গণপরিবহনে মাস্তানি

রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছিল বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাস। হঠাৎই পেছন থেকে আসা একই পরিবহনের আরেকটি বাস সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসে থাকা যাত্রীদের কয়েকজন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সামনের বাসে থাকা হেলপার ছিটকে পড়েন রাস্তায়। দৃষ্টি পড়ে ট্রাফিক পুলিশেরও। পুলিশ এগিয়ে আসলেই বাস দুটি দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করে। বাসে তের বছরের মেয়ে উঠলেও উঠতে পারেননি রহিমা নামের এক নারী যাত্রী। পরবর্তীতে এক পাঠাও চালক রহিমাকে নিয়ে বাসের পিছু ছুটতে থাকে।

মঙ্গলবার সকাল ১১টা। রাজধানীর কাওরান বাজার মোড়ে মিরপুর, উত্তরা ও গাবতলীগামী প্রায় ৮/৯টি বাস পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কি করেছে। কে, কার আগে যাত্রী তুলবে তা নিয়ে নিয়মিতই প্রতিযোগিতা। বাসগুলোর গতি রোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অন্য বাস। চালকদের এমন কাণ্ডে বিব্রত যাত্রীরা। দুই বাসের মধ্যবর্তী স্থানে কয়েকজন যাত্রী প্রায় ২৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড আটকা পড়েন। ভয়ে চিৎকার করেন তারা। একজন বৃদ্ধ ‘আল্লাহ আল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করতে থাকেন। বাসগুলো চলে গেলে বৃদ্ধ মো. হাসেম বলেন, আল্লাহ’র রহমতে বেঁচে গেছি। আরেকটু হলেই বাসের চাপায় মারা যেতাম। চালকরা কোনো আইনকানুন মানেন না। যাত্রীর লোভে যখন তখন যে কাউকে চাপা দিয়ে মারতেও পারে। পুরো রাস্তা দখল করে বাস চালাতে চায় তারা। যেভাবে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখলাম, যেন তারা উন্মাদ হয়ে গেছে। সঙ্গে থাকা আরেক যাত্রী বললেন, এ যেন মগের মুল্লুক। যাত্রীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। সব ক্ষমতাই তাদের। গণপরিবহনে সেবার নামে মাস্তানি চলছে।

 

রাজধানীতে প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। অভিযোগও ভূরিভূরি। বাস শ্রমিকদের খাম-খেয়ালিপনায় ঢাকার সড়কে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা। চলছে নৈরাজ্য। মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি। বেপরোয়া হেলপার থেকে চালক। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। ফলাফল সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায়ই নগরীর প্রতিটি সড়কে সর্বোচ্চ গতিতে ওভারটেকিং করছে বাস, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার। পুরো সড়ক দখলে নিয়ে গণপরিবহন চালাচ্ছেন তারা। বিনা প্রয়োজনে পেছনের বাসগুলোকে আটকাতে ঘনঘন লেন বদলানো হয়। এদিকে প্রায় ৪ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মাঝে মধ্যে অভিযান দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। রাজধানীতে প্রায় ৩০০টি রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করলেও বিআরটিএ’র অভিযান চলে দু’একটি স্থানে। ফলে অনেকটাই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছেন গণপরিবহন শ্রমিকরা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসচালকদের মধ্যে অনেকেই মাদকাসক্ত। তারা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। আছে অদক্ষতাও। বারবার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে পরিবহন শ্রমিকরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। এসব শ্রমিকদেরকে বেপরোয়া করছেন বাসের মালিকরাই। কারণ তারা মালিকের জমা ওঠানোর তাগিদে বার বার অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন। রাজধানীর প্রতিটি সড়কে প্রতিযোগিতা করে চলছে গণপরিবহন। প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। এতে নিহতের পাশাপাশি আহতের সংখ্যাও বেড়েছে। অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করছেন। হাসপাতালের বিছানায়ও কাতরাচ্ছেন কেউ কেউ। এসবের অধিকাংশই ঘটছে পরিবহন শ্রমিকদের উগ্রতার জন্য। ফলে গণপরিবহনে তাদের মাস্তানির পরিমাণ বেড়ে যায়। পরিবহন নেতারাও এসবকে সমর্থন দিয়ে আসছেন। মালিকরা অধিক লাভের আশায় চালকদেরকে আইন অমান্য করার সুযোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিটি বাসেই নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে কয়েকগুণ পরিবহনভিত্তিক ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ওয়েবিলের নামে মানুষের পকেট কাটছেন পরিবহন শ্রমিকরা। দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোও পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাছে জিম্মি। সড়ক নিরাপদ আইন- ২০১৮ ও বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়ার বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান না নিলে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

