গন্তব্য ২০৪১

শেখ সারহান নাসের তন্ময় : কথায় আছে শিকড় ছেড়ে শিখরে ওঠা যায় না। ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের প্রগতিসম্পন্ন আগামীর কথা বলতে গেলে এ স্বপ্নযাত্রার গোড়ার কথা তথা ধারাবাহিক বিবর্তনের কথা বলতে হবে। আমরা জানি, শোষিত-বঞ্চিত- নিপীড়িত বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস হাজার বছরের। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব বাঙালির সেই অনন্ত সংগ্রামেরই সৃষ্টি। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, এরপর জাতির পিতা সৃষ্টি হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে, অধিকারহারা মানুষের ন্যায্যতা নিশ্চিতের অভিপ্রায়ে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাবসানের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক পৃথক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণ ও সমীকরণ তৈরি হয়। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানে বাঙালি জাতিসত্তার অক্ষুণœতা বজায় রাখতে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে উদ্যোগের অগ্রভাগে ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব। শ্বাপদসংকুল পথ পেরিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পথে। জাতির পিতার হাত ধরে যে রাষ্ট্রের জন্ম ও পথচলা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ হত্যাকা- এবং ’৭৫-পরবর্তী সময়ে সেই রাষ্ট্র ন্যুব্জ হয়ে যায় খন্দকার মোশতাক-জিয়া-এরশাদদের দুঃশাসন ও স্বৈরশাসনে। ধ্বস্তবিধ্বস্ত সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শুরু করলেন এক নতুন লড়াই। যে লড়াইয়ের শুরু ১৯৮১-তে এবং সে লড়াইয়ের লক্ষ্য ২০৪১।

 

আগের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। দেশভাগের পরে তরুণ নেতা শেখ মুজিব খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সহাবস্থান সম্ভব নয়। প্রথমত নৃতাত্ত্বিক ও জাতিসাত্তিক বৈপরীত্য, দ্বিতীয়ত বাঙালিয়ানার ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানি আগ্রাসন। সেজন্য প্রথমেই তিনি বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। একদিকে প্রতিটি সভা-সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলার লেখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করার দাবি উত্থাপন করতে থাকেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গোছাতে থাকেন। তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তমুদ্দন মজলিস, ছাত্রলীগ ও অন্যান্যের সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিব গণস্বাক্ষর কার্যক্রমেও যেমন অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনিভাবে রাজপথে মিছিল করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে একটানা ১২ দিন তিনি আমরণ অনশনও করেছেন, কারাগারে বসে আন্দোলনের দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনের পুরোভাগে ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ২১টি প্রতিশ্রুতির প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে। নবীন সংসদ সদস্য শেখ মুজিব ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে সংসদের কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণের দাবি পেশ করেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণয়ন এবং ১৯৭৫ সালে দাফতরিক কাজে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলনবিষয়ক পরিপত্র জারি করেন।

 

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের মাঝেই বাঙালির আরেকটি বিজয় হচ্ছে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকবর্তিকা শেখ মুজিব ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পথে জনতা, সংগঠন, দল সর্বোপরি দেশকে প্রস্তুত করছিলেন। তিনি বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে রূপায়ণ করেছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘ছয় দফা’ দাবি উত্থাপন করেন, যেটি আমাদের মুক্তির সনদ, বাঁচার দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার ছয় দফা দাবি আমাদের স্বাধীনতার পথ সুগম করেছিল, গণমানুষের মাঝে স্বাধিকারবোধ জাগ্রত করেছিল। এরপর শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় আইয়ুব শাসনবিরোধী ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বীরের বেশে মুক্ত হন শেখ মুজিব। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক সংবর্ধনাসভায় ছাত্র-জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালির মুক্তির রূপকল্প প্রদান করেন। সে বছরের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। এরপর সত্তরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু অখ- পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন। তবু যখন ইয়াহিয়া-ভুট্টোর অপরাজনীতি, অপকৌশল থামল না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বিজয়ী একমাত্র দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না, তখন বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক স্বাধীনতার পথ বেছে নিলেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি ‘জাতির জনক’ ঘোষণা করল। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বিশ্বকাঁপানো ভাষণ প্রদান করলেন। সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রণতূর্য উদিত হলো। অনিবার্য হয়ে পড়ল মুক্তির যুদ্ধ। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করলেন। শুরু হলো বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ।

