চাকরিচ্যুত পুলিশের নেতৃত্বে ভুয়া চক্র

গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের অনুসরণ করতে থাকেন। এমনকি তাদের লক্ষ্যবস্তুতে থাকেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও। একপর্যায়ে মামলা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান সব কিছু লুট করে নেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এমন ভুয়া ডিবির সংখ্যা সারা দেশে দুই শতাধিক। তবে এসব চক্র চলে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরিচ্যুত এসব পুলিশের মধ্যে আছেন- এসআই জাহাঙ্গীর, ভূঁইয়া রাসেদুল আলম, এএসআই সোহরাব, কনস্টেবল গোলাম মোস্তফা শাহীন ও কামরুজ্জামান। ভুয়া পুলিশের নেতৃত্বে থাকা এসব চাকরিচ্যুত পুলিশের সংখ্যা সারা দেশে প্রায় ৩০ জন। সারা দেশেই বিস্তৃত রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। এতে ম্লান হয়ে যাচ্ছে পুলিশের ইমেজ। শুধু পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির কারণেই নয়, বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের অনেক সদস্যকে সাজা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, ২০১৭ সাল থেকে গত বছর আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের ৯ হাজার ৮০০টি গুরুদন্ড দেওয়া হয়েছে।

 

তবে ভুয়া পুলিশের মধ্যে জসিম মোল্লা (৩৫) একজন। পুলিশের সদস্য না হয়েও নিজেকে পরিচয় দিতেন পুলিশের এসআই। পুলিশের পোশাক পরে এসআই পরিচয়ে বড় বড় ব্যবসায়ীকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। শুধু তা-ই নয়, তার একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা ঢাকা, নরসিংদী, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ছদ্মবেশে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ ডাকাতি করতেন।

 

গত বছর ৯ নভেম্বর জসিম মোল্লাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার সহযোগী জাহিদুল কাজী ও ইয়াসিন নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।

 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন মামলা পর্যালোচনা করে গত পাঁচ বছরে ভুয়া ডিবির অভিযোগে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে।

 

তারা হলেন- দুলাল হোসেন, ইব্রাহীম মিয়া, বাদশা মন্ডল, আবুল কাশেম গাজী, নুর ইসলাম শেখ, শহিদুল ইসলাম, রিয়াদ আহম্মেদ, জাকির হোসেন, বাবু মিয়া, সাইফুল ইসলাম, ফজল মিয়া, মাসুদ করিম, কামরুল ইসলাম, কবির তালুকদার, কাওসার, রায়হান, শাহ আলম, আবদুর রহমান সাজ্জাদ, বাবলু, আল আমিন, আবদুল হান্নান, মো. আলী, উজ্জ্বল, মামুন হাসান শাহীন, শহীদ মিয়া, আবদুল ছগির, কামরুল শেখ, লাবলু, আবুল কালাম আজাদ, সৈয়দ আহম্মেদ শহীদ, জাহিদুল ইসলাম জিহাদ, আলী, জসিম উদ্দিন, জমির, ইয়াছিন, সবুজ, শহিদুল ইসলাম, আবদুল মালেক, সোহাগ, বাবু, শাহ আলম, বাবুল, সবুজ খান, মিন্টু পাটোয়ারী, রাসেল মোল্লা, ইকবাল মিয়া, মনিরুল ইসলাম, খোকন মিয়া, খাইরুল আলম, ফারুক, ইলিয়াস, ফয়সাল ইসলাম, সোহান শিকদার, খন্দকার লতিফুল হক, তানভীর, সাজিদ আহমেদ রাসেল, আফসার হোসেন বাবু, এনজেল স্যামুয়েল কস্তা, হারুন, জোবায়ের হোসেন পারভেজ, আরিফ হোসেন, খোকন চন্দ্র দেবনাথ, ফরিদ উদ্দিন, পারভেজ, সাইফুল ই নাদিম, শফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুল, জসিম, নাছির, আশিকুর রহমান, শাহ মো. দোজাহান, মিঠুন, হাবিবুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, নয়ন মোল্লা, সুসেন মিত্র, শাহাদৎ হোসেন, সাইদ মনির আল মাহমুদ, রুবেল ইসলাম, জাকির হোসেন ও পীযূষ সুর। পীযূষ আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সিপাহি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন। চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরটি একটি। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন খান। তাঁতীবাজার থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে পাঠাও মোটরসাইকেলে নিউমার্কেটের উদ্দেশে রওনা হন গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর। পথে দুজন মোটরসাইকেলে ওই ব্যবসায়ীকে অনুসরণ করেন। ওই দিন বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের মূল প্রবেশগেটের সামনে আসামাত্র একটি প্রাডো জিপ মহিউদ্দিনকে বহনকারী মোটরসাইকেল ব্যারিকেড দেয়। গাড়ির ভিতর থেকে তিনজন নেমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে মহিউদ্দিনকে জাপটে গাড়িতে তুলে নেয়। তার সঙ্গে থাকা নগদ ২০ লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে কেরানীগঞ্জ এলাকার একটি নির্জন স্থানে তাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এই ফিল্মি স্টাইলের পুরো ঘটনায় নেতৃত্ব দেন গোলাম মোস্তফা শাহীন ওরফে শাহীন পুলিশ নামে চাকরিচ্যুত এক পুলিশ সদস্য।