 

ফার্মগেট থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব চার কিলোমিটার। সরকারের নতুন ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী এই পথের ভাড়া ১০ টাকা। তবে এই রুটে চলাচলকারী প্রত্যেকটি বাসে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। যদিও একই ভাড়ায় মিরপুর ১০ পর্যন্ত যাওয়া যায়। ৪ কিলোমিটার পথের ভাড়া বৈধ করতে রাখা হয়েছে ওয়েবিল। যাত্রীরা ভাড়ার চার্ট দেখতে চাইলে তাদেরকে দেখানো হয়, তাদেরই পাতানো ওয়েবিলের কাগজ। যার কোনো বৈধতা নেই। এ ছাড়া ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত ২০ টাকার স্থলে কখনো কখনো ৩০ টাকা আদায় করেন। এদিকে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বিপক্ষে কাজ করছে গণপরিবহন সংগঠনগুলো। ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে তাদেরই পরিবহনগুলো। গত ৩ মাস আগে সড়ক পরিবহন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ওয়েবিল বন্ধের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা বন্ধ হয়নি। উল্টো অসংখ্য পরিবহন মালিকরা নতুন করে ওয়েবিল বসিয়েছেন। দূরত্বের হিসাবে ভাড়া ঠিক না করে নির্দিষ্ট একটি এলাকা থেকে আরেকটি এলাকা পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করছেন তারা। বাস কোম্পানির ঠিক করা দূরত্বের মাঝখানে  কেউ নামলেই পুরো পথের ভাড়াই দিতে হয়। এ ছাড়া ওয়েবিলগুলো কৌশল করে এমন জায়গায় বসানো হয়েছে, যেখানে অল্প সংখ্যক মানুষ নামেন।

 

আগারগাঁওয়ে একটি সরকারি অফিসের পিয়ন মো. শামীম। অফিসের উদ্দেশ্যে ফার্মগেট থেকে শিকড় পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। ১০ টাকা ভাড়া দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বাসের কন্টাক্টর। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় বাকবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে চালক বাস বন্ধ করে তার আসন থেকে নেমে এসে আরও ১০ টাকা ছিনিয়ে নেন। এ সময় শামীমের শার্টের পকেট ছিঁড়ে যায়। তিনি বলেন, সরকারের নির্ধারিত ভাড়াই দিয়েছিলাম। বাসের স্টাফরা সন্ত্রাসী কায়দায় ২ গুণ ভাড়া নিলো। প্রতিদিন এই রুটে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। সবাই পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি। তারা সরকারের নির্ধারিত ভাড়া নেন না। তাদের নির্ধারিত ভাড়াই সকলকে পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় যাত্রীদেরকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। বাস থেকে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়। তাদের মাস্তানি কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।

পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, মালিকের টার্গেটই বড় সমস্যা। তার উপরে জ্বালানি খরচ, টোল, চাঁদা, পথের খরচ, ঘুষ দিয়ে তাদের কিছু থাকে না। দৈনিক পারিশ্রমিকসহ সব খরচ তুলতেই সড়কে প্রতিযোগিতায় নামছেন তারা। এসব তাদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে নানা চাপ সহ্য করতে না পেরে যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটে দুর্ঘটনা। এর বাইরে চালকেরা পথচারীর অসতর্কতা,  মোটরসাইকেল, রিকশা সহ নানা যানবাহন হুটহাট করে লেন পরিবর্তন করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। লাব্বাইক পরিবহনের চালক আনোয়ার কবির বলেন, সকাল থেকেই গাড়ি নিয়ে বের হই। দিন শেষে মালিকের টার্গেট অনুযায়ী টাকা জমা দিতে হয়। বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে হয়। তেল নিতে হয়। তার উপরে সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তারা ‘পাস’ বলে ভাড়া দেয় না। ওয়েবিল আমারও চাই না। কারণ বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়েবিলের নামে আমাদেরকে ১০ টাকা করে দিতে হয়। ২/৩ জন যাত্রী বেশি উঠালে তারা ২০ টাকা করে আদায় করে। অন্যথায় বাসে যাত্রী সংখ্যা বেশি লিখে রাখে। প্রতিদিন ৫/৬ হাজার টাকা ভাড়া আদায় হলেও দিন শেষে বাসের সহকারীকে দিয়ে নিজের কিছু থাকে না। ফলে বাড়তি আয়ের জন্য সব সময় চিন্তা করি।