 

৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, তা পূর্ণতা পেল ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে; যিনি ২২৮ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনে ফিরে এসেছেন বিজয়ের বারতা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল থেকেই স্বাধীনতার সংগ্রামকে দেশ গঠনের সংগ্রামে রূপান্তর করলেন। প্রণয়ন করলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত বাহাত্তরের সংবিধান। যার মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য যে পথ ও মতকে সঠিক বলে বিশ্বাস করেছিলেন তার সমন্বিত রূপ হচ্ছে বাহাত্তরের সংবিধান তথা এর মূলনীতি। এই নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রাতিস্বিক লক্ষ্য ছিল অসামান্য। মানবিক, স্বাবলম্বী ও কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়াসে বঙ্গবন্ধুর এরূপ রাষ্ট্রদর্শন সামগ্রিকভাবে ‘মুজিববাদ’ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিসত্তার অক্ষুণœতা ও বিকাশের প্রয়োজনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নীতি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যুগপৎ ও একমুখী যাত্রার মধ্য দিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রদর্শনের প্রবর্তন করেছিলেন। গণতন্ত্রের মাঙ্গলিক অভিযাত্রার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে মডেল রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার, ধর্মের দোহাই দিয়ে সামাজিক বিভেদ, সবকিছুকে ধর্মীয় রং দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং পরধর্ম-পরমত সহিষ্ণু রাষ্ট্র বিনির্মাণের নীতি গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ জুন নোয়াখালীর মাইজদিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে এটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তা-ই থাকবে; তাই আমি আশা করি।

 

বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থব্যবস্থা একটি মজবুত ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশি ব্যাংক, জীবনবীমা, সাধারণ বীমা, পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকল, বাংলাদেশ বিমান ও জাহাজ করপোরেশনসহ বিভিন্ন বিকল প্রতিষ্ঠান সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সব ধরনের বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর Economic Policy সম্পর্কে অসাধারণ একটি ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।’ কৃষিজীবী ও কৃষি-উৎপাদন নির্ভর বাংলাদেশে একটি Sustainable Agricultural System নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি উপকরণ বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ, কৃষিপণ্যে ভর্তুকি, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা মওকুফ, গবাদি পশু বিতরণ, লবণশিল্পকে কর অব্যাহতিসহ নানামাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর নীতি ও কৌশলগুলোর কার্যকারিতা বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের Per capita Income Ges Gross Domestic Product-এর গ্রাফটা দেখলে সহায়ক হয়। যেমন ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় ছিল ১৫২ মার্কিন ডলার এবং সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ৯৪ মার্কিন ডলার। তবে মাত্র তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক লিডারশিপে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় গিয়ে পৌঁছায় ২৭৮ মার্কিন ডলারে এবং পাকিস্তানের ১৬৮ মার্কিন ডলার। জিডিপির ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পাকিস্তানের ৯.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই জিডিপি ১৯৭৫ সালে গিয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের ১৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ১১.৩৪ বিলিয়ন ডলার।

 