 

জানা যায়, ২০০৮ সালে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে চাকরিচ্যুত হন সাবেক এই কনস্টেবল। এরপর জড়িয়ে পড়েন ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে। ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের শান্তিপুরে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হন ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন সায়মন। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ইসরাইল হোসেন দেশে-বিদেশে দীর্ঘ চিকিৎসার পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। ওই ঘটনায় খিলগাঁও থানায় করা মামলাটি পরে ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী ইসরাইল হোসেন ও তার ছেলে শরীফ হোসেন সায়মনকে হত্যা করে ৩৮ লাখ টাকা লুট করার মামলায় তিনজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে চার্জশিট দেয় পুলিশ। যে তিনজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয় তাদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা শাহীন ওরফে শাহীন পুলিশের নামও ছিল। অন্য দুজন ছিলেন সিরাজুল ইসলাম শাহীন ওরফে শুটার শাহীন ও কাজী সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী থানায় একটি মামলা করেন শফিউল আজাদ নামে এক ব্যক্তি। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে পাঁচ-ছয়জন লোক র‌্যাব পরিচয়ে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এরপর তার কাছ থেকে মূল্যবান সব কিছু নিয়ে রাজধানীর ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে তারা মাওয়া রোডের নিমতলা এলাকায় তাকে নামিয়ে দেয়।

 

২০২১ সালের ২২ আগস্ট মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করেন ওয়ারী থানার এসআই হারুন অর রশিদ। চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয় ডিবিতে কর্মরত এসআই ভূঁইয়া রাসেদুল আলম, এসআই জাহাঙ্গীর আলম এবং এএসআই সোহরাব হোসেনকে। এদের মধ্যে সোহরাব পলাতক। তাদের সহযোগী রিপন গাজী, মুক্তার হোসেন, আশিক ইকবাল খান ওরফে রাজীব, রাসেল আহম্মেদ মোল্লা, শরিফুল ইসলাম সাগর ও শফিক ওরফে তুহিনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে।

 

ভুয়া ডিবির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কেউ ডিবি বললেই তাদের গাড়িতে উঠবেন না, আগে যাচাই করবেন। প্রয়োজনে আশপাশের মানুষের সহযোগিতা নেবেন।

 

সব অপকর্মে জড়িত তারা : শুধু পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই আর ডাকাতি নয়, অন্য সব অপকর্মেও পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট রাতে ডিবির তৎকালীন পশ্চিম বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মজিবর রহমানের কক্ষের ড্রয়ার ভেঙে ৫ হাজার পিস ইয়াবা চুরি হয়। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি মামলা করেন ডিবি পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক শাহাবুদ্দিন খলিফা। পরে চুরির অভিযোগে কনস্টেবল সোহেল রানাকে (৩৮) গ্রেফতার করা হয়। সোহেল রানা ১৮ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করে আসছিলেন। কয়েক বছর ধরে তিনি ডিবি কার্যালয়ের তৎকালীন উত্তরা জোনাল টিমের এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লুর অধীনে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের কাকনা গ্রামে।

 

একই বছর ১৯ এপ্রিল ঢাকার সাভারে সহযোগীসহ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক কনস্টেবল ৯৯০ পিস ইয়াবাসহ ঢাকা জেলা ডিবি (উত্তর) পুলিশের হাতে আটক হন। গত বছর ১৮ জুলাই গাবতলী বাস টার্মিনালে ডিবি পরিচয়ে সোনার দোকানের এক কর্মচারীর কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই করেন রূপনগর থানার এএসআই জাহিদুল ইসলাম ও এসআই মাসুদুর রহমান।

 