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক বলেন, যারা দায়িত্বে আছে তারা এসব দেখছেন না। শুধু চালকদের দোষ দেয়া যায় না, গণপরিবহনের মালিকরাও দায়ী। বাসের মালিকদের ইনকামের টার্গেট পূরণ করতেই তারা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেন। রাজধানীর প্রতিটি সড়ক যদি পরিকল্পনা করে হাতিরঝিলের মতো করা যেত, তাহলে চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকতো না। টিকিট কেটে যাত্রী তুললে এমনটা হয় না। এখন যে সিস্টেম চালু আছে তাতে চালককে গাড়িও চালাতে হয়, ইনকামের বিষয়টিও দেখতে হয়। ফলে দুর্ঘটনা থামছে না। এ জন্য বিআরটিএ দায়ী। তাদের ব্যর্থতার জন্যই সড়কে এই অবস্থা বিরাজ করছে।

সড়ক অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের আশকারায় পরিবহন সেক্টর আজ বেপরোয়া। চালকরাও সেই সুযোগে  বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। কোনো আইনকেই তারা তোয়াক্কা করছেন না। যাত্রীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। মারধরসহ নানা সময় হত্যা পর্যন্ত করছেন। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। ঢাকার ৯৫ শতাংশ বাসের চালক এখন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন সড়কে মাস্তানি করে। প্রতিনিয়তই ওভারটেক করছেন চালকরা। পরিবহন সংগঠনগুলোর প্রভাব খাটিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন। এখনই এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যান্য বিষয়ের মতো পরিবহন সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রেও দ্রুত বিচার আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই পরিবহন ক্ষেত্রে অপরাধ কমে আসবে। এ ছাড়া যেসব চালকরা মাদকাসক্ত নয়, তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। পরিবহন স্টাফরা মাদকাসক্ত কিনা তা বিভিন্ন স্পটে পরীক্ষা করতে হবে। এ পদ্ধতি চালু রাখলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» কক্সবাজার-ঢাকা রুটে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক

» নির্মাণাধীন ভবনে লার্ভা পেলে নির্মাণ কাজ বন্ধ : তাপস

» বাংলাদেশ সিরিজের জন্য দল ঘোষণা করল জিম্বাবুয়ে

» চুয়েটের দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ফের সড়ক অবরোধ

» ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে চায় ভারত

» থাইল্যান্ডে পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী

» ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাত ব্যক্তির মৃত্যু

» রাবির ভর্তির বিভাগ পছন্দক্রম ফরম পূরণের তারিখ ঘোষণা

» শুভ জন্মদিন ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’

» মন্ত্রী-এমপির স্বজন যারা মনোনয়ন প্রত্যাহার করেনি, সময়মতো ব্যবস্থা: কাদের

উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

গণপরিবহনে মাস্তানি

রাজধানীর বাংলামোটর মোড়ে দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছিল বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাস। হঠাৎই পেছন থেকে আসা একই পরিবহনের আরেকটি বাস সজোরে ধাক্কা দেয়। এতে বাসে থাকা যাত্রীদের কয়েকজন সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েন। সামনের বাসে থাকা হেলপার ছিটকে পড়েন রাস্তায়। দৃষ্টি পড়ে ট্রাফিক পুলিশেরও। পুলিশ এগিয়ে আসলেই বাস দুটি দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করে। বাসে তের বছরের মেয়ে উঠলেও উঠতে পারেননি রহিমা নামের এক নারী যাত্রী। পরবর্তীতে এক পাঠাও চালক রহিমাকে নিয়ে বাসের পিছু ছুটতে থাকে।