স্বাধীনতার পর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি তথা বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে Geo- politically important এবং Geo-strategically Strong হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনৈতিক বিচক্ষণতায় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পায় এবং জাতিসংঘ, ওআইসি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, আইএলও, আইএমএফ, আইবিআরডি, ইউনেস্কোসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে অতি অল্প সময়ে। ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি, ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি বঙ্গবন্ধুর win-win negotiation-এর একটি প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। নয়া বিশ্বব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু শান্তির সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানব জাতির অস্তিত্ব নির্ভর করে শান্তির ওপর। সমগ্র বিশ্বে মানুষের গভীরতম আকাক্সক্ষা হচ্ছে শান্তি। শান্তি স্থায়ী হতে পারে কেবল ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে।… আমি সমগ্র পৃথিবীকে দেখাতে চাই যে, বাঙালি শুধু রক্ত দিতে জানে না, শান্তিকামী বাঙালি জানে কীভাবে শান্তি বজায় রাখতে হয়।’ বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের মধ্যকার শীতল যুদ্ধে সমাজতন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং সব জাতির সমমর্যাদা নীতিতে আগ্রহী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির প্রধানতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুবার কূটনৈতিকভাবে পরাজিত করেছেন। আমেরিকার প্রথম কূটনৈতিক পরাজয় হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং দ্বিতীয়বার পরাজয় হয় বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক রাখতে তাদেরই আগে প্রস্তাব নিয়ে আসতে হয়েছিল বাংলাদেশে। টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক মি. স্টুয়ার্টকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে বলেছিলেন, ‘কিন্তু তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। আমি স্বীকৃতি চাই এবং যদি সম্পর্ক আরও উন্নত করতে হয় তাহলে মার্কিন সরকারকে বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। মার্কিন জনগণের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি সাহায্য চাই, কিন্তু কোনো শর্ত যুক্ত থাকবে না।

 

দেশের এমন উড্ডয়নকালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশকে ভূপাতিত করল দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি। এক অন্ধকার যুগে নিক্ষিপ্ত হলো বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি। লুণ্ঠিত হলো মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রাধিকার, ভোটাধিকার। এমন পরিস্থিতে নিশ্চিত মৃত্যুর সব সম্ভাবনা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশে ফেরার আগে আমেরিকান সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজউইককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ এ দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রয়াসে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেকে নিয়োজিত করলেন অসীম সাহসী সংগ্রামে। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে চলমান সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনীতি ও জননীতি বাস্তবায়ন করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু যে অভিলক্ষ্যে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা অর্জিত হয়েছে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। আজকের পদ্মা সেতুও ছিল বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য-অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত প্রবলভাবে প্রতীয়মান উত্তরবঙ্গের মঙ্গা আজ জাদুঘরে চলে গেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি মান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে Millennium Development Goal, Sustainable Development Goal  যেমন অর্জন করছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব উন্নয়ন দর্শন হিসেবে ভিশন ২০২১ অর্জন করে ভিশন ২০৪১ পূরণের অভিযাত্রায় রয়েছে।

 

তবু মাঝে মাঝে বাংলাদেশ থমকে দাঁড়ায় দেশি ও আন্তর্জাতিক অপশক্তির অনভিপ্রেত থাবায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকূল শক্তি, মৌলবাদী শক্তিগুলো এক হয়ে দেশকে আবারও নিয়ে যেতে চায় গহিন অন্ধকারে। তাদের পেছনে শ্যাডো-পাওয়ার হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক কুশীলবরা। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনভিপ্রেত বৈদেশিক হস্তক্ষেপ হয়েছে অগণতান্ত্রিক শক্তি (মোশতাক-জিয়ার শাসন), ধর্মান্ধ অপশক্তি (জামায়াত) এবং কৃত্রিম জাতীয়তাবাদী (জিয়ার দর্শন-বিএনপির শাসন) শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর অভিপ্রায়ে। কূটনীতিরও একটি গ্র্যামার আছে, বিধি-পরিধি আছে। হাতে গোনা দু-একটি পরাশক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা তাদের সেই Diplomatic jurisdiction ভুলে যান বা অতিক্রম করে ফেলেন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এই যুগে যেটি মোটেও কাম্য নয়। দেশের ভিতরে ভিন্ন রাজনৈতিক মত-পথ-দর্শন থাকবে। সহনশীল মাত্রায় রাজনৈতিক বিরোধও থাকবে। সেগুলো আমরা নিজেরা সমাধান করব। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখব। এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও মোড়লগিরি প্রত্যাশা করি না, প্রশ্রয়ও দেব না। বাংলাদেশ বীরের জাতি। কখনো মাথা নত করে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা জাতির পিতার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম, আমরা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করব না।

