে, ভোলা থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে কাজের জন্য ঢাকায় আসে মোশাররফ। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি চালাতো। এরপর জড়িয়ে পরে অপরাধ কর্মকাণ্ডে। অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশারফ গ্রুপের সদস্যরা। এবং একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের সন্ত্রাসী দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাধা দিলে তারা বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা করে।

 

শনিবার রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে মো. মোশারফ ওরফে লম্বু মোশারফকে (৪৫) গ্রেপ্তার করে। তার ৫ জন সহযোগী হলো- মো. বিল্লাল ওরফে মো. বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল (৩০) মো. মোহন ওরফে বাইক মোহন (৩১) সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু (৪৪) মো. রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল ওরফে ট্রলার রুবেল(৩৩), মো. সুমন মিয়া ওরফে সুমন হোসেন (৩০)।

 

অভিযানের সময় ১টি বিদেশী পিস্তল, ১টি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৩টি বড় ছোরা, ২টি চাপাতি, ২টি চাকু, ১টি চাইনিজ কুড়াল, ১টি দা, ১টি ফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড ১টি গ্রীল কাটার, ১টি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, ৫টি মোবাইল এবং নগদ অর্থ জব্দ করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

 

গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন জানান, গ্রেপ্তাররা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও তার আশপাশের আমিনবাজার, তুরাগ, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতো। তাদের সন্ত্রাসী দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। লম্বু মোশারফ এর নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এসব এলাকায় জমি দখল, হাউজিং- এ চাঁদাবাজি, নৌপথে চাঁদাবাজি, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত। লম্বু মোশারফের নির্দেশে তার সহযোগীরা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য জাহাজ আটকিয়ে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি করতো।

 

এছাড়াও লম্বু মোশারফ ও তার সহযোগীরা সাভার ও তুরাগ এলাকার বিভিন্ন ইট ভাটার মালিকের কাছ থেকে মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করত। তারা মোহাম্মদপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা বিভিন্ন হাউজিং এলাকায় নির্মানাধীন ভবন, নতুন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জমি দখলের নামে চাঁদাবাজি করত। কেউ চাঁদা দিতে রাজি না হলে লম্বু মোশারফের বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভয়-ভীতি প্রদর্শন করত, চাঁদা না পেলে তার বাহিনীর সদস্যরা রাতের আধারে নিরাপত্তা কর্মীকে মারধর করে ট্রলার/অন্যান্য বাহনে নির্মাণ কাজের উপকরণাদি জোর করেই নিয়ে যেত।

 

তিনি বলেন, জমি দখল, চাঁদাবাজি ও অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য তারা দেশী ও বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্রসহ অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দ্বারা সাধারণ মানুষকে ভয় দেখাত। গাংচিল বাহিনী রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের মধ্যে এক অজানা ভয় ও আতঙ্কের নাম ছিল। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের এ অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাঁধা প্রদান করলে তারা বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের উপর হামলা করে।

 

র‍্যাব কর্মকর্তা মঈন বলেন, মোহাম্মদপুরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে লম্বু মোশারফ গ্রুপের সদস্যরা একাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ করত। তারা অধিকাংশ সময় নদীর কাছে আস্তানা গড়ে তুলে এবং নদী পথে ডাবল ইঞ্জিন চালিত ট্রলার ব্যবহার করে যাতায়াত করত। তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, অবৈধ অস্ত্র, অপহরণসহ বিভিন্ন মামলার তথ্য পাওয়া যায় বলেও জানায় র‍্যাব।

মোশারফের বিভিন্ন নামের কারণ

গ্রেপ্তার মোশারফ হোসেন সম্পর্কে র‍্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, সে ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার একটি বিদ্যালয়ে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালে কাজের জন্য ঢাকায় আসে। প্রথমে সে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি চালাতো। পরবর্তীতে সে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। ২০০০ সালে রাজধানী কাফরুল থানাধীন এলাকায় ছিনতাই এর মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে, গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনার এর মাধ্যমে সে গাংচিল বাহিনীতে প্রবেশ করে এবং পর্যায়ক্রমে সে আনার এর অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হয়।

 

র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, ২০১৭ সালে আনার এর মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনী বিভিন্নভাগে বিভক্ত হয়। এর মধ্যে মূল অংশের নেতৃত্ব প্রদান করত তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড গ্রেপ্তার লম্বু মোশারফ। উচ্চতায় লম্বা হওয়ায় সে ‘লম্বু মোশারফ’ এবং মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সময় ভূক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে ‘গলাকাটা মোশারফ’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