মঙ্গলবার সকাল ১১টা। রাজধানীর কাওরান বাজার মোড়ে মিরপুর, উত্তরা ও গাবতলীগামী প্রায় ৮/৯টি বাস পাশাপাশি ধাক্কাধাক্কি করেছে। কে, কার আগে যাত্রী তুলবে তা নিয়ে নিয়মিতই প্রতিযোগিতা। বাসগুলোর গতি রোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে অন্য বাস। চালকদের এমন কাণ্ডে বিব্রত যাত্রীরা। দুই বাসের মধ্যবর্তী স্থানে কয়েকজন যাত্রী প্রায় ২৫ থেকে ৩০ সেকেন্ড আটকা পড়েন। ভয়ে চিৎকার করেন তারা। একজন বৃদ্ধ ‘আল্লাহ আল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করতে থাকেন। বাসগুলো চলে গেলে বৃদ্ধ মো. হাসেম বলেন, আল্লাহ’র রহমতে বেঁচে গেছি। আরেকটু হলেই বাসের চাপায় মারা যেতাম। চালকরা কোনো আইনকানুন মানেন না। যাত্রীর লোভে যখন তখন যে কাউকে চাপা দিয়ে মারতেও পারে। পুরো রাস্তা দখল করে বাস চালাতে চায় তারা। যেভাবে ধাক্কাধাক্কি করতে দেখলাম, যেন তারা উন্মাদ হয়ে গেছে। সঙ্গে থাকা আরেক যাত্রী বললেন, এ যেন মগের মুল্লুক। যাত্রীদের কোনো নিরাপত্তা নেই। সব ক্ষমতাই তাদের। গণপরিবহনে সেবার নামে মাস্তানি চলছে।

 

রাজধানীতে প্রতিনিয়তই ঘটছে এমন ঘটনা। অভিযোগও ভূরিভূরি। বাস শ্রমিকদের খাম-খেয়ালিপনায় ঢাকার সড়কে বেড়েছে বিশৃঙ্খলা। চলছে নৈরাজ্য। মানা হচ্ছে না নিয়মনীতি। বেপরোয়া হেলপার থেকে চালক। থামছে না মৃত্যুর মিছিল। ফলাফল সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতি বছর হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায়ই নগরীর প্রতিটি সড়কে সর্বোচ্চ গতিতে ওভারটেকিং করছে বাস, মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার। পুরো সড়ক দখলে নিয়ে গণপরিবহন চালাচ্ছেন তারা। বিনা প্রয়োজনে পেছনের বাসগুলোকে আটকাতে ঘনঘন লেন বদলানো হয়। এদিকে প্রায় ৪ বছরেও বাস্তবায়ন হয়নি সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মাঝে মধ্যে অভিযান দেখা গেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। রাজধানীতে প্রায় ৩০০টি রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল করলেও বিআরটিএ’র অভিযান চলে দু’একটি স্থানে। ফলে অনেকটাই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থাকছেন গণপরিবহন শ্রমিকরা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাসচালকদের মধ্যে অনেকেই মাদকাসক্ত। তারা ট্রাফিক আইন সম্পর্কে ভালোভাবে জানেন না। আছে অদক্ষতাও। বারবার দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে রক্ষা পেয়ে যাচ্ছেন। ফলে পরিবহন শ্রমিকরা কোনো কিছুর তোয়াক্কা করেন না। এসব শ্রমিকদেরকে বেপরোয়া করছেন বাসের মালিকরাই। কারণ তারা মালিকের জমা ওঠানোর তাগিদে বার বার অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন। রাজধানীর প্রতিটি সড়কে প্রতিযোগিতা করে চলছে গণপরিবহন। প্রতিনিয়তই ঘটছে ছোট বড় দুর্ঘটনা। এতে নিহতের পাশাপাশি আহতের সংখ্যাও বেড়েছে। অনেকেই পঙ্গুত্ববরণ করছেন। হাসপাতালের বিছানায়ও কাতরাচ্ছেন কেউ কেউ। এসবের অধিকাংশই ঘটছে পরিবহন শ্রমিকদের উগ্রতার জন্য। ফলে গণপরিবহনে তাদের মাস্তানির পরিমাণ বেড়ে যায়। পরিবহন নেতারাও এসবকে সমর্থন দিয়ে আসছেন। মালিকরা অধিক লাভের আশায় চালকদেরকে আইন অমান্য করার সুযোগ দিচ্ছেন। এ ছাড়া প্রতিটি বাসেই নেয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়া। সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে কয়েকগুণ পরিবহনভিত্তিক ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। ওয়েবিলের নামে মানুষের পকেট কাটছেন পরিবহন শ্রমিকরা। দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোও পরিবহন শ্রমিক সংগঠনগুলোর কাছে জিম্মি। সড়ক নিরাপদ আইন- ২০১৮ ও বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়ার বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থান না নিলে পরিবহন খাতের নৈরাজ্য বন্ধ করা সম্ভব হবে না।