 

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ পৃথিবী এখনো দুই ভাবে বিভক্ত। বঙ্গবন্ধুর নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ আজও যুদ্ধের বিপক্ষে এবং শান্তির পক্ষে। এটি বাংলাদেশের চিরায়ত অবস্থান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে বাংলাদেশ শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একটি শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘শান্তির মডেল’ উপস্থাপন করেছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এখনো মধ্যমপন্থা নীতি অনুসরণ করে আসছে।

 

কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এবং পরাশক্তিভিত্তিক বলয়ের ক্ষেত্রে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে একপক্ষীয় নীতি অবলম্বন করা লাগতে পারে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে একটি ঝোড়ো হাওয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ এখন উদীয়মান অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের দেশ। বাংলাদেশকে আর দাবায়ে রাখা যাবে না।

লেখক : সংসদ সদস্য, বাগেরহাট-২ । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» কোনো সমস্যা হলে ট্রিপল নাইনে জানাতে বললেন আইজিপি

» নোয়াখালীর সেই পুকুরে এবার মিলল ৪০ রুপালি ইলিশ

» রমজানের তৃতীয় জুমায় বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের ঢল

» রাজার আমন্ত্রণে ভুটান সফরে তথ্য প্রতিমন্ত্রী

» কারিনা-কারিশমার রাজনীতিতে নামার গুঞ্জন

» ‘জিয়া মুক্তিযোদ্ধার ছদ্মাবরণে পাকিস্তানের দোসর ছিলেন’

» কবি মুক্তাদির চৌধুরী তরুণের ইন্তেকাল

» পুলিশের সোর্সকে চাকু মেরে হত্যা মামলার পলাতক দুই আসামি গ্রেফতার

» ব্যবহৃত অলংকারের জাকাত দিতে হবে কি?

» ফেসবুক দীর্ঘদিন লগ আউট না করলে কী হয়?

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

গন্তব্য ২০৪১

শেখ সারহান নাসের তন্ময় : কথায় আছে শিকড় ছেড়ে শিখরে ওঠা যায় না। ঠিক সেভাবেই বাংলাদেশের প্রগতিসম্পন্ন আগামীর কথা বলতে গেলে এ স্বপ্নযাত্রার গোড়ার কথা তথা ধারাবাহিক বিবর্তনের কথা বলতে হবে। আমরা জানি, শোষিত-বঞ্চিত- নিপীড়িত বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস হাজার বছরের। টুঙ্গিপাড়ার শেখ মুজিব বাঙালির সেই অনন্ত সংগ্রামেরই সৃষ্টি। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, এরপর জাতির পিতা সৃষ্টি হয়েছে সময়ের প্রয়োজনে, অধিকারহারা মানুষের ন্যায্যতা নিশ্চিতের অভিপ্রায়ে। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনাবসানের মধ্য দিয়ে ভারত ও পাকিস্তান নামক পৃথক দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হলে দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে ভূরাজনীতির নতুন মেরুকরণ ও সমীকরণ তৈরি হয়। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানে বাঙালি জাতিসত্তার অক্ষুণœতা বজায় রাখতে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে ওঠে, যে উদ্যোগের অগ্রভাগে ছিলেন তরুণ শেখ মুজিব। শ্বাপদসংকুল পথ পেরিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি ও বাংলাদেশকে নিয়ে গেছেন স্বাধিকার ও স্বাধীনতার পথে। জাতির পিতার হাত ধরে যে রাষ্ট্রের জন্ম ও পথচলা, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের মর্মন্তুদ হত্যাকা- এবং ’৭৫-পরবর্তী সময়ে সেই রাষ্ট্র ন্যুব্জ হয়ে যায় খন্দকার মোশতাক-জিয়া-এরশাদদের দুঃশাসন ও স্বৈরশাসনে। ধ্বস্তবিধ্বস্ত সেই বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা শুরু করলেন এক নতুন লড়াই। যে লড়াইয়ের শুরু ১৯৮১-তে এবং সে লড়াইয়ের লক্ষ্য ২০৪১।

