সংগৃহীত ছবি
অনলাইন ডেস্ক : ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময়ে গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে দেশের ১৭টি কারাগারে বাইরে থেকে হামলা ও বন্দিদের বিদ্রোহের নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় জঙ্গি থেকে শুরু করে সব শ্রেণির বন্দিরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে কারারক্ষীরা গুলিও চালান। এতে গাজীপুরের হাই সিকিউরিটি ও জামালপুর কারাগারে ১৩ জন বন্দি নিহত হন। ১৭টি কারাগারে আহত হন ২৮২ জন কারারক্ষী।
ওই সময়ে পাঁচটি কারাগার থেকে দুই হাজারের বেশি বন্দি পালিয়ে যান। পরে পালিয়ে যাওয়া অনেক বন্দি কারাগারে ফিরে আসেন। আবার অনেককে গ্রেফতার করা হয়। তবে ওই ঘটনার পর এক বছর পার হলেও এখনও পালিয়ে যাওয়া ৭০০ বন্দিকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
পালিয়ে যাওয়া এসব বন্দির মধ্যে হলি আর্টিজানে হামলাকারীসহ নয়জন দুর্ধর্ষ জঙ্গিও রয়েছেন।
হামলা ও বিদ্রোহের ঘটনার পর দেশের সব কারাগারে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। ভবিষ্যতে বন্দিদের পালিয়ে যাওয়া রোধ করতে দেশের সব কারাগারের সীমানাপ্রাচীর আরও উঁচু করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছে। কারাগার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় গত বছর জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। এর মধ্যে গত বছর ১৯ জুলাই নরসিংদী কারাগারে বাইরে থেকে হামলা ও কারা বিদ্রোহের ঘটনায় পালিয়ে যায় ৮২৬ জন বন্দি। এরপর ওই বছরের ৫ আগস্ট বিটিভিতে শেখ হাসিনার দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ দেখে বেশ কিছু কারাগার থেকে বন্দিরা পালাতে বিক্ষোভ শুরু করেন। এরপর ৬ থেকে ৮ আগস্ট সাতক্ষীরা, কুষ্টিয়া, শেরপুর ও গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকে আরও প্রায় ১২শ’ বন্দি পালিয়ে যান। ওই সময়ে কারাগার থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ থেকে শুরু করে চাল-ডাল পর্যন্ত লুট করা হয়।
কারা সূত্র জানায়, আন্দোলনের সময় হামলা ও বিক্ষোভের ঘটনায় ১৭টি কারাগারের মধ্যে আটটি কারাগার যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর পাঁচটি কারাগার থেকে দুই হাজারের বেশি বন্দি পালিয়ে যান।
পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের মধ্যে জঙ্গি ও মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ৯৮ জন বন্দি রয়েছেন। এর মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত জঙ্গি ছিলেন নয়জন। এ ছাড়া এখনও ৭০ জনের মতো বিচারাধীন জঙ্গি পলাতক রয়েছেন। এছাড়া খোয়া যাওয়া ৯২টি অস্ত্রের মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৫টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এখনও উদ্ধারের বাইরে রয়েছে ২৭টি। আন্দোলনের সময় বিভিন্ন কারাগারে বিশৃঙ্খলায় ২৮২ জন কারারক্ষী আহত হন। তাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখনও ৭০০ জন বন্দি পলাতক রয়েছেন বলে শুক্রবার গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মোহাম্মদ মোতাহের হোসেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় গত বছর ১৯ জুলাই প্রথমে হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করা হয় নরসিংদী কারাগারে। ওই সময় পাঁচজন কারারক্ষী আহত হন। ঘটনার পর অনেক বন্দি আবার কারাগারে ফিরে আসেন। কিন্তু দুই দিন পর্যন্ত তাদের কারাগারে নিয়ে রাখার মতো অবস্থা ছিল না।
এ ঘটনার পর ওই বছর ২৩ জুলাই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কারাগারটি পরিদর্শনে যান। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের জানান, নরসিংদী জেলা কারাগার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া জঙ্গিদের আবারও গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, “নরসিংদী কারাগারে অস্ত্রাগার লুট করা হয়েছে। যেসব জঙ্গি দেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ছিল, পুলিশ বাহিনী যাদের অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আটক করেছিল। এর মধ্যে এখানে নয়জন ছিল। তারাও পালিয়ে গেছে। যেসব জঙ্গি পালিয়েছে, তারা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ছিল। দু’জন নারী জঙ্গিও পালিয়েছে।
সূত্র মতে, কারাগারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ঘটনা ঘটে কাশিমপুর ও জামালপুর কারাগারে। শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। এই পরিস্থিতির মধ্যে ৮ আগস্ট গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বিদ্রোহ করেন বন্দিরা। তারা গেট ভেঙে ও দেয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। বাধ্য হয়ে দেয়াল টপকাতে যাওয়া বন্দিদের ওপর কারারক্ষীরা গুলি চালান। ওই দিন গুলিতে ছয়জন বন্দি নিহত হন। এরপরও কারাগারটি থেকে ২০৯ বন্দি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
একই দিন দুপুরে জামালপুর কারাগারের ভেতর বন্দিরা বিদ্রোহ শুরু করেন। এক পর্যায়ে বন্দিদের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি চালালে এই কারাগারে সাত বন্দির মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় জেলার ও তিন কারারক্ষীসহ আরও ১৯ জন আহত হন।
৭ আগস্ট কুষ্টিয়া জেলা কারাগার ফটকের তালা ভেঙে শতাধিক বন্দি পালিয়ে যান। বন্দিদের মারধরে অন্তত ২৫ কারারক্ষী আহত হন।
অন্যদিকে ৭ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঘিরে আটক হওয়া আসামিরা রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে সিরাজগঞ্জ কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার সময় অন্য বন্দিরাও মুক্ত হওয়ার জন্য কারা অভ্যন্তরে বিক্ষোভ শুরু করেন, যা ছিল নজিরবিহীন ঘটনা।
হাই সিকিউরিটি কারাগারে যা ঘটেছিল
জানা গেছে, গত বছর ৬ আগস্ট সকালে নানা অনিয়ম ও বন্দিদের মারধরের অভিযোগ তুলে এবং মুক্তির দাবিতে কয়েক শ’ বন্দি বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে কারারক্ষীদের জিম্মি করেন তারা। কারারক্ষীরা তাদের শান্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে বন্দিরা দেয়াল টপকে বেরিয়ে যেতে থাকেন। তখন কারারক্ষীরা গুলি চালান। এতে ছয় বন্দি নিহত হন।
যা ঘটেছিল জামালপুর কারাগারে
গত বছর ৮ আগস্ট দুপুর ২টার পর জামালপুর জেলা কারাগারে থাকা বন্দিরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে মারামারি শুরু করেন। তাদের একটি পক্ষ মুক্তির জন্য বিদ্রোহ করে। ওই সময় কারারক্ষীদের ওপর আক্রমণ করেন তারা। এক পর্যায়ে তারা কারাগারে আগুন দেন। কারাগারের একটি গেটও ভেঙে ফেলেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কারারক্ষীরা গুলি চালালে সাতজন নিহত হন। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