২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গাবতলী থেকে অস্ত্র, গুলি ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ জলিল মাতুব্বর নামে এক এসআইকে গ্রেফতার করে দারুস সালাম থানা পুলিশ। এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, শুধু পুলিশ নয়, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতিবাচক বিষয়গুলো ওই প্রতিষ্ঠানের খারাপ দিক হয়ে থাকে। পুলিশের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটানো নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকে এগুলো হয়ে আসছে। পুলিশ প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে কিছু তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটন করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়া দরকার। কেউ ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কারও কাছে এলে ৯৯৯-এ ফোন দেওয়া, ওই এলাকায় হইচই বাধিয়ে দেওয়া কিংবা যে গাড়িতে ওই লোকগুলো আসছে সেই গাড়ির নম্বর সংগ্রহ করে রাখা প্রয়োজন।

সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» পুলিশ শুধু আইনশৃঙ্খলায় নয়, মানবিকতায়ও নজির স্থাপন করেছে: হাবিবুর রহমান

» নেতাদের মুক্তি চেয়ে রিজভীর নেতৃত্বে মিছিল

» ৭ আইনজীবীর আদালত অবমাননার আদেশ বুধবার

» উপজেলায় সুষ্ঠু ভোট করতে সিইসির নেতৃত্বে ইসিতে বৈঠক

» দেশি-বিদেশি চক্র নির্বাচিত সরকারকে হটানোর চক্রান্ত করছে : কাদের

» বাংলাদেশ-কাতারের মধ্যে ১০ চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই

» মেহজাবীন ও সিয়ামের দ্বন্দ্ব!

» মাইক্রোবাসের ধাক্কায় রিকশাচালক যুবক নিহত

» বাংলাদেশের ভাবমূর্তি নষ্টের অপতৎপরতা সফল হবে না: নানক

» আগামীকাল ১২ ঘণ্টা গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

চাকরিচ্যুত পুলিশের নেতৃত্বে ভুয়া চক্র

গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে তারা বিভিন্ন ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তিদের অনুসরণ করতে থাকেন। এমনকি তাদের লক্ষ্যবস্তুতে থাকেন স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাও। একপর্যায়ে মামলা ও ভয়ভীতি দেখিয়ে মূল্যবান সব কিছু লুট করে নেন তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, এমন ভুয়া ডিবির সংখ্যা সারা দেশে দুই শতাধিক। তবে এসব চক্র চলে চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরিচ্যুত এসব পুলিশের মধ্যে আছেন- এসআই জাহাঙ্গীর, ভূঁইয়া রাসেদুল আলম, এএসআই সোহরাব, কনস্টেবল গোলাম মোস্তফা শাহীন ও কামরুজ্জামান। ভুয়া পুলিশের নেতৃত্বে থাকা এসব চাকরিচ্যুত পুলিশের সংখ্যা সারা দেশে প্রায় ৩০ জন। সারা দেশেই বিস্তৃত রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। এতে ম্লান হয়ে যাচ্ছে পুলিশের ইমেজ। শুধু পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতির কারণেই নয়, বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের অনেক সদস্যকে সাজা দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র বলছে, ২০১৭ সাল থেকে গত বছর আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন অভিযোগে পুলিশ সদস্যদের ৯ হাজার ৮০০টি গুরুদন্ড দেওয়া হয়েছে।

 

তবে ভুয়া পুলিশের মধ্যে জসিম মোল্লা (৩৫) একজন। পুলিশের সদস্য না হয়েও নিজেকে পরিচয় দিতেন পুলিশের এসআই। পুলিশের পোশাক পরে এসআই পরিচয়ে বড় বড় ব্যবসায়ীকে বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেইল করে হাতিয়ে নিতেন মোটা অঙ্কের টাকা। শুধু তা-ই নয়, তার একটি গ্রুপ রয়েছে, যারা ঢাকা, নরসিংদী, শরীয়তপুর ও মুন্সীগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের ছদ্মবেশে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ ডাকাতি করতেন।

 

গত বছর ৯ নভেম্বর জসিম মোল্লাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। তার সহযোগী জাহিদুল কাজী ও ইয়াসিন নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করা হয়।

 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন মামলা পর্যালোচনা করে গত পাঁচ বছরে ভুয়া ডিবির অভিযোগে যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের কয়েকজনের নাম পাওয়া গেছে।

 