 

আগের কথায় ফিরে যাওয়া যাক। দেশভাগের পরে তরুণ নেতা শেখ মুজিব খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের সহাবস্থান সম্ভব নয়। প্রথমত নৃতাত্ত্বিক ও জাতিসাত্তিক বৈপরীত্য, দ্বিতীয়ত বাঙালিয়ানার ওপরে পশ্চিম পাকিস্তানি আগ্রাসন। সেজন্য প্রথমেই তিনি বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বহুমাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। একদিকে প্রতিটি সভা-সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলার লেখার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করার দাবি উত্থাপন করতে থাকেন, অন্যদিকে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গোছাতে থাকেন। তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। তমুদ্দন মজলিস, ছাত্রলীগ ও অন্যান্যের সমন্বয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় শেখ মুজিব গণস্বাক্ষর কার্যক্রমেও যেমন অংশগ্রহণ করেছেন, তেমনিভাবে রাজপথে মিছিল করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, গ্রেফতার হয়েছেন, ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ থেকে একটানা ১২ দিন তিনি আমরণ অনশনও করেছেন, কারাগারে বসে আন্দোলনের দিকনির্দেশনাও দিয়েছেন। ১৯৫৩ সালে একুশের প্রথম বার্ষিকী পালনের পুরোভাগে ছিলেন শেখ মুজিব। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে প্রদত্ত ২১টি প্রতিশ্রুতির প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হবে। নবীন সংসদ সদস্য শেখ মুজিব ১৯৫৬ সালের ১৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত আইন পরিষদের অধিবেশনে সংসদের কার্যসূচি বাংলা ভাষায় মুদ্রণের দাবি পেশ করেন এবং ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানান। অবশেষে ১৯৫৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা পাকিস্তানের দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় সংবিধান প্রণয়ন এবং ১৯৭৫ সালে দাফতরিক কাজে সর্বত্র বাংলা ভাষার প্রচলনবিষয়ক পরিপত্র জারি করেন।

 

ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের মাঝেই বাঙালির আরেকটি বিজয় হচ্ছে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের নিরঙ্কুশ জয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকবর্তিকা শেখ মুজিব ১৯৫৫ সালের ২১ অক্টোবর আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এভাবেই বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পথে জনতা, সংগঠন, দল সর্বোপরি দেশকে প্রস্তুত করছিলেন। তিনি বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনকে পাকিস্তানি শাসন-শোষণ ও শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে রূপায়ণ করেছিলেন। তিনি ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘ছয় দফা’ দাবি উত্থাপন করেন, যেটি আমাদের মুক্তির সনদ, বাঁচার দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার ছয় দফা দাবি আমাদের স্বাধীনতার পথ সুগম করেছিল, গণমানুষের মাঝে স্বাধিকারবোধ জাগ্রত করেছিল। এরপর শেখ মুজিবুর রহমানকে কেন্দ্র করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং পরবর্তী রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ায় আইয়ুব শাসনবিরোধী ঊনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেয়। পতন ঘটে আইয়ুব খানের। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বীরের বেশে মুক্ত হন শেখ মুজিব। ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে এক সংবর্ধনাসভায় ছাত্র-জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালির মুক্তির রূপকল্প প্রদান করেন। সে বছরের ৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। এরপর সত্তরের নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় লাভের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু অখ- পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দিলেন। তবু যখন ইয়াহিয়া-ভুট্টোর অপরাজনীতি, অপকৌশল থামল না এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে বিজয়ী একমাত্র দল আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলো না, তখন বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক স্বাধীনতার পথ বেছে নিলেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ছাত্রসমাজ বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি ‘জাতির জনক’ ঘোষণা করল। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তাঁর বিশ্বকাঁপানো ভাষণ প্রদান করলেন। সেই ভাষণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের রণতূর্য উদিত হলো। অনিবার্য হয়ে পড়ল মুক্তির যুদ্ধ। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করলেন। শুরু হলো বাঙালির সশস্ত্র প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধ।