 

গ্রেপ্তার লম্বু মোশারফ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে মোহাম্মদপুর ও আশপাশের এলাকা তুরাগ, আমিনবাজার, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভার এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, ভূমিদখলসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সে বিভিন্ন সময়ে মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, কাফরুলসহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মগোপনে থাকত। তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশ অ্যাসল্টসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির অধিক মামলা রয়েছে।

যেভাবে নাম হলো চোরা বিল্লাল

খন্দকার আল মঈন বলেন, গ্রেপ্তার বিল্লাল হোসেন ওরফে চোরা বিল্লাল ২০০৬ সালে মুন্সিগঞ্জ থেকে পরিবারের সাথে ঢাকায় আসে। ঢাকায় এসে সে গার্মেন্টসে চাকুরী ও বিভিন্ন গাড়ীর হেলপার হিসেবে কাজ করে। পরবর্তীতে ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার সময় লম্বু মোশারফের সাথে সু-সম্পর্ক গড়ে উঠে এবং লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী হিসেবে পরিচিত হয়। সে লম্বু মোশারফের নির্দেশে চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ভূমি দখল, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি, হত্যাসহ বিভিন্ন সস্ত্রাসী কার্যক্রম করত। সে কারণে ‘চোরা বিল্লাল’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

যেভাবে নাম হলো বাইক মোহন

তিনি আরও বলেন, গ্রেপ্তার মোহন ওরফে বাইক মোহন লম্বু মোশারফের অন্যতম সহযোগী। সে ২০১০ সালে ভোলা থেকে ঢাকায় এসে বসবাস শুরু করে। সে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি, রাইড শেয়ারিং এর মাধ্যমে মোটরবাইক চালানোর কাজ করত। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে একটি রিয়েল এস্টেটে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেয়। চাঁদা আদায়সহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনার সময় লম্বু মোশারফ মোহনের বাইকে চলাচল করত বলে সে বাইক মোহন হিসেবে পরিচিত।

 

র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তার সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু লম্বু মোশারফের অন্যতম প্রধান সহযোগী। আগে সাবু মোহাম্মদপুর এলাকায় রাজমিস্ত্রীর কাজ করত। ২০১৭ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরির সময়ে লম্বু মোশারফের সাথে যোগ দেয়। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বিভিন্ন ট্রলার, জাহাজ চলাচলের সময় এবং রুট তার নখদর্পনে থাকার কারণে সে জলদস্যু সাবু হিসেবে পরিচিতি পায়। লম্বু মোশারফের নির্দেশে সে বুড়িগঙ্গা নদীতে বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি, ডাকাতি ও অপহরণের সাথে জড়িত ছিল।

 

গ্রেপ্তার রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল এরফে ট্রলার রুবেল সম্পর্কে র‍্যাব মুখপাত্র বলেন, লম্বু মোশারফের গ্রুপের অন্যতম সদস্য। সে ২০০৬ সাল থেকে ট্রলার/নৌকা চালিয়ে জীবন- জাপন শুরু করে। ২০১৮ সালে লম্বু মোশারফের সাথে পরিচয়ের সূত্র ধরে সে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীর বিভিন্ন মালবাহী নৌকা ও ট্রলারে চাঁদাবাজি/ডাকাতির সময়ে সে নৌকা বা ট্রলার চালনা করত বলে ট্রলার রুবেল হিসেবে পরিচিত৷

 

র‍্যাবের এই কর্মকর্তা জানান, মো. সুমন মিয়ার জন্ম ঢাকার বাবুবাজার এলাকায়। সে বিভিন্ন সময়ে গার্মেন্টসে চাকরি ও ডিসের লাইনে চাকরি করত। ২০২০ সালে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরির সময় লম্বু মোশারফের দলে যোগ দেয়। লম্বু মোশারফ এর নির্দেশে বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক সংগ্রহ ও মাদক পৌঁছে দেয়ার কাজ করত বলে জানা যায়। তার বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় মাদক ও চাঁদাবাজি সংক্রান্ত ২টি মামলা রয়েছে৷

 

গ্রেপ্তার প্রত্যেকেই বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার জেল খেটেছে ও তাদের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় এলাধিক মামলা রয়েছে বলেও জানান র‍্যাব মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন ।

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com