 

ফার্মগেট থেকে আগারগাঁওয়ের দূরত্ব চার কিলোমিটার। সরকারের নতুন ভাড়ার তালিকা অনুযায়ী এই পথের ভাড়া ১০ টাকা। তবে এই রুটে চলাচলকারী প্রত্যেকটি বাসে নেয়া হচ্ছে ২০ টাকা। যদিও একই ভাড়ায় মিরপুর ১০ পর্যন্ত যাওয়া যায়। ৪ কিলোমিটার পথের ভাড়া বৈধ করতে রাখা হয়েছে ওয়েবিল। যাত্রীরা ভাড়ার চার্ট দেখতে চাইলে তাদেরকে দেখানো হয়, তাদেরই পাতানো ওয়েবিলের কাগজ। যার কোনো বৈধতা নেই। এ ছাড়া ফার্মগেট থেকে মিরপুর ১০ পর্যন্ত ২০ টাকার স্থলে কখনো কখনো ৩০ টাকা আদায় করেন। এদিকে সরকার নির্ধারিত ভাড়ার বিপক্ষে কাজ করছে গণপরিবহন সংগঠনগুলো। ওয়েবিলের নামে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে তাদেরই পরিবহনগুলো। গত ৩ মাস আগে সড়ক পরিবহন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ ওয়েবিল বন্ধের ঘোষণা দিলেও বাস্তবে তা বন্ধ হয়নি। উল্টো অসংখ্য পরিবহন মালিকরা নতুন করে ওয়েবিল বসিয়েছেন। দূরত্বের হিসাবে ভাড়া ঠিক না করে নির্দিষ্ট একটি এলাকা থেকে আরেকটি এলাকা পর্যন্ত ভাড়া ঠিক করছেন তারা। বাস কোম্পানির ঠিক করা দূরত্বের মাঝখানে  কেউ নামলেই পুরো পথের ভাড়াই দিতে হয়। এ ছাড়া ওয়েবিলগুলো কৌশল করে এমন জায়গায় বসানো হয়েছে, যেখানে অল্প সংখ্যক মানুষ নামেন।

 

আগারগাঁওয়ে একটি সরকারি অফিসের পিয়ন মো. শামীম। অফিসের উদ্দেশ্যে ফার্মগেট থেকে শিকড় পরিবহনের একটি বাসে উঠেন। ১০ টাকা ভাড়া দিলে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বাসের কন্টাক্টর। এ নিয়ে সৃষ্টি হয় বাকবিতণ্ডা। এক পর্যায়ে চালক বাস বন্ধ করে তার আসন থেকে নেমে এসে আরও ১০ টাকা ছিনিয়ে নেন। এ সময় শামীমের শার্টের পকেট ছিঁড়ে যায়। তিনি বলেন, সরকারের নির্ধারিত ভাড়াই দিয়েছিলাম। বাসের স্টাফরা সন্ত্রাসী কায়দায় ২ গুণ ভাড়া নিলো। প্রতিদিন এই রুটে হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করে। সবাই পরিবহন শ্রমিকদের কাছে জিম্মি। তারা সরকারের নির্ধারিত ভাড়া নেন না। তাদের নির্ধারিত ভাড়াই সকলকে পরিশোধ করতে হয়। অন্যথায় যাত্রীদেরকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করা হয়। বাস থেকে ফেলে দেয়ার হুমকি দেয়। তাদের মাস্তানি কোনোভাবেই বন্ধ হচ্ছে না।

পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানায়, মালিকের টার্গেটই বড় সমস্যা। তার উপরে জ্বালানি খরচ, টোল, চাঁদা, পথের খরচ, ঘুষ দিয়ে তাদের কিছু থাকে না। দৈনিক পারিশ্রমিকসহ সব খরচ তুলতেই সড়কে প্রতিযোগিতায় নামছেন তারা। এসব তাদের মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে নানা চাপ সহ্য করতে না পেরে যাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেন। ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘটে দুর্ঘটনা। এর বাইরে চালকেরা পথচারীর অসতর্কতা,  মোটরসাইকেল, রিকশা সহ নানা যানবাহন হুটহাট করে লেন পরিবর্তন করার কারণে দুর্ঘটনা ঘটে। লাব্বাইক পরিবহনের চালক আনোয়ার কবির বলেন, সকাল থেকেই গাড়ি নিয়ে বের হই। দিন শেষে মালিকের টার্গেট অনুযায়ী টাকা জমা দিতে হয়। বিভিন্ন স্থানে চাঁদা দিতে হয়। তেল নিতে হয়। তার উপরে সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তারা ‘পাস’ বলে ভাড়া দেয় না। ওয়েবিল আমারও চাই না। কারণ বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়েবিলের নামে আমাদেরকে ১০ টাকা করে দিতে হয়। ২/৩ জন যাত্রী বেশি উঠালে তারা ২০ টাকা করে আদায় করে। অন্যথায় বাসে যাত্রী সংখ্যা বেশি লিখে রাখে। প্রতিদিন ৫/৬ হাজার টাকা ভাড়া আদায় হলেও দিন শেষে বাসের সহকারীকে দিয়ে নিজের কিছু থাকে না। ফলে বাড়তি আয়ের জন্য সব সময় চিন্তা করি।

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামছুল হক বলেন, যারা দায়িত্বে আছে তারা এসব দেখছেন না। শুধু চালকদের দোষ দেয়া যায় না, গণপরিবহনের মালিকরাও দায়ী। বাসের মালিকদের ইনকামের টার্গেট পূরণ করতেই তারা অবৈধ পন্থা অবলম্বন করেন। রাজধানীর প্রতিটি সড়ক যদি পরিকল্পনা করে হাতিরঝিলের মতো করা যেত, তাহলে চালকদের অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকতো না। টিকিট কেটে যাত্রী তুললে এমনটা হয় না। এখন যে সিস্টেম চালু আছে তাতে চালককে গাড়িও চালাতে হয়, ইনকামের বিষয়টিও দেখতে হয়। ফলে দুর্ঘটনা থামছে না। এ জন্য বিআরটিএ দায়ী। তাদের ব্যর্থতার জন্যই সড়কে এই অবস্থা বিরাজ করছে।

সড়ক অব্যবস্থাপনা ও যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সরকারের আশকারায় পরিবহন সেক্টর আজ বেপরোয়া। চালকরাও সেই সুযোগে  বেপরোয়া হয়ে উঠছেন। কোনো আইনকেই তারা তোয়াক্কা করছেন না। যাত্রীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করছেন। মারধরসহ নানা সময় হত্যা পর্যন্ত করছেন। তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। ঢাকার ৯৫ শতাংশ বাসের চালক এখন নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছেন। দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছেন সড়কে মাস্তানি করে। প্রতিনিয়তই ওভারটেক করছেন চালকরা। পরিবহন সংগঠনগুলোর প্রভাব খাটিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন। এখনই এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অন্যান্য বিষয়ের মতো পরিবহন সংশ্লিষ্ট অপরাধের ক্ষেত্রেও দ্রুত বিচার আইনের আওতায় আনতে হবে। তাহলেই পরিবহন ক্ষেত্রে অপরাধ কমে আসবে। এ ছাড়া যেসব চালকরা মাদকাসক্ত নয়, তাদেরকে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ সুবিধা দিতে হবে। পরিবহন স্টাফরা মাদকাসক্ত কিনা তা বিভিন্ন স্পটে পরীক্ষা করতে হবে। এ পদ্ধতি চালু রাখলে দুর্ঘটনা কমে আসবে। সূএ:মানবজমিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



উপদেষ্টা – মো: মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদ,বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি। (দপ্তর সম্পাদক)  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com