 

৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত যে স্বাধীনতা, তা পূর্ণতা পেল ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে; যিনি ২২৮ দিন পাকিস্তানের কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনে ফিরে এসেছেন বিজয়ের বারতা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে ১১ জানুয়ারি ১৯৭২ সাল থেকেই স্বাধীনতার সংগ্রামকে দেশ গঠনের সংগ্রামে রূপান্তর করলেন। প্রণয়ন করলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত বাহাত্তরের সংবিধান। যার মূলনীতি ছিল জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। বঙ্গবন্ধু তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন এবং মানুষের মঙ্গলের জন্য যে পথ ও মতকে সঠিক বলে বিশ্বাস করেছিলেন তার সমন্বিত রূপ হচ্ছে বাহাত্তরের সংবিধান তথা এর মূলনীতি। এই নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রাতিস্বিক লক্ষ্য ছিল অসামান্য। মানবিক, স্বাবলম্বী ও কল্যাণরাষ্ট্র বিনির্মাণের প্রয়াসে বঙ্গবন্ধুর এরূপ রাষ্ট্রদর্শন সামগ্রিকভাবে ‘মুজিববাদ’ নামে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। যার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টির ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিসত্তার অক্ষুণœতা ও বিকাশের প্রয়োজনে বাঙালি জাতীয়তাবাদ নীতি গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের যুগপৎ ও একমুখী যাত্রার মধ্য দিয়ে নতুন একটি রাষ্ট্রদর্শনের প্রবর্তন করেছিলেন। গণতন্ত্রের মাঙ্গলিক অভিযাত্রার মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে মডেল রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন আমাদের জাতির পিতা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের ব্যবহার, ধর্মের দোহাই দিয়ে সামাজিক বিভেদ, সবকিছুকে ধর্মীয় রং দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক এবং পরধর্ম-পরমত সহিষ্ণু রাষ্ট্র বিনির্মাণের নীতি গ্রহণ করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালের ২৬ জুন নোয়াখালীর মাইজদিতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোমার ধর্ম তোমার কাছে, আমার ধর্ম আমার কাছে এটাই হলো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। বাংলাদেশ তা-ই থাকবে; তাই আমি আশা করি।

 

বঙ্গবন্ধু দেশের অর্থব্যবস্থা একটি মজবুত ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে জাতীয়করণ নীতি গ্রহণ করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশি ব্যাংক, জীবনবীমা, সাধারণ বীমা, পাটকল, বস্ত্রকল, চিনিকল, বাংলাদেশ বিমান ও জাহাজ করপোরেশনসহ বিভিন্ন বিকল প্রতিষ্ঠান সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সব ধরনের বহির্বাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর Economic Policy সম্পর্কে অসাধারণ একটি ধারণা পাওয়া যায় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠকে প্রদত্ত তাঁর ভাষণে। তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করেই আমার ইকোনমিক সিস্টেম গড়তে হবে।’ কৃষিজীবী ও কৃষি-উৎপাদন নির্ভর বাংলাদেশে একটি Sustainable Agricultural System নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধু সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কৃষি উপকরণ বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ, কৃষিপণ্যে ভর্তুকি, ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষিজমির খাজনা মওকুফ, গবাদি পশু বিতরণ, লবণশিল্পকে কর অব্যাহতিসহ নানামাত্রিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন। রাষ্ট্র পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর নীতি ও কৌশলগুলোর কার্যকারিতা বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের Per capita Income Ges Gross Domestic Product-এর গ্রাফটা দেখলে সহায়ক হয়। যেমন ১৯৭২ সালে পাকিস্তানে মাথাপিছু আয় ছিল ১৫২ মার্কিন ডলার এবং সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের ৯৪ মার্কিন ডলার। তবে মাত্র তিন বছর পর ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর ক্যারিশমাটিক লিডারশিপে বাংলাদেশে মাথাপিছু আয় গিয়ে পৌঁছায় ২৭৮ মার্কিন ডলারে এবং পাকিস্তানের ১৬৮ মার্কিন ডলার। জিডিপির ক্ষেত্রেও এমনই হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ছিল ৬.২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং পাকিস্তানের ৯.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সেই জিডিপি ১৯৭৫ সালে গিয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের ১৯.৪৫ বিলিয়ন ডলার এবং পাকিস্তানের ১১.৩৪ বিলিয়ন ডলার।