তারা হলেন- দুলাল হোসেন, ইব্রাহীম মিয়া, বাদশা মন্ডল, আবুল কাশেম গাজী, নুর ইসলাম শেখ, শহিদুল ইসলাম, রিয়াদ আহম্মেদ, জাকির হোসেন, বাবু মিয়া, সাইফুল ইসলাম, ফজল মিয়া, মাসুদ করিম, কামরুল ইসলাম, কবির তালুকদার, কাওসার, রায়হান, শাহ আলম, আবদুর রহমান সাজ্জাদ, বাবলু, আল আমিন, আবদুল হান্নান, মো. আলী, উজ্জ্বল, মামুন হাসান শাহীন, শহীদ মিয়া, আবদুল ছগির, কামরুল শেখ, লাবলু, আবুল কালাম আজাদ, সৈয়দ আহম্মেদ শহীদ, জাহিদুল ইসলাম জিহাদ, আলী, জসিম উদ্দিন, জমির, ইয়াছিন, সবুজ, শহিদুল ইসলাম, আবদুল মালেক, সোহাগ, বাবু, শাহ আলম, বাবুল, সবুজ খান, মিন্টু পাটোয়ারী, রাসেল মোল্লা, ইকবাল মিয়া, মনিরুল ইসলাম, খোকন মিয়া, খাইরুল আলম, ফারুক, ইলিয়াস, ফয়সাল ইসলাম, সোহান শিকদার, খন্দকার লতিফুল হক, তানভীর, সাজিদ আহমেদ রাসেল, আফসার হোসেন বাবু, এনজেল স্যামুয়েল কস্তা, হারুন, জোবায়ের হোসেন পারভেজ, আরিফ হোসেন, খোকন চন্দ্র দেবনাথ, ফরিদ উদ্দিন, পারভেজ, সাইফুল ই নাদিম, শফিকুল ইসলাম ওরফে বাবুল, জসিম, নাছির, আশিকুর রহমান, শাহ মো. দোজাহান, মিঠুন, হাবিবুর রহমান, শরিফুল ইসলাম, নয়ন মোল্লা, সুসেন মিত্র, শাহাদৎ হোসেন, সাইদ মনির আল মাহমুদ, রুবেল ইসলাম, জাকির হোসেন ও পীযূষ সুর। পীযূষ আগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সিপাহি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০১৭ সালে তিনি সেখান থেকে চাকরিচ্যুত হন। চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্যদের নেতৃত্বে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরটি একটি। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার একজন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন খান। তাঁতীবাজার থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে পাঠাও মোটরসাইকেলে নিউমার্কেটের উদ্দেশে রওনা হন গত বছর ৩ সেপ্টেম্বর। পথে দুজন মোটরসাইকেলে ওই ব্যবসায়ীকে অনুসরণ করেন। ওই দিন বেলা ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের মূল প্রবেশগেটের সামনে আসামাত্র একটি প্রাডো জিপ মহিউদ্দিনকে বহনকারী মোটরসাইকেল ব্যারিকেড দেয়। গাড়ির ভিতর থেকে তিনজন নেমে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে মোটরসাইকেল থেকে মহিউদ্দিনকে জাপটে গাড়িতে তুলে নেয়। তার সঙ্গে থাকা নগদ ২০ লাখ টাকা ও মোবাইল ফোন সেট ছিনিয়ে নেয় তারা। পরে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পাশে কেরানীগঞ্জ এলাকার একটি নির্জন স্থানে তাকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এই ফিল্মি স্টাইলের পুরো ঘটনায় নেতৃত্ব দেন গোলাম মোস্তফা শাহীন ওরফে শাহীন পুলিশ নামে চাকরিচ্যুত এক পুলিশ সদস্য।

 

জানা যায়, ২০০৮ সালে বিভিন্ন অপকর্মের কারণে চাকরিচ্যুত হন সাবেক এই কনস্টেবল। এরপর জড়িয়ে পড়েন ডাকাতি ও ছিনতাইয়ে। ২০১৪ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের শান্তিপুরে ছিনতাইকারীদের গুলিতে নিহত হন ব্যবসায়ী শরীফ হোসেন সায়মন। একই ঘটনায় গুলিবিদ্ধ ইসরাইল হোসেন দেশে-বিদেশে দীর্ঘ চিকিৎসার পর ২০১৬ সালের ১ এপ্রিল রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। ওই ঘটনায় খিলগাঁও থানায় করা মামলাটি পরে ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়। মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী ইসরাইল হোসেন ও তার ছেলে শরীফ হোসেন সায়মনকে হত্যা করে ৩৮ লাখ টাকা লুট করার মামলায় তিনজনের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালে চার্জশিট দেয় পুলিশ। যে তিনজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয় তাদের মধ্যে গোলাম মোস্তফা শাহীন ওরফে শাহীন পুলিশের নামও ছিল। অন্য দুজন ছিলেন সিরাজুল ইসলাম শাহীন ওরফে শুটার শাহীন ও কাজী সিরাজুল ইসলাম সিরাজ। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীর ওয়ারী থানায় একটি মামলা করেন শফিউল আজাদ নামে এক ব্যক্তি। মামলায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন, ২০১৯ সালের ৫ ডিসেম্বর ওয়ারীর টিপু সুলতান রোডে পাঁচ-ছয়জন লোক র‌্যাব পরিচয়ে তাকে মাইক্রোবাসে তুলে নেয়। এরপর তার কাছ থেকে মূল্যবান সব কিছু নিয়ে রাজধানীর ডেমরাসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে তারা মাওয়া রোডের নিমতলা এলাকায় তাকে নামিয়ে দেয়।