 

স্বাধীনতার পর দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি তথা বিশ্বরাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশকে Geo- politically important এবং Geo-strategically Strong হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’। বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনৈতিক বিচক্ষণতায় স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে ১১৬টি দেশের স্বীকৃতি পায় এবং জাতিসংঘ, ওআইসি, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন, কমনওয়েলথ, আইএলও, আইএমএফ, আইবিআরডি, ইউনেস্কোসহ ২৭টি আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করে অতি অল্প সময়ে। ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব সহযোগিতা ও শান্তিচুক্তি, ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ-ভারত স্থলসীমান্ত চুক্তি বঙ্গবন্ধুর win-win negotiation-এর একটি প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। নয়া বিশ্বব্যবস্থায় বঙ্গবন্ধু শান্তির সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণ প্রদান করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘মানব জাতির অস্তিত্ব নির্ভর করে শান্তির ওপর। সমগ্র বিশ্বে মানুষের গভীরতম আকাক্সক্ষা হচ্ছে শান্তি। শান্তি স্থায়ী হতে পারে কেবল ন্যায়বিচারের ওপর ভিত্তি করে।… আমি সমগ্র পৃথিবীকে দেখাতে চাই যে, বাঙালি শুধু রক্ত দিতে জানে না, শান্তিকামী বাঙালি জানে কীভাবে শান্তি বজায় রাখতে হয়।’ বঙ্গবন্ধু পুঁজিবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের মধ্যকার শীতল যুদ্ধে সমাজতন্ত্রের পথ বেছে নিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে বেতার ও টেলিভিশনে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং সব জাতির সমমর্যাদা নীতিতে আগ্রহী। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু বিশ্বরাজনীতির প্রধানতম পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে দুবার কূটনৈতিকভাবে পরাজিত করেছেন। আমেরিকার প্রথম কূটনৈতিক পরাজয় হয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং দ্বিতীয়বার পরাজয় হয় বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনৈতিক সম্পর্ক রাখতে তাদেরই আগে প্রস্তাব নিয়ে আসতে হয়েছিল বাংলাদেশে। টাইম ম্যাগাজিনের সাংবাদিক মি. স্টুয়ার্টকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্ভাব্য কূটনৈতিক সম্পর্ক বিষয়ে বলেছিলেন, ‘কিন্তু তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। আমি স্বীকৃতি চাই এবং যদি সম্পর্ক আরও উন্নত করতে হয় তাহলে মার্কিন সরকারকে বাস্তবতা স্বীকার করতে হবে। মার্কিন জনগণের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি সাহায্য চাই, কিন্তু কোনো শর্ত যুক্ত থাকবে না।

 

দেশের এমন উড্ডয়নকালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত বাংলাদেশকে ভূপাতিত করল দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অপশক্তি। এক অন্ধকার যুগে নিক্ষিপ্ত হলো বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি। লুণ্ঠিত হলো মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার, রাষ্ট্রাধিকার, ভোটাধিকার। এমন পরিস্থিতে নিশ্চিত মৃত্যুর সব সম্ভাবনা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা। দেশে ফেরার আগে আমেরিকান সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজউইককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নিতেই হয়। মৃত্যুকে ভয় করলে জীবন মহত্ত্ব থেকে বঞ্চিত হয়।’ এ দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের প্রয়াসে বঙ্গবন্ধুকন্যা নিজেকে নিয়োজিত করলেন অসীম সাহসী সংগ্রামে। ১৯৯৬-২০০১ এবং ২০০৯ থেকে চলমান সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনীতি ও জননীতি বাস্তবায়ন করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু যে অভিলক্ষ্যে বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তা অর্জিত হয়েছে মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মাধ্যমে। আজকের পদ্মা সেতুও ছিল বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাংলাদেশ। আজ বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য-অনিশ্চয়তা দূর হয়েছে। ২০০১-২০০৬ পর্যন্ত প্রবলভাবে প্রতীয়মান উত্তরবঙ্গের মঙ্গা আজ জাদুঘরে চলে গেছে। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। আজ জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি একটি মান পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক লক্ষ্যমাত্রা হিসেবে Millennium Development Goal, Sustainable Development Goal  যেমন অর্জন করছে, তেমনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব উন্নয়ন দর্শন হিসেবে ভিশন ২০২১ অর্জন করে ভিশন ২০৪১ পূরণের অভিযাত্রায় রয়েছে।

 

তবু মাঝে মাঝে বাংলাদেশ থমকে দাঁড়ায় দেশি ও আন্তর্জাতিক অপশক্তির অনভিপ্রেত থাবায়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিকূল শক্তি, মৌলবাদী শক্তিগুলো এক হয়ে দেশকে আবারও নিয়ে যেতে চায় গহিন অন্ধকারে। তাদের পেছনে শ্যাডো-পাওয়ার হিসেবে কাজ করে আন্তর্জাতিক কুশীলবরা। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বকাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অনভিপ্রেত বৈদেশিক হস্তক্ষেপ হয়েছে অগণতান্ত্রিক শক্তি (মোশতাক-জিয়ার শাসন), ধর্মান্ধ অপশক্তি (জামায়াত) এবং কৃত্রিম জাতীয়তাবাদী (জিয়ার দর্শন-বিএনপির শাসন) শক্তিকে ক্ষমতায় বসানোর অভিপ্রায়ে। কূটনীতিরও একটি গ্র্যামার আছে, বিধি-পরিধি আছে। হাতে গোনা দু-একটি পরাশক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা তাদের সেই Diplomatic jurisdiction ভুলে যান বা অতিক্রম করে ফেলেন। আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার এই যুগে যেটি মোটেও কাম্য নয়। দেশের ভিতরে ভিন্ন রাজনৈতিক মত-পথ-দর্শন থাকবে। সহনশীল মাত্রায় রাজনৈতিক বিরোধও থাকবে। সেগুলো আমরা নিজেরা সমাধান করব। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখব। এ ক্ষেত্রে আমরা কোনো বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ও মোড়লগিরি প্রত্যাশা করি না, প্রশ্রয়ও দেব না। বাংলাদেশ বীরের জাতি। কখনো মাথা নত করে না। আমাদের পূর্বপুরুষরা জাতির পিতার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম, আমরা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপস করব না।

 

বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত শোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ পৃথিবী এখনো দুই ভাবে বিভক্ত। বঙ্গবন্ধুর নীতি অনুসরণ করে বাংলাদেশ আজও যুদ্ধের বিপক্ষে এবং শান্তির পক্ষে। এটি বাংলাদেশের চিরায়ত অবস্থান। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে বাংলাদেশ শান্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। একটি শান্তির বিশ্ব প্রতিষ্ঠার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা ‘শান্তির মডেল’ উপস্থাপন করেছেন। তা ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে এখনো মধ্যমপন্থা নীতি অনুসরণ করে আসছে।

 

কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এবং পরাশক্তিভিত্তিক বলয়ের ক্ষেত্রে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে একপক্ষীয় নীতি অবলম্বন করা লাগতে পারে, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতিতে একটি ঝোড়ো হাওয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশ এখন উদীয়মান অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও মানবসম্পদের দেশ। বাংলাদেশকে আর দাবায়ে রাখা যাবে না।

লেখক : সংসদ সদস্য, বাগেরহাট-২ । সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com