 

২০২১ সালের ২২ আগস্ট মামলাটির চার্জশিট আদালতে দাখিল করেন ওয়ারী থানার এসআই হারুন অর রশিদ। চার্জশিটে অভিযুক্ত করা হয় ডিবিতে কর্মরত এসআই ভূঁইয়া রাসেদুল আলম, এসআই জাহাঙ্গীর আলম এবং এএসআই সোহরাব হোসেনকে। এদের মধ্যে সোহরাব পলাতক। তাদের সহযোগী রিপন গাজী, মুক্তার হোসেন, আশিক ইকবাল খান ওরফে রাজীব, রাসেল আহম্মেদ মোল্লা, শরিফুল ইসলাম সাগর ও শফিক ওরফে তুহিনকেও অভিযুক্ত করা হয়েছে।

 

ভুয়া ডিবির বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, ‘কেউ ডিবি বললেই তাদের গাড়িতে উঠবেন না, আগে যাচাই করবেন। প্রয়োজনে আশপাশের মানুষের সহযোগিতা নেবেন।

 

সব অপকর্মে জড়িত তারা : শুধু পুলিশ পরিচয়ে ছিনতাই আর ডাকাতি নয়, অন্য সব অপকর্মেও পুলিশ সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০১৯ সালের ১৬ আগস্ট রাতে ডিবির তৎকালীন পশ্চিম বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মজিবর রহমানের কক্ষের ড্রয়ার ভেঙে ৫ হাজার পিস ইয়াবা চুরি হয়। এ ঘটনায় রমনা থানায় একটি মামলা করেন ডিবি পুলিশের তৎকালীন পরিদর্শক শাহাবুদ্দিন খলিফা। পরে চুরির অভিযোগে কনস্টেবল সোহেল রানাকে (৩৮) গ্রেফতার করা হয়। সোহেল রানা ১৮ বছর ধরে পুলিশে চাকরি করে আসছিলেন। কয়েক বছর ধরে তিনি ডিবি কার্যালয়ের তৎকালীন উত্তরা জোনাল টিমের এডিসি বদরুজ্জামান জিল্লুর অধীনে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি মানিকগঞ্জের দৌলতপুরের কাকনা গ্রামে।

 

একই বছর ১৯ এপ্রিল ঢাকার সাভারে সহযোগীসহ পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) এক কনস্টেবল ৯৯০ পিস ইয়াবাসহ ঢাকা জেলা ডিবি (উত্তর) পুলিশের হাতে আটক হন। গত বছর ১৮ জুলাই গাবতলী বাস টার্মিনালে ডিবি পরিচয়ে সোনার দোকানের এক কর্মচারীর কাছ থেকে স্বর্ণালঙ্কার ছিনতাই করেন রূপনগর থানার এএসআই জাহিদুল ইসলাম ও এসআই মাসুদুর রহমান।

 

২০২০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর গাবতলী থেকে অস্ত্র, গুলি ও বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ জলিল মাতুব্বর নামে এক এসআইকে গ্রেফতার করে দারুস সালাম থানা পুলিশ। এ বিষয়ে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ বলেন, শুধু পুলিশ নয়, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের নেতিবাচক বিষয়গুলো ওই প্রতিষ্ঠানের খারাপ দিক হয়ে থাকে। পুলিশের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন অপকর্ম ঘটানো নতুন কিছু নয়। অনেক আগে থেকে এগুলো হয়ে আসছে। পুলিশ প্রতিটি ঘটনা তদন্ত করে কিছু তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটন করে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়া দরকার। কেউ ডিবি পুলিশ পরিচয়ে কারও কাছে এলে ৯৯৯-এ ফোন দেওয়া, ওই এলাকায় হইচই বাধিয়ে দেওয়া কিংবা যে গাড়িতে ওই লোকগুলো আসছে সেই গাড়ির নম্বর সংগ্রহ করে রাখা প্রয়োজন।

সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

 